দেবশ্রী চক্রবর্তী

মায়াজম
0
ঘাগড়- একটি হারিয়ে যাওয়া নদী সরস্বতী



মানুষের সখ বিচিত্র। কত মানুষের কতরকম যে সখ তা আর বোলে বোঝানো সম্ভব না।নিত্যনতুন আবিষ্কার এর মধ্যে দিয়েও মানুষ নিজের সখ পূরন করে। আজ এক নদীকে আবিষ্কার নিয়ে লেগে থাকা একদল উন্মাদ মানুষের কথা লিখবো।


বৈদিক শ্লোকের মতন বয়ে যায় কাল । কালের দীর্ঘ যাত্রা পথে গড়ে ওঠা নগর, গ্রাম, শিল্প, নটনটীদের চলমান চিত্র কালের স্রোতে এক ছলাতে কোথায় মিলিয়ে যায় ।তারপর বর্তমানের বাকে এসে যুগযুগান্ত ধরে বহমান সভ্যতার নদী খাত শুকিয়ে জীবাশ্মে পরিণত অতীত উঠে আসে ইতিহাসের পাতায় । আজ অতীতের এক নদী খাতে খনন কার্য চালিয়ে ইতিহাসের সেই বহমান অন্তঃসলিলার স্রোতকে কমন্ডুলুতে তুলে এনে নব জীবন দান করবো বলে ছুটে চলেছি কাল থেকে কালান্তরে । 

কিছু বছর আগে প্রকাশিত বিবিসির একটি রিপোর্ট পড়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম । আশ্চর্য হওয়ারই কথা । রিপোর্টটিতে লেখা ছিলো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে রাজস্থানের থর মরুভূমির চিত্র ধরা পরেছে, যেখানে অন্তঃসলিলা হয়ে বয়ে চলেছে সরস্বতী নদী । ১৯৯০ সালে আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল হরিয়ানা অঞ্চলে ভারতের পবিত্র নদী সরস্বতী আবিষ্কার করা হয়েছে । সরস্বতী নদীকে নিয়ে ব্রিটিশ রাজত্বেও এক দীর্ঘ গবেষণা করা হয়েছিল । হিন্দু শাস্ত্র বেদে সরস্বতী নদীর বর্ণনা করতে গিয়ে এর গতিপথের এক দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া আছে । তাতে বলা হয়েছে ভারতবর্ষের উত্তরে অবস্থিত শিবালিক পর্বত থেকে হরিয়ানা, পাঞ্জাব পার করে এই নদী বর্তমানের রাজস্থানের থর মরুভূমিতে প্রবেশ করে বর্তমানের পাকিস্তানের সিন্ধু নদীতে মিলিত হয়েছে । ইংরেজ রাজত্বকালে রাজস্থানের ইতিহাস রচনার জন্য লেফট্যানেন্ট কর্নেল জেমস টডকে নিয়োগ করা হয়েছিল । টড দীর্ঘ সময় ধরে রাজস্থানের ইতিহাস সংস্কৃতি তথা সেখানকার সাধারণ মানুষদের কথা তুলে এনে এগারো খন্ডের একটি রিপোর্ট জমা দেন । এই রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর ১৮৩৫ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে টডের মৃত্যু হয় । কারণ এই দীর্ঘ যাত্রার ধকল তিনি নিতে পারেন নি । আজ আমাদের আলোচ্য বিষয়  সরস্বতী নদী তাই সেই আলোচনায় ফিরে আসি । টড তার রিপোর্টে লিখে গেছেন যে, মরুস্থলীতে তিনি বালির মধ্যে বেশ কিছু শুকনো নদী খাত দেখতে পেয়েছেন । যার ধারে প্রাচীন ভারতীয় নগর সভ্যতার আভাস তিনি পেয়েছেন । একসময় সেখানে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল । যার প্রমাণ স্বরূপ সেখানে আজও বাড়ি,ঘর, মানুষের ব্যাবহারের জিনিস পত্র , এমন কি মানুষ এবং পশুর কঙ্কালও তিনি দেখেছেন । স্থানীয় অধিবাসীদের গল্পকথা এবং লোক গানে তিনি ঘাগড় এবং হাকরা নদীর উল্লেখ পান যাকে স্থানীয় মানুষ প্রাচীন নদী সরস্বতী বলে মনে করেন । এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে ঘাগড় নদীই যে সরস্বতী নদী তার প্রমাণ কি । ব্রিটিশ রাজত্ব এই নিয়ে পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু গবেষণা হয় । এবং কলকাতা  থেকে প্রকাশিত "Memoir of a map of Hindoostan "এ ঘাগড় নদীর একটি নক্সা তুলে ধরা হয় । ঘাগড় একটি মরসুমি নদী যা শিবালিক পর্বত থেকে উৎপত্তি হয়ে চণ্ডীগড়ের থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে পিঞ্জরে এসে সমতলে মিলিত হয়েছে । এরপর আম্বালা, শীর্শা এবং হনুমানগড় হয়ে রাজস্থানে প্রবেশ করেছে । ঘাগড় হাকরা  নাম নিয়ে বর্তমান পাকিস্থানে প্রবেশ করে সিন্ধু নদীতে মিলিত হয়েছে । বর্তমান সময়েও ঘাগড় নদীকে বর্ষ ঋতুতে বইতে দেখা যায় । টডের রাজস্থানে বর্ণিত ঘাগড় নদীর তীরে ধ্বংস প্রাপ্ত নগর সভ্যতা প্রমাণ দেয় যে কোন এক সময়ে এখানে নদী কেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । 

পাকিস্থানের সিন্ধ এবং বর্তমান  হরিয়ানার ভাওয়ালপুরের মধ্যে এক দীর্ঘ নদী পথের উল্লেখ আমরা বিভিন্ন মধ্যযুগীয় গ্রন্থে পাই ।বহু মধ্য যুগীয় গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে সেই পথ দিল্লী থেকে ছিলো । সব থেকে অবাক করে ঋক বেদে সরস্বতীর যে গতিপথের বর্ণনা দেওয়া আছে , সেই পথে গেলে বর্তমান রাজস্থানের থর মরুভূমিতে বেশ কিছু নদীখাত , নগর সভ্যতা এবং মিষ্টি জলের কুয়ো পাওয়া যায় । মরুভূমির মাঝে মিষ্টি জলের কুয়ো সত্যি আমাদের অবাক করে । শুধু তাই না । আরেকটা জিনিশ খুব অবাক করে, তা হচ্ছে নদীখাতের ধারে একশটি উট চালিত সেচে জল দেওয়ার চাকা , যা দিয়ে নদী থেকে জল সেচে দেওয়া হতো । ১০৩৭ সালে সুলতান মামুদ যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন এবং তার পরবর্তী সময় ১৩৯৮ সালে তৈমুর যখন সমরখন্দ থেকে আফগানিস্থান পার করে ভারতে প্রবেশ করেন তখন তারা ঘাগড় নদীর তীরে সরস্বতী নামে এক সমৃদ্ধ নগরের বর্ণনা করেছিলেন । যে নগরীতে প্রায় ১০,০০০ মানুষের বসবাস ছিল, এবং তারা প্রত্যেকে শিক্ষা, সস্কৃতি এবং সম্পদে স্বয়ং সম্পূর্ণ ছিলেন । এই সরস্বতী নগরী বর্তমানে হরিয়ানা রাজ্যের শীর্ষা । 
বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবন বতুতা তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে বলেছেন, পূর্ব রাজপুতানায় তিনি নদীর ধারে সমৃদ্ধ নগর দেখেছেন, তিনি দেখেছেন ঢেউ খেলানো শস্য ক্ষেত এবং আখের বাগান । বর্তমান সময়ে বসে এসব কল্পনা করতে সত্যি অবাক লাগে । আফগানিস্থান থেকে পাওয়া , পাস্তুন ভাষায় রচিত একটি কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ করে ব্রিটিশ গবেষকরা সরস্বতী নদীর উল্লেখ কচ্ছের রান অঞ্চলে পান । তাতে উল্লেখ আছে যে বর্তমানে যেখানে কচ্ছের রান , সেখানে প্রাচীনকালে সরস্বতী নদী থেকে শাখাপ্রশাখা বেরিয়ে বেশ কিছু শাখা নদী প্রবেশ করে বেশ কিছু ব দ্বীপ তৈরি করে এবং আরব থেকে বেশ কিছু মানুষ প্রাচীনকালে সেখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন । 

লেখা শেষ করার আগে একটি ছোট্ট তথ্য পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই , তা হল, আমরা তো জানি যে সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । কিন্তু বর্তমানের বেশ কিছু আবিষ্কার এই চিত্র তুলে ধরছে যে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ সিন্ধু নদের সাথে আরেকটি নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল, আর সেই নদী হচ্ছে সরস্বতী ।


ঋকবেদের পয়তাল্লিশটি স্তোত্রে বাহাত্তরবার এবং তিনটি স্তোত্র সম্পূর্ন ভাবে সরস্বতী নদীকে 
উৎসর্গ করা হয়েছে । ঋকবেদে এই নদীকে দুটি বিশেষ নামে আহ্বান করা হয়েছে ইলা এবং ভারতী । বেদ এবং পুরানে এই নদীর উচ্ছল জল্প্রবাহের এবং নদীর দুই তীরের শস্যশ্যামলা ভূমির বর্ননা করা হয়েছে । প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন বর্ননায় এই নদীর উল্লেখ আমরা পাই । ঋকবেদের রচয়িতারা সরস্বতী নদী ধারে বসে এই নদীর উচ্ছল কলকালনীর ধ্বনীর ছন্দের ঋকবেদের স্তত্র রচনা করেছিলেন । নদীর এই ধ্বনী দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে যেহেতু ঋকবেদ রচিত হয়েছিল, তাই এই নদীকে বাকদেবী অথবা ভাষ দেবী বলা হয় । ব্রম্ভার এই কন্যার বর্ননা বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেও পাওয়া যায় । ঋকবেদে সরস্বতীর সাত বোনের উল্লেখ আছে । বেদের একটি স্তোত্রে লেখা আছে সরস্বতী তার দুই বোন যমুনা আর সুতলেজ নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে । এই তথ্য অনুযায়ি পরবর্তী সময়ে বৃটিশ রাজত্বে গবেষনা করে সত্যি এই দুই নদীর মাঝে শুকনো নদী খাতের সন্ধান পাওয়া গেছে । স্বরস্বতী নদীর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে নানা রকম কারন বিভিন্ন পৌরানিক গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে । আমি মহাভারত থেকে একটি গল্প তুলে ধরছি, যাতে বর্ননা দেওয়া আছে যে , উতাথ্য নামে একজন ঋষি ছিলেন । তার স্ত্রীকে বরুন দেব অপহরন করলে তিনি তার স্ত্রীকে খুজে বার করার জন্য সরস্বতীকে সুকিয়ে যেতে বলেন । এবং এই সময় এই নদী রাজস্থানের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে । সার মানে হ্রদ । রাজস্থানে বহু জায়গার নাম সার দিয়ে । এর থেকে বোঝা যায় যে এই সব অঞ্চল গুলোতে কোন এক সময়ে জলের প্রবাহ ছিল । রাজস্থানের পুস্করের ওপর দিয়ে নাকি এক সময় সরস্বতী নদী প্রবাহিত হত । 

মহাকবি কালিদাশের মেঘদূতে মেঘের যে প্রবাহ, রূপ এবং দিক পরিবর্তনের উল্লেখ আছে তা অদ্ভূতভাবে সরস্বতী নদীর যাত্রাপথকে উল্লেখ করে । বরাহমিহিরের বৃহত সঙ্ঘিতায় এই নদীর ভৌগলিক মানচিত্রের উল্লেখ আমরা পাই । বানভট্টের হর্ষচরিতে লেখা আছে সপ্তম শতকের মধ্যভাগে হর্ষবর্ধন নামে একরাজা রাজত্ব করতেন উত্তর ভারতে । এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে হর্ষবর্ধনের পিতার মৃত্যু হলে তিনি সস্বতী নদীতে পিতার অস্তি বিসর্জন দেন এবং সেখানে স্নান করেন । প্রতিহার রাজ মিহির ভোজের একটি প্রসস্তি প্রিথুডাকা কোন এক সময়ে এই সরস্বতী নদীর তীরে লেখা হয়েছিল । শুধু তাই না মুঘল যুগের রেভিনিউ রিপোর্ট এবং তারিখ ই মুবারক শাহি তে এই নদীর প্রবাহের উল্লেখ আমরা পাই । 

কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জামানায় সরস্বতী নদীর গতিপথ খুঁজে বের করতে একটি কমিটি তৈরি হয়। কিন্তু, ইউপিএ সরকারের জামানায় এই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসতেই ফের এই প্রকল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজ শুরু হয়। প্রাচীন মরে যাওয়া সরস্বতী নদীর গতিপথ খুঁজে পাওয়াটা সহজ ছিল না। ইসরো-র সাহায্যে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে হরিয়ানার তিন জেলায় সরস্বতী নদীর সম্ভাব্য গতিপথকে চিহ্নত করা হয়। এর পরেই সেখানে ড্রেজিং শুরু হয়। আদি বদরীতে মাটি খুঁড়তেই গলগল করে জল বেরিয়ে আসতে থাকে। আপাতত ঠিক হয়েছে কুরুক্ষেত্র, যমুনানগর এবং কৈথাল জেলায় সরস্বতী নদীর যে গতিপথ উপগ্রহের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাকে পুনরুজ্জীবীত করা হবে। এর জন্য ৩০ জুলাই সরস্বতী নদীর ওই গতিপথে জল ঢোকাবে হরিয়ানা সরকার। 

আশা করা হচ্ছে, বর্ষা থাকায় এই জল আপাতত শুকোবে না। তবে, দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে দাদুপুর ফিডার ক্যানেলে একটি বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। সেখান থেকে জল নিয়ে আসা হবে এই সরস্বতী নদীতে। 
আইআইটি-র শিক্ষক-ছাত্র থেকে শুরু করে ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবনে কাজ করছে। পরবর্তীকালে পুনর্জন্ম পাওয়া সরস্বতী নদীর তীর ধরে সৌন্দর্যায়নেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। 
যদিও, ৪ হাজার বছর আগে লুপ্ত হয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীরর পুনরুজ্জীবন প্রকল্পকে মোদী সরকার যেভাবে মান্যতা দিচ্ছে, তাতে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে গঙ্গা-যমুনা এবং সরস্বতী নদীকে যেহেতু হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ত্রিধারা হিসাবে ধরা হয়, তাই হিন্দুত্বের জিগিরকে জাগিয়ে তুলতেই কি সরস্বতী নদীর এই পুনরুজ্জীবন প্রকল্প— এই নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কারণ, খরা প্রবণতার মোকাবিলা বা মরুরাজ্য রাজস্থানের কোণে কোণে জল পৌঁছে দেওয়া যেখানে মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেখানে প্রাকৃতিক কারণে হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবন প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে কতটা সহায়ক হবে, তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। 

রাজস্থান এবং গুজরাটের কচ্ছের রান অঞ্চলে খনন কার্যের ফলে মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রবল জলধারা । আমি দু মাস আগে জয়শালমির গেছিলাম । সেখানে দেখে এসেছি একশ দিনের কাজের মাধ্যমে সরস্বতীর গতিপথে খননকার্য চালানর ফলে সেখানে কি ভয়ঙ্কর স্রোত বয়ে চলেছে । রাজস্থানের ৫০ কিলোমিটার খননকার্য চালানোর ফলে জলধারা দেখা নিয়েছে । সেখানে মানুষ চাষাবাদ শুরু করেছে । পাঞ্জাব থেকে কৃষি বিশেষজ্ঞরা এসে সেখানে নিত্য শিক্ষা দিচ্ছেন । মরুভূমির মাঝে আমি নিজের চোখে চাষ হতে দেখেছি । আর হয় তো ২০ বছর পর থর মরুভূমির অস্তিত্ব থাকবে না । হরিয়ানা, পাঞ্জাব,রাজস্থান এবং গুজরাটে নদীর মাটি নিয়ে কার্বোন টেস্ট করে ধরা পরেছে যে এই নদী দশ হাজার বছর পুরোন এই নদী । ভাবা এটোমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ইসরোর মিলিত উদ্দোগে স্যাটেলাইট ইমেজ এর মাধ্যমে এই অনুসন্ধান চলছে । যা প্রথম শুরু হয় ১৯৭১ সালে আমেরিকার স্যাটেলাইট ইমেজ অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভারতবর্ষে উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে ধরা পরে এই নদীর অন্তঃশলীলা প্রবাহ । 

গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী— এই তিন নদীকে হিন্দুদের পবিত্র ধারা বলে মনে করা হয়। এলাহাবাদের সঙ্গমে গঙ্গা ও যমুনার দেখা মিললেও, সরস্বতীকে দেখা যায় না। মনে করা হয়, অদৃশ্য হয়েও সরস্বতী নদী এই সঙ্গমে এসে মিশেছে। যদিও, ইতিহাস বলছে ৪ হাজার বছর আগে মৃত্যু হয়েছে সরস্বতী নদীর।৪ হাজার বছর আগে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃত্যু হয়েছিল সরস্বতী নদীর। বেদ-এ এই নদীর উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে কোনওদিনই দেখা মেলেনি সরস্বতী নদীর। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে সরস্বতী নদীর ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। এই নদীর তীরে বসবাসকারীরা মূলত ছিলেন লিঙ্গোপাসক। তাই পরে এঁদের ‘হিন্দু ধর্মালম্বী’ বলেই গণ্য করা হয়েছে। মহাভারত-এও উল্লেখ মেলে এই সরস্বতী নদীর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধস্থলের কাছ দিয়েই নাকি প্রবাহিত ছিল সরস্বতী নদী। তবে, সরস্বতী নদীর উৎসস্থল নিয়ে আজও ধোঁয়াশা আছে। একদল ইতিহাসবিদদের দাবি, সিন্ধু নদ ছিল এর উৎস। কিন্তু, আবার একদল ইতিহাসবিদদের দাবি, বর্তমানে হরিয়ানার আদি বদরিতে নাকি এর উৎস। চার হাজার বছর আগে সরস্বতী নদী নাকি হরিয়ানার যমুনানগর জেলার ৪১টি গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হত। এমনকী, কুরুক্ষেত্রও নাকি ছিল সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত। হর্ষবর্ধনের রাজধানী থানেশ্বরও নাকি ছিল সরস্বতী নদীর তীরবর্তী শহর। হরিয়ানা থেকে রাজস্থান হয়ে গুজরাটে নাকি শেষ হয়েছিল সরস্বতীর প্রবাহ। 

তিনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবী৷ তিনি আমাদের অন্তঃস্থ শক্তির প্রতীক৷ আবার তিনিই হারিয়ে যাওয়া নদী৷ ভারতীয় পুরাণ ও ইতিহাসে এভাবেই মিলেমিশে আছেন সরস্বতী৷
সরস্বতী শব্দের মধ্যেই এই দু ধরনের অর্থের দেখা মেলে৷ প্রথমত, ‘স্ব’ অর্থাৎ আমাদের অন্তঃস্থ শক্তির ‘সার’৷ তা থেকেই সরস্বতী৷  আবার ‘সরস বতী’ রূপেও সরস্বতী শব্দের ব্যাখ্যা করেন অনেকে৷ সরস্বতী তাই একাধারে নদী ও দেবী দুইই৷
ঋকবেদেই প্রথম সরস্বতী শব্দের উল্লেখ মেলে৷ গায়ত্রী ছন্দে বাঁধা সে সূক্তটি এরকম-
পাবকা নঃ সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী। যজ্ঞং বষ্টু-ধিয়াবসুঃ।।
চোদয়িত্রী সূনৃতানাম্ চেতন্তী সুমতীনাম্। যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।
মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।।

এখানে সরস্বতীকে অন্নদাত্রী, শিক্ষয়িত্রী, জ্ঞানদাত্রী ও জলদাত্রী হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে৷ অধুনা অবলুপ্ত বৈদিক নদী সরস্বতীর ধারণা আমরা এখান থেকেই পেয়ে যাই৷ বৈদিক সভ্যতার ভিত্তি ছিল এই নদীর জলরাশিই৷ কিন্তু কালক্রমে তা হারিয়ে যায়৷ বস্তুত সিন্ধু সভ্যতাও সরস্বতীর জলেই পুষ্ট হয়েছিল৷ আজ যে যমুনাকে আমরা দেখি, তা এককালে সরস্বতীরই উপনদী ছিল৷ আমরা স্মরণ করতে পারি, কৃষ্ণের দাদা বলরাম একবার যমুনাকে আকর্ষণ করেছিলেন৷ পৌরাণিক এ কাহিনীর ভিতর থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট৷ বড়সড় কোনও পরিবর্তনের জেরেই কারণেই রাজস্থানের কোনও গ্রামের কাছে হারিয়ে যায় সরস্বতীর পথ৷ তবে অন্তঃসলিলা হয়ে সরস্বতী আজও বয়ে চলে বলে অনেকের ধারণা৷ সরস্বতী নদী যে ছিল এ নিয়ে আজ আর কোনও সংশয় নেই৷ দীর্ঘ গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে৷

আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরেশিয়ার বরফ গলার সাথে সাথে হিমালয়ের বরফ গলা শুরু হয় । দশ হাজা বছর আগে হিমালয়ের বরফ গলা শুরু হলে সেই বরফ গলা জল প্রবল স্রোতে নেমে আসে সমতলের দিকে । এই সময়েই সরস্বতী নদীর জন্ম হয়েছিল । আমাকে যদি টাইম মেশিনে বসিয়ে বলা হয় যে আমি কোন সময়ে যেতে চাই, আমি চোখ বন্ধ করে বলবো যে আমি আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে যেতে চাই । যখন হিমালয়ের জল গলে ক্ষর স্রোতা নদী ও ঝর্না নেমে আসছিল সমতলের দিকে , আমি সেই প্রবল স্রোতকে প্রনভরে দেখতে চাই । 

পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার পশ্চিম দিকে ভতিন্ডা এবং পাটিয়ালার মাঝা খান দিয়ে বেশ কিছু শুকনো নদী খাতের সন্ধান পাওয়া গেছে । যা আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে হনুমানগড়ে এসে একসঙ্গে ঘাগরে মিলিত হয়েছে । কোন এক সময়ে এই সব শুকনো নদী খাত দিয়ে সরস্বতী নদী প্রবাহিত হয়ে থর মরুভূমির মধ্যে দিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের মরুপ্রদেশে মিলিত হত । 

নাসা এবং ইসরোর স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পরেছে, বর্তমান থর মরুভূমির মাঝখান দিয়ে এখনো অন্তশলিলা হয়ে বয়ে চলেছে সরস্বতী । কোন এক সময়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের ফলে এই নদী পাতালে প্রবেশ করেছিল । ১৯৫০ সালে ভারতীয় প্রত্নতত্ববীদ অমলানন্দ ঘোষ মহাশয় থর মরুভূমির বালিতে পলিমাটি পলিমাটির সাথে বেশ কিছু মৃত শামুখের খোলের সন্ধানও পেয়েছিলেন । এর থেকে প্রমানিত হয় যে কোন এক সময়ে এই অঞ্চলে নদী প্রবাহিত হত এবং এই সব প্রানীর অস্তিত্ব ছিল । 

বিখ্যাত ভারতীয় ভূতত্ববীদ কে এস বৈদ্য মহাশয় তার গবেষনায় লিখে গেছেন যে সরস্বতী কোন এক সময়ে ভারতের সব থেকে ক্ষরস্রোতা নদী ছিল । এবং এই নদীর তীব্র স্রোত চম্বলের কাছে ভাগ হয়ে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে, যাকে অনেকে যমুনা বলে মনে করে । জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন প্রধান তথা বিখ্যাত ভূতত্ববীদ ভি এম কে পুরি সুইজারল্যান্ডের গ্ল্যাসিয়ার অরগ্যান্সের একটি আন্তর্জাতিক সভায় বক্তব্য রেখেছিলেন, ১৯৯৮ সালে তিনি এবং তার সহকর্মী বি সি বর্মা মারকান্ডা এবং বাট্টা উপত্যকার মাঝে প্রায় পনেরোশ অন্তঃশলিলা স্রোতের সন্ধান পেয়েছেন । তারা উল্লেখ করেছেন যে এই সব স্রোত গুলি শিবালিক থেকে নেমে এসেছে । প্রায় ৪০০০ থেকে ৫০০০ মিটার উচ্চতায় তারা এইসব স্রোতের জন্মস্থান খুজে পেয়েছেন । শিবালিক থেকে সরস্বতীর  নদী উৎপত্তি হয়ে এই নদী মারকান্ডা এবং বাট্টা উপত্যকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছিল । পুরি এবং বৈদ্যর গবেষনা যদি সত্যি বলে এনে নিই, তাহলে এটা সত্যি যে হিমালয়ের বরফ গলা জলের প্রোবল স্রোত পশ্চিম ভারতে সরস্বতী নদী নামে প্রবাহিত হয়েছিল । এবং এই নদীর থেকে বেশ কিছু স্রোত বেরিয়ে বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছিল । রাজস্থানের জয়শালমির জেলার মরুভূমিতে খনন কার্য চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মরুভূমির ভেতর থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে আসছে প্রবল জল স্রোত । কোন কোন জায়গায়  মরুভূমির মাঝে খুজে পাওয়া যায় মিষ্টি জলের কূয়ো । ইসরো এবং নাসার স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পরেছে , জয়শালমিরের থর মরুভূমির ওপর দিয়ে অন্তঃশলীলা হয়ে বয়ে যাচ্ছে সরস্বতী নদী । কিশানগড় থেকে তানোট সহ আন্তর্জাতিক  সীমান্ত পারের বেশ কিছু অঞ্চল এর ওপর এই নদীর স্যাটেলাইট চিত্র ধরা পরেছে । 

১৯৯৫ সালে ভাবা এটমিক এনার্জির দুই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী , ডঃ কুলকার্নি এবং ডঃ রাও রাজস্থানের থর মরুভূমির বেশ কিছু শুকনো নদী খাত থেকে বালি সংগ্রহ করে রেডিও কার্বোন পরীক্ষা করে জানত পেরেছিলেন যে আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে নদী বয়ে যেত । 
হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার প্রতিটি নগর এবং বন্দর এর ওপর দিয়ে বয়ে যেত সরস্বতী । কিছুদিন আগে ইরানে প্রাপ্ত সিন্ধু সভ্যতার একটি শিলমোহরে সরস্বতী নদীর বর্ণনা পাওয়া যায় । উত্তরে কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্থান হয়ে কচ্ছের রান ধরে গুজরাটে যে যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে এই নদী বয়ে গেছিল, সেই সেই অঞ্চলে এই সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল । বালুচিস্তানের বোলান নদীর তীরে কৃষি ভিত্তিক নদীমাতৃক যে সভ্যতার সন্ধান পাওয়া গেছে, তাকে প্রাক হরপ্পা সভ্যতা বলে ধরা হয়ছে । এবং মনে করা হয়ে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত শুকনো নদী খাদে বয়ে যেতো সরস্বতী । এই নদীর তীরে কৃষিভিত্তিক নদীকেন্দ্রীক হরপ্পা সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল । পরে ভয়ঙ্কর ভূমি কম্পের ফলে নদী ভূগর্ভে অন্তর্ধান হলে এই সভ্যতা নানা রকম পরিবর্তনের সম্মুখীন হয় । কারো কারো মতে ভূ-পৃষ্ঠ ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় সিন্ধু অঞ্চলের মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের অনেকাংশে মরুভূমির প্রভাব পড়ায় ধীরে ধীরে মাটি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর ফলে এ সভ্যতা আর আগের মতো শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। মর্টিমার হুইলারের মতে, সভ্যতার শুরুতে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও বনাঞ্চলের যে চিত্র ছিলো তা শেষ দিকে ছিলো প্রায় অনুপস্থিত। এতে কৃষি-ব্যবস্থার পাশাপাশি বন্দর হিসেবে মহেঞ্জোদারো নগরীর গুরুত্ব হ্রাস পায়। ড. হুইলার মনে করেন সিন্ধু সভ্যতার পতনের বেশ আগে থেকেই এর পতনের আভাস পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালের মহেঞ্জোদারো নগরীকে তিনি পূর্বের মহেঞ্জোদারোর ‘ছায়ামাত্র’ বলে অভিহিত করেন।এই সভ্যতার ধ্বংসের পেছনে অনেক ঐতিহাসিক প্রবল ভূমিকম্পের ফলে সরস্বতী নদীর হারিয়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন । 

ভৌগোলিক দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে কি সরস্বতী নদী শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ?অনুমান করা যায় যে বৈদিক সরস্বতী (আঞ্চলিক নাম সরসুতী) হরিয়ানার থানেশ্বর অঞ্চলে প্রবাহিত। ঋগ্বেদে (VIII, 36.6 সূক্ত) বলা হয়েছে সপ্তথি সরস্বতী নদীগুলির মাতা (সিন্ধুমাতা) একসাথে দুগ্ধ ও স্রোতস্বিনীদের নিয়ে বিপুল গর্জনে তীব্র স্রোতে প্রভূত জলধারায় স্ফীত হয়ে প্রবাহিত।
ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি,অন্যটি নদী। সরস্‌ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈপ্‌প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী-এ মত স্বামী নির্মলানন্দের।আলোকময়ী বলে সর্বশুক্লা।শংকরনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী।ঋগ্বেদেএবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া,ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়।বেদেরমন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতি জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।দেবীভাগবতে সরস্বতী জ্যোতিরূপা।ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে। এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত,জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত।কবি বিহারীলাল চক্রবতী সারদামঙ্গল কাব্যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন।রামায়ণরচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন,সে সময়জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।ঋগ্বেদেইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুদ ওঅশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনো-বাইন্দ্রের চিকিৎসক।শুক্লযজুর্বেদে তিনি চিকিৎসক রূপে রুদ্র অশ্বিদ্বয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।সরস্বতীর রোগ নিরাময় শক্তির কথা পরবর্তী সময়েও জনশ্রুতিতে ছিল।‘কথা সরিৎসাগর’-এ সোমদেব (একাদশ শতক) জানিয়েছেন,পাটলিপুত্রের নারীরা রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ঔষধ ব্যবহার করতেন।নিরুক্তকারযাস্কের মতে, সরস্বতী শব্দের অর্থ যাতে জল আছে। সৃ ধাতু নিষ্পন্ন করে সরশব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। নদী সরস্বতী আর্যভূমিরঅন্যতম নদী-রূপে ঋগ্বেদে বহুবার কীর্তিত ও স্তোত হয়েছে। ঋগ্বেদে সরস্বতীসিন্দু ও তার পাঁচটি উপনদী নিয়ে সপ্তসিন্ধুর বারংবার উল্লেখ আর্যভূমিতেএদের অপরিসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে।‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’ – অর্থাৎ নদী হিসাবে সরস্বতীকে। সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই হয়তো শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী বিদ্যার দেবী হয়ে উঠেছেন। সরস্বতীর আর-এক নাম ভারতী। তিনি ‘ব্রাহ্মণ’-এ বাক্ নামে পরিচিতা।দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সরস্বতীকে ব্রহ্মার মানসকন্যা হিসাবে কল্পনা করা হয়।সরস্বতীর বাহন হাঁস ছাড়াও মেষ আর বরাহকে পাওয়া যায়।প্রত্নতাত্ত্বিক এন এস ভট্টসারি একটি লেখায় বলেছেন,এই নদীর তীরে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তার অধিবাসীরা মেষ এবং শূকর পালন করতেন এবং সরস্বতীর নির্মলধারায় হাসেরা খেলা করত । হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন।গান্ধারের পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে।পাথরের একটি ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, এর সঙ্গে হিন্দুদের সরস্বতীর কোনো পার্থক্য নেই।মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদিত ছিল। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ১৬ জন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতম হলেন সরস্বতী।শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর জৈন সম্প্রদায় উভয়েই সরস্বতীকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীত একজন প্রধান দেবীরূপে স্থান হয়ে গেল।শুধুবৈদিক যুগে নয় পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুরপর্বতে, এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতেঅবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণা বৃক্ষের নিকটে, তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ। এতি হিন্দুদের তীর্থস্থান।ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, পক্ষান্তরে সরস্বতী নদী ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি।সরস্বতীও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত।মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতনার মরুভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা হল চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ওনাগোদ্ভেদ। রাজস্থানের মরুভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়। আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়।তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। ভারতের বর্তমান উদয়পুর,মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিমপ্রান্তে মরু অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভুটানের মরুভূমিতে সরস্বতীর বিলোপস্থানই বিনশন। লাট্যায়ণেরশ্রৌত সূত্র মতে, “সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিত,তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন হয়ে প্রবাহিত, সে অংশকেউ দেখতে পায় না,তাকেই বিনশন বলা হয়”।অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে।মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশন নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে।নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে।অনেকেই বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী।সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী।নদী সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনে এত রেখাপাত করেছিল যে পরবর্তীকালে গঙ্গাসরস্বতীর স্থান দখল করলেও তারা তাকে ভুলতে পারেনি। প্রয়োগে অন্তঃসলিলারূপেগুপ্তভাবে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে সরস্বতীর সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে গঙ্গার স্রোত ধারা থেকে সরস্বতীর মুক্তি হিন্দুদের প্রিয় ওপবিত্র বিশ্বাস। সরস্বতী নিয়ে নানা ব্যাখ্যা নানা বিশ্লেষণ প্রচলিত আছে।তাই সঠিক সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা, তবে অসম্ভব নয়।হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী যুগে দীর্ঘ মরুভূমির পথ পেরিয়ে মানুষের যে দলটি পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ নদীবহুল অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারা নিজেদের আর্য নামে অভিহিত করেছিল। নদী তাদের জীবনে সর্বরকম সহায়তা করে এতটাই স্বস্তি দিয়েছিল যে তারা আন্তরিকভাবেই এই নদীরূপা শক্তিকে বন্দনা করেছিল। এভাবেই বৈদিক সভ্যতার পত্তন হল, শুরু হল ঋষিদের মননসমৃদ্ধ বৈদিক ধর্মচিন্তার, যার ফসল হল ঋক্‌, সাম যজুঃ ও অথর্ব নামক বেদসমূহ।
যে কোন কাজেই শক্তি বা তেজের প্রয়োজন বা প্রয়োগ অবধার্য। খোলা চোখেই দেখা যায় সূর্য হল এই পৃথিবীর পক্ষে এক অফুরন্ত তেজের আধার। তাই স্বাভাবিকভাবেই সূর্য আমাদের প্রথম দেবতা। কিন্তু আমরা তো জানি, শুধু বাবাতে আমাদের মন ভরে না, মাকেও চাই। আসলে মায়ের আদরই তো আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি। তাই একজন মাতৃরূপা দেবীরও আবশ্যক হল। যে বিশাল জলধারা মাতৃস্নেহে আর্যজাতিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে লালন করেছিল, তিনিই তো হতে পারেন আমাদের প্রথম দেবী। এই দেবীর নাম হল সরস্বতী, কারণ সরস্‌ শব্দের অর্থ জল।
শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধানা এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্যা ছিলেন। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।

তবে নদীরূপা ছাড়াও ঋক্‌ বেদে সরস্বতীর আরেকটা পরিচয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সরস্‌ শব্দের আদি অর্থ জ্যোতি। সূর্যরশ্মির তিনটি রূপ ইরা, ভারতী ও সরস্বতীর একত্রিত রূপ হল সরস্বতী। ইনি ত্রিলোকের সর্বত্রব্যাপী সূর্যতেজের স্ত্রীশক্তি। ইনি স্বর্গ-মর্ত্যকে দীপ্তি দ্বারা ব্যাপ্ত করে বিরাজমান। বেদে জ্যোতিরূপা সরস্বতীর উদ্দেশ্যে অনেক শ্লোক উৎসর্গ করা হয়েছে। একটা অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী কুব্জা ছিলেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, এই বর্ণনা একই সঙ্গে সূর্য তেজোময়ী সরস্বতী এবং নদীরূপা সরস্বতীর ইঙ্গিত দেয়। আলো যেমন এঁকেবেঁকে যেতে পারে, তেমনই নদীর স্রোতও আঁকাবাঁকা ভাবেই চলে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, আকাশের ছায়াপথ নামক অংশটিই হল দিব্য বা জ্যোতিরূপা সরস্বতী।

দেবী সরস্বতীকে আমরা জানি শুধুমাত্র বিদ্যাদায়িনী হিসেবে। কিন্তু বৈদিক যুগে আরো অনেক গুণের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। 'প্রণো দেবী সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী' -- তিনি বাজিনীবতী অর্থাৎ অন্নদায়িনী। সূর্যকরের সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। পৃথিবী শস্যশালিনী হয়। এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন। ঋষিদের বারবার প্রার্থনা, সরস্বতী যেন তাঁদের ধন দান করেন। নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল; নদীর জল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল। তাই দেবী হলেন ধনদাত্রী। পরবর্তী কালেও সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
তিনি দানবদলনী। যে ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আর্যসভ্যতার বিকাশ, সেখানে নদী সরস্বতী প্রাকৃতিক ভাবেই প্রহরীরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাই আত্মরক্ষার জন্য আর্যরা সরস্বতীর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পৌরাণিক যুগেও দেবীর এই শত্রুদলনী রূপটি বর্তমান ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে 'সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যার্দিনীম্‌।'

বেদে নিরামিষ ও আমিষ খাবারের খুব সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।  বেদ বলছে, তুমি বৈষয়িক চিন্তা করতে করতে এবং অপরের অমঙ্গল প্রার্থনা করতে করতে যে খাবার খাও তাই আমিষ খাবার।  আর অপরের মঙ্গল কামনা করতে করতে, সৎ  চিন্তায় মগ্ন হয়ে যে খাবার খাওয়া হয় তা নিরামিষ খাবার।  

সরস্বতী নদীর তীরে বসে ঋষিররা তপস্যা করেছিলেন মাছ খেয়ে।  তার উল্লেখ আমরা বেদে পাই।  বেদ বলছে যে খাদ্য তোমার শরীরের জন্য ভালো, যা হজম করতে পারবে তাই খাও।মহাভারতের শল্য পর্বের ৩৮ নম্বর শ্লোকে এর উল্লেখ আছে।

সূর্যের তেজোরূপা হবার দরুণ সূর্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে তাঁকেই দান করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় যখন যে দেবতা প্রাধান্য পেয়েছেন, তখন তাঁর গুণগুলিও সরস্বতীতে আরোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। তাই তিনি কখনও শত্রুদলনী, কখনও চিকিৎসকও বটে। এই কারণে তাঁকে সূর্য, ইন্দ্র, মরুৎ ও দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমা্রদের স্ত্রী হিসেবেও উপস্থাপিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্ত্রী বলে পরিচিতা হয়েছেন। ব্রহ্মা, পুরাণানুসারে বেদকে ধারণ করেছিলেন। জ্ঞানের উৎস এই বেদ, তাই ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হলেন সরস্বতী বা সাবিত্রী। ত্রিদেব ধারণাতে বিষ্ণু ছিলেন প্রধান দেবতা, তাই প্রধানা দেবীকে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেই ধরা হয়েছে।


বেদে সরস্বতীর উল্লেখ একটি নদী হিসেবে আছে, যার আবহাওয়া এবং চারিপাশের বাস্তু বিদ্যাচর্চারর জন্য বিশেষ উপযোগী ছিল। ঋষিগন এই নদীর তীরে বসে বেদ রচনা করেছিলেন।  আকাত্ম হয়ে এই মহান কাজ করেছিলেন।  এবং সেই সময় জীবন ধারণের সকল উপাদান যেমন জল,খাদ্য,নির্মল বাতাস এই নদী তাদের যুগিয়ে ছিল, তাই সরস্বতী হচ্ছেন বিদ্যার দেবী।  পরবর্তী হিন্দু শাস্ত্রে এই নদীকে বিকৃত করে বর্ত্তমান এ আমরা যে রূপে দেখি সেই রূপ দিয়েছে।  

আমার মনে হয় বেদ, উপনিষদ এবং গীতা পড়া উচিৎ,  পুরাণ না। কারণ পুরাণ বহু যুগ পরে রচিত কিছু কাল্পনিক গল্প কথা, বেদকে বিকৃত করা হয়েছে এতে।  যম এবং যমী দুই ভাই, বোন।  প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে যমী দিন এবং যম রাত্রিরর প্রতীক।  দিনের সাথে রাত্রির মিলন কোন দিন সম্ভব না।  কিন্তু পুরাণ কত বিকৃত,  এতে লিখেছে যম তার বোন যমীর সাথে সংগমের ইচ্ছায় তার পিছু নেয়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)