আমার নেশা [নাচ]
‘নাচ’ এই শব্দ টা শুনলেই আমার শরীরে মনে এক শিহরণ খেলে যায়। ছোটো থেকেই নাচ আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমার মা বলেন আমি যখন হাঁটতে শিখেছি তখন থেকেই কোনো কোনো গান শুনলেই আমি হাত পা নেড়ে নাচ করতে শুরু করতাম। আমার বাবা চাকুরী করতেন DVC (দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন)সেই সুবাদে ওনার পোস্টিং গুলো গ্রামের দিকেই হতো, আমি যখন এক বছরের তখন বাবার পোস্টিং হয় বর্ধমান জেলার পানাগড়ের কাছে দামোদরে পাড়ে রণডিহা গ্রামে , তখন ওখানে ইলেকট্রিক ছিল না, আমাদের কলোনি তে রাত দশটা পর্যন্ত জেনারেটার চলতো, আমি ১৯৭০ সালের কথা বলছি তখন আমি চার বছরের সেই সময় ওয়ি গ্রামে কারো বিয়ে হলে নাচুনী আনা হত বিশেষ করে যখন বউ নিয়ে আসতো পাল্কী করে, ছেলেরাই মেয়ে সেজে ঘাঘ্ররা ওড়না পরে নাচত আমি ছোটো থেকেই ওই নাচ দেখার জন্য চলে যেতাম তাতে আমাদের নেমন্ত্রন্ন থাকুক বা নাই থাকুক, ঘুঙ্গুরের শব্দ আমাকে পাগল করে দিত। সে সময় তো টিভি ছিলনা, আমাদের বাড়িতে গ্রামাফোনও ছিলনা রেডিও তে গান শুনে শুনে নাচ করতাম, কিভাবে নাচতে হয় কি করে পায়ের কাজ করতে হয় কিছুই জানতাম না তবু জানিনা নিজের ভিতরে একটা ইচ্ছা উৎসাহ ক্সজ করত। সিনেমাও দেখিনি তখনো কারণ সিনেমা হল ছিল পানাগড়ে যা প্রায় সাত আট কিলোমিটার দূরে, যখন থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি তখন গ্রামে একবার যাত্রা হল আমার বাবা এবং কিছু কন্ট্র্যাকটর আর গ্রামের জমিদারের উৎসাহে যতদিন প্যান্ডেল বাঁধা হছিল আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, না জানে কি হবে কত নাচ হবে গান হবে, অবশেষে এল সেই দিন আমার জীবনের প্রথম যাত্রাপালা “সন্তান” মিতা চ্যাটারজী অভিনয় করেছিলেন, আমরা সব বাচ্চারা এতো আগ্রহ নিয়ে দেখেছিলাম যে পুরোটা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল পরে আমরা কলোনীর ছেলেমেয়েরা ওই যাত্রার স্ক্রিপ্ট লিখে নিজেরা অভিনয় করি এবং মা কাকিমা কাকুদের সামনে করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলাম তাতে আমরা কিছু নাচ করেছিলাম এবং বলাবাহুল্য যে আমি অগ্রণী ভূমিকায় ছিলাম। নাচের সাথে সাথে অভিনয় ও আবৃতি তেও যেনো আমার নেশা ধরে গিয়েছিল। স্কুলে দিদিমণি মাস্টারমশাই রা আমাকেই কবিতা পাঠ করতে বলতেন , আমি তখন বুঝতাম না কেন, আমার বাবা খুব ভালো আবৃতি অভিনয় করতেন, হয় তো সেটাই আমার মধ্যে এসেছে, একবার ওই বয়সেই সব বন্ধুদের কে নিয়ে নাচ শেখানো শুরু করি এবং আমাদের কোয়ার্টারে ঢুকতে চাতাল ছিল তার সামনে চেয়ার পেতে মা কাকিমাদের সামনে সবাই মিলে নাচ দেখাই, তখন সবাই মা-কে বলেন আমাকে নাচ শেখাতে কিন্তু রণডিহা তে তা সম্ভব হয়নি/ এরপর বাবার বদলি হয় বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী তে এখানেও আমাদের কলোনী এক প্রান্তে বাকী সোনামুখী শহর ও বিভিন্ন পাড়া আর এক প্রান্তে, অপরূপ সৌন্দর্যময়ি এই সোনামুখী , শাল পিয়াল পলাশ মহুয়ায় সাজানো এখানে আমি সোনামুখি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাশ ফাইভে ভর্তি হই, এই স্কুল ১৮৫৭ সালে স্থাপিত এবং আমি যখন ভর্তি হই ১৯৭৫সালে ছাত্রী সংখ্যা ছিল ৮০০। এই স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী তে প্রথমবার আমি “দামদর শেঠ” কবিতা টি আবৃতি করি কিন্তু এতো মেয়ে আর অতো দিদিমণিদের সামনে ভয় পেয়ে কিযে বলেছিলাম কেউ শুনতে পায়নি,তাই নিয়ে আমার বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করেছিল, কিন্তু ক্লাস সিক্সে যখন উঠলাম সেবছর ইলেভেন এ মামাধ্যমিক উঠে গিয়ে ক্লাশ টেন এ হয়ে গেলো তো দুই ব্যাচের দিদিদের farewell দেওয়া হল সে অনুষ্ঠানে আমি লিচুচোর কবিতা টি করি যদিও অনুষ্ঠনের আগেই দিদিমনিরা ক্লাশে এসে এসে আমার আবৃতি শুনে ফেলেছিলেন তারপর থেকে আমাকে নিজে থেকে কোনো অনুষ্ঠানে নাম দিতে হয়নি আমার জায়গা পাকা হয়ে গিয়েছিল। ক্লাশ সিক্স থেকে আমার নাচ শেখা শুরু হয় নাচের দিদিমণি প্রথম দিনই আমার নাচের ভঙ্গি দেখে বলেছিলেন এর নাচ যেনো কোনোদিন বন্ধ না হয়। সে যে কি উৎসাহ ঘুঙ্গুর বানানো, আমরা নিজের হাতে দড়ি তে ঘুঙ্গুর বেঁধেছিলাম, দিদিমণি তখন সপ্তাহে দু দিন আসতেন, সেই দুদিন স্কুল থেকে এসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, অবাক হয়ে দেখতাম দিদিমণির নৃত্য ভঙ্গিমা, কি করে উনি পায়ে নূপুরের বোল তুলতেন, আমি আমার স্বপ্নকে সামনে পেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতাম, ধীরে ধীরে শুরু হলো বিভিন্ন তাল শেখা প্রথমে রবীন্দ্র নৃত্য শিখেছি ভালোভাবে, দিদিমণি মা র কাছে আমার খুব প্রশংসা করতেন কারণ আমি খুব তাড়াতাড়ি শিখেনিতাম। বছর খানেক শেখার পর আমাদের কলোনিতে এক প্রোগ্রামে আমরা গ্রুপ ডান্স ও সোলো ডান্স করি, তখন আমার নাচ দেখে সোনামুখী কলেজের এক প্রফেসার দম্পতী তখন ওনারা দুজনেই রেডিও তে গান গাইতেন (আমি কাকু কাকিমা বলতাম) মা কে বলেছিলেন যেনো আমার নাচ কখনো বন্ধ না করে, তো এই ভাবেই চলছিল আমার নাচ শেখা সাথে আবৃত্তি নাটক, ক্লাস সেভেন এ উঠার পর মা উঠে পডে লাগলেন আমাকে গান শেখানোর জন্য, কিন্তু আমার তন মন তো নাচের নেশায় মত্ত ছিল, তবু মায়ের ইচ্ছায় শুরু হল গান শেখা , এল হারমোনিয়ম, এক কাকিমা ছিলেন আমাদের কলোনিতে উনি রেডিয়ো তে গান গাইতেন হল ওনার কাছে গানের হাতে খড়ি, প্রথমে তো কি ভাবে বসে হারমোনিয়ম বাজাতে হয় তা শিখলাম,তারপর শুরু হল সরগম প্রথমে তো মন ই লাগতো না মনে হত কবে গান শিখবো, ছয় সাত মাস এভাবে চলার পর প্রথম গান “আয় তবে সহচরী” এবং প্রথম রাগ ভৈরব বন্দিস”ধন ধন মুরত” আমার গান শুনে সবাই খুব প্রশংসা করত তাই মা ও খুব খুশি ছিলেন কিন্তু আমি আনন্দ পেতাম নূপুরের ধ্বনিতে, যে কোনো গানে চেষ্টা করতাম তার মানে অনুযায়ী নাচ করার, আমার নাটক শেখা শুরু হয় ক্লাশ ফাইভ থেকে প্রথম নাটক রবীন্দ্র নাথের “নটির পূজা” তাতে আমি ভিক্ষুণীর পার্ট করেছিলাম, যখন ক্লাশ টেন এ উঠলাম বাবা বললেন “এবার সব কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখো পড়ায় মন দাও” কিন্তু মন তো মানে না কলোনিতে বর্ষার অনুষ্ঠান শুরু হলো আর আমি নাচবো না তাতো হতেই পারেনা আমি নাচলাম “ এসো নঁক পবনে ছায়া বিথী তলে” গানের উপর কলসি নিয়ে আমার নাচ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল তাই বাবা ও আর কিছু বলেন নি, ফাইনাল পরীক্ষার আগে আমারা পানাগড়ে চলে এলাম্ বাবার বদলির জন্য আর মা পানাগড়ে কাঁকসা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হয়ে এলেন তাই আমাদের নিজের বাড়ি পানাগড়ে ই বানানো হলো, বন্ধ হয়ে গেলো আমার নাচ শেখা কিন্তু আমি পাগলের মত ঘরে নাচতাম, পানাগড়ের প্রতিটি প্রোগ্রামে আমার বন কে নাচ শেখাতাম মা এর স্কুলের দিদিমণিরা ওই অঞ্চলের সবাই খুব প্রশংসা করতো তবু জানিনা বাবা আমাকে বাইরে আর নাচ করতে দিতেন না,বোনের নাচের সাথে গান আমিই গাইতাম, এখানে আমি ক্লাশ এলেভেন এ ভর্তি হই কাঁকসা উচ্চ বিদ্যালয়ে, নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আমি সুকান্ত্ র প্রিয়তমাসু কবিতাতি আবৃতি করি যখন প্রিন্সিপাল ভাষণ দিতে উঠলেন উনি কিছু কথা বলার পর আমার আবৃতির খুব প্রশংসা করলেন, ব্যাস এই স্কুলেও হয়ে গেলো নাম আবৃতি তে, এরপরে স্কুলের বার্ষিক প্রতিযোগিতায় প্রথম হলাম আবৃতি আর ডিবেটে, তখন তখন খুব সকারি লেভেল এ কম্পিটিশন হত প্রথমে পঞ্চায়েতে তারপর ব্লক লেভেল এ তারপর ডিস্ত্রিক্ট লেভেল এ সব কম্পিটীশন এ আমি প্রথম হতাম আবৃতি আর ডিবেটে,(একটা কথা বলতে ভুলে গেছি আবৃতি নাটক আমার বাবা শেখাতেন) দুরগাপুর রাণীগঞ্জ সব জায়গাতে আমি প্রাইজ পেয়েছি কিন্তু এর মধ্যে আমার নাচ যেনো হারিয়ে যেতে বসেছিল, এর মধ্যেই টুয়েলভ এ পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গেলো Indian Air Force এ চাকুরী রত পাত্রের সাথে, বাবা কারো কোনো কথা শুনলেন না, তবে তাতে আমার খারাপ কিছু হল না বরং ভালোই হলো, আমার স্বামী সর্বত ভাবে আমাকে support করলেন, শুরু হল Air Force এ আমার নাচের নতুন জীবন, পড়াশুনার সাথে সাথে নাচ ও চলল, টিভি তে ডিডি ওয়য়ান এ রাত ১১ টার সময় ক্ল্যাসিকাল এর প্রোগ্রাম হোতো এখনো হয় সেই প্রোগ্রাম দেখে নিজের নৃত্য শৈলী আরো উন্নত করার চেষ্টা শুরু করলাম, এয়ার ফোরসের বিভিন্ন প্রোগ্রামে নাচ করতে লাগলাম, Air Force e ladies দের জন্য AFFWA(Air Force Family Welfare)group আছে তাতে প্রতি মাসে একটা প্রোগ্রাম হয় আমি তাতে অগ্রণী ছিলাম নিজে তো নাচতাম অনান্য মহিলাদের কেও শিখাতাম তাছাড়া বছরে তিনটে বড় অনুষ্ঠান হয়, জনাষ্টমি, দুর্গা পূজা, Air Force Day(8th October)প্রতিটি প্রোগ্রামে আমার মুখ্য ভুমিকা থাকত, প্রতি দুর্গা পূজায় ৪০ মিনিটের একটা গীতি নাট্য “মহিষাসুর মর্দিনী” যা রবীন্দ্র নৃত্য ও ভারতনাট্যমের আঙ্গিকে শেখাতাম, এছাড়া ক্লাসিকাল বেস ফিল্মি নৃত্য, ফোক, রবীন্দ্র নৃত্য সব করতাম করাতাম, ভারতের যেখানেই আমার স্বামীর পোস্টিং হয়েছে সব জায়গায় আমি নাচ শিখিয়েছি, গান, নাটক সব করেছি।যে বার আমি “লাগা চুনরী মে দাগ” নাচটা করি কত্থকের উপর, সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল কারণ গানটা পুরো সাত মিনিটের, সবাই বলে বিনা টেকে সাত মিনিট এক সাথে নাচা অসম্ভব । অনেক বার আমাকে সম্মান দিয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, কিন্তু এ সব Air Frce এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এটাই আক্ষেপ, এর বাইরে আমি কিছু করিনি কারণ সে সুযোগ এবং সময় পাইনি, বিভিন্ন স্কুলে Music Teacher এর চাকরী করেছি, কারণ নাচে না পারলেও গানে আমি পরীক্ষা দিয়েছি, বিশারদ করেছি, তবুও আমি নাচ পাগলের মত ভালোবাসি, স্কুলেও প্রতিবারই বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমি দু একটা নাচ শিখিয়েছি প্রিন্সিপাল এর অনুরোধে(নাচের শিক্ষিকা থাকতেও) মেয়েকেও শিখিয়েছি, স্বামী রিটায়ার করার পর দিল্লী তে স্থায়ি হয়েছি। এখানেও কিছু অনুষ্ঠান করেছি মেয়েকে নিয়ে। এখন আমার হাঁটুতে ব্যাথা আস্টো আরথারাইটীস, কোমরের ব্যাথায় মাঝে মাঝে ই শয্যা শায়ী হয়ে যাই, তবুও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা এখনো মাঝে মাঝে নেচে উঠি, নাচ আমার অঙ্গে মনে প্রাণে সারাজীবন রয়েছে থাকবে, আমাকে কোনো কিছুই আটকাতে পারবেনা এর জন্য প্রচুর সম্মান, আদর পেয়েছি, হয়তো বড় আর্টিস্ট এর তকমা লাগেনি কিন্তু Air Force এর যেখানে পোস্টিং হয়েছে সব জায়গায় আমি সবার চেনা এবং ভালোবাসার পাত্রী ছিলাম নাচের জন্য। আমি স্বপ্নেও দেখি আমি নাচচ্ছি, নাচ আমার নেশা, নাচ আমার জীবন।
সুচিন্তিত মতামত দিন