ইন্দিরা দাশ - মায়াজম

Breaking

২৪ আগ, ২০১৮

ইন্দিরা দাশ

                          নেশারু
Image result for wallpaper of drinks
"আরে, লোকটা এমনিতে তো ভালই। কিন্তু এত নেশা করলে দিনের বেলায় এমন অবস্থা তো হবেই!" ব্যাঙ্কের কাউন্টারের বাইরের লাইনে কথাটা শোনা গেল। বক্তা গলা নামানোর বিশেষ চেষ্টা করেননি। আর করেই বা কি হবে, এ তল্লাটে, এই গন্ডগ্রামের একমাত্র ব্যাঙ্কে সোহম ব্যানার্জি'র এই পরিচয়ই সবাই জানে। সোহম বাবু নিজেও কি জানেনা? সকালের সময়টায় সাধারণত ব্যাঙ্কের বাকি কর্মচারীরা কেমন চটপটে ঝাঁ-চকচক উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। সেখানে লালচে চোখ কচলে, কোনমতে গোটা-দশেক হাই আড়াল করে সোহমের সকাল শুরু হয় ক্যাশ-কাউন্টারে। গোণাগুণতি'তে ভুলভাল সে করেনা। তাই বড়বাবু স্নেহ করেন। কিন্তু নিখুঁত অথচ ঢিমে তেতালায় যে গতিতে সে কাজ করতে থাকে তা দেখতে দেখতে সামনের কাস্টমার ধৈর্য হারাতেই পারে। কি শান্ত হেসে বিরক্তির ছোটখাটো বক্রোক্তিগুলো অগ্রাহ্য করে কাজ করতে পারে সোহম! তার সহ্যশক্তি দেখে শুধু তার সহকর্মীরা অবাক হয়না, হয় কিছু কিছু বাইরের লোকও। 
"একটু লাল চা খাবেন বাবু?" পিয়ন করিম চাচারও কষ্ট হয় মাঝেমাঝে ফর্সা, রোগা, মুখচোরা মানুষটাকে দেখতে দেখতে। কেন যে হাসনাবাদের শেষ প্রান্তে এই ব্যাঙ্কে মানুষটা উঠে এসেছিল, আর এসে এখানেই পড়ে রইল তা সে ভেবে উঠতে পারেনা। 
সোহম বাবুর কোয়ার্টারের কাজটুকুও সে’ই করে দেয় বিগত এগারো বছর হল। আগে আগে তো চব্বিশ ঘন্টাই সে বাবুর কাছে থাকত। বছরখানেক হোল হাঁস-মুরগী পালবার ঝোঁক ধরেছে, তাই নিজের পুরনো ঘরখানা সারিয়ে নিয়েছে চাচা। 
সোহম একলা মানুষ। সকালের জলখাবার, টিফিন আর রাতের রুটিটুকু শুধু করে দিতে হয়। অল্প ক'টা জামাকাপড় কাচা। দুখানা ঘর, তার মধ্যে ভেতরের যে ঘরটাতে সারারাত বোম-ভোলানাথ হয়ে নেশার ঘোরে সে বসে থাকে সেখানে তো কাউকে ঢুকতেই দেয়না বাবু। 
"আরে চাচা, ওঘরে আমার বড় জরুরি জিনিসপত্তর থাকে, আমি নিজেই পরিস্কার করে নেব। তুমি কিন্তু আমার সাদা শার্ট দুটো ইস্তিরি না করিয়ে দিলে পরপর দুদিন আমার আফিসে পরবার জামাকাপড় থাকবেনা, একটার কলারের কাছটা একটু রিফুও করিয়ে দিও!" 
সোহমের কথা শুনে কি অল্প অপত্যস্নেহ জাগে করিমের মনে! ছেলেপুলে তার হয়নি তো কি হয়েছে, বিবি মরে যাওয়া ইস্তক এই সাধাসিধে লোকটার দেখাশোনা করতে করতে এমন মিঠে কথায় কেমন যেন মায়া জড়ায় তার মনে। 
দোষ শুধু একটাই। প্রায় রাতভর ভেতরের ঘরটায় আলো জ্বলে। মানুষটা জেগে আছে টের পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে পায়ের শব্দ শোনা যায়, মাঝেমধ্যে কলের গান বাজে। না, চিৎকার, অসভ্যতা নেই, বোতল ভাঙাভাঙিও না। রাত বাড়লেই সিগারেট ধরায় বাবুটা, সে আবার পাতলা কাগজে তামাক পাকিয়ে নিজেরটা নিজেই বানায় সে। নেশাটা সেভাবেই নিশ্চয়ই করে। আজকাল অনেক মানুষই এই সব ড্রাগের নেশার কবলে পড়ে। বুধন চাষির ছেলেটা শহরে পড়তে গিয়ে এসব চক্করে পড়ে মরেই গেলো! এ বাবুটাও বোধহয় মাস মাইনের টাকা এতেই উড়িয়ে ফ্যালে। তিনকুলে তার কেউ বোধহয় নেই। কোনও আত্মীয়-বান্ধব আসেনা। বছর চল্লিশের মদ্দা মানুষটার মেয়েছেলের প্রয়োজনও পড়েনা! শুধু দু'মাসে, তিন মাসে লোকটা শহরে গিয়ে পিঠে ভারী রুকস্যাকটা নিয়ে ফেরে। একলাই ফিরে আসে। নেশার জিনিসপত্র, চরস, ভাঙ, এসবেরই প্রয়োজন হয়ে পড়ে ,আর কি হবে! এছাড়া আর কি আনতে দৌড়বে সে। মাথার ওপর বাপ-মা নেই, তাই এ বদভ্যেস ছাড়বার জন্য বলা-কওয়ার মানুষেরও অভাব। 
একতলা কোয়ার্টার'টার ছোট ভেতরঘরের আলো ভোর হওয়ার একটু আগে নিবে যায়। লোকটা বোধহয় ঠিক তিন কি চার ঘন্টাই প্রতিরাতে ঘুমোয়। তবু কাজের জায়গায় তার ভদ্র ব্যবহার দেখে আশ্চর্য হয় অনেকে। 
আশ্চর্য হয়না শুধু সোহম নিজে।
অফিস থেকে ফিরে গা ধুয়ে, সকালের তাড়াহুড়োয় না পড়া কাগজটা পড়তে পড়তেই রাত হতে থাকে। করিম চাচাকে তাড়াতাড়িই ছেড়ে দেয় সে। তরকারি-রুটি ছাড়াও বয়স্ক মানুষটা মাঝেসাঝে দিশি মুর্গির ডিম-কারি করে দিয়ে যায়। ব্যাস, তাই দিয়ে যথেষ্ট তৃপ্তির অল্প একটু খাওয়া।

"দোরটা দিয়ে যান বাবু, আপনি যা বেখেয়াল," করিমের কথা শুনে সদর দরজাটা বন্ধ করে এসেই নিজের জগতে পা রাখে সোহম। ভেতরঘরের সুন্দর আলোটা জ্বালিয়ে তার দরজাটাও এঁটে বন্ধ করে সে। তার নিশ্চিন্ত বিশ্রামে কেউ বিরক্ত করুক তা তার পোষাবে না। এটা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব এলাকা, যেখানে প্রবেশ করলে আর তার কোন অভাববোধ থাকেনা। হুঁশ থাকেনা জাগতিক দুঃখ, সুখ, ব্যর্থতার সম্বন্ধে। মায়ের চোখের জলের ভয়ে ভাগ্যিস পাশ'টা করে চাকরিটা নিয়ে চলে আসতে পেরেছিল সে! অর্থ যে অনর্থ তা বাবা-মা গত হওয়ার পর খুড়তুতো ভাইরা, কাকারাও তো যথাসময়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল সোহমকে। এখানে কিন্তু এই নিভৃত একান্তে রাত এলেই তার একমাত্র নেশাটুকুর জন্য সময় বের করে নিতে পারে সে। আশেপাশের লোক যাই বলুক, এই সময়টুকুর জন্য তার মন সারাদিন মুখিয়ে থাকে। শান্ত হয়ে, একা হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় সোহম। তারপর তুলে নেয় হাতে তার নেশার সরঞ্জাম।
কি মমতায় তুলির আঁচড় পড়তে থাকে ক্যানভাসের বুকে। প্যালেটের রঙ সৃষ্টি করে পান্না বনানী, আকোয়ামেরিন সাগরের ঢেউ, গোলাপী প্রবালদ্বীপ। কোনদিন রেখায় রেখায় ভর করে বটে ফেলে আসা দিনের চেনা একজোড়া চোখ। কখনও বা তুলির আঁকিবুঁকিতে হাজির হয় কমলালেবুর কোয়ার মত পাতলা ঠোঁটজোড়া, যা কিনা অনায়াসে বলে দিতে পেরেছিল প্রত্যাখ্যানের কথাগুলো। পৃথিবীর সমস্ত সুখলাভের জন্য একমাত্র অর্থবল প্রয়োজন সে ব্যাপারটা সেই মানবী কয়েক মুহুর্তে বুঝিয়ে দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল অন্য সাথীর হাত ধরে বিদেশবাসের প্রলোভনে। কিন্তু শুধু সেই ছবিতে থমকে থাকেনা সোহমের নেশারু রাত। তার ভুলে যাওয়া আর্টকলেজের স্মৃতিকে ম্লান করতে পারেনি পরবর্তীকালের কমার্স, ব্যাঙ্কিংএর পাঠ। হাসনাবাদের নদীর পার, ঠাকুমার গল্পে শোনা ওপারের ঝাপসা না-দেখা দেশ, এমন কি করিম চাচার নানা ভঙ্গিমার ছবিও ফুটে ওঠে ইজেলের গায়ে। নাই বা দেখল কেউ, নাই বা সে বাণিজ্য করল তার অন্তরের ধনটুকু নিয়ে। সমস্ত রাত ছবি আঁকতে আঁকতে একান্তে সে নিজেকে খুঁজে পায়, স্বচ্ছন্দ আরামে অবগাহন করে তার মনন। সেই নিরালা জগতে সে একলা নয়। হাজার রূপরেখায়, রঙের মধ্যে মাঝেমাঝে তার মনে হয় সে নিজেও ওদেরই একজন। সে পৃথিবীতে অপমান, লোভ, প্রত্যাখান, পরাজয় নেই। সেখানে সোহম নিজেই নিজের মধ্যে সমাহিত, ধ্যানমগ্ন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র