মদ্যের মদালসা
“মানবজীবন মধুর জীবন, মজা লোটো যখন তখন।/মদপাত্র পূর্ণ রেখো, খালি হবে গিলবে যখন।” মদ (Alcoholic drink/Alcoholic beverage) এক ধরনের পানীয় যাতে ইথাইল অ্যালকোহল বা ইথানল থাকে। ইথানল একটি স্নায়ু সংবেদনশীলতা অবদমক। এটি পান করলে মনে উৎফুল্ল ভাব সৃষ্টি হয়, সাময়িক দুঃশ্চিন্তা কমে যায় এবং সামাজিকভাবে মেলামেশা করার ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়, নেশা হয়, মোহ বা মৌজ বা ঢুলুঢুলু ভাব ধরে এবং জ্ঞানও হারাতে পারে। অনেক সংস্কৃতিতে মদ্যপান গুরুত্বপূর্ব সামাজিক ভূমিকা পালন করে।বেশিরভাগ দেশে মদের উৎপাদন, বিক্রয় এবং পান নিয়ন্ত্রণকারী আইন ও বিধিমালা আছে। কিছু দেশে মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলেই মদ্যপান আইনসিদ্ধ। ২০১৪ সালে বিশ্বে মদ্য উৎপাদন ব্যবসায় অর্থের পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
ইথানল, যা ইথাইল অ্যালকোহল নামেও পরিচিত, একপ্রকারের অ্যালকোহল। এটি দাহ্য, স্বাদবিহীন, বর্ণহীন, সামান্য বিষাক্ত ও বিশিষ্ট গন্ধযুক্ত এবং অধিকাংশ মদের প্রধান উপাদান। এর রাসায়নিক সংকেত হল CH3-CH2-OH, বা C2H6O, বা EtOH, C2H5OH বা C2H6O tongue emoticon tongue emoticon tongue emoticon
নির্জল অ্যালকোহল (Absolute alcohol) হল জলবিহীন ইথাইল অ্যালকোহল। এতে ৯৯% বিশুদ্ধ অ্যালকোহল থাকে।
এটি জৈব সংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয় অ্যাবসোলুট অ্যালকোহল ১০০% বিশুদ্ধ, জলবিহীন ইথাইল অ্যালকোহল
(C2H5OH) মেথিলেটেড স্পিরিট বা শোধিত অ্যালকোহলের সঙ্গে চুন যোগ করলে স্পিরিটে অবস্থিত জল শোষিত হয়। এরপর একে বেশ কিছুক্ষণ রিফ্লাক্স করে পাতিত করলে বিশুদ্ধ অ্যালকোহল বা অ্যাবসোলুট অ্যালকোহল পাওয়া যায়। এছাড়া রেকটিফাইড স্পিরিটের সঙ্গে বেঞ্জিন যোগ করে পাতিত করলেও অ্যাবসোলুট অ্যালকোহল উৎপন্ন হয়। অ্যাবসোলুট অ্যালকোহল বিভিন্ন সাংশ্লেষণিক এবং বিশ্লেষণমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া এর সঙ্গে প্রয়োজনমত জল যোগ করে প্রাপ্ত দ্রবণও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।
মদ সৃষ্টি এবং মদ্যপানের অভ্যাস বহু প্রাচীন। বাঙালিরা মদকে ‘মাল’ বলে। অবশ্য মাল বললে এলিটদের গায়ে লাগে, ইজ্জত চলে যায়। এলিটরা অবশ্য ড্রিংক বলা পছন্দ করে। একদিন শুনছিলাম, এক বেহেড গরিব মাতাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছিল – “আমরা খেলে বলে মাল খেয়েছি, ওরা খেলে ড্রিংক করেছে।” সংস্কৃত ‘মল’ ধাতুর সঙ্গে ‘অ’ প্রত্যয় যোগে ‘মাল’ শব্দটির আবির্ভাব, যার একাধিক আভিধানিক অর্থ আছে। যেমন -- পণ্যদ্রব্য, ধনসম্পদ, কুস্তিগির, সাপের ওঝা, মদ-সুরা, খাজনা, মালা ইত্যাদি। তবে বর্তমানে কথ্য বাংলা ভাষায় ‘মাল’ একটি চমকপ্রদ শব্দ, যার অর্থ ও প্রয়োগ ততোধিক ব্যাপক। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ‘মাল’ হতে পারে অর্থ-সম্পদ, জিনিসপত্র, মদ-মাদক, বিতর্কিত/অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব, আবেদনময়/ময়ী নারী বা পুরুষ এবং আপত্তিকর কিছু অর্থ ! শব্দটা নর-নারীর বিশেষণ হিসাবে অবমাননাকর হলেও দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার আমরা অহরহই দেখি।
পান শুরুর আগে স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী সবাই সবার মদের পেয়ালা উঁচু করে ‘toast’ জানান। সাধারণত ইংরেজিতে ‘cheers’ বা ‘bottom’s up’ জানানোই হয়। চৈনিকরা অবশ্য ‘কান পেই’, জাপানিজরা ‘খোং পে’, কোরিয়ানরা ‘গোম বে’ ইত্যাদি বলে থাকেন। বাঙালিরা বাংলা অভিধান হাতড়িয়েও ‘cheers’ শব্দটির যুতসই কোনো বাংলা তর্জমা খুঁজে পাননি। তা সত্ত্বেও বাঙালি হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। পরিশীলিত মদের আসরে বাঙালিদের কাছে ‘Cheers’ হল ‘আনন্দ করো’। অপরিশীলিত বাঙালিরা বললেন ‘মালে বাড়ি’।
হিন্দুদর্শনে মানুষের ছয়টি পরম শত্রুকে চিহ্নিত করেছেন, যা ষড়রিপু হিসাবে প্রসিদ্ধ। ষড়রিপুগুলি হল কাম (Lust), ক্রোধ (Anger), লোভ (Greed), মোহ (Delusion), মদ (Egostitic pride), মাৎসর্য্য (Jealousy)। জ্ঞানীরা বলেন, মদ বলতে এখানে ‘আমিত্ব’ বোঝানো হয়েছে। ‘আমিত্ব’ মানে নিজেকে নিয়ে মিথ্যা অহমিকা। মানুষের সাধারণভাবে জীবনযাপন করার মতো বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় বস্তুসমুহ থাকা সত্ত্বেও অতৃপ্ত মন অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী হওয়ায় মনের সে অস্থিরতা, ‘আরও চাই আরও চাই’ ভাব তার নাম মদ রিপু। মদরিপু হচ্ছে কাম-ক্রোধ-লোভের অতি মাত্রায় বহিঃপ্রকাশ। মদ রিপুর বশবর্তী মানুষের সাধারণত ঈশ্বরে ভক্তি থাকে না, তার অতিদ্রত মতিভ্রম ঘটে এবং এক পর্যায়ে মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়। মদরিপু থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজের উচুতলার ধনী লোকের দিকে নজর না দিয়ে, গরিব-দুঃখী ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের দিকে গভীরভাবে মনযোগ নিবন্ধ করলে ক্রমে-ক্রমে মদ রিপু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মানুষ মদ রিপুর বশবর্তী হয়ে যেভাবে জীবনযাপন করে, তার সামান্যতম যদি ধর্ম-কর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি নিবন্ধ করে তাহলে সহজেই মানুষের মতো মানুষ হওয়া যায়। এই মদ কখনোই ‘Alcohol’ নয়।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মদের ইতিহাস মানবসভ্যতার কৃষি-শিল্পের মতোই কয়েক হাজার বছরের পুরানো। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ সাল থেকে ৬০০০ সাল সময়টাতে প্রাচীন জর্জিয়া, ইরান, আর্মেনিয়া অঞ্চলে প্রথম মদ উৎপাদনের প্রমাণ মেলে। আদি গ্রিসের ম্যাসিডোনিয়া, মিশর এবং চিন দেশেও মদ বেশ শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। তখন মদ ছিল মূলত দ্রাক্ষারস বা প্রক্রিয়াজাত আঙ্গুর ফলের নির্যাস। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে ভারতবর্ষে প্রথম আফিম চাষ ও আফিম ব্যবসা শুরু করেছিল এবং এর জন্য একটি ফরমান জারী ও কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ করে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে আফিম উৎপাদন করে চিনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করে এবং এদেশে আফিমের দোকান চালু করে । ১৮৫৭ সালে আফিম ব্যাবসাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এনে প্রথম আফিম আইন প্রবর্তন এবং ১৮৭৮ সনে আফিম আইন সংশোধন করে আফিম ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতঃপর গাঁজা ও মদ থেকেও রাজস্ব আদায় শুরু হয় এবং ১৯০৯ সালে বেঙ্গল এক্সাইজ অ্যাক্ট ও বেঙ্গল এক্সাইজ ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। আফিম, মদ ও গাঁজা ছাড়াও আফিম ও কোকেন দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের মাদকের প্রসার ঘটলে ১৯৩০ সালে সরকার ‘The Dangerous Drugs Act-1930’ প্রণয়ন করে। একইভাবে সরকার আফিম সেবন নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৩২ সালে ‘The Opium Smoking Act-1932’ প্রণয়ন এবং ১৯৩৯ সালে ‘The Dangerous Drugs Rules-1939’ প্রণয়ন করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানদের জন্য মদ পান নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫০ সনে ‘TheProhibtion Rules-1950’ তৈরি হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সনে ‘The Opium sales Rules-1957’ প্রণীত হয়। এরপর ষাটের দশকে বেঙ্গল এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টকে ‘এক্সাইজ এন্ড ট্যাক্সেশন ডিপার্টমেন্ট’ হিসাবে নামকরণ করে অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্ত করা হয়।
মদের উপাদান : আঙুর সহ অন্যান্য ফল, চাল, গম, ভুট্টা, দুধ, মধু, বিভিন্ন গাছ-গাছড়া প্রভৃতির ভিতর শর্করা বা চিনির যে অংশ থাকে তাকে ‘ইস্ট’ (একধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছত্রাক) দিয়ে চোলাই করে বা গেঁজিয়ে অ্যালকোহলে রূপান্তর করাই মদ উৎপাদনের মূল নীতি। যেমন -- আঙ্গুর ফলের ৮০% ভাগ জল আর ২০% চিনি, যা ওই ইস্টের মিশ্রণে বাগে আনলে জল, এলকো ও আঙুরের একধরনের সুগন্ধ দ্রব্যে সংশ্লেষিত হয়। এর সঙ্গে আরও কিছু উপাদান বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি হয় নানা ধরের মদ। এক গ্লাস ৪ ওজনের সাধারণ মদে (a glass of 4oz wine) যেসব উপাদান থাকে তা মোটামুটিভাবে এরকম –- (১) জল ২৫০ গ্রাম, (২) ইথাইল অ্যালকোহল ২৫ গ্রাম, (৩) গ্লিসারিন ৩ গ্রাম, (৪) পেকটিন ১ গ্রাম, (৫) অ্যাসিড ১ গ্রাম, (৬) পলিফেনল ৫০০ গ্রাম এবং অন্যান্য সুগন্ধ দ্রব্য। মদ-মাত্রার হিসাবটা হল -- ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০০ মিলিলিটার মদে ৫০ মিলি অ্যালকোহল থাকলে তাকে বলে ৫০ মাত্রার মদ।
বাংলায় সকল কড়া অ্যালকোহলিক পানীয়গুলো মদ হিসাবেই পরিচিত। সম্ভবত ভ্যারিয়েশন বোঝেন এমন লোক কম, তাঁরা সব পানীয়কেই মদ দিয়েই চালিয়ে দিতে চান। কারণ ওয়াইন আঙ্গুর দ্বারা তৈরি মূলত, অপর দিকে জিন তৈরি মূলত জামের, ভদকা গম, আলু অনেক কিছুর হয়, শ্যাম্পেন-ব্র্যান্ডি ওয়াইনেরই একটি প্রকরণ, তাই ওয়াইন রাখাটা সুনির্দিষ্ট হয়। ওয়াইন নামটি খুব অপ্রচলিত তা বলা যাবে না। অভিধানের যে অর্থ দেওয়া তা বিবৃতিমূলক, একেবারে টু দ্য পয়েন্ট দেওয়াটা টাফ। আমরা তো সুন্দর করতে গিয়ে ‘আঙুরের মদ’ শিরোনাম দিতে পারি না, আবার অপ্রচলিত ‘অলি’ দিতে পারি না, অপরদিকে এত বিস্তৃত একটা ব্যাপার সব জেনারালাইজ করে ‘মদ’ দেওয়াটাও আমার কাছে কোনো সুন্দর সমাধান মনে হয় না। সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজার কিসিমের মদ, যাদের সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিন্যাস করা বেশ মুশকিল। তবে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। নিম্ন মাত্রার (মোটামুটি ভাবে ২০ থেকে ৩৮ মাত্রার), মধ্য মাত্রার (৪১ থেকে ৫০ মাত্রার) ও উচ্চ মাত্রার (৫৪ থেকে ৬৫ মাত্রার) মদ। মদের ধর্ম তথা গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে পণ্ডিতেরা মূল শ্রেণিবিন্যাস করে থাকেন। সেটি তিনভাগে বিভক্ত – (১) Fermented Liquors (গাঁজানো মদ) : যেমন -- আপেল মদ (Cider Wine), দ্রাক্ষা মদ (Grape Wine), বিয়ার (Beer), তাড়ি মদ, পান্তা মদ (Rice Wine) ইত্যাদি। (২) পাতিত মদ (Spirituous Liquors/Distilled Liquors) : যেমন -- হুইস্কি (Whisky), রাম (Rum), ব্রান্ডি (Brandy), টাকিলা (Tequila), ভদকা (Vodka), চিনা সাদা মদ (White Wine) ইত্যাদি। ৩) পরিশোধিত মিশ্র মদ (Refined & comprehensive drinks) : যেমন -- জিন (Gin), ভেরমাউথ( Vermouth), লিকার (liqueur), বিটার (Bitter) ইত্যাদি।
(১) বিয়ার (Beer) : মদের মধ্যে সবার উপরে রয়েছে বিয়ার। মদ্যপান শুরু করার সময় বিয়ারের মাধ্যমেই প্রায় বেশিরভাগ মানুষের হাতেখড়ি হয়ে থাকে। বিয়ার খুব কম দামে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত স্থানেই পাওয়া যায়। তাই মদের মধ্যে বিয়ারের জুড়ি মেলা ভার। হাস্যকর এই যে, যাঁরা বিয়ার পান করেন, তাঁরা এটা মদ নয় বলে আত্মতৃপ্তি বোধ করেন। বিয়ার পৃথিবীর প্রাচীনতম ও জনপ্রিয়তম মদের অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৩৫ বিলিয়ন গ্যালন (১৩৩ বিলিয়ন লিটার) বিয়ার
বিক্রি হয়। এটি এক প্রকারের গাঁজনকৃত ও কার্বনযুক্ত পানীয়, যা চোলাইকৃত যব ও জলের মিশ্রণ থেকে তৈরি করা হয়।
মার্কিন ঘরে বানানো বিয়ার প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তাদের মতে ৭০-৮০ আলাদা ধরনের বিয়ার আছে। প্রতি বছরই বিয়ারের নতুন নতুন ক্লেভার যোগ করা হয়। এই মদটির স্বাদ তেতো। সাধারণ মদের চেয়ে বিয়ারে অ্যালকোহল কম থাকে।
বিক্রি হয়। এটি এক প্রকারের গাঁজনকৃত ও কার্বনযুক্ত পানীয়, যা চোলাইকৃত যব ও জলের মিশ্রণ থেকে তৈরি করা হয়।
মার্কিন ঘরে বানানো বিয়ার প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তাদের মতে ৭০-৮০ আলাদা ধরনের বিয়ার আছে। প্রতি বছরই বিয়ারের নতুন নতুন ক্লেভার যোগ করা হয়। এই মদটির স্বাদ তেতো। সাধারণ মদের চেয়ে বিয়ারে অ্যালকোহল কম থাকে।
(২) ওয়াইন (Wine) : মদ হিসাবে দ্বিতীয় নম্বরে আছে ওয়াইন। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে ৮ থেকে ১৫ শতাংশ। যেহেতু এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ খুব কম থাকে, তাই যাঁরা কখনোই মদ পান করেননি, তাঁরাও অনায়াসেই খেতে পারেন। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই পাওয়া যায়। ওয়াইন হল একপ্রকার অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়, যা সাধারণত গাঁজনকৃত আঙুরের রস থেকে তৈরি হয়। প্রাকৃতিকভাবে আঙুরে ভারসাম্যপূর্ণ রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি থাকায় এটি অতিরিক্ত চিনি, অ্যাসিড, এনজাইম বা অন্য কোনো উপাদান যোগ করা ছাড়াই সরাসরি গাঁজন করা যায়। বিভিন্ন রকমের ইস্ট ব্যবহার করে গাঁজনকৃত আঙুরের রস থেকে ওয়াইন প্রস্তুত হয়। ইস্ট আঙুরের রস থেকে প্রাপ্ত চিনিকে অ্যালকোহলে পরিণত করে। বিভিন্ন রকম ও মানের আঙুর ও ইস্ট হতে বিভিন্ন ধরন ও মানের ওয়াইন প্রস্তুত করা হয়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপেল এবং জামের গাঁজন থেকেও ওয়াইন প্রস্তুত করা হয়, এবং সেসব ক্ষেত্রে গাঁজনকৃত ফলের নামানুসারে ওয়াইনটির নামকরণ করা হয়। যেমন: অ্যাপল ওয়াইন বা এলডারবেরি ওয়াইন।, এবং এগুলো সাধারণত ফ্রুট ওয়াইন বা কান্ট্রি ওয়াইন। এছাড়া অন্যান্য কিছুক্ষেত্রে, যেমন -- বার্লি ওয়াইন এবং রাইস ওয়াইন (যেমন -- সাকি) তৈরি হয় স্টার্চ বা শর্করাভিত্তিক উপাদান, ও পুনরায় উৎপাদিত বিয়ার থেকে। এধরনের ওয়াইন প্রচলিত ওয়াইনের চেয়ে আর একটু বেশি অ্যালকোহলযুক্ত। যেমন -- জিঞ্জার ওয়াইন বা আদা দ্বারা তৈরিকৃত ওয়াইন, এটি হচ্ছে ব্র্যান্ডি সহ ফোর্টিফায়েড ওয়াইন। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে উৎপাদনের পদ্ধতি নয়, বরং উচ্চ পরিমাণ অ্যালকোহল বিশিষ্ট পানীয়কেই ওয়াইন বলা যেতে পারে।
(৩) ভদকা (Vodka) : ‘ভদকা’ শব্দটি এসেছে রুশ শব্দ ‘ভোদা’ থেকে, যার অর্থ ‘জল’, এটি তখন ভদকা হিসেবে পরিচিত ছিলো না, এটিকে তখন ‘ব্রেড ওয়াইন’ নামে ডাকা হত। কড়া মদের মধ্যে ভদকা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়। জল ও ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার ফ্লেভার মিশ্রিত করে ভদকা তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের দানাশস্য, যেমন - রাই, গম এবং আলু, মিষ্টি আলু, চিটাগুড়, প্রভৃতির যে-কোনো একটির গাঁজনকৃত তরল থেকে ভদকা তৈরি করা সম্ভব। ভদকায় অ্যালকোহলের উপস্থিতি সাধারণত শতকরা ৩৫ থেকে ৫০ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। রাশিয়ান, লিথুনিয়ান, পোলীয় ভদকার ক্ষেত্রে এর আদর্শ পরিমাণ মোট আয়তনের শতকরা ৪০ ভাগ (৮০% প্রুফ)।
কিংবদন্তী অনুসারে ১৪৩০ সালে একজন সাধু, মস্কোর ক্রেমলিনের ভেতরে চুদোভ মনাস্ট্রিতে সর্বপ্রথম রুশ ভদকার প্রস্তুত প্রণালী তৈরি করেন। পাতনের যন্ত্র এবং বিশেষ জ্ঞান থাকায় তিনি নতুন ধরনের, উচ্চ মানসম্পন্ন একটি অ্যালকোহলিক পানীয়র আবিষ্কারক হয়ে ওঠেন। এই ‘ব্রেড ওয়াইন’ (সেসময় যে নামে পরিচিত ছিল) একটি বড়ো সময় ধরে শুধু মস্কোতেই পাওয়া যেত। এই মদ শিল্প বিপ্লবের আগে পর্যন্ত তা বাইরে পৌঁছোয়নি। এই কারণে এই পানীয়ের সঙ্গে মস্কোর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুসারে ভদকার জন্ম চোদ্দো শতকের দিকে, রাশিয়ায়। কিন্তু ভদকার উৎপত্তির সুনির্দিষ্ট স্থানটি জানা যায় না। বিশ্বাস করা হয় এটির উৎপত্তি হয়েছে দানাশস্য উৎপাদনকারী দেশগুলোতে, যার মধ্যে আছে বর্তমানের পোল্যান্ড, পশ্চিম রাশিয়া, বেলারুশ, লিথুনিয়া, এবং ইউক্রেইন। এছাড়া এটি স্ক্যানডিনেভিয়ার একটি অনেক দিনের পুরোনো ঐতিহ্য। ১৭৫১ সালে, ৮ জুন রুশ অফিসিয়াল কাগজপত্রে ‘ভদকা’ শব্দটির প্রথম লিখিত ব্যবহার হয় রুশ সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের এক আদেশপত্রে। ভদকা ডিসটিলারিসের মালিকানাস্বত্ব দাবি করে এই আদেশপত্র জারি করা হয়েছিল। ভদকা থেকে প্রাপ্ত শুল্ক ছিল জার শাসনামলের রাশিয়ার অর্থাগমের একটি বড়ো উৎস। তখন সরকারি রাজস্বের প্রায় ৪০% আসত শুধু ভদকা সংক্রান্ত বাণিজ্য থেকে।
ভদকা পুরুষদের তুলনায় নারীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। যাঁরা চড়া মদ পান করতে অভ্যস্ত, তাঁদের পক্ষে খুবই উপকারী ভদকা। ভদকার সঙ্গে কমলালেবুর রস মিশিয়ে খেলে সব থেকে বেশি ভালো লাগে। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে প্রায় ৪০ শতাংশ। ফলের রস দিয়েই বানানো হয়ে থাকে এই পানীয়টিকে। ভদকা জাদুঘরের প্রতিবেদন অনুযায়ী রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্দেলিয়েফ আদর্শ অ্যালকোহলের পরিমাণ ৩৮% নির্ধারণ করেন। কিন্তু সেসময় পাতিত স্পিরিটের শুল্ক নির্ধারণ করা হত অ্যালকোহলিক শক্তিক্ষমতা অনুযায়ী, আর এই শুল্ক নির্ধারণী হিসাব সহজ করতে এই হার কিছুটা বাড়িয়ে ৪০% করা হয়। এ ধরনের কড়া মদের ক্ষেত্রে ভদকা হিসাবে পরিচিত হওয়ার জন্য সরকার একটি সর্বনিম্ন অ্যালকোহলিক প্রুফ নির্ধারণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্ধারিত, ইউরোপীয় ভদকার ক্ষেত্রে এই অ্যালকোহলের পরিমাণের হার হচ্ছে ৩৭.৫%।
বিশ্বে কড়া মদের মধ্যে ভদকা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়। জল ও ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার ফ্লেভার মিশ্রিত করে ভদকা তৈরি হয়। কিন্তু ভদকার শুধু মদালসাতেই কাজ শেষ হয় না। ভদকার অনেক কার্যকারিতা আছে। এবার জেনে নেওয়া যাক ভোদকা বিষয়ে কার্যকারী তথ্য – (১) ভদকায় চিনি মিশিয়ে ছিটিয়ে ফুল সতেজ থাকে। (২) জলের সঙ্গে ভদকা মিশিয়ে লাগালে চশমার কাচ খুব তাড়াতাড়ি দারুণ পরিষ্কার করা যায়। (৩) গদি, তোশক বা ম্যাটট্রেসের জীবাণুমুক্ত হয়। (৪) রুপোর গয়না পালিশ করে ঔজ্বল্য বাড়াতে ভদকা ব্যবহার করা হয়। (৫) ব্যান্ড-এইড চামড়ার সঙ্গে এমনভাবে আটকে গিয়েছে যা তোলা বেশ কষ্টকর মনে হলে তুলোয় করে ভদকা লাগিয়ে দিলে তা সহজেই উঠে যায়।(৬) জামা-কাপড়ের দুর্গন্ধমুক্ত করতে দারুণ সাহায্য করে ভদকা। (৭) চুল পরিষ্কারে ভদকার কোনো তুলনা হয় না। (৮) ঘরে মাউথওয়াশ তৈরি করতে ভদকার কোনো জুড়ি নেই। (৯) ঘরে খুব পোকামাকড় হলে ভদকা স্প্রে করলে। কাজ হবে। (১০) কালো কাপড়ের রং ঠিক রাখতে জলের সঙ্গে ভদকা মিশিয়ে লাগালে খুব কাজে লাগে।
(৪) অ্যাবসিনতে : অ্যাবসিনতে পানীয়টিকে বেশ কয়েকটি দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঝাঁঝের দিক থেকে সবার উপরে অ্যাবসিনতে নামক পানীয়টি। তবে উনিশ শতকে মধ্য ইউরোপে এই পানীয়টি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বেশিরভাগ দেশে বন্ধ করে দেওয়া হলেও, এখনও ভালো চাহিদা আছে এই সবুজ রঙা পানীয়টির।
(৫) শ্যাম্পেন : শ্যাম্পেনের কথা না-বললে এই তালিকা শেষ হয় না। এই পানীয় সাধারণত আঙুরের রস পচিয়ে তৈরি করা হয়। অবশ্য এই পানীয় যতবেশি পুরনো হয় তত বেড়ে যায় এটির দাম। শ্যাম্পেন মূলত ফ্রান্সেই তৈরি করা হয়। ফ্রান্সে তৈরি করা শ্যাম্পেন দীর্ঘদিন ধরেই পানীয়ের জগতের শিরোমনি হয়ে আছে। সম্প্রতি একদল গবেষক ১৭০ বছরের পুরনো শ্যাম্পেন পরীক্ষা করে দেখছেন এর প্রাচীন প্রস্তুত প্রণালী বের করার চেষ্টা করেছেন।
২০১০ সালে বাল্টিক সাগরের তলদেশ থেকে একদল ডুবুরি ১৭০ বছরের পুরনো ১৬৮ বোতল শ্যাম্পেন উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত বোতলগুলোর মধ্যে বেশকিছু বোতলে সাগরের নোনা জল ঢুকে নষ্ট হয়ে গেলেও, কিছু বোতল অক্ষতই ছিল। সেই অক্ষত শ্যাম্পেনের বোতলগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ফ্রান্সের আদি ওয়াইন প্রস্তুতকারকরা শ্যাম্পেন তৈরিতে আধুনিক সময়ের তুলনায় অধিক চিনি ব্যবহার করত। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই শ্যাম্পেনে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার আর্সেনিকও পাওয়া গেছে। কিন্তু শ্যাম্পেন তৈরিতে তৎকালীন ওয়াইন প্রস্তুতকারকরা কেন আর্সেনিকের মতো বিষ ব্যবহার করত তা জানা যায়নি। ১৭০ বছরের পুরনো শ্যাম্পেন চেখে দেখেছিলেন ফরাসি অধ্যাপক ও ওয়াইন বিশেষজ্ঞ ফিলিপ জেনদার্ত। অবশ্য ফিলিপের পক্ষে মাত্র একশো মাইক্রোলিটার শ্যাম্পেন চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই অল্প একটু পানীয় চেখে দেখার পর ফিলিপ যা বলেছিলেন তা হল – “এর ঘ্রাণ নেওয়া এককথায় অসম্ভব। কিন্তু এটা সত্যিই দুর্দান্ত। এর স্বাদ অনেকটা তামাক এবং চামড়ার সঙ্গে মিলে যায়। তবে অতটুকু পানীয় পান করার পরবর্তী তিন ঘণ্টা পর্যন্ত এর স্বাদ আমার মুখে ছিল।”
শ্যাম্পেন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শিল্পকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। শ্যাম্পেন উৎপাদন ও বিক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আঙুরের বাগান, ওয়াইনের সেলার এবং বিক্রয় কেন্দ্রগুলোকে সাংস্কৃতিকভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করে ইউনেস্কো। এক বৈঠকে বিশ্বের ১১টি সাইটের সঙ্গে এটিকেও বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয় ইউনেস্কো। এ মর্যাদা পাওয়ার কারণে এখন থেকে শ্যাম্পেন উৎপাদন ও বিক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো বিশেষ সুরক্ষা পাবে। ইউনেস্কো বলছে, শ্যাম্পেন উৎপাদন এমন এক শৈল্পিক প্রক্রিয়া, যা কৃষিভিত্তিক শিল্প উদ্যোগের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
(৬) তাড়ি : দুধ-সাদা রঙের তাড়ি তালগাছের রস গেঁজিয়ে তৈরি দেশি মদ। তাড়ি ‘পচানি’ নামেও পরিচিত। এই তাড়ি বা বাংলা মদ বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। ভদকা যেমন রাশিয়ার। তেমনই তাড়ি বাংলার একটি ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য হাজার বছরের বাংলার সংস্কৃতির একটি উপাদান। সেই প্রাচীন আমল থেকেই বাংলার প্রাচীন আদিবাসীরা এর প্রাচীন তৈরি পদ্ধতি এখনও ধরে রেখেছে।
উৎপাদন পদ্ধতি : বাংলায় তৈরির প্রাচীনকালের সেই পদ্ধতি এখনও তাড়ির উৎপাদকরা মেনে চলে। এর জন্য প্রয়োজন তাল গাছ। তবে সে তাল গাছ মর্দা (পুরুষ) হলে ভালো হয়, যে গাছে ফল বা তাল হয় না। পুরুষ তালগাছের রস ভালো পাওয়া যায়। মাদি (স্ত্রী) গাছ অর্থাৎ তাল হয় এমন গাছেও রস পাওয়া যায়, তবে তা কম। এই পুরুষ গাছের এক প্রকার জটা বের হয়। দেখতে লম্বা ও চিকন ঠিক জলের পাইপের মতো দেখতে। এই জটাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কেটে এবং মন্থন করে এই জটার নীচে মাটির ঠিলে (হাড়ি) পাতা হয়। এই রস দুই তিন দিন পর সংগ্রহ করা হয়। দুই-তিনদিন পর রস সংগ্রহ করার ফলে রস যেমন বেশি পাওয়া যায়, তেমনই রোদের তাপে রসগুলি বেশ জাগ (পচে যায়) হয়। এই রস সংগ্রহ করে আনার পর তা বড়ো একটা পাতিলে (হাড়ি) সংরক্ষণ করা হয়। তবে প্রতিদিন সংগ্রহ করা রস খুব সুস্বাদু ও মিষ্টি। দিন কয়েক আগে বিহারে বিষমদ খেয়ে মৃত্যু হয় ১৬ জনের। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিহারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব এইসব বিষমদের পরিবর্তে তাড়ি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তাড়ি পান করলে হয় নেশা নেশা ভাব, মনে জাগে আনন্দ। গ্রীষ্মের সকালে গ্রাম বাংলায় ঠান্ডা, মিষ্টি, উত্তেজক এই পানীয়টির সন্ধান মেলে। কিন্তু বেলা গড়িয়ে ওই রস যখন ‘ফ্রাগমেন্টেড’ হয়ে নেশার সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়, তখন তার কদর বাড়ে নেশারুদের মধ্যে। সে তখন তাড়ি। আদিবাসীদের প্রিয় নেশার দ্রব্য তো বটেই, দেশজ মদের স্বাদ নিতে ভিড় জমান আসক্তেরাও। চৈত্র মাসের শুরু থেকে জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি এমন তাড়িতেই বুঁদ হয়ে থাকেন মদ্যপায়ী মানুষেরা। অনেকে বলেন, তাড়ি পান করলে পেটের কসা-খিঁচাও নাকি দূর হয়ে যায়। কোষ্টকাঠিন্য দূর হয়। সকালে আশ্চর্যজনকভাবে পেট পরিষ্কার হয়ে যায়।
(৭) মহুয়া : মহুয়া হল এক প্রকার দেশি মদ, যা মহুয়া গাছ (Madhuca longfolia) এর ফুল থেকে তৈরি করা হয়। ভারতের মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ছত্রিশগড়ের সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতীয় সম্প্রদায় এই মদ
তৈরি করে। দেশি মদের ভিতর এই মদ একটু দামি। এই মদে মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যায়। এর রস ক্ষুধাবৃদ্ধিকারক, বলকারক। এই মদ পশ্চিমবাংলার সাঁওতাল পরগণা এবং বাঁকুড়া জেলায় প্রচুর তৈরি হয়। এর ফুলের রস চিনির সঙ্গে মিশিয়ে পান করলে গাত্রদাহ, কাশি নিরাময় হয়।
তৈরি করে। দেশি মদের ভিতর এই মদ একটু দামি। এই মদে মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যায়। এর রস ক্ষুধাবৃদ্ধিকারক, বলকারক। এই মদ পশ্চিমবাংলার সাঁওতাল পরগণা এবং বাঁকুড়া জেলায় প্রচুর তৈরি হয়। এর ফুলের রস চিনির সঙ্গে মিশিয়ে পান করলে গাত্রদাহ, কাশি নিরাময় হয়।
(৮) হাঁড়িয়া : হাঁড়িয়া হল ভাত থেকে তৈরি এক প্রকার বিয়ার জাতীয় মদ, যা ভারতের বিহার,
ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্রিশগড়ে প্রস্তত করা হয়। সিদ্ধ ভাত এবং হরীতকী একসঙ্গে গাঁজিয়ে এটি তৈরি করা হয়। হাঁড়িয়া সম্পুর্ণ তৈরি হতে প্রায় সাতদিন সময় লাগে। হাঁড়িয়া ঠান্ডা করে পরিবেশন করা হয়। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ অন্যান্য দেশি মদের থেকে কম। এটিকে কেউ কেউ বাংলা মদও বলে থাকে। এই মদে একটা উৎকট গন্ধযুক্ত। অ্যালকোহলের মাত্রা ঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয় বলে, এটি পান করা নিরাপদ নয়।
ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্রিশগড়ে প্রস্তত করা হয়। সিদ্ধ ভাত এবং হরীতকী একসঙ্গে গাঁজিয়ে এটি তৈরি করা হয়। হাঁড়িয়া সম্পুর্ণ তৈরি হতে প্রায় সাতদিন সময় লাগে। হাঁড়িয়া ঠান্ডা করে পরিবেশন করা হয়। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ অন্যান্য দেশি মদের থেকে কম। এটিকে কেউ কেউ বাংলা মদও বলে থাকে। এই মদে একটা উৎকট গন্ধযুক্ত। অ্যালকোহলের মাত্রা ঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয় বলে, এটি পান করা নিরাপদ নয়।
যে মদ নিয়ে এত কথা, সেই মদের দাম সম্বন্ধে ধারণা নেব না, তাই হয় নাকি ? ভারতবর্ষে মদের দাম একই মদ সব রাজ্যে একরকম নয়। ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন দাম। এই দাম নির্ভর করে কোন্ রাজ্য মদের উপর কত সেস নিচ্ছে তার উপর। এই অনুচ্ছেদে আমি জানাব বিশ্বের সবচেয়ে দামি মদের পরিচয়। তবে যেসব মদ্যপ্রেমীরা পাউচ প্রতি ৯ টাকা ১৫ টাকার দামের চোলাই কিংবা বোতল প্রতি ৭৫ টাকায় বাংলা কিংবা ৫০০ টাকায় ইন্ডিয়ান রাম কিনে সেবন করেন, এই অনুচ্ছেদ তাঁদের জন্য নয়। তবে কৌতূহলীরা জেনে নিতেই পারেন উচ্চদামের মদের সংবাদ। চমকে গেলে লেখক দায়ী নহে।
(১) গ্লেনফিডিচ স্পেশাল সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি (৫০ বছরের স্পেশাল এডিশন) : এটি একটি হুইস্কি। হুইস্কিটি বছরে মাত্র ৫০ টি বোতল বাজারে আসে। এই হুইস্কিটি ৫০ বছরের পুরোনো এই সেইরকম দামি। এক একটি বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১ লক্ষ টাকা।
(২) হাইল্যান্ড পার্ক (৫০ বছরের পুরোনো স্পেশাল সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি) : এটিও হুইস্কি। সারা বিশ্বে মাত্র ২৭৫ টি বোতল বাজারে আনা হয়। হুইস্কিটি বানানো হয় ১৯৬০ সালে। দাম প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা। এই হুইস্কির বোতলটি তৈরি করেছে বিশ্বখ্যাত ‘জিলিস’ নামক কোম্পানি।
(৩) ম্যাকালান (৬০ বছরের পুরোনো স্পেশাল সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি) : শুধু দামে নয়, স্বাদে-গন্ধেও এই হুইস্কির সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া। বোতলের ঢাকনাটি ক্রিস্টালে তৈরি করা এবং প্রত্যেকটা বোতলই ৬০ বছরের পুরোনো। ভারতীয় মুদ্রায় এই মদের প্রতি বোতলের দাম প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা।
(৪) ম্যাকালান ১৯২৬ স্পেশাল হুইস্কি : সারা বিশ্বে মাত্র ৫০ টি বোতল আছে এই মদটির। প্রতি বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৪৭ লক্ষ টাকার একটু বেশি। পৃথিবীর ধনী ব্যক্তিদের সেলারে শোভা পায় এই মদ।
(৫) ডেলিমোর ৬৪ ট্রিনিটাস সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি : সারা বিশ্বে মাত্র তিনখানি বোতল আছে। এটি ৬৪ বছরের পুরোনো মদ। বলা হয় এই হুইস্কিটি তৈরি করার জন্য সবচেয়ে সেরা উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। এই জিনিয়াসটির দাম ভারতীয় মুদ্রায় এক কোটি টাকার একটু বেশি।
(৬) ডেলিমোর স্কচ হুইস্কি : ইনিও জিনিয়াস। ১৮৬৮ সালে এই বিশেষ হুইস্কিটি বানানো হয়েছিল। এই জিনিয়াস মদটিকে অনেকে ‘লিকুইড গোল্ড’ নামে জানেন। প্রতিটি বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ১ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা।
(৭) ম্যাকালান স্কচ হুইস্কি : ইনিও জিনিয়াস। ৬৪ বছরের পুরোনো এই স্কচ হুইস্কিটি। প্রতিটি বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ২ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা।
(৮) মাস্টার অফ মল্ট : জিনিয়াসের জিনিয়াস এই হুইস্কিটি ২০১১ সালে হঠাৎ করেই একটি বাড়ির বেসমেন্টে খুঁজে পাওয়া যায়। এই হুইস্কির বোতলটি তখনই ছিল ১০৫ বছরের পুরোনো। প্রতিটি বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ৮ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা।
(৯) টাকিলা লেঃ ৯২৫ : এই হুইস্কির বিশেষত্ব এর বোতলটি। এই বোতলের অর্ধেক খাঁটি প্লাটিনামে তৈরি, আর বাকি অর্ধেক সাদা সোনা দিয়ে তৈরি। এর সামনের এমব্লেমটিও প্লাটিনামে তৈরি। প্রতিটি বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ৯ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা।
(১০) হেনরি IV হেরিটেজ কোনিয়াক : এটি কোনিয়াকটি আজ পর্যন্ত তৈরি হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে দামি। প্রখ্যাত ডিজাইনার জোস ডাভালোস এই বোতলটির ডিজাইন করেছেন। বোতলটি সোনা এবং প্ল্যাটিনাম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বোতলটির সমস্ত শরীর ৬৫০০ টি হিরের টুকরো দিয়ে সাজানো। তবে শুধু বোতল নয়, এই কোনিয়াকটি বানানো হয়েছিল ১৭৭৬ সালে। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাঠের পিপেতে রাখা ছিল বোতলবন্দি করার আগে।
ধর্মে ধর্মে মদ : দামি মদই পান করুন বা কম দামের মদ, মদ মদই। যে মদ পানের বিষয়ে প্রায় সব ধর্মেই নিষিদ্ধ হয়েছে।
ইসলাম ধর্মে মদ্যপান : প্রথমেই আসি ইসলাম ধর্মে। কেন-না ধর্মেই মদ নিয়ে বেশি আলোচিত। সব ইসলামিরাই চোখ বুজে বলে দিতে পারেন – ‘মদ ইসলামে হারাম’। মদিনার মানুষের নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় ছিল মদ। মদ ছাড়া একটি দিন অতিবাহিত হবে, এটি মদিনার লোকেরা মানতেই পারত না। আর মদ এমন একটি নেশাদ্রব্য, যা এর আসক্ত হলে তার থেকে ফিরে থাকা খুবই কঠিন। এহেন স্পর্শকাতর একটি নেশাদ্রব্যকে আল্লাহ একবারে হারাম ঘোষণা না-করে, তিনটি পর্যায়ে হারাম ঘোষণা করেন। মদ ইসলামে কেন হারাম হল ? ডাঃ হাফেজ মাওলানা মোঃ সাইফুল্লাহ মানসুর (সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলাম প্রচার পরিষদ) স্পষ্ট করেই বলেছেন – (১) প্রথম পর্যায় -- হিজরত করে মদিনায় পৌছোনোর কিছুদিন পর রসুল সহ কতিপয় সাহাবি মদের অকল্যাণকর বিষয়গুলো অনুভব করতে থাকেন। একদা হজরত মা’আয ইবনে জাবাল এবং কিছুসংখ্যক আনসার সাহাবি রসুলে করিমের দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন – “হে আল্লাহর রাসুল মদ ও জুয়া মানুষের বুদ্ধি-বিবেককে বিলুপ্ত করে ফেলে এবং ধনসম্পদও ধ্বংস করে দেয়। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?” এ প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ সুরা বাকারার এই আয়াতটি অবতীর্ণ করে বলেন – “(হে নবি) তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে – মদ ও জুয়ার ব্যাপারে নির্দেশ কী? বলে দাও -- ওই দুটির মধ্যে মানুষের বিরাট ক্ষতিকর বিষয় রয়েছে যদিও লোকদের জন্য তাতে সামান্য কিছুটা উপকারিতাও আছে, কিন্তু তাদের উপকারিতার চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।” (সুরা বাকারা -- ২১৯) এখানে শুধুমাত্র মদকে মানুষের জন্য ক্ষতিকর বস্তু হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে মদে সাময়িক কিছু লাভের কথা বলা হলেও ক্ষতির দিকটা যে তার চেয়ে অনেক বহুগুণ তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এবং এটি যে আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয় বস্তু তা ব্যক্ত করা হয়েছে, যেন মানুষের মন ও মস্তিস্কে মদ হারাম হওয়ার বিষয়টি গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়৷ (২) দ্বিতীয় পর্যায় -- একদিন হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ সাহাবিগণের মধ্যে থেকে তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেন। আহারাদির পর যথারীতি মদ্যপানের ব্যবস্থা করা হল এবং সবাই মদ্যপান করলেন। এমতাবস্থায় মাগরিবের নামাজের সময় হলে সবাই নামাজে দাঁড়ালেন এবং একজনকে ইমামতি করতে এগিয়ে দিলেন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যখন তিনি সুরা আল কাফিরুন ভুল পড়তে লাগলেন, তখনই নামাজে মদ্যপান থেকে পুরোপুরি বিরত রাখার জন্যে দ্বিতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল। আল্লাহ সুরা নিসার ৪৩ নং আয়াতে বলেন -- “হে ঈমানদারগণ ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছে যেও না৷ নামাজ সেই সময় পড়া উচিত, যখন তোমরা যা বলছ তা জানতে পারো৷ অনুরূপভাবে অপবিত্র অবস্থায়ও (নামাজের কাছে যেও না)।” এখানে শুধু মদ পানই নয়, বরং যে-কোনো নেশা দ্রব্য পান করে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়৷ কারণ এটি মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতি করে দেয় ও মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটায়। যে জিনিস মানুষের মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটিয়ে দেয় এবং মানুষের আচরণগুলো অস্বাভাবিক করে দেয়। এ জাতীয় জিনিস পান করে আল্লাহর পবিত্রতম ফরজ হুকুমগুলির মতো ইবাদত পালন করা খুবই বেমানান। তাই আল্লাহ এটি পান করে বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়তে বা এর ধারের কাছে যেতেও নিষেধ করে দেন।(৩) তৃতীয় পর্যায় -- একদা হজরত আতবান ইবনে মালেক কয়েকজন সাহাবিকে নিমন্ত্রণ করেন, যাদের মধ্যে সাদ ইবনে আবি অক্কাসও উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর মদ্যপান করার প্রতিযোগিতা এবং নিজেদের বংশ ও পূর্বপুরুষদের অহংকারমূলক বর্ণনা আরম্ভ হয়। সাদ ইবনে আবি অক্কাস একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন যাতে আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসা-কীর্তন করা হয়। ফলে একজন আনসার যুবক মদ্যপ অবস্থায় রাগাম্বিত হয়ে উটের গণ্ডদেশের একটি হাড় সাদের মাথায় ছুঁড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে সাদ রসুলের দরবারে উপস্থিত হয়ে উক্ত আনসার যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এমতাবস্থায় হুজুর দোয়া করলেন – “হে আল্লাহ ! শরাব সম্পর্কে আমাদের একটি পরিষ্কার বর্ণনা ও বিধান দান করুন।” তখনই সুরা মায়েদার উদ্ধৃত মদ ও মদ্যপানের বিধান সম্পর্কিত বিস্তারিত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এখানে আল্লাহ মদ ও জুয়া এবং এই পর্যায়ের সমস্ত বস্তুকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করে দেন৷ আর তৃতীয় নির্দেশটি আসার আগে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক ভাষণে লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন -- মহান আল্লাহ মদ অত্যন্ত অপছন্দ করেন৷ তাই মদ চিরতরে হারাম হয়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়৷ কাজেই যাদের কাছে মদ আছে তাদের তা বিক্রি করে দেওয়া উচিত ৷ এর কিছুদিন পরেই পূর্বের ঘটনাটি ঘটে যার পরিপেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল হয় – “হে ঈমানদারগণ ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পুজোর বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকালাপ৷ এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে।” (সুরা মায়েদা -- ৯০) এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর নবি করিম ঘোষণা করেন, এখন যাদের কাছে মদ আছে তারা তা পান করতে পারবে না এবং বিক্রিও করতে পারবে না বরং তা নষ্ট করে দিতে হবে৷ কাজেই তখনই মদিনার সমস্ত গলিতে মদ ঢেলে দেওয়া হয়৷ অনেকে জিজ্ঞেস করেন -- হে আল্লাহর রাসুল, এগুলো ফেলে না-দিয়ে আমরা ইহুদিদেরকে তোফা হিসাবে দিই-না কেন ? জবাবে নবি করিম বলেন – “যিনি একে হারাম করেছেন তিনি একে তোফা হিসাবে দিতেও নিষেধ করেছেন।” কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন – “হে আল্লাহর রাসুল, আমরা মদকে সিক্কায় পরিবর্তিত করে দিই ?” তিনি এটিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং নির্দেশ দেন – “না ওগুলোও ঢেলে দাও”। এক ব্যক্তি অত্যন্ত জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করেন -- ওষুধ হিসাবে ব্যবহারের নিশ্চয়ই অনুমতি আছে ? জবাব দেন – “না এটা ওষুধ নয়, বরং রোগ”৷ আর একজন আর্জি করেন – “হে আল্লাহর রসুল ! আমরা এমন এক এলাকার অধিবাসী যেখানে শীত অত্যন্ত বেশি এবং আমাদের পরিশ্রমও অনেক বেশি করতে হয়৷ তাই আমরা মদের সাহায্যে ক্লান্তি ও শীতের মোকাবিলা করি।” তিনি জিজ্ঞেস করেন – “তোমরা যা পান করো, তা কি নেশা সৃষ্টি করে ?” লোকটি জবাব দেন – “হ্যাঁ”৷ তখন তিনি বলেন – “তাহলে তা থেকে দূরে থাকো।” লোকটি তবুও বলেন, “কিন্তু এটা তো আমাদের এলাকার লোকেরা মানবে না।” তখন রাসুল জবাব দেন – “তারা না-মানলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো”৷
নির্দিষ্ট করে বললে, কোরানে হারাম জিনিসকে ‘হারাম’-ই বলা হয়েছে। এখানে ‘হারাম’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যে সকল জিনিসকে হারাম বলা হয়েছে, তার জন্য কোনো কারণ আল্লাহ দেননি। এটা আল্লাহর নির্দেশ এবং অনেক জায়গায় কোনো কিছুকে হারাম করার জন্য দোজখের (নরক) ভয়ও দেখানো হয়েছে। কোরানে পাঁচটি আয়াত পাওয়া যায়, যেখানে মদ বা নেশা নিয়ে বলা হয়েছে।
(১) “হে ঈমানদারগণ ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাকো, তখন নামাজের ধারে-কাছেও যেও না, যতক্ষণ-না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ,.....।.” (৪ : ৪৩) এই আয়াতে হারাম বা নিষিদ্ধ শব্দটি নেই বা দোজখের ভয়ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও দেখানো হয়নি। কেন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে ? কারণ নামাজে কি বলা হচ্ছে, সেটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। না-বুঝলে সে নামাজ পড়ার কোনো মানে নেই। যেহেতু নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মানুষের বোধবুদ্ধি এমনি লোপ পায় যে, সে কী বলছে তা বোঝে না। সেই কারণেই নামাজের কাছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। নেশাগ্রস্ত হতে কিন্তু নিষেধ করা হয়নি। এখন কেউ যদি অল্প নেশা করে এবং তার বোধ বুদ্ধিও লোপ না পায়, তাহলে কি তাকে কোরানের এই আয়াত অনুসারে মদ্যপায়ীকে দোষী বলা যাবে ?
(২) “হে মুমিনগণ ! মদ, জুয়া, মূর্তিপুজোর বেদি ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃণ্যবস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা(কে) বর্জন করো। তাহলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ, জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না।”(৫ : ৯০-৯১) এই আয়াতেও ‘হারাম’ বা ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটি নেই বা দোজখের ভয়ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও দেখানো হয়নি। সুতরাং মদকে হারাম বলা যায় না। শব্দের শেষে যে ‘হু’ আছে, তা একবচন। যদি মদ, জুয়া, মূর্তিপুজোর বেদি ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর সবগুলোকেই বর্জন করতে বলা হত তাহলে ‘হুম’ বহুবচন থাকত। আয়াতটি ভালো করে পড়লে যা বোঝা যায়, এগুলো শয়তানের হাতিয়ার, যা দিয়ে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। এই কারণেই শয়তানকে বর্জন করতে বলা হয়েছে, যাতে মুসলমানরা সফলকাম হতে পারে।
(৩) “যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তারা যা ভক্ষণ করেছে, সে জন্য তাদের কোন গোনাহ নেই....” (“Those who have attained to faith and do righteous deeds incur no sin by partaking of whatever they may, so long as they are conscious of God and [truly] believe and do righteous deeds, and continue to be conscious of God and to believe, and grow ever more conscious of God, and persevere in doing good: for God loves the doers of good.”
(Rashad Khalifa 5 : 93) “Those who believe and lead a righteous life bear no guilt by eating any food, so long as they observe the commandments, believe and lead a righteous life, then maintain their piety and faith, and continue to observe piety and righteousness. GOD loves the righteous.” (Muhammad Asad 5 : 93) এই আয়াতটিতে ইংরেজি অনুবাদ দিলাম এই কারণে যে, বাংলা অনুবাদে এমন কিছু শব্দ ঢোকানো হয়েছে, যা আরবি কোরানে নেই। এই আয়াতটিতে দেখুন, হারাম ছাড়া সকল খাবার খাওয়া যায়। খাবার নয়, সৎ কাজের উপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সৎ ভালো কাজের কথা বারে বারেই বলা হয়েছে।
(Rashad Khalifa 5 : 93) “Those who believe and lead a righteous life bear no guilt by eating any food, so long as they observe the commandments, believe and lead a righteous life, then maintain their piety and faith, and continue to observe piety and righteousness. GOD loves the righteous.” (Muhammad Asad 5 : 93) এই আয়াতটিতে ইংরেজি অনুবাদ দিলাম এই কারণে যে, বাংলা অনুবাদে এমন কিছু শব্দ ঢোকানো হয়েছে, যা আরবি কোরানে নেই। এই আয়াতটিতে দেখুন, হারাম ছাড়া সকল খাবার খাওয়া যায়। খাবার নয়, সৎ কাজের উপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সৎ ভালো কাজের কথা বারে বারেই বলা হয়েছে।
(৪) “এবং খেজুর বৃক্ষ ও আঙ্গুর ফল থেকে তোমরা নেশা ও উত্তম খাদ্য তৈরী করে থাক, এতে অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।”(১৬ : ৬৭) এখানেও নেশা বা মদকে হারাম বলা হয়নি। বরং নেশা ও উত্তম খাদ্য একই পংক্তিতে রেখেছেন।
(৫) “তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এই দুইয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্যে উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়ো।” (২ : ২১৯) অতএব মদের ভালো ও মন্দ দুটো দিক আছে, যা আগের আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট। এই আয়াতেও দেখুন মদের উপকরিতা ও অপকারিতা নিয়ে বলা হয়েছে। উপকারিতার বিপরীত অপকারিতা বা অপব্যবহার হয়, পাপ হয় না। কিন্তু কেন জানি আমাদের আলেমরা মহাপাপ বলছেন, যা বোধগম্য নয়। আরবিতে জুনাহুন শব্দের অর্থ পাপ। মহাপাপ আর মহা-অপকারিতা এক কথা নয়। কোরানের কোথাও মদ বা নেশাকে সরাসরি হারাম বলা হয়নি। মদের ভালো বা মন্দের উল্লেখই কোরানে করা হয়েছে। মদকে মুসলমানদের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তুর্কি সেলজুক খলিফারাই তাঁদের সৈন্যদের মদ খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য হাদিসের মাধ্যমে মদকে ‘হারাম’ করে।
হিন্দুধর্মে মদ্যপান : খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকে ভারতবর্ষে মদের ব্যবহারের কথা জানতে পারা যায়৷ অবশ্য তারও আগে মদ্যপানের ব্যবহার ছিল না, এ কথা বুক ঠুকে করে বলা যায় না৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভারতে মদ্যপানের ইতিহাস ৬০০০ বছরের বেশি৷ মদের সন্ধানে প্রথমে কিঞ্চিৎ পুরাণ ঘুরে আসা যাক। পুরাণে যে সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যান পাই, তাতে আমরা দেখতে পাই সমুদ্রমন্থনকালে সমুদ্র থেকে একে একে উঠেছে দুগ্ধ, ঘৃত, চন্দ্রদেব, দেবী লক্ষ্মী, ঐরাবত (হস্তি), উচ্চৈঃশ্রবা (অশ্ব), কৌস্তভমণি, অমৃতভাণ্ড হাতে ধন্বন্তরি, কালকূট বিষ আর সবশেষে উঠল বারুণী সুরা বা মদ৷ সুরার ভাণ্ডটি দেবতারাই গ্রহণ করলেন, দানবরা প্রত্যাখ্যান করলেন। তাই দেবতারা ‘সুর’ এবং দানবরা ‘অসুর’ (সুরাবিহীন ) নামে পরিচিত হল৷ দেবরাজ ইন্দ্র প্রায় সর্বক্ষণ সুরা পান করে থাকেন, যার নাম সোমরস৷ জলের দেবতা বরুণও মদ্যপান পছন্দ করেন, ইনি পান করেন ‘বারুণী’ নামে সেই সুরা, যা সমুদ্র থেকে উঠেছিল৷ বিষ্ণু, যিনি জীবকে রক্ষা করেন তিনিও সুরা পান করেন৷ দেবী চণ্ডী যিনি মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, ওই যুদ্ধের সময় তিনি অল্প অল্প মদ্যপান করছেন, এ রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। শিব শুধু মদ বা সিদ্ধি নয়, সব রকম নেশাই করতেন৷ পদ্মপুরাণে উল্লেখ আছে -- খাওয়া তো দূরের কথা, কেউ যদি মদিরা আঘ্রাণ বা স্পর্শ করে, তা হলে মৃত্যুর পরে তার স্থান হবে ‘রৌরব’ নামক নরকে (হিন্দুপুরাণগুলিতে মোট ২৮ টি নরকের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে রৌরব একটি। রৌরব শব্দটি এসেছে রুরু নামক হিংস্র জন্তু থেকে, যার নামে এই নরকের নাম। হিংসাপরায়ণ হয়ে শুধুমাত্র নিজেকে ও পরিবারকে ভালো রেখে অন্যের ক্ষতি করলে রুরু নামক সর্পসম জন্তুরা পাপীর শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।)।
ঋকবেদে সোমরসের উল্লেখ আছে৷ ঋকবেদে সোমরস সম্পর্কে স্তোত্র আছে৷ এই সোমরসই কী মদ ? দ্বিমত আছে। কেউ বলেন ঋকবেদে উল্লিখিত সোমরস মদ নয়, আবার কেউ বলেন সোমরসই মদ। লতা জাতীয় এই সোমরস জিনিসটা আসলে ঠিক কী ? সম্ভবত হিন্দুকুশ অঞ্চলে ‘এফিড্রা সিনিকা’ নামক এক লতা। তবে পণ্ডিতেরা নিশ্চিত নন। পূর্ণিমা আলোয় পাহাড়ি ছাগলে টানা গাড়িতে এই লতাটাকে মূলসুদ্ধ তুলে নিয়ে আসা হত ঋষিদের যজ্ঞস্থানে। সেখানে আনয়ন করা সোমলতাগুলিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে লতাগুল্মসহ পাথরে পেষাই করা হত। পিষানো লতাগুল্মকে পশমের ছাঁকনিতে রেখে দশ আঙুলে চটকানো হত। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৯৪ নম্বর সূক্তে সোমলতা পেষাই করার পাথরগুলির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন – “এই অবিনাশী প্রস্তরদিগের গুণকীর্তন করো। দশ আঙুল যখন সোমরস নিষ্পীড়ন করার সময় এদের স্পর্শ করে, পাথরটাকে মনে হয় দ্রুতগামী ঘোড়া। দশটি রজ্জু তাদের টেনে নিয়ে চলেছে।” পাথরে পেষাই করার পর ঈষৎ হলুদ রঙের ওই রস দুধে মিশিয়ে টানা ৯ দিন ধরে গাঁজানোর জন্য অপেক্ষা করা হত। এরপর যা পাওয়া যেত, তাইই হল সোমরস। এটাকে সযত্নে রাখা হত নিরাপদ স্থানে। যে কাঠের পাত্রে রাখা হত, সেই পাত্রকে ‘গ্রহ’ বলা হত। মাটির পাত্রে রাখা হলে, ‘স্থালী’ বলা হত। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা -- তিনবার সোম থেকে রস নিষ্কাশন করা হত। কে, কতবার পান করবেন, তারও বিধিসম্মত নিয়ম ছিল। যজ্ঞের পুরোহিত বা ঋত্বিকদের দিনে তিনবার সোমরস পান করার অধিকার থাকলেও, যজমানদের অধিকার কিন্তু একবার, সন্ধ্যাবেলায়।
ঋকবেদে ১০০০ টি স্তোত্রে মানুষ ও দেবতার পানীয় বলে সোমরসের উল্লেখ আছে৷ ঋকবেদের নবম মণ্ডলে শুধু সোমরস নিয়েই ১৪৪ টি স্তোত্র আছে, যেগুলি সোমমণ্ডল নামে পরিচিত। বলা হয়েছে, এই রসের নৈবেদ্য দেবতাদের প্রলুব্ধ করে স্বর্গের বাইরে নিয়ে আসত৷ ঋক ও অথর্ববেদের ফুল ও ফল থেকে তৈরি বহুরকম মদের উল্লেখ আছে৷ তার মধ্যে প্রধান তিনটি হল --- কিলালা (কলা থেকে তৈরি মদ ), মাসারা (চাল থেকে তৈরি মদ ) আর মদিরা (মধু থেকে তৈরি মদ )। সোমরস পান করা হত মাখন, দই, দুধ এবং ভাজা বা শুকনো শস্য দানার সঙ্গে৷ ঋকবেদে এই সোমরসের গুণ ও আনন্দদায়িনী শক্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস করা হয়েছে৷ এমনকী সোমরসের সম্মানার্থে একটি বলিদান যজ্ঞ হত৷ অভিধানে সোমরসের অর্থে বলা হয়েছে ‘সোম লতা হতে তৈরি মদ’। “বলবান্ ইন্দ্রদেব সোমরস পান করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন এবং উপর্য্যুপরি যজ্ঞত্রয়ে সোমরস পান করিয়াছিলেন” (‘দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। ‘সোম’ নামক প্রবন্ধে বৈদিক সোমরস যে সুরা অর্থেই ব্যবহৃত হইত না লেখক তাহাই প্রমাণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন – (সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
দেহ ও মনের উপর সোমরসের প্রতিক্রিয়ার কথা ঋগবেদে আছে। ‘সোম ঘোটকের ন্যায় দ্রুতগামী’, ‘সে আপন তেজ বিকীর্ণ করে’, ‘যে মাদকরস বর্ষণ করে’, ‘সোম স্তবের যোগ্য’, ‘সোমপায়ী ব্যক্তি লুণ্ঠনকার্যে পটু’, ‘সোম অন্ন, গাভী ও উত্তম গৃহ উপার্জন করিয়ে দেয়’ ‘কবিরা তাকে স্তব করে’ [রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ]
এক শ্রেণির পণ্ডিতগণ অবশ্য বেদে উল্লিখিত সোমরসকে মদ বলতে নারাজ। তাঁরা বলেন -- মনুষ্য দেহের বীর্যকণাই বাস্তবিক সোম। এ বিষয়ে শক্তশালী বেদ প্রমাণ আছে। বীর্য বাদে অন্যান্য ঔষধি আদিকেও সোম বলা হয়। সুরার কথা সমগ্র বেদে কোথাও নেই। “সোমং মন্যনে পপিবান্যস্তংপিংষন্তোষধিম্।/সোমং যং ব্রহ্মানো বিদুর্নো তস্যশনাতি কশ্চন।।” (ঋক ১০/৮৫/৩) পদার্থঃ ( যত) যে ( ঔষধিম্) ঔষধকে ( সংপিংষন্তি) সম্বায়ক রূপে পিষে তার রস বের করে নিতে হয়। কিন্তু (মান্যতে) মানতে হয় যে ( সোমং পপিবান্) আমরা যে ঔষধি সোম পান করে থাকি এ ধারণা ঠিক নয় ( যং সোমং) যে সোমকে ( ব্রক্ষ্মনঃ) জ্ঞানী পুরুষই( বিদুঃ) জানে ( তস্য) ওই সোমকে ( কশ্চনঃ) এই ঔষধী রস পানকারী কেউই ( অশ্চতি) গ্রহণ করে না। সোম তো শরীরে উৎপন্ন হওয়া বীর্যই। তার রক্ষণ জ্ঞানীরাই করে থাকে এবং বীর্যধারণই বাস্তবিক সোমপান। জ্ঞান সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত পুরুষ এই সোমকে নিজের জ্ঞানাগ্নির ইন্ধন বানিয়ে থাকে এবং বীর্য রূপ সোমের উর্ধ্বগতি দ্বারা ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকারের যোগ্য বানায়। ভাবার্থ -- সোমলতার রস পান সোমপান নয়। বীর্যের রক্ষণই সোমপান। এই সোমপানকে ভৌতিক প্রবৃত্তকারী পুরুষ করতে পারে না। বাস্তবিক সোমরসপান ব্যতীত আরও অনেক ভৌতিক ঔষধীরূপী সোমরস আছে যে গুলো রোগ নিবারণ এবং যজ্ঞাদি কর্মে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু এগুলো ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকারের জন্য পরোক্ষ উপাদান মাত্র। আখের সমার্থক শব্দ সোম। আজকের আখই হয়তো বেদের সোম জাতীয় উদ্ভিদ। বেদে চার প্রকারের সোমের উল্লেখ পাওয়া যায় – (১) ‘সোমঔষধিনামধিরাজ’ (১/১৩/২) (২) ‘সোমবীরুধাপতে’ (৩/১১/৪/১) (৩) ‘গিরিষু হি সোমঃ-শতঃ’ (৩/৩/৪/৭) (৪) ‘রেতঃ সোমঃ’ (১৩/৭)। সোম নামের একজন দেবতার কথাও জানা যায়। সম্ভবত এই সোমদেবতা সোমরসের সমস্ত রকমের অধিকর্তা ছিলেন। তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া সোমরসের স্বাদ পাওয়া যেত না।
সোম মদ হোক না হোক, একটা পর্যায়ে হিন্দুধর্মে মদ বা যে-কোনো নেশাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও ঋগবেদে (১/১৯১/১০) চামড়ার পাত্রে রাখা মদ্যপানের কথা আছে। তদুপরি ঋগবেদের অষ্টম মণ্ডলে দুটি জায়গায় আমরা কিন্তু (২/১২, ২১/১৪) সুরাপ্রমত্ত ব্যক্তিদের ব্যাপক নিন্দা করা হয়েছে। মন্ত্র, সংহিতা, উপনিষদের যুগ শেষ হয়ে শুরু হল স্মৃতির শাসন। এ সময় সমাজের মাথারা মাদকদ্রব্যের উপর রক্তচক্ষু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যদিও মনু এক জায়গায় (৫/৫৬) মদ্যপানকে বৈধতা দিয়ে বলেছেন ‘স্বাভাবিক জীব বৃত্তি’। আবার বেশ কয়েক জায়গায় মদ্যপানকে চরমতম অপরাধ বলেছেন। ব্রাহ্মণ হত্যা, গুরুপত্নীগমন আর সুরাপানকে একই মাপের অপরাধ বলেছেন (৯/২৩৫)। মদ্যপানকে নিষিদ্ধও করা হয়েছে। মনু ছাড়াও প্রাচীন ভারতে উনিশজন ঋষি বিধি-নিষেধের উপর স্মৃতিসংহিতা লিখে গেছেন। সবাই সমসাময়িক না-হলেও, আপস্তম্ব, গৌতম আর বশিষ্ঠ এঁরা একই যুগের। বাকি ষোলোজন বিষ্ণু, পরাশর, ভৃগু ইত্যাদি পরবর্তীকালে। এরা মদ্যপানের উপর খড়্গহস্ত। বিশেষত ব্রাহ্মণদের তো মদ্যপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। ব্রাহ্মণরা মদ্যপান করতেই পারবেন না। মদ্যপান করলে ফুটন্ত মদ্যপানে বাধ্য করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। গরম শিসা বা রুপো গলায় ঢেলে প্রায়শ্চিত্তও করতে হবে। এছাড়া আরও ভয়ংকর ভয়ংকর সব শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে, যা শুনলে শরীর কেঁপে উঠবে। ঋগবেদে বলা হয়েছে -- “নকী রেবন্তঃ সখ্যায়া বিন্দসে পীয়ন্তি তে সুরস্বঃ।/য়দা কুয়োসি নদানু সমূহস্যাদিত পিতেব হূয়সে।।” (ঋগবেদ, ৮/২১/১৪) অর্থাৎ, তোমার নেশাকারী সঙ্গী অথবা বন্ধু যদি সবচেয়ে বিদ্বান বা ধনীও হয় তারপরও বজ্রপাততূল্য এবং অবশ্য পরিত্যজ্য। মনুসংহিতা বলছে -- “সুরা বৈ মলমন্নানাং পাপ্মা চ মলমুচ্যতে।/তস্মাদ্ ব্রাহ্মণরাজন্যৌ বৈশ্যশ্চ ন সুরাং পিবেৎ।।” (মনুসংহিতা, ১১/৯৪) অর্থাৎ, সুরা হল অন্নের মলস্বরূপ, পাপরূপ তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় নির্বিশেষে সকলের জন্যই অবশ্য বর্জনীয়।
বেদ ও মনুসংহিতার যুগে মদ সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও পুরাণ ও রামায়ণ-মহাভারতের যুগে এসে এই নিষেধাজ্ঞায় শিথিলতা এসেছিল বোধহয়। রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণ যুগে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজা-রানি, দেবদেবতারাও ভালোই মদ খেতেন।
বেদ ও মনুসংহিতার যুগে মদ সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও পুরাণ ও রামায়ণ-মহাভারতের যুগে এসে এই নিষেধাজ্ঞায় শিথিলতা এসেছিল বোধহয়। রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণ যুগে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজা-রানি, দেবদেবতারাও ভালোই মদ খেতেন।
বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণে দেখতে পাই -- রাম বিয়ের পর তার স্ত্রী সীতাকে রাজকীয় পানীয় হাতে তুলে দিচ্ছেন৷ চোদ্দো বছর বনবাস পর্বে যাওয়ার সময় সীতা গঙ্গার উদ্দেশ্যে বলেছেন, “হে দেবী, আমরা যদি এই বনবাস শেষে বেঁচে ফিরতে পারি তা হলে এক হাজার কলস সুরা আমি তোমায় উৎসর্গ করব।” রাম যেদিন রাবণকে হত্যাকর্ম সেরে সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফেরে, সেদিন অযোধ্যার মানুষ রামকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে বেশ কয়েকদিন ধরে পানোত্সব করেছিল৷ রামায়ণে চার প্রকারের সুরার উল্লেখ পাওয়া যায়৷ শুধু রাম-সীতা নয়, বানরদের মধ্যেও মদ্যপানের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ রাক্ষসদের মধ্যেও মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। রামায়ণের বীর হনুমান ছোট্টো আকার ধারণ করে রাবণের অন্তঃপুরে গিয়ে দেখেন মদ্যপান বেহুঁশ হয়ে রাবণের রানিরা পরস্পর পরস্পরকেকে আলিঙ্গন করে শুয়ে আছেন। রাম তো সীতাকে উদ্ধার করে অযোধ্যায় নিয়ে গিয়ে দিব্যি ‘স্বহস্তে মৌরেয় মদ্য’ দিচ্ছেন সীতাকে। বালকাণ্ডে ঋষি বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠ অতিথি আপ্যায়ন করছেন সুরাভাণ্ড দিয়েই। বানরেরাও প্রচুর মদ্যপান করতেন। শর্তানুসারে সীতা উদ্ধারের কথা ভুলে গিয়ে সুগ্রীব যে সময় নারীসঙ্গ আর সুরাপানে মত্ত ছিলেন সে সময় লক্ষ্মণ সুগ্রীবে রাজদরবারে এসে চড়াও হয়। সে সময় বেহেড মাতাল কিষ্কিন্ধ্যারাজ সুগ্রীব লক্ষণের সামনে টলমল করতে করতে হাজির হয় এবং লক্ষ্মণের কাছে বিস্তর তিরস্কৃত হন।
ব্যাসদেব বিরচিত মহাভারতেও আমরা যথেষ্ট মদ্যপানের উল্লেখ পাই। যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞে মদিরার সমুদ্র হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে৷ শুধু অশ্বমেধই নয়, যে-কোনও বড়ো ধরনের যজ্ঞে মদ্যপানের রেওয়াজ ছিল৷ এমনকি মহাভারতের সময়ে মহিলারাও পর্যন্ত মধ্য পান করতেন৷ বিরাট রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণা তাঁর দাসীকে হুকুম করছেন মদ আনার জন্য৷ বিরাট রাজার পত্নী সুদেষ্ণা জলের বদলে মদ্যপান করতেই ভালোবাসতেন। যদুবংশেও মদ্যপানে ভারতজোড়া খ্যাতি ছিল৷ কৃষ্ণ মদ্য পান করতেন আর বলরাম তো প্রচুর মদ খেতেন, বলরামের প্রিয় মদের নাম ‘আসব’৷ বনভোজনে গিয়ে অতিরিক্ত মদ্যপানের পর বেহেড মাতাল হয়ে যাদবরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ধ্বংস হয়ে যায়। কত ঘটনা আর উল্লেখ করব ! মহাভারতে মদ খাওয়ার কথার ছড়াছড়ি। মহাভারতে আদিপর্বের শেষ দিকে কৃষ্ণ, অর্জুন, দ্রৌপদী, সুভদ্রা তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এক বার যমুনার ধারে বনভোজনে গিয়েছিলেন। বেহেড মাতাল দ্রৌপদী আর সুভদ্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন ব্যাসদেব।
মহাভারতের বীরেরা শরীর আর মনকে চাঙা রাখার জন্য যুদ্ধের সময় নিয়মিতই মদ্যপান করতেন। সে যুগে ‘কিরাত দেশীয় মদ্য’ বোধহয় সবচেয়ে সেরা ছিল। রথী-মহারথীরা তো খেতেনই, তাদের ঘোড়াদেরও খাওয়ানো হত। মহাভারতে সকলেই মদ খেতেন। মহিলারাও পান করতেন। এ ব্যাপারে ব্যাসদেব কোনো রাখঢাক করেননি। বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ প্রমুখ মুনিঋষিদের আশ্রমেও মদের ভালো জোগান ছিল। তাই তাঁদের আশ্রমে অতিথিরা এলে এইসব পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। ভরদ্বাজের মুখে শুনুন -- “আমি ইন্দ্রাদি তিন লোকপালকে আহ্বান করিতেছি, তাঁহারা আমার অতিথি সৎকারের ইচ্ছাপূরণ করুন। মৈরেয় মদ্য এবং সুসংস্কৃত সুরা প্রবাহিত করিতে থাকুন।”
রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ছাড়ুন -- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বারো রকমের মদ বা সুরার উল্লেখ পাই৷ কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দেখি সুরাধ্যক্ষ নামে একটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পদও ছিল। মদ কেনাবেচার উপর নজরদারিও থাকত। ছিল নানা আইন এবং তা কঠোরভাবে মানতে হত। মদ্যপানের আসরে শুধু ‘সচ্চরিত্র’ লোকেদেরই পরিমিত মদ দেওয়া হত। তবে শুধুমাত্র সমাজের উঁচুতলার মানুষরাই কেবল মদের আসর থেকে মদ বাইরেও নিয়ে যেতে পারতেন। সাধারণ পাবলিকদের মদ্যপান শুধু বার বা পানশালার মধ্যেই প্রবেশাধিকার দেওয়া করা হত। অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত কয়েকটির মদের নাম জেনে নিই --- চাল থেকে তৈরি হত মোদক, ময়দা থেকে প্রসন্ন, চিনি থেকে আসব, অরিষ্ট, গুড় থেকে মৈরেয় ও মাধ্বী৷ মদের দোকান বা পানশালা সম্পর্কে কৌটিল্য বলছেন -- পানশালায় অনেক ঘর থাকবে, সেই ঘরে বিছানা ও বসার চেয়ার থাকবে৷ ঘরগুলি গন্ধদ্রব্য, ফুলের মালা, জল ও অন্যান্য স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থাও থাকবে৷ ধনী এবং গরিব-গুর্বোদের পৃথক পানশালা ছিল। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই নয়, কৌটিল্য বলেছেন বিশেষ উৎসব উপলক্ষে সাধারণ মানুষ বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা মদ উৎপাদন করতে পারবেন৷
মল্লনাগ বাৎস্যায়ন ছিলেন বেদজ্ঞ ভারতীয় দার্শনিক। অর্থশাস্ত্র প্রণেতা কৌটিল্য ও কামসূত্রের প্রণেতা বাৎসায়ন একই ব্যক্তি। ধারণা করা হয়, তিনি গুপ্তযুগে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ভারতে বর্তমান ছিলেন। কামসূত্র প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিত মল্লনাগ বাৎস্যায়ন রচিত সংস্কৃত সাহিত্যের একটি প্রামাণ্য মানব যৌনাচার সংক্রান্ত গ্রন্থ। বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে চৌষট্টি কলার মধ্যে একটি পান ও ভোজনের উল্লেখ আছে৷ সেখানে ‘আসব’ নামে পানীয়ের কথা বলা হয়েছে৷ বাৎস্যায়নের কামসূত্রের দশম অধ্যায়ে বলা হয়েছে – “পুরুষ নারীকে আহ্বান করে মদ দেবেন। তার পর তার চুলে বিলি কেটে দেবেন, আলিঙ্গন করবেন।” এছাড়া নানা মদের কথা বলা আছে৷ সেই সব মদ, ফল, ফুল, সবজি, নুন, তেতো, ঝাল, টক ইত্যাদি নানা ধরনের মশলা বা চাটনির (চাট ?) সঙ্গে মিশিয়ে পান করতে বলা হয়েছে৷ আয়ুর্বেদশাস্ত্রে আয়ুর্বেদ চিকিৎসক চরক তার লেখা চরকসংহিতায় চুরাশি রকমের মদের উল্লেখ করেছেন৷ চরক লিখছেন – “মদ স্বাভাবিক পানীয়, রোজ পরিমিত পান করলে এ অমৃতের মতো, কিন্তু যথেচ্ছ পান করলে রোগের জন্ম দেয়।”
প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও সমান তালে মদ্যপান করতেন। কোনৈ বিধিনিষেধ ছিল না, কোনো জড়তাও ছিল না।কালিদাসের লেখা ‘শকুন্তলা’ নাটকে দেখা যাচ্ছে, সে যুগে মদের দোকান থেকে মদ বিক্রি করা হত। এমনকি রাজসভার পারিষদদের মধ্যেও মদ্যপানের রেওয়াজ ছিল৷ কালিদাসের লেখায় প্রায়ই ঠোঁটে মদিরার সুগন্ধ মাখানো মহিলাদের উল্লেখ পাওয়া যায় – “ভাসাং মুখৈরাসব গন্ধ-গর্ভৈব্যাপ্তান্তরাঃ”৷ ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে মদ্যপানের কথা আছে৷ ‘মেঘদূত’ কাব্যে মদকে বলা হয়েছে ‘উপভোগ করার ফল’৷ ‘কথাসরিৎসাগর ’-এও রাজার মদ্যপানের বর্ণনা আছে৷ ‘রত্নাবলী’ কাব্যে দেখা যায় নারী-পুরুষনির্বিশেষে মদ্য পান করে নাচ গানে অংশ নিচ্ছে৷
বৌদ্ধধর্মে মদ্যপান : বৌদ্ধমতে মদ খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। গৃহস্থ যাঁরা পঞ্চশীল মাত্র গ্ৰহণ করবে তাঁরাও মদ্যপান করতে পারবে না। তঁহার সোম পান করিতেন। আর্যরা সৌভ্রামণিযাগে তাঁরা সুরাপান করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বৌদ্ধধর্ম’ গ্রন্থে লিখেছন – “পুরাণে বলে পূর্বে সকলেই সুরাপান করিতেন, কিন্তু শুক্রাচাৰ্য্য শাপ দেওয়ায়, মদ খাওয়া মহাপাপ।” ভিক্ষুদের জন্য বুদ্ধদেব যেসব নিয়ম বেঁধেয দেন, তার কতকগুলি নিয়ম গৃহস্থের পালনীয়। ধাৰ্মিকসূত্রে গৃহস্থের কুলধৰ্ম বলে যেসব বিধান দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে জীবহত্যা, চুরি, মিথ্যাভাষণ, ব্যভিচার ও সুরাপান -- এই পঞ্চনিষেধ সর্বসাধারণ। অক্ষয়কুমার মৈত্রের ‘বৌদ্ধধর্ম’ গ্রন্থেও একইরকম বিবৃতি পাচ্ছি – “সমস্ত দেশে লোকে জীবহিংসা ও সুরাপান পরিত্যাগ করিয়াছে ; চণ্ডাল ভিন্ন আর কেহ লশুনাদি আহার করে না। বাজারে মদের দোকান দেখিতে পাওয়া যায় না। …বৌদ্ধধর্ম্ম প্রবর্ত্তিত হইবার পূর্ব্বে জীবহিংসা ও সুরাপান প্রচলিত ছিল ; -- শাস্ত্রে তাহার নিন্দা ও প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা থাকিলেও লোকসমাজে তাহা প্রচলিত হইয়া পড়িয়াছিল। বৌদ্ধমত প্রচলিত হইবার পর জীবহিংসা ও সুরাপান নিবারিত হইয়া যায়।” বৌদ্ধধর্মে সুরাপান দোষাবহ বটে এবং যুদ্ধ-বিগ্রহও। তবে স্বয়ং বুদ্ধ তাঁর দ্বিতীয় ‘কর্মবিপাক’-এ স্বীকার করেছেন যে, তিনি মদ্যপান করতে। অবশ্য ইহজীবনে নয়, পূর্বজীবনে। বুদ্ধ বলছেন – “হে ভিক্ষুগণ, অতীত জন্মে আমি বারাণসীতে গরিব মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছিলাম। তখন আমার বদঅভ্যাস ছিল মদ খাওয়া। তখনকার সময়ে নন্দ নামক একজন অরহৎ ভিক্ষুকে মদ খেয়ে আমি অপবাদ দিয়েছিলাম, এমনি অরহৎ ভান করে, গোপনে পঞ্চকামভোগী, দুঃশীল বলে গালিগালাজ করেছিলাম। সেই বাচনিক পাপের ফলে বহুজন্ম নরকের আগুনে দগ্ধ হয়েছিলাম, দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভ করেও মিথ্যা অপবাদে লাঞ্চিত হয়েছি বহুজন্ম। অবশিষ্ট কর্মের ফলে চিঞ্চামানবিকা গর্ভবতী সেজে জনসমক্ষে আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে।” তৃতীয় বিপাকে তিনি আরও বলেছেন – “হে ভিক্ষুগণ অতীত জন্মে বারাণসীতে আমি এক গরিব পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম। আমি ছিলাম মদতি। মদের নেশায় সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকতাম। তখন সুরভী নামক এক পচ্চেক বুদ্ধ ভিক্ষান্নে এসেছিলেন। আমি চিৎকার দিয়ে বলেছিলাম---- মুণ্ডিত মস্তক, দুঃশীল, অন্যের প্রস্তুত করা খাদ্য অগ্রে ভোজনকারী, পবিত্ররূপে সেজে আসছে এই বলে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলাম। উক্ত বাচনিক কর্মবিপাকের ফলে আমি বহুজন্ম নরকের তীব্র দহনে দুঃখ ভোগ করেছি। অন্তিম জন্মে বুদ্ধ হয়েও সুন্দরী হত্যার মিথ্যা অপবাদ পেতে হল।”
খ্রিস্টধর্মে মদ্যপান : মদ খাওয়া সম্পর্কে খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে বলা হয়েছে। শাস্ত্র খ্রিস্টানদের কোনো নেশা তথা বিয়ার বা মদ খাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয় নাই। প্রকৃতপক্ষে, কোনো কোনো শাস্ত্রাংশ মদ খাওয়া সম্পর্কে ইতিবাচক ব্যাখ্যা দিয়েছে। উপদেশক ৯ : ৭ পদ শিক্ষা দিয়েছে, “তাই তুমি গিয়ে... ... আনন্দপূর্ণ অন্তরে দ্রাক্ষারস খাও”। গীতসংহিতা ১০৪ : ১৪-১৫ পদ বলেছে যে, ঈশ্বর মদ (দ্রাক্ষারস) দিয়েছেন, যেন তা “মানুষের মনকে খুশি করে।” আমোষ ৯ : ১৪ পদে আলোচনা করা হয়েছে যে, নিজের আঙুর ক্ষেত থেকে (দ্রাক্ষারস) মদ খাওয়া ঈশ্বরের আশীর্বাদের চিহ্ন। যিশাইয় ৫৫ : ১ অনুপ্রাণীত করেছে, “বিনা পয়সায়, বিনামূল্যে দ্রাক্ষারস আর দুধ ক্রয় করো।” মদ খাওয়ার বিষয়ে ঈশ্বর খ্রিস্টানদের আদেশ দিয়েছেন তারা যেন মাতাল না হয় (ইফিষীয় ৫ : ১৮)। মাতাল হওয়া ও তার পরিণতিকে বাইবেল দোষ বলে গণ্য করে থাকে (হিতোপদেশ ২৩ : ২৯-৩৫)। খ্রিস্টানদের বলা হয়েছে, তারা যেন তাদের দেহকে কোনো কিছুর অধীনে ‘প্রভুত্ব’ করতে না দেয় (১ করিন্থীয় ৬ : ১২; ২ পিতর ২ : ১৯)। বেশি করে মদ খেলে তা নিঃসন্দেহে নেশায় আসক্ত করে তোলে। শাস্ত্র এ বিষয়ে নিষেধ করে দিয়েছে যেন একজন খ্রিস্টান এমন কিছু না-করে, যাতে অন্য কোনো খ্রিস্টান বিঘ্ন পায়, অথবা তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে পাপ করতে প্ররোচিত হয় (১ করিন্থীয় ৮ : ৯-১৩)। এইসব নীতিমালার আলোকে, যে-কোনো খ্রিস্টানের পক্ষে বলা কষ্টকর, সে ঈশ্বরের গৌরবের জন্য অতিরিক্ত মদ খেয়েছে (১ করিন্থীয় ১০ : ৩১)। যিশু জলকে দ্রাক্ষারসে (মদে) পরিণত করেছিলেন। ১ তিমথীয় ৫:২৩ পদে পৌল তিমিথীয়কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন -- যেন সে জল খাওয়া বন্ধ করে দেয় (তার পেটের সমস্যা হতে পারে বলে), কিন্তু অল্প অল্প দ্রাক্ষারস খায়। তখনকার দিনে আঙুরের রস গেঁজিয়ে মদ তৈরি করা হত। এটা যে একেবারে আঙুরর রস ছিল তা বলা ভুল হবে। আবার এটাও বলা ঠিক নয় যে, তা ছিল আজকের দিনে ব্যবহৃত অবিকল মদের মতো। তবে এটা ঠিক, বাইবেল কিন্তু নেশা হয় এরকম বিয়ার, মদ ইত্যাদি খেতে খ্রিস্টানদের নিষেধ করেননি। তবে মাতাল বা নেশায় আসক্ত হওয়া থেকে একজন খ্রিস্টানকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে (ইফিষীয় ৫ : ১৮; ১ করিন্থীয় ৬ : ১২)।
বাইবেল মাতাল হওয়াকে এবং মাত্রাতিরিক্ত মদ পান করাকে নিন্দা করে, কিন্তু পরিমিত মাত্রায় মদ পান করাকে নিন্দা করে না। (১ করিন্থীয় ৬ : ৯, ১০) আসলে প্রাচীনকাল থেকেই ঈশ্বরের উপাসনা করে এমন নারী-পুরুষরা মদ্য জাতীয় পানীয় পান করে আসছে, যে-পানীয় সম্বন্ধে বাইবেলে দুশো বারেরও বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। (আদিপুস্তক ২৭ : ২৫) “আনন্দপূর্বক তোমার খাদ্য ভোজন করো, হৃষ্টচিত্তে তোমার দ্রাক্ষারস পান করো,” (উপদেশক ৯ : ৭)। যেহেতু দ্রাক্ষারস মনকে আনন্দিত করে, তাই সাধারণত কোনো উৎসবে, যেমন বিবাহভোজে, এই পানীয় পরিবেশন করা হত। এইরকম একটা ভোজেই, যিশু তাঁর প্রথম অলৌকিক কাজ করেছিলেন অর্থাৎ জলকে ‘উত্তম দ্রাক্ষারসে’ পরিণত করেছিলেন। (যোহন ২ : ১-১১) মদকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হত (লুক ১০ : ৩৪; ১ তিমথীয় ৫ : ২৩)।
পানাহারের ক্ষেত্রে আত্মসংযমী হওয়া ঈশ্বরের কাছ থেকে এক মৌলিক চাহিদা। (হিতোপদেশ ২৩ : ২০; ১ তিমথীয় ৩ : ২, ৩, ৮) ইন্দ্রিয়দমনের অভাব ঈশ্বরের অসন্তুষ্টি নিয়ে আসে। বাইবেল বলে -- “দ্রাক্ষারস নিন্দক; সুরা কলহকারিণী; যে তাহাতে ভ্রান্ত হয়, সে জ্ঞানবান নয়।” (হিতোপদেশ ২০ : ১) একটা যে-উপায়ে মদ মূর্খ ব্যক্তিদের ভ্রান্ত করতে পারে, তা হল তাদের নৈতিক মানদণ্ড নষ্ট করে দেওয়ার মাধ্যমে। হোশেয় ৪ : ১১ পদ বলে -- “মদ্য ও নতুন দ্রাক্ষারস, এই সকল বুদ্ধি হরণ করে।” জন নামের একজন ব্যক্তি তিক্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই বিষয়টা শিখেছিলেন। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে, তিনি একটা হোটেলে গিয়ে ঢোকেন, এরপর অতিরিক্ত মদ পান করেন এবং পারদারিকতায় জড়িয়ে পড়েন — এগুলো ছিল এমন কাজ, যেগুলোর জন্য পরে তিনি গভীরভাবে অনুশোচনা করেছিলেন এবং আর কখনো না-করার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিয়েছিলেন। মদের অপব্যবহার আমাদেরকে শারীরিকভাবে, নৈতিকভাবে এবং আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বাইবেল বলে যে -- মাতাল ব্যক্তিরা কখনোই অনন্তজীবন পাবে না। (১ করিন্থীয় ৬ : ৯, ১০)
অল্প পরিমানে মদ খাওয়া খ্রিস্টানদের জন্য স্বাধীনতা বলা যায়, কিন্তু মাতাল হওয়া বা নেশায় আসক্ত হওয়া অবশ্যই পাপ। যেহেতু বাইবেল মদ খাওয়া ও তার পরিণতির বিষয়ে সতর্ক করে দেয়, অতিরিক্ত মদ খেলে সহজেই প্রলোভিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং অন্যদের বিরুদ্ধে মন্দ কাজ করা বা অন্যদের জন্য বাধাজনক কাজ করার সম্ভাবনা থাকে; তাই স্বাভাবিকভাবে মদ খাওয়া থেকে খ্রিস্টানদের দূরে থাকার কথা বলেছেন। অর্থাৎ মদ পান করো, কিন্তু মাতাল হোয়ো না। মদ তুমি পান করবে, মদ যেন তোমায় পান না-করে।
ধর্মকথা এবং আমরা : দেখতেই পেলাম, মদ্যপান সব ধর্মেই মোটামুটি নিষিদ্ধ করেছে। তাহলে মদ্যপান করে কে ! উত্তর : সব ধর্মাবলম্বীরাই মানুষরাই মদ্যপান করেন। ধর্ম ধর্মের কথা বলেছে, মানুষ চলেছে মানুষের পথে। অন্য ধর্মাবলম্বীরা মদ্যপান নিয়ে তেমন চিৎকার না-করলেও, ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কিছু মানুষ সারাক্ষণ চিৎকার করে চলেছেন, ‘মদ্যপান কোরানে হারাম’ ‘মদ্যপান কোরানে হারাম’ বলে। মদ্যপান হারাম, শূকরের মাংস হারাম, মূর্তিপুজো হারাম, সুদ খাওয়া হারাম – তবু সবেতেই আছেন তাঁরা। প্রায় প্রতিটি মোগলশাসক বেহেড মাতাল ছিল। সেটা কোনো কথা নয়, ওসব হারাম-টারাম দেখিয়ে লাভ নেই। কম-বেশি সব ধর্মের মানুষরাই মদ্যপান করে থাকেন। না-হলে এত কোটি কোটি ডলারের রেভেনিউ কোথা থেকে জমা হয় প্রতিটি দেশের সরকারের কোশাগারে ? হিন্দু দেশ, মুসলিম দেশ, খ্রিস্টান দেশ, বৌদ্ধ দেশ -- কোন্ দেশের সরকার মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছে ? মদ্যপান এবং মদ বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আনার জন্য কোনো দেশের কোনো ধর্মাবলম্বী মানুষ আন্দোলন করেছেন বলে তো শুনিনি। হিন্দু বা সনাতন ধর্মের কিছু মানুষও তাঁদের সাইটগুলিতে বারবার বলার চেষ্টা করে থাকে, হিন্দুধর্মে মদ বা সুরা নিষিদ্ধ।প্রমাণ করতে থাকে সোমরস আদৌও কোনো মদ নয়।
মদ পান করুন। আপনার ভালো লাগলে আপনি পান করুন। না ভালো লাগলে মদ্যপান করবেন না। প্লিজ, কথায় কথায় ধর্ম টেনে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন না, “আমার ধর্ম কত ভালো !” ধর্ম ভালো কি মন্দ হয় ধর্মগ্রন্থ বা কিতাব দিয়ে নয়, ধর্ম ভালো বা মন্দ বোঝায় সেই ধর্মাবলম্বী আচার-আচরণ, জীবনচর্যায়। অতএব কোরান-বেদ-বাইবেল দেখাবেন না। রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ২০১৭ সালে ওয়াইন মার্কেটিং প্রায় ৩০২.০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু তাই নয়, এই মার্কেটিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ প্রায় ৪২৩.৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ে পৌঁছোবে। এই বৃদ্ধির পরিমাণ ২0১৭ থেকে ২0২৩ সালের মধ্যে ৫.৮%। কে পান করে এত মদ ! মানুষই তো ?
মদ শুধু পুরুষরাই পান করে না, মদ পানের ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রায় ধরেই ফেলেছে মহিলারা। তাদের মধ্যে মদ্যপানের অভ্যাস দ্রুত বাড়ছে। বিশ্ব জুড়ে পরিচালিত এক সমীক্ষায় এই দাবি করা হয়েছে। ১৮৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নেওয়া প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে এর আগে গবেষকরা দেখিয়েছিলেন, পুরুষদের মধ্যে মদ্যপানের অভ্যাস ছিল বহুগুণ বেশি এবং এ কারণে মদ্যপানজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় তারা বেশি ভুগত। কিন্তু এর পরবর্তী প্রজন্মে মদ্যপানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই ব্যবধান কমে এসেছে। গবেষকরা বলছেন, সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মদ্যপানের ক্ষেত্রে দুই লিঙ্গের ব্যবধান দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নারীর তুলনায় পুরুষদের মদ পানের অভ্যাস ছিল দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু এখন মদ পানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই অনুপাত এক দশমিক এক। গবেষণাটি চালায় অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস। যদিও এই সমীক্ষার তথ্য সংগ্রহ করা হয় সারা বিশ্ব থেকে, জরিপের বেশিরভাগ তথ্য এসেছে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে। গবেষকরা বলেছেন, মদ্যপানের অভ্যাস এবং মদ্যপানজনিত নানা সমস্যাকে ঐতিহাসিকভাবে একটি পুরুষালি সমস্যা হিসেবে দেখা হত। কিন্তু এখন আর এরকম অনুমানের কোনো সুযোগ নেই। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক মার্ক পেটিক্রু বলেন, সমাজে নারী এবং পুরুষের ভূমিকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বিগত দশকগুলোতে। এটি অংশত মদ্যপানের ক্ষেত্রে এই নতুন প্রবণতা কিছুটা ব্যখ্যা করে, পুরোপুরি নয়। তিনি বলেন, এখন অ্যালকোহলের সহজলভ্যতাও হয়তো আরেকটি কারণ। আর যারা অ্যালকোহল বিপণন করছে, তারা ভোক্তা হিসেবে নারী, বিশেষ করে তরুণীদের টার্গেট করছে। তবে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ইউরোপীয়রা সবচেয়ে বেশি মদ্যপান ও ধূমপান করেন৷ সময়মতো সতর্ক না-হলে ফলাফল ভয়ংকর৷ তাই এ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের সাবধান করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা৷
মদ্যপান করা আর মদ্যপানে রেকর্ড গড়া এক জিনিস নয়। সেই রেকর্ড ভাঙার হাতছানিতে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের জেরে মৃত্যু হয়ে গেল প্রৌঢ়ের। বিচারে অনিচ্ছাকৃত হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হলেন পানশালার পরিবেশক। আদালতের রায়ে ৪ মাসের কারাদণ্ড এবং এক বছরের জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে ফ্রান্সের ক্লেমঁ-ফেরঁ শহরের এক পানশালা আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে মোট ৫৬ শট মদ পান করে নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন রেনোঁ প্রুদম (৫৬)। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান তাঁর মেয়ে ও বন্ধুরা। এর পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রুদম। তাঁকে হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগে ভর্তি করা হয়। পরের দিন সেখানেই তিনি মারা যান। গ্রাহকের মৃত্যুর জেরে পানশালার পরিবেশক জিল ক্রেপঁকে অভিযুক্ত করেছে ফরাসি আদালত। আসলে মামলার শুনানিতে সাক্ষ্য দিতে এসে তিনি কবুল করেছিলেন, ওই সন্ধ্যায় পানশালার নোটিশ-বোর্ডে মদ্যপানের নজির সংক্রান্ত তথ্য লিখে তিনি ভুল করেছিলেন। বোর্ডে লেখা রেকর্ড ভাঙার লোভেই শেষপর্যন্ত প্রাণ হারাতে হয় প্রুদমকে। আদালতের রায় মেনে নিতে পারেননি ক্রেপঁর আইনজীবী রেনঁ পোর্তোজোয়া। তাঁর দাবি, 'আদালতের রায় আবেগতাড়িত এবং উদাহরণ তৈরি করার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।' পোর্তোজোয়া জানিয়েছেন, তাঁর মক্কেল কোনো অপরাধ করেননি। বরং মেয়ের আব্দারেই মদ্যপানের রেকর্ড ভাঙতে উৎসাহী হন প্রুদম।
মদে কি খুব দুর্গন্ধ ? সব মদে দুর্গন্ধ না-থাকলেও কিছু মদে বেশ দুর্গন্ধ। বিশেষ করে চোলাই বা তাড়ির মতো মদে বেশ বদ গন্ধ। তবে বহু মানুষকে দেখেছি যে মদই পান করুক না-কেন নাক টিপে চোখে বুজে পান করেন। খেতে বিস্বাদ বলে অনেকে চোখ-মুখও খিঁচিয়ে থাকেন। রাবণ কী মদ পান করতেন জানি না। সেই মদে দুর্গন্ধ ছিল বলে রাবণ খুব বিরক্তি বোধ করতেন। রাবণ মদ্যপানে খুব শৌখিন ছিলেন। তাই চেয়েছিলেন সারা পৃথিবীর মদ যেন দুর্গন্ধমুক্ত হোক। না, সেই ইচ্ছা রাবণের পূরণ হয়নি। তবে রাবণের যুগে দুর্গন্ধমুক্ত মদ তৈরি করা না-গেলেও বর্তমানে গন্ধহীন মদ পাওয়া যায়।
মদ খেলে মানুষ মাতাল হয় কেন ? : মদ তো পান করবেন, কিন্তু মাতাল হন কেন ? পা কেন টলমল করে ? কেন ঢলে পড়ে শরীর ? মদে আসক্তি শুধু মাতাল হওয়াকেই বলে না। মাতাল না-হয়েও মানুষ মদের প্রতি আসক্ত হতে পারে। আবার মদ্যপান করেও কেউ কেউ মাতাল হন না বা মাতলামো করেন না বা এমন পর্যায়ে মদ্যপান করেন না যার ফলে ‘আউট’ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। মদ্যপানে নেশা হওয়া এবং মাতাল হয়ে মাতলামো হল দ্রব্যের গুন। শুধু মানুষ নয়, মদ্যপানে অন্যান্য প্রাণীরাও মাতাল হয়। প্রাণীরা কখনোই সজ্ঞানে মদ্যপান করে না। ভুলবশত কিংবা কেউ পান করিয়ে দিলে তবেই প্রাণীদের মদ্যপান হয়। কোনো প্রাণীকে নিয়মিত মদ্যপান করালে সেই প্রাণীরও মদে আসক্তি এসে যায়। মাঝেমধ্যেই শুনে থাকবেন, পাহাড়ি বা আদিবাসী অঞ্চলে হাতিরা ঢুকে ঘরে বানিয়ে রাখা ভুলবশত মদ্যপান করে বাড়িঘর ভাঙচুর করে।
মদে রাসায়নিক পদার্থ হিসাবে থাকে অ্যালকোহল। এটি স্নায়ুতন্ত্রের কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটায়, ফলে মানুষের মস্তিস্ক তার কর্মকাণ্ড ঠিকভাবে চালাতে পারে না, যার বহিঃপ্রকাশ হল মাতলামি ।তবে ‘মাতাল’ শব্দটির প্রতিটি মদ্যপায়ীর কাছে সম্ভবত নিজস্ব সংজ্ঞা আছে এবং একটা ‘থ্রেশহোল্ড’ও আছে। সাধারণত যাঁরা মদ্যপান করে না, তাঁদের মনে মাতাল বলতেই ভেসে ওঠে মদ খেয়ে হৈ-হল্লা করো, গালিগালাজ করো, স্ত্রীকে মেরে হাড় ভেঙে দাও -- এসব একশ্রেণির মন্দ মানুষদের আচরণ। পরিবারে ও সমাজে অশান্তির সৃষ্টিকারী এইসব মানুষরা অবশ্যই মন্দ মানুষ। এইসব মন্দ মানুষদের দিয়ে মন্দ কাজও করিয়ে নেওয়া যায় অনায়াসে। এক বোতল মদের লোভ দেখালেই, এরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। একশ্রেণির ধান্দাবাজ বা সুবিধাবাদী মানুষও এইসব মন্দ মানুষদের মদ পান করিয়ে মন্দ কাজ করিয়ে নেয়।
কিন্তু এরাই তো সব নয়, আরও ভিন্ন জাতের মাতাল আছে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনার ‘থ্রেশহোল্ড’। আপনি নিজেকে কতোটুকু লাগাম ছাড়া করবেন এটি তার উপর নির্ভর করে। নিজের ধারণক্ষমতার বাইরে পান করলে আচরণে ও শরীরে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। যাঁরা মদ খেয়ে ন্যুইসেন্স তৈরি করে, তাঁরা আসলে নিজের টলারেন্স লেভেলের বাইরে পান করে। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখেছি থ্রেশহোল্ডের বাইরে যেতে যেতে ক্রমশ তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সমাজে মাতাল বলে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। অনেক লোক আছে যারা সামান্য পান করেও মাতালের অভিনয় করে।
মদ্যপান বিষয়গুলোতে রক্ষণশীল সমাজে মদ্যপান এবং মাতালামিকে সমার্থক হিসাবে দেখা হয়। তবে 'মাতালামি'র চেয়ে উপযুক্ত ব্যবহার মনে হয় ‘মদাসক্তি’ বা ‘মদকে ভাললাগা’ শব্দগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে। আমার পর্যবেক্ষণ হল স্বাভাবিক অবস্থায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীনতা (পাগলামি অর্থে নয়) মদ্যপানের পরে প্রকটভাবে প্রকাশ পায়।
এমবিটিআই অনুযায়ী যারা এক্সট্রোভার্ট টাইপের, তারা নেশাগ্রস্ত হওয়ার পর সাধারণত জোরে কথা বলে, জোরে হাসে, অপরকে কথা বলতে দেয় না। পক্ষান্তরে, ইন্ট্রোভার্ট টাইপের লোকজন গভীর ভাবনায় ডুবে যায়, চাপা কিন্তু ভারী স্বরে কথা বলে, অপরের কথা শোনে। তাই পানকারীকেই তার শারিরীক সক্ষমতা ও রিয়্যাকশনের ধরন বিচার করে ঠিক করতে হয় তাঁর থ্রেশহোল্ড, কতটুকু পান করবে এবং কতটুকু রিয়্যাক্ট করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, সমাজে কারও একবার যদি ‘মাতাল’ বলে পরিচিতি জুটে যায়, মদ ছাড়লেও তার মাতাল নাম ঘোচে না।
যেসব মানুষ নিয়মিত অ্যালকোহলের নেশা করে তাদের মধ্যে আচার-আচরণের অস্বাভাবিকতা বা অসংলগ্নতা দেখা যায়৷ তাঁরা কিন্তু অ্যালকোহলের জন্য এই আচার-ব্যবহারের অস্বাভাবিকতাকে 'অস্বীকার' করে থাকে৷ অস্বীকার করাটাই একটা বিশেষ মানসিকতা, যা নেশা করার জন্য ধীরে ধীরে গভীরে তৈরি হয়৷ বন্ধুদের সঙ্গে কলেজ পালিয়ে বারে বসে রোজ আড্ডা দেয় ও মদ খায়৷ অস্বীকার করা, মিথ্যা বলা বা অজুহাত দেওয়া যাঁরা নিয়মিত অ্যালকোহলের নেশা করে, তাঁদের অনেকের মধ্যে এরকম দেখা যায়৷ মদ খেয়ে বা মদের নেশায় অস্বাভাবিক আচার-আচরণ যাকে সোজা কথায় ‘মাতলামি’ বলা হয়, কেউই সহ্য করতে চান না৷ যারা অ্যালকোহল খায় তাদের প্রায় ২০% এর অপকারিতার শিকার হয়, তাঁরা নিজেদের সংযত করতে পারে না, অ্যালকোহলের পরিমাণ ক্রমশ বাড়িয়ে শেষপর্যন্ত বিপদ ডেকে আনে৷ আসুন, মদ্যপ্রেমীদের কুযুক্তিগুলি জেনে নিই –- (১) ‘আমি মদ খাই, মদ আমাকে খায় না’। (২) আমি দুঃখ-কষ্ট ভুলতেই মদ খাই৷ (৩) নেশা করলে আমার শরীর-মন ভালো থাকে৷ (৪) কাজকর্মে উত্সাহ পাই। (৫) আমি জানি কতটুকু অ্যালকোহল খেতে হবে, কী পরিমাণে খেতে হবে, কী পরিমাণে খেলে ক্ষতি হয়৷ (৬) আমি এতো বোকা নই যে নিজের ক্ষতি করব।
অবচেতন মনকে চেতন মন দিয়ে অনেক সময় অস্বীকার করলেও অবচেতন মন মনের অবদমিত আবেগ, নিগূঢ় ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করবেই৷ নিজেকে কষ্ট দেওয়া, নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা, মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা মানুষকে নেশায় আসক্ত হওয়ার পথে ঠেলে দেয়৷ দুর্ভাগ্যবশত শত যুক্তি-তর্ক বা বিচার-বিবেচনা তখন কোনোরকম কাজ করে না। নেশা করা খারাপ -- এটা অনেক মানুষই জানে তবুও ‘জেনে শুনে বিষপান’ এর মতো নেশার প্রতি আসক্ত পড়ে জ্ঞানপাপীরা৷ অনেক সময় নেশা করতে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক দিক দিয়ে অনেক রকমের সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ পাড়াতে, মহল্লায় বা বাড়িতে নেশা করার জন্য মারধর, ভয় দেখানো, ঘরে বন্ধ করে রাখা, পুলিশি হামলা, ঝামেলা অনেক সময় মানুষদের নেশা ছাড়ার থেকে নেশা করে যাওয়ার দিকে নিয়ে যায়৷ অতএব সাধু সাবধান। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, একজন অমদ্যপায়ীর চাইতে মদ্যপায়ীর মস্তিস্ক ভিন্ন ভাবে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করে। এই মদও আসক্তির কারণ হয়। এটা সাধারণত মস্তিষ্ককে অবদমিত করে, শরীরে অন্যান্য খাদ্যপ্রাণ গ্রহণে বাধা দেয়, কথা জড়িয়ে যায়, মাংশপেশীর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে, কো-অর্ডিনেশন ব্যাহত করে, ফলে আসক্তের সিরোসিস ছাড়াও ব্রেইন ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অ্যালকোহল আসক্তিকে ‘অ্যালকোহলিজম’ নাম দেওয়া হয়েছে। এ তো গেল শারীরিক বিপর্যয়। মদ্যপের শারীরিক বিপর্যয় হল তো বয়েই গেল, তাতে আমার কী যায় আসে ! কিন্তু যখন মদ্যপের মদ্যপান সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনে, তখন আমার কিছু যায়-আসে বইকি। সামাজিক বিপর্যয় কীভাবে আসে ? ধর্ষণ, খুন, পতিতাপল্লিতে গমন –- এই তিনটি ঘৃণ্য অপরাধ মদ্যপানের পর সংঘটনের মধ্য দিয়ে সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে। কোনো মানুষ মদ্যপ হলে মদ্যপান না-করা মানুষরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের পর মস্তিষ্ক হিতাহিতজ্ঞানরহিত হয়ে এই ধরনের অপরাধ মানুষ অনায়াসে করে ফেলে। মদ্যপ মানুষটির তখন পুলিশ-ভয় কাজ করে না, হাজতবাস-কারাগারবাস-ভয় কাজ করে না, পাবলিকের গণপিটুনি খাওয়ার ভয় থাকে না। মদ উৎপাদন, মদ বিক্রয় এবং মদ্যপান নিষিদ্ধ করা হলে ধর্ষণ, খুন, পতিতাপল্লিতে কামকেলির মতো অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে যাবে। কারণ বিনা মদে কেউ এ ধরনের অপরাধ করতে পারে না। ধূমপানে কতটা ক্ষতি হয় আমি জনি না, তবে মদ্যপানে যে শারীরিক-মানসিক-পারিবারিক-সামাজিক সবরকমের ক্ষতি করে, এটা প্রমাণিত। সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে আমার বিনীত আবেদন, যেভাবে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছেন আইন করেছেন, ঠিক তেমনভাবে অবিলম্বে বাংলা-চোলাই মদ উৎপাদন, মদ বিক্রয় এবং মদ্যপান নিষিদ্ধ করুন, বিলাতি মদের আমদানি নিষিদ্ধ করুন। তাতে কোটি কোটি টাকার রাজস্বে টান পড়বে ঠিকই, তবে অপরাধমুক্ত একটা সমাজ একটা দেশ উপহার দেওয়া যাবে। গ্যারান্টি।
মদ্যপানীয়ের যে রাসায়নিকটির জন্য মাতালামো হয় তার নাম অ্যালকোহল। তবে যে-কোন অ্যালকোহল নয়, মদে থাকা ইথানল (ethanol) নেশা বা মাতলামোর জন্য দায়ী। ইথানল তৈরি হয় কোনো শর্করা জাতীয় দ্রব্যের গাঁজনের (ফারমেন্টেশান) ফলে। এটা একটা রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যার উপজাতগুলির একটি হল ইথানল। এই ইথানল পাকা ফলেও উপস্থিত থাকে। যার ফলে রাতে শোয়ার আগে পাকা ফল খেলে ভালো ঘুম আসে। অনেকে বলেন রাতে শোওয়ার আগে পাকা আম খেলে ভালো ঘুম নাকি গ্যারান্টি।
বিভিন্ন ফল বা খাদ্যদ্রব্য বা উদ্ভিদ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনে মদ তৈরি করা হয়, যেখানে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে বিভিন্ন মাত্রায়। শর্করা (গ্লুকোজ) থেকে ইস্ট দ্বারা ইথানল তৈরি হয়। মানুষ যখন মদের মাধ্যমে ইথানল গ্রহণ করে তখন এই ইথানল রক্তের মাধ্যমে প্রাণীর মস্তিষ্কে যায় এবং নিউরন কোশের মধ্যে যোগাযোগকে শিথিল করে দেয়। ফলে মনে বেশ ফুরফুরে, হালকা হালকা ভাব বোধ করি। খুব বেশি মাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণ অবশ্য বিষক্রিয়া হয়ে যায়। মানুষের দেহ কিছু পরিমাণ অ্যালকোহল সহ্য করতে পারে। কাশির ওষুধগুলিতে কিছু পরিমাণ অ্যালকোহল আছে। নির্দিষ্ট ডোজে কাশির সেবন করলে গাঢ় ও নিরুপদ্রব ঘুম হয়। অনেকে আবার এই কাশির ওষুধের অস্বাভাবিক ডোজ বাড়িয়ে নেশাও করে।
যাই হোক, অ্যালকোহল ডিহাইড্রোজিনেজ (alcohol dehydrogenase) নামক একটি এনজাইম বা উৎসেচক রক্তের মধ্যে থাকা অ্যালকোহল ভেঙে ফেলে। প্রায় ৪০০ মিলিলিটারের রাম বা হুইস্কির মধ্যে থাকা অ্যালকোহল (৪০ শতাংশ অ্যালকোহল) পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করতে আমাদের দেহের ২৪ ঘণ্টর একটু বেশি সময় লাগে। প্রশ্ন উঠতে পারে, অ্যালকোহল ডিহাইড্রোজিনেজ মানুষের শরীরে এলো কীভাবে ? উত্তর সহজ, আদিকালে বন্যজীবনে থাকা অবস্থায় পাকা ফল খেয়ে অ্যালকোহলের বিষক্রিয়ার হাত থেকে বাঁচতে আমাদের দেহে এক ধরনের এনজাইমের উদ্ভব হয়েছিল মানুষের শরীরে। কিন্তু তার মানে এই না যে, আধুনিক হোমো-স্যাপিয়েন্সের মধ্যেই জিনটি উদ্ভব হয়েছে। আমাদের বন্যজীবনে অতি আদি কোনো পূর্বসূরীর কাছ থেকে এই জিন প্রবাহিত হয়ে বিবর্তনিক ধারায় আসতে পারে আমাদের শরীরে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে শুধু আগেই নয়, বরং যখন হোমো-স্যাপিয়েন্স আবির্ভূতই হয়নি, সেই ১০ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম মানব-পূর্বসূরীদের জেনোমে দেখা দেয় এই জিন। আর সেই জিনটি এখনও রয়ে গিয়েছে এবং সংখ্যায়-কাজে সমৃদ্ধ হয়েছে বিবর্তনিকভাবেই। মানুষ যে মাতাল হতে পছন্দই করবে সেটা আর অদ্ভুত কী !
যেই অ্যালকোহল ডিহাইড্রোজিনেজ জিনটিকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন, তাকে বলে ADH4। ধারণা করা হত মানুষের দেহে এই জিনটি তখনই এসেছে, মানুষ যখন প্রথম খাদ্য গাঁজানো (ফারমেন্টেশান) আরম্ভ করে। অর্থাৎ মাত্র ৯,০০০ বছর আগে থেকে। দুধে থাকা ল্যাকটোজ হজমের জিনটিও একইরকম সময়ে এসেছে প্রমাণিত। তাই, উপরের দাবিটি খুব অযৌক্তিক ছিল না। প্রাচীন মিশরীয় পাত্রে অ্যালকোহলের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। তাদের চিত্রকর্ম জুড়েও আছে মদ্যপানীয়র উপস্থিতি। কিন্তু ২৮ ধরনের প্রাইমেটকে (গরিলা, শিম্পাঞ্জি, মানুষ ইত্যাদি) নিয়ে নতুন গবেষণাটি বলছে, এই ADH4 জিনটির একটি আদিরূপ পাওয়া যেত ৫০ মিলিয়ন বছর আগের প্রাইমেটদের মধ্যে, যা মৃদু পর্যায়ের অ্যালকোহলকে পরিপাক করতে পারত। কিন্তু ১০ মিলিয়ন বছর আগে এই জিনের উন্নত ভার্সন আবির্ভূত হয়, যা আগের জিনটি চেয়ে ৪০ গুণ বেশি সক্ষমতার সঙ্গে অ্যালকোহল হজমে সাহা্য্য করে। এই পরবর্তী জিনটিই আমাদের আধুনিক ADH4 জিনের পূর্বসূরী। এই নতুন ভার্সনটা কিন্তু শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে দেখা যায় না।
পৃথিবী উত্তপ্ত অবস্থা থেকে ঠান্ডা হয়ে এসেছে ১০ মিলিয়ন বছর আগেই। পৃথিবী ধীরে ধীরে ভরে উঠতে থাকল প্রাণী আর উদ্ভিদে। প্রাইমেটরা গাছের পাকা ফল খাওয়া শুরু করল। যে পাকা ফলে ব্যাকটেরিয়া শর্করা থেকে ইথানল তৈরি করত। কিন্তু, ADH4 প্রোটিনটিতে মিউটেশান না-হলে এইসব পাকা ফল অল্প খেয়েই প্রাইমেটরা মাতাল হয়ে যেত এবং বেশি খেতে পারত না। অর্থাৎ আমাদের আদি পূর্বসুরি প্রাইমেটদের মধ্যে থাকা নতুন ADH4 জিনটি আমাদের বিবর্তনকে প্রভাবিত করেছে। অতএব দেখা যাচ্ছে নেশার ঝিম নেওয়াটা আমাদের বিবর্তনের সঙ্গেই জড়িত। তবে প্রথম বিষক্রিয়াটার কারণ জিন ছিল না। যেহেতু নতুন জিনটি অ্যালকোহলকে সহ্য করতে সক্ষম করেছে মানুষদের, সেহেতু অ্যালকোহলকে আর এড়িয়ে যায়নি প্রাইমেটরা। আর তারই ধারাবাহিকতায় থিতু হওয়া মানুষেরা গাঁজন শুরু করে পানীয় উৎপাদন করে। আর অল্পপানে যেহেতু বিষক্রিয়া হচ্ছে না, সেহেতু অ্যালকোহল ভালোলাগার অনুভূতি থেকে মাতাল হওয়ার জন্য পজিটিভ ফিডব্যাক হিসাবে কাজ করে।
অ্যালকোহল ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইমের কয়েকটা ভার্সন মানুষের শরীরে পাওয়া যায়। যার একটির নাম ADH1B। মানুষ বলতে পৃথিবীর মানুষ প্রজাতি বোঝায় না। যেমন প্রায় সব জাপানি, কোরিয়ান এবং চিনা মানুষের মধ্যে এই জিনটির স্বতন্ত্র ভার্সন থাকে, যার নাম ADH1C। অ্যালকোহল ডিহাইড্রোজিনেজ যখন অ্যালকোহলকে পরিপাক করে তখন এরা অ্যালডিহাইড (aldehyde) নামক একটি রাসায়নিক তৈরি করে। অতিমাত্রায় অ্যালডিহাইড আমাদের শরীরের জন্য বিষাক্ত। এশীয়দের এই স্বতন্ত্র জিনটি অন্য ভার্সনটির চেয়ে অ্যালকোহলকে ৪০-১০০ গুণ বেশি মাত্রায় বিষাক্ত অ্যালডিহাইডে পরিণত করে। মূলত এই জিনটি অ্যালকোহলকে অতিদ্রুত মাত্রায় পরিপাক করে। যার বিষাক্ত উপজাত অ্যালডিহাইডকে মানুষের শরীর অতি দ্রুত বের করে দিতে পারে না। ফলে মদ্যপানে অ্যালডিহাইডজনিত বিষক্রিয়া হয় উত্তর-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মধ্যে। সেই কারণেই পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের চেয়ে কম মাত্রায় মদ্যপান করতে পারে জাপানি, চিনা এবং কোরিয়ানরা।
মোদ্দা কথা, মদের মধ্যে যে ইথাইল অ্যালকোহল (ethyl alcohol/ethanol: CH3CH2OH) থাকে তা আমাদের দেহের পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র দ্বারা শোষিত হয়ে পৌঁছে যায় যকৃতে। সেখান থেকে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, পেশী, কলা সহ সারা দেহে । এই প্রক্রিয়াটা খুব দ্রুত ঘটে যায় এবং এটাই দেহে অনেক সময় উত্তেজনা বা সুখানুভূতির জন্ম দেয়। পূর্ণ-পাকস্থলী বা ভরা পেটে মদ গ্রহণে অবশ্য এলকোহল শোষণ হয় অপেক্ষাকৃত ধীরে। সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ার পর দেহের উপর অ্যালকোহলের ক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় প্রতিক্রিয়া। আমাদের দেহে যেহেতু অ্যালকোহল সঞ্চয় করার উপায় নেই, তাই শরীর এই সুরারসকে প্রক্রিয়াজাত করতে এবং কিছুটা শরীর থেকে বিতাড়িত করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। বৃক্ক বা কিডনি আর ফুসফুস মিলে দেহের প্রায় ১০% এলকোকে মূত্র ও প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রস্থান করায়। আর যকৃত বাকি ৯০% বিশ্লেষণ করে তৈরি করে অ্যাসিসিটেট (acetate, CH3CO2−)। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার ফলে মানব শরীর ও মনে বিভিন্ন প্রকারের প্রভাব পড়ে। যেমন -- ঠিকমতো কথা বলতে না পারা বা কথা জড়িয়ে যাওয়া, অকারণে হাসা, অকারণে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলা, খুশি খুশি মেজাজ, ঠিকমতো হাঁটতে না-পারা, বমি করা, মাথা ধরা, অপেক্ষাকৃত বেশি কামাতুর হয়ে পড়া, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া ইত্যাদি।
এখানেই শেষ নয়, মদ্যপান করার পর মানুষ সব অসুন্দরই সুন্দর দেখতে থাকেন। যে মহিলাদের সঙ্গী হিসাবে পছন্দ নয়, তাঁকেও আর ততটা অপছন্দ করেন না। কারণ মদ্যপদের সৌন্দর্যবোধ কিছুটা লুপ্ত হয়। জেগে ওঠে যৌন চেতনা। তখন নাকি কেবল যৌন আবেদন রয়েছে শরীরের এমন অংশই তাঁরা পরখ করেন। তখন সামান্যাই অসামান্যা হয়ে ধরা দেয় পুরুষের কাছে – এমনই বলছেন গবেষকরা। সেই কারণেই বোধহয় পুরুষরা যৌনকর্মীদের কাছে গেলে প্রায় সকলেই মদ্যপান করে থাকেন। এক্ষেত্রে মদ আর নারী যেন সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি আমেরিকার নেবরাস্কা–লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২১ থেকে ২৭ বছর বয়সি কলেজ পড়ুয়া যুবকদের উপর মদের প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে পেয়েছেন এক অভিনব চিত্র। কয়েকজন যুবককে কমলালেবুর রসের সঙ্গে মদ দেওয়া হয়। যতক্ষণ-না তাঁদের নেশা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের মদ্যপান করানো হয় এবং কয়েকজনকে মদের গন্ধ দেওয়া পানীয় দেওয়া হয়, যার মধ্যে নামমাত্রই অ্যালকোহল ছিল। এই যুবকদের কাছে দৃষ্টিযন্ত্রও দেওয়া হয়, যেখানে ধরা থাকবে মহিলাদের শরীরের কোন্ অংশের
উপর দৃষ্টি রাখছেন তাঁরা। এরপরে ৮০ কলেজ ছাত্রীকে পার্টি পোশাকে বিভিন্ন বার বা পার্টিতে পাঠানো হয়, যেখানে যুবকরা গিয়েছেন। পূর্বে অবশ্য ওই যুবকরা সেইসব মহিলাদের দেখে ‘ভাল’, ‘মন্দ’, ‘চলে যাবে’ এ জাতীয় মূল্যায়ন করেছিলেন।
মদ্যপানের পর মহিলাদের সম্পর্কে সেইসব যুবকরা দৃষ্টিভঙ্গির বদল ফেলেছেন। অর্থাৎ যে যুবকরা পূর্বে যাঁকে ‘মন্দ’ বা ‘চলে যাবে’ মূল্যায়ন করেছিলেন, সেই যুবকরাই মদ খাওয়ার পরে তাঁদেরই ‘আকর্ষণীয়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। যা থেকে গবেষক দলের প্রধান সারা গার্ভাইস বলেছেন, মদ্যপান করলে মহিলাকে যৌনপণ্য হিসাবেই দেখেন পুরুষ। তাঁদের সেই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ‘সেক্স রোল’ পত্রিকায়।
মদ্যপানের অপকারিতা : মদ এবং মদ্যপান সামাজিক অনাচার ও অপরাধগুলির অন্যতম নায়ক। মদ্যপায়ী নৈতিকতা ও আচার-ব্যবহারে পৈচাশিক হয়ে ওঠে। ফলে সমাজে পারস্পারিক কলহ-বিবাদ, মারামারি, খুন এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত সংগঠিত হয়ে থাকে। মদ্যপানের মাধ্যমে অনেক বড়ো বড়ো পাপের পথ উন্মুক্ত হয়। এতে মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেচনা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং মন্দ কাজের পথ সুগম করে। মদ্যপানে বহু অপকারিতা ও ক্ষতিকর দিক আছে। যে মদ্যপ্রেমীরা এই মুহূর্তে আমাকে শাপশাপান্ত করে বলছেন, ‘মদ্যপানের বিরুদ্ধে যাঁরা তাঁদের মাথায় পড়ুক বাজ’, তাঁদের জন্য বিনম্র নিবেদনে ক্ষতিকর দিকগুলি একটু দেখা যাক -- (১) মদ্যপান মানুষের শরীরকে ধ্বংস করে দেয়, মদ্যপায়ী দিনে দিনে শুকিয়ে যেতে থাকে, শরীরে নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। (২) মদ্যপানের কারণে মানুষের চিন্তাশক্তি লোপ পায়, তার স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা হারিয়ে যায়। (৩) মদ্যপান মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও শত্রুতা সৃষ্টির কারণ হিসাবে দেখা দেয় এবং এরই জের ধরে মানবসমাজে ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসে। (৪) মদ্যপানের কারণে মানুষ তাঁর নিজের দায়িত্বের ব্যপারে উদাসীন হয়ে যায়, সেই কারণে পরিবার ও সমাজজীবনের ভারসাম্য হারিয়ে যায়। (৫) মদ্যপান করে মানুষ যখন মাতাল অবস্থায় থাকে, তখন সে তার নিজের গোপন কথা বা দুর্বলতার কথা অনায়াসে বলে দেয় সকলকে। সুতরাং তার নিজস্ব বলতে আর কিছু থাকে না। (৬) মদ্যপানে মানুষকে পুতুলে পরিণত করে, তাঁকে দেখলে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ ঘৃণা ও উপহাস করে। কারণ তার চালচলন সবসময়ই অস্বাভাবিক থাকে। (৭) মদ মানুষকে সমস্ত খারাপ কাজের প্রতি উৎসাহিত করে, এটি ব্যভিচার ও নরহত্যার অন্যতম কারণ। মদ সমস্ত মন্দ কাজ ও অশ্লীলতার জন্য দায়ী। (৮) মদের আর্থিক ক্ষতিও অপরিসীম। মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, মদ খেলে মানসিক ও শারীরিক শিথিলতার কারণে যৌন আনন্দলাভের ক্ষমতা হ্রাস পায়। দীর্ঘদিন অ্যালকোহল ব্যবহারের ফলে যা হতে পারে -- বিস্মৃতি, মানসিক অবসাদ, অল্পে বিরক্তি বা মেজাজ হারানো, হাইপারটেনশন, গর্ভপাত, ক্যানসারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি, ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ে, লিভারের ক্ষতি হয়, মস্তিষ্কের টিসু ক্ষয়, হার্টের পেশি দুর্বল হয়ে অ্যারিথমিয়া ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। হজমের সমস্যা, স্বাভাবিক কামক্রিয়ায় বাধা, বয়সের তুলনায় বৃদ্ধ লাগে, বুদ্ধিবৃত্তিগত ক্রিয়া কমে যায়। উপরোক্ত জৈব পরিবর্তনের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অ্যালকোহলের ক্রিয়া যথেষ্ট ক্ষতিকর। ভারতে ঘরোয়া হিংসা এবং পথ দুর্ঘটনার বেশিরভাগই ঘটে থাকে মাত্রাছাড়া অ্যালকোহল গ্রহণের কারণে।
গবেষকরা আগে বলতেন এক বা দুই পেগ মদ খেলে রক্তচাপ বাড়ে না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় না হৃৎপিণ্ড৷ কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিমিত পরিমাণে মদ্যপান করলেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ যাঁরা অল্প পরিমাণে মদ্যপান করেন, তাদের তুলনায় যাঁরা একেবারেই মদ খান না, তাদের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যায় এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও কম থাকে তাঁদের৷ ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের ওই প্রতিবেদনে গবেষকরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষের উপর গবেষণা করেছেন৷ মদ্যপানের মাত্রা এবং মানবদেহের উপর প্রভাব দেখা হয়েছে গবেষণায়৷ বিশেষ করে এডিএইচওয়ানবি জিনের উপর মদের প্রভাব দেখার চেষ্টা করেছেন৷ গবেষণায় দেখা গেছে যাঁরা অল্প মদ্যপান করেন তাঁদের তুলনায় যাঁরা মদ্যপান করেন না, তাঁদের হৃদরোগের সম্ভাবনা ১০ ভাগ কমে যায়৷ মদ্যপানে হৃৎপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণের প্রক্রিয়া অনিয়মিত হয়ে পরে বলে পূর্বে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা৷ নিয়মিত পান করলে এই অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে৷ গবেষকরা বলেছিলেন, হৃৎপিণ্ডে কোলেস্টোরল জমে যাওয়া থেকে মুক্ত থাকতে হলে সপ্তাহে এক বা দু-বার মদপান করে যেতে পারে৷ বয়স, শরীরের ওজন ও ধূমপানের অভ্যাসের ভিন্নতা থাকার পরেও মদ্যপানের ফলে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রায় ১৪ শতাংশ৷
ঘরে-বাইরে, অফিসের কাজে মাথায় হাজার চাপ। আর নিতে পারছেন না। ভাবছেন একটু মদ্যপান করলে কয়েক ঘণ্টা জমিয়ে ঘুম দিয়ে নিতে পারবেন। মদ্যপান করে ঘুমানোর ফলটা কী হয়, সেটা কি জানেন ? জেনে দেখুন তো, পছন্দ হয় কি না ! (১) প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করলে আপনার গভীর ঘুম হবে না। যাকে আমরা বলি ‘ডিপ স্লিপ’। (২) মদ্যপানের ফলে বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন। রক্তসঞ্চালন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। (৩) দেখলেন হয়তো ঘুম থেকে উঠে আর কাউকে চিনতে পারছেন না। আপনার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে ! (৪) ঘন ঘন ঘামবেন, আর ভ্যাসোপ্রেসিন হরমোনের ফলে স্বাভাবিকের থেকে বেশি মূত্রত্যাগ হতে পারে আপনার। (৫) নাসিকা গর্জন অত্যন্ত বেড়ে যাবে। যার ফলে স্ত্রী বা পার্টনারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। (৬) সবসময় ঘুম ঘুমভাবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন আপনি। অথচ ঘুমাতে পারবেন না। হিসাব মতো ভারতে ৩০ শতাংশ পুরুষ ও ৫ শতাংশ মহিলা নিয়মিত মদ্যপান করে থাকে। অধিকাংশ কমবয়সি, যাঁরা কৌতূহলবশত বা নানাবিধ চাপে পড়ে মদ্যপান শুরু করে, তাঁরা পরবর্তীকালে এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ১৯৮০-র দশকে ভারতে প্রথম অ্যালকোহলের স্বাদ গ্রহণের বয়স ছিল গড়ে ২৮ বছর। বর্তমানে গড় বয়স দাঁড়িয়েছে ১৭ বছর। অ্যালকোহলে আসক্তি মস্তিষ্ক ও শরীরের ক্ষেত্রে নিয়মিত বেড়ে ওঠা এক ধরনের অসুস্থতা, যা আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রেও বিশেষ প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু (WHO)-এর হিসাবমতো মদ্যপদের মধ্যে পান করার জন্য গুরুতর অজুহাত গড়ে ওঠে। যাঁরা মদ্যপান করে না, তাঁদের তুলনায় একজন নিয়মিত মদ্যপায়ী তিন গুণ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ শারীরিক সমস্যায় ভুগে থাকে। ভারতে প্রতি পাঁচজনের একজন অ্যালকোহল গ্রহণের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালে ভর্তি প্রতি পাঁচজনের একজন ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরির শিকার এবং দুই-তৃতীয়াংশ অন্যান্য আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি অ্যালকোহল আসক্ত। অ্যালকোহল ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা অন্যদের তুলনায় বেশি হিংসামূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষত তাদের সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে। হিংসার চরিত্র নানা প্রকার হয়, যেমন শারীরিক, কামবাসনা সংক্রান্ত, আবেগজনিত বা অর্থনৈতিক।মাত্রাছাড়া মদ্যপান মদ্যপায়ীর মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে এলোমেলো করে দিয়ে অস্বাভাবিক কামতাড়িত বা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে। দীর্ঘদিনের বিঞ্জ ড্রিঙ্ককিং বা অতিরিক্ত মদ্যপান ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ফলে উদ্বেগ, অবসাদ ও মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হয়।
অ্যালকোহল অ্যাডিকশন বা মাদকাসক্তি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ? : যে ব্যক্তি মদ্যপানের মাত্রা আয়ত্তে রাখতে পারে না, বিশেষত একবার শুরু করলে আর থামতেই পারে না, তাকেই অ্যালকোহলের শিকার বলা হয়। একাধিক পরীক্ষার সাহায্যে কোনও ব্যক্তি মদ্যাসক্ত কি না তা জানা যায়। কয়েকটা যে কেউ নিজে থেকে করতে পারে, বাকিগুলি কোনও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে করা উচিত। নিজেকে পরীক্ষা করার সহজতম পদ্ধতি কেজ (সিএজিই) টেস্ট। এটি চারটি প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে তৈরি -- (১) কখনও কি মনে হয়েছে, মদ্যপানের মাত্রা কমানো দরকার ? (২) যখন কেউ কোনো মদ্যপের সমালোচনা করে, তখন মদ্যপ ব্যক্তি কি উত্তেজিত বা অত্যন্ত বিরক্ত হয় ? (৩) কখনও কি নিজের মদ্যপ্রীতি নিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হয় বা বিষয়টি খারাপ লাগে ? (৪) সকালে ঘুম ভেঙে এক পেগ মদ বা অ্যালকোহল না-খেলে কি নার্ভ চাঙা হয় না বা আড়ষ্টতা কাটে না ?
উপরের প্রশ্নগুলির দুটি বা তার বেশির উত্তর যদি 'হ্যাঁ' হয়, তা হলে সেই মদ্যপ ব্যক্তিকে আসক্ত বলে চিহ্নিত করে পেশাদারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। অডিট টেস্টের মাধ্যমেও অ্যালকোহলিক সমস্যার সমাধান হতে পারে। অ্যালকোহল অ্যাডিকশন কাটিয়ে ওঠার প্রথম শর্তই হল, আসক্তিকে একটা নির্দিষ্ট সমস্যা হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া। এই বিষয়ে কোনো বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। ডাক্তার আসক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি বিশদে বুঝে নিতে পারবেন। সেই সঙ্গে সমস্যার গভীরতা আন্দাজ করতেও সক্ষম হবেন। ডাক্তার মনে করলে মদ্যপের বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। আসক্তির মাত্রার বিষয়ে এই সমস্তই তাঁকে সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা করায় সহায়তা দেবে। মদের আসক্তিতে চিকিৎসায় মূলত দুটি লক্ষ্য থাকে -- প্রথমত, আসক্ত ব্যক্তির জীবনযাপনে অ্যালকোহলের ব্যবহার বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, ওই মানুষটিকে বিশেষ সহায়তা দিয়ে পরবর্তী দিনগুলি অ্যালকোহল ছাড়া কাটাতে সাহায্য করা। চিকিৎসা শুরু হয় ডিটক্সিফিকেশন পদ্ধতিতে। যার মেয়াদ এক সপ্তাহ বা তার বেশি হতে পারে। একসময় রোগী অবশ্যই মদ্যপান বন্ধ রাখবেন। ফলে উইড্রয়াল সিম্পটমের সম্ভাবনা থাকে। যে কারণে ওষুধ দেওয়া হয়। এই সময়ে আসক্ত ব্যক্তি শারীরিক দিক থেকে আসক্তি কাটিয়ে উঠতে থাকে। যখন রোগীকে ক্রমশ আসক্তির চরিত্র ও ক্ষতিকর দিকগুলি সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা হয়। সেই সঙ্গে সুস্থ হয়ে ওঠার বিষয়টিও বোঝানো যায়। সেই সময়ে কাউন্সেলর বা মনোচিকিৎসক রোগীর আবেগের বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেন, যেগুলি থেকে মদের প্রতি আসক্তি গড়ে উঠেছিল। এইভাবেই চিকিৎসা চলে। রোগীকে আসক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নেশার কুফল বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে হয়। সম্মিলিত থেরাপির সাহায্যে রোগীদের কাছে নিজেদের অসুবিধাগুলি আলোচনা করে সারিয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়। কী ধরনের মানসিক অবস্থায় পড়ে তাঁরা আসক্ত হয়েছিলেন তা আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতায় অ্যালকোহল বিরোধী লড়াইয়ের মানসিকতা গড়ে ওঠে এবং আগেকার ব্যবহার পরিবর্তনে একাধিক মানুষ সচেষ্ট হয়। এই পর্বের শেষে রোগী নতুন করে নেশার কবলে পড়ার লক্ষণগুলি নিজেই চিহ্নিত করতে পারে এবং অস্বাভাবিকতা কাটানোর ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে সচেতন হয়ে ওঠে, যা একটা শিক্ষা পর্ব। এতে রোগীর পরিবার ও বন্ধুরাও সমস্যাটির বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষা লাভ করে এবং গ্রুপ মিটিংয়ের মাধ্যমে সাহায্যকারী হিসাবে নিজেদের ভূমিকা ও গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হয়। চিকিৎসার তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্বে রয়েছে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য তার গতিবিধির বিষয়ে সজাগ থাকা। রোগীকেও অন্যান্য রোগীদের সহায়তার জন্য নিয়মিত গ্রুপ মিটিংয়ে যোগ দেওয়াকে কর্তব্য হিসাবে জানতে হবে। প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করতে পারেন -- গুরুরাজ জি, প্রতিমা মুর্তি, সিরিজ এন এবং বেঙ্গল ভি -অ্যালকোহল রিলেটেড হার্ম - ইমপ্লিমেশন্স ফর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড পলিসি ইন ইন্ডিয়া, পাবলিকেশন নং-৭৩, নিমহানস, ব্যাঙ্গালোর, ভারত ২০১১।
================================
তথ্যসূত্র :
(১) http://zhidao.baidu.com/question/3839501.html
(২) http://matadornetwork.com/nights/how-to-say-cheers-in-50-languages/
(৩) http://en.wikipedia.org/wiki/Prohibition
(৪) http://icb.oxfordjournals.org/content/44/4/315.full
(৫) http://news.sciencemag.org/biology/2014/12/ability-consume-alcohol-may-have-shaped-primate-evolution
(৬) http://www.livescience.com/48958-human-origins-alcohol-consumption.html
(৭) http://en.wikipedia.org/wiki/Alcohol_flush_reaction
(৮) http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_countries_with_alcohol_prohibition
(৮) http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_countries_with_alcohol_prohibition
(৯) http://wineintro.com/basics/health/chemistry.html
(১০) http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_wine
(১০) http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_wine
(১২) http://www.drinkingandyou.com/site/uk/health/male%20body.htm
এই লেখকের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করতে পারি?
উত্তরমুছুন