মঞ্জিল
এটা কী খাচ্ছিস রে ইন্দ্র?ধোঁয়াটা যেন কেমন! বাবা যখন বিড়ি খায় তখন এমন হয় নাতো।মাথাটা ঝিমঝিম করছে রে।পলু আমার পিঠে চড় মেরে বলেছিল - ওরে পাগল এটা বিদেশী বিড়ি।আমার চারবন্ধু হেসে উঠেছিল একসাথে। আমিও ওদের সাথে ক্লাস এইটে পড়ি তখন।কিন্তু মনে হতো ওরা অনেক বড়ো। সেদিন ওইভাবে হেসে ওঠাটা অপমানে লেগেছিল।ওরা যে রাস্তা দিয়ে স্টেশান থেকে এই মাঠের দিকে এসেছিল,আমি রাগের মাথায় হাঁটা লাগিয়েছিলাম তার উল্টো পথে।ওরা কেউ ডাকেওনি,অদ্ভুত!তো সেই অচেনা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার একটা নেশার ঘোর তৈরি হয়েছিল,আমি নিজেকে বোধহয় আবিষ্কার করেছিলাম নতুনভাবে। আমার নেশার জগৎ।অচেনা রাস্তা।যা আমাকে কখনই বাড়ির দিকে নিয়ে যাবে না।আমি আরও পিছিয়ে পড়বো ওদের থেকে তবু রোজ আবিষ্কার করে চলবো নিজেকে,নতুন জগতের আলোয়।
সেদিন আমি ঢুকে পড়েছিলাম এক আশ্চর্য আশ্রমে।সেখানে বিশাল বাগান আর বাগান জুড়ে বিশাল সব পাথরের স্ট্যাচু। আমি হাত দিয়েছিলাম ওদের গায়ে।ভেজা,অথচ জল নেই কোথাও।বাগানের মালি কোথা থেকে এসে শক্ত করে আমার কান চেপে ধরেছিল।বলেছিল,বেরিয়ে যা হতভাগা,দেখছিস না ওরা কাঁদছে।আরও বলেছিল আমাদের স্বভাবটাই নাকি এমন কেউ কাঁদলে তাকে বেশি করে খোঁচাই।বেরিয়ে এসেছিলাম ভয়ে।কিন্তু মাথায় চেপে বসেছিল অচেনা রাস্তায় হাঁটার নেশা।
এরপর একদিন আবার...পিসির বাড়ি যাচ্ছি,রাস্তায় জ্যাম।লম্বা লাইন দিয়ে বাসগুলো দাঁড়িয়ে আছে।নেমে এগিয়ে দেখি ওমা,একদল ধর্মঘটী শ্রমিক রাস্তা অবরোধ করেছে।সোজা গেলে পিসির বাড়ি,বাঁদিকে ছিল কারখানা।আমি ডানদিকের অচেনা রাস্তাটা ধরলাম। ওখানে দেখলাম রাস্তার মাঝে বড়ো বড়ো আয়না বসানো।প্রত্যেকটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন লালপেড়ে শাড়ি পরা ভদ্রমহিলারা।আয়নার দিকে মুখ বাড়িয়ে মাথায় সিঁদুর পরছেন সবাই।একটা বাচ্চা ছেলে হঠাৎ এসে আমার হাত ধরলো।আর বলে উঠলো, বাবা গেছেন কারখানায়।ঝামেলা চলছো তো জানেন না।সেদিন আমার গোটা শরীর ভিজে উঠেছিল। ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম।কিন্তু নেশাটা আরও চেপে বসলো মাথায়।
একবার ঝলমলে এক উৎসবের দিনে সব আত্মীয়রা এসে হাজির।মাছের বাজারে গেলাম।অসম্ভব ভীড়।আমি দেখলাম এগিয়ে লাভ নেই।মাছের বাজারের গায়েই একটা গলি।সেই অচেনা পথ।হাঁটা লাগালাম।দেখলাম বড়ো বড়ো বাক্সে বরফ চাপা দেওয়া মাছ।মাছগুলোর মুখ হাঁ করা,আর মুখে কড়ে আঙুল।মানুষের।বৃদ্ধ, জোয়ান, শিশু।সবধরনের কড়ে আঙুল।দু একটা হাতে তুলে নেড়েচেড়ে দেখলাম।বরফের থেকেও ঠাণ্ডা।এতো আঙুল এলো কোথা থেকে।গোটা শরীর বরফের মতো জমে উঠেছিল সেদিন।এরপর তিনটে মাস ভালো করে খেতেও পারিনি,ঘুমোতেও পারিনি।তবু নেশার ঘোর বারবার টেনে নিয়ে গেছে অচেনা রাস্তায়।
অফিস না গিয়ে মর্গে চলে গেছি।শ্মশানবন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঢুকে গেছি সেলুন পাড়ায়।যেখানে ইঁটের ওপর বসিয়ে মহিলাদের নেড়া করা হচ্ছিল।কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই চুল কাটায় উৎসাহ দিচ্ছিলেন গ্রামের প্রধান।
এরপর অচেনা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কেটে গেল কতগুলো বছর। কেরিয়ার, শরীর, প্রেম সব গেল।তবু নেশা ছাড়লাম না।
আজ যে কী হল।হঠাৎ নারীশরীরের জন্য পাগল হয়ে উঠলো মন। ইন্দ্র ঠিকানা দিল। সেই বাড়িতে ঢোকার আগে পাশের রাস্তায় নজর পড়ে গেল।নেশা চেপে বসলো মাথায়।হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম এক অন্ধকার মাঠে।এতো সেই মাঠ।সেই ক্লাস এইট।ইন্দ্র,পলু,নিলয় আর মনোজ গাঁজা খাচ্ছে।কিন্তু মাঠে এতোগুলো তাঁবু কেন?একটা একটা করে পর্দা সরিয়ে দেখতে লাগলাম।সবাইতো আমার এলাকার।অথচ কেউ চিনতে পারছে না আমায়।হঠাৎ একটা তাঁবু দেখি চুপচাপ বসে আছে আমার বোন।আমার মা, আমাদের বাড়ির তিনটে আধার কার্ড পুড়িয়ে ভাত রান্না করছে।আজ কি নেশাটা বেশি হয়ে গেল?মাথাটা ঘুরছে,চোখ বুজে আসছে।মায়ের পাশেই শুয়ে পড়লাম।শুনতে পেলাম আমার বোন বলছে,দাদাভাই আমাদের দেশ কোথায়?
সুচিন্তিত মতামত দিন