প্রজাপতি উড়ে গেলে
আজ ঘন্টা তিনেক কাট মারতেই হবে। কিন্তু ছিলিম কোন উপায়ই দেখছে না। তিলকবাবু সক্কাল থেকে আজ যেন একটু বেশিই গোমড়া। ছিলিম কাট মারবে, লোকটা বোধয় আগেই ঠাহর করতে পারে। আজ ছাড় না পেলে ছিলিম মা-মাটি এক করে দেবে। পালিয়ে যাবে, কাল ফিরে এসে আবার নাহয় পা ধরবে। সুদেবের ‘স্ক্যান্ডাল-টু’ লেগেছে বিচিত্রা হলে। প্রায় তিন হপ্তা কাবার। কাল শুক্কুরবার, নির্ঘাত দেবে পাল্টে। ছিলিম চিন্তায় সারারাত ঘুমোয়নি। সকালে সব্বাই ওঠার আগেই, দোকান ঝাঁটপাট দিয়ে, টেবিল চেয়ার মুছে ঝাঁ তকতক করে দিয়েছে। কাস্টমার এলেই সবার আগে ছিলিমই দৌড়চ্ছে।
কাত্তিকদা, দু নম্বরে দুটো ডিম টোস্ট -
ছিলিম কিচেনে খবর দিয়েই ছুটল
ওয়ে পালাচ্ছিস যে? কি কেস আজ?
কার্তিকও ছাড়বার পাত্তর নয়। ছিলিম মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়াল একটু
কি রে বল? নয়তো দেব কিন্তু পাছায় গরম খুন্তি
মানে বিচিত্তায়
কি? আব্বার সিনেমা? শালা নেশা দেখো মালটার? পাক্কা মাতাল
হ্যাঁ, এইটুকুই নেশা। সুদেব-ফারুক, হিন্দি-বাংলা যায় আসুক না কেন ছিলিম লোভ সামলাতে পারে না। এরজন্যে মাতাল বলবে? ওদিকে তিলকবাবু সন্ধে হলেই যে কিচেনের পেছনে গিয়ে ঢুকুঢুকু। আর কাত্তিকের পোএর মুখে অত বুলি, সেও তো তিলকবাবু ক্যাশে বসলেই দুঢাকা চুরি করে মারে। ‘আমি মাতাল হলে তুই চোর শালা’ ছিলিম স্বগতোক্তি করে। চা, ডিমটোস্ট, রোল, চাউমিনের চালু দোকান। ভালই ভিড় থাকে ‘শানু টিফিন সেন্টার’এ। ছেলের নামে দোকান তিলকবাবুর। ছিলিম, কার্তিককে নিয়ে গোটা ছ’য়েক জোয়ান খাটে। মাঝে মাঝে এতেও কুলোয় না।
ছিলিম, আট নম্বর টেবিল মোছ!
তিলকবাবুর ষাঁড়ের মত গর্জনে টনক নড়ল ছিলিমের।
আজ পাঁচটায় একটু যাব? সাড়ে আটটায় ঢুকে যাব
টেবিল মুছে অনেক সাহস সঞ্চয় করে আর্জি পেশ করল ছিলিম।
আবার কোতায়? বলিচি না সন্দেবেলা কেউ কোত্থাও যাবে না।
তিলকবাবু নাকচ করে দিলেন।
আমি যাই কই? টিংগু, বিলা তো প্রতি হপ্তায় যায়। আজকেই শুধু
উউউউহ আজগেই শুদু, পতি মাসেই লাগে তোর, যাবি কোতায় শুনি, বই দেখতে যাবি বললে চাম গুটিয়ে দেব। উনি ফারুক খান হবেন!
ছিলিম নখ খাওয়ার বদলে গোটা আঙুলগুলোই মুখে পুড়ে দিল।
কাল শুক্কুরবার, পাল্টে যাবে বই, সুদেবদার বই
কে দা? দাদা? কবে থেকে র্যা? ওরে কে আছিস, দেকে যা সুদেবের ভাই দোকান করছে
অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল তিলকবাবু। ছিলিম দাঁত কিড়মিড় করছে। ওর সব হিরোদেরই খুব আপনার মনে হয়। আর হিরোইনদের- থাক। তাই বলে এত গঞ্জনা কিসের? দেবো একদিন বলে বৌটাকে, ঢুকুঢুকুর কথা। ধুইয়ে দিয়ে যাবে। যেদিন বেশি পেটে পড়ে সেদিন ভয়ে আর বাড়িই ফেরে না। ক্যাশের চৌকিতেই টানা দেয়।
ওরা যেটা বই বা সিনেমা বলছে সেটা তো আসলে রঙিন বাড়ি। ছিলিম হলে গেলেই ঐ বাড়িতে ঢুকে যায়। ওর মধ্যে কখনো সুদেব, কখনো ফারুক কিম্বা জামির এর আত্মা ঢুকে পড়ে। ও পরিস্কার দেখতে পায় ওর মাথার ওপর লাল নীল-হলুদ-সবুজ আকাশ। ও টের পায় ওর চোখেমুখে সুধাশ্রী বা আঁচলের গেরুয়া ওড়না দোল খাচ্ছে। এই তিনঘন্টা পুরোপুরিই ওর একার। একার বলতে তো এইটুকুই। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বেঞ্চে শুয়ে আকাশের তারা গুণতে গুণতে কখনো ঝাঁপ দেয় পাহাড় থেকে, ঝুলতে থাকে হেলিকপ্টার বেয়ে। ওর হাত ধরে থাকে ওর হিরোইন, শক্ত করে ধরে থাকে ছিলিম। ছাড়লেই ওকেও ছেড়ে দিতে হবে দুনিয়া। ছিলিমের যা যা খাওয়া, পরা, ঘোরার শখ সব তো ঐ বাড়িতেই গচ্ছিত আছে। এই আকাটের দল এসব বুঝলে তো? নেশা? নেশার তোরা জানিসই কি? নেশা জানত ছিলিমের বাবা লক্ষণ। রাত হলেই বেরিয়ে পড়ত ঘর ছেড়ে। আবার ভোররাতে ঢুকে যেত ঠিক। ছিলিমের মা তো ছিলিমকে জন্ম দিয়েই টিকিট কেটেছিল। একদিন ছিলিমও পিছু নিল লক্ষণের । লক্ষণ জানলা খোঁজে। খোলা জানলা। পেলেই দাঁড়িয়ে পড়ে আর মন ভরে ব্লু ফিল্মের শুটিং দেখে বাড়ি বাড়ি। ছিলিম এক ছুটতে বাড়ি ফিরে আসে। বালিশ জড়িয়ে খুব কাঁদে। খানিক পর চোখ যখন লেগে আসছিল চেঁচামেচি শুনে বাইরে এসে দেখে লক্ষণ ধরা পড়ে গণপিটুনি খেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। একেই বলে নেশা, নেশার জন্য প্রাণ দিল বাপটা। বছর কুড়ির ছিলিম অমন তো কিছুই পারল না।
ওকে ছেড়ে দিন কাকু, আমরা সামলে নেব, মালটা নয়তো ভেগেই যাবে।
কার্তিক চোখ নাচিয়ে বলে গেল। তিলকবাবু নিমরাজি হলেন, গজর গজর করতে করতে বাড়ি গেল দুপুরের চাট্টি গিলতে। ফাঁক পেয়ে কার্তিক চেপে ধরল ছিলিমকে।
চাঁদু এমনি এমনি নয় বুঝলে? এক’শো ছাড়। শিউলিকে একটা ব্রা দেব বলেছি। সেদিন ছিঁড়ে গেল শালা টানাটানিতে।
কেউ কম যায় না। শিউলি সামনের একচালা দোকানে সব্জী বেঁচে। তাকেও টানাটানি করে আসে কার্তিক। তাই ব্যাটাকে রাতে হাল্কা হওয়ার জন্য উঠলে মাঝে মাঝে বেঞ্চে পায় না ছিলিম। নেশা শেখাচ্ছে ছিলিমকে। দুবেলা দুটো ভাত, রাতের শোয়া দিয়ে প্রতি মাসে কুঁতিয়ে পাঁচ’শো দেয় তিলকবাবু। বই দেখার জন্য এমনিই বেরিয়ে যায় ছিলিমের। তারমধ্যে আবার এক’শো ওকে। কিন্তু এখন উপায় নেই।
ছিলিম সাইকেলের মতো পায়ে প্যাডেল করতে করতে নামছে ঝরনা বেয়ে। সবুজ উপত্যকায় আকাশি রঙের প্রজাপতির গাউন পরে শুয়ে আছে সুধাশ্রী। ছিলিম সেখানে পৌঁছাতেই প্রজাপতিগুলো একে একে উড়ে যাচ্ছে। কোনটা ছুঁয়ে যাচ্ছে ছিলিমের কাঁধ, হাত। টুং টাং শব্দে ছিলিম চমকে উঠছে।
অ্যাই গায়ে পা দিচ্ছ কেন?
প্যাডেল করতে গিয়ে ছিলিমের খেয়ালই নেই সামনের লোকের ঘাড়ে পা তুলে দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা চেনা ঠেকছে। শানুদা না?
হল ভাঙল আটটায়। ছিলিম বেরিয়ে শানুকে খুঁজল। সাইকেল নিয়ে পাঁই পাঁই করে দৌড়চ্ছে শানু। একটু পর একটা পুলিশের ভ্যানও বেরল। হলে ঢোকার আগে ভ্যানটা এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। ছিলিম টিংকুর সাইকেল নিয়ে ধাওয়া করল। হঠাৎ নিজেকে ফারুক খান মনে হল। পা চালাল জোরে। সোজা রাস্তায় না গিয়ে ভেতরের অলিগলি দিয়ে পেয়ে গেল শানুকে। শানুও গলিই ধরেছিল। ভ্যান তখনও রাস্তায়।
কি হল শানুদা?
আস্তে চুপ
আরে পালাচ্ছ কেন? পুলিশ?
ফারুক খানের স্টাইলেই জানতে চাইছে ছিলিম।
খবর পেয়ে গেছে আমার কাছে মাল আছে।
পকেট থেকে একটা সাদা পাউডারের প্যাকেট বের করল শানু। ফারুক খান ভয়ার্ত এক্সপ্রেশন দিল। আশপাশ ভাল করে দেখে নিয়ে শানুর জামা প্যান্ট নিজে পরে নিল, নিজেরটা দিল শানুকে। সাইকেলটাও বদলে নিল। পকেটে প্যাকেট পুড়ে ‘আলবিদা’ বলে এগিয়ে গেল ছিলিম বড় রাস্তায়।
তিলকবাবু গরাদের পেছনের ছিলিমের হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন।
আমার শানুর জন্য এত করলি? আমি নেতা ধরেছি, মিনিস্টার অব্দি যাব, তোকে বের করবই, ভাবিস না।
কাকু সামনের মাসে ফারুক-আঁচলের বই লাগবে, তার আগে যদি হয়-
উলঙ্গ হয়ে গায়ে হেরোইন পাউডার মেখে রাস্তায় পাগলের প্রচুর আক্টিং করেছিল ছিলিম। কিন্তু এক অফিসার এসে গা থেকে পাউডার নিয়ে চেখেই ছিলিমকে কেলাতে শুরু করল। এরপরই ঘরবদল।
খারাপ লাগে না ছিলিমের। এই সবই তো ঐ রঙিন বাড়ি থেকে শিখেছে ছিলিম। এরকম ভাবেই তো সুদেব, জামিররা আজ এত বড় হিরো। কত লোকে দেখতে যায় ওদের। ভাগ্যি এমন এক নেশা ছিল। অত লোক না হলেও তিলকবাবুর কাছে তো ছিলিম হিরো।
রঙচটা সিলিংএর দিকে তাকিয়ে প্রজাপতির পরের সিনে ভাসল ছিলিম।
-সমাপ্ত-
সুচিন্তিত মতামত দিন