শিবানী শর্মা - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

শিবানী শর্মা


অথঃ 'মন্দোদরী’ কথা

       








পঞ্চকন্যা’ হিন্দু মহাকাব্যের প্রবাদপ্রতিম প্রধান পাঁচটি নারী চরিত্র। যাঁদের প্রশংসাসূচক স্তবগান ও নাম পঠনে সকল পাপ দূর হবে বলেই বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। সংস্কৃত স্তব-স্তুতিতে পঞ্চকন্যার বিষয়ে বলা হয়েছেঃ
अहल्या द्रौपदी कुन्ती तारा मन्दोदरी तथा ।
पञ्चकन्याः स्मरेन्नित्यं महापातकनाशिनीः ॥
পুরাণে পূজনীয় পঞ্চকন্যার এক কন্যা ‘মন্দোদরী । রামায়ণ থেকে অহল্যা, তারা ও মন্দোদরী এবং মহাভারত থেকে দ্রৌপদী ও কুন্তীকে নেয়া হয়েছে। বঙ্গানুবাদে কুন্তীর বদলে সীতাকে বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও মন্দোদরীর স্থান প্রত্যেক উল্লেখেই আছে।
মন্দোদরী পৌরাণিক ‘পঞ্চকন্যা’ ও ‘পঞ্চসতী’র একজন হলেও রামায়ণে কিন্তু মন্দোদরীর ভূমিকা খুবই সংক্ষিপ্ত। অন্যান্যদের তুলনায় মন্দোদরীর জীবনের বর্ণনাও খুব কম। হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ অনুসারে মন্দোদরী ছিলেন লঙ্কার রাক্ষস রাজা রাবণের রাজমহিষী। তাঁকে রাজা রাবণের শুধুই এক ধর্মপ্রাণা ও নীতি পরায়ণা পত্নী বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে মন্দোদরীর বৈশিষ্ট্য কি, যে কারণে পূজনীয়া পঞ্চকন্যার অন্যতমা বলে তাঁর নাম উল্লিখিত হয়েছে? আসুন সেই বৈশিষ্ট্যগুলির অনুসন্ধান করি এবং মন্দোদরী সম্পর্কে আরও কিছু নতুন তথ্য জানি।
পালিতা কন্যা মন্দোদরী
উত্তর রামায়ণ গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে ঋষি কশ্যপের পুত্র ময়াসুর হেমা নামে এক অপ্সরাকে বিবাহ করেন। তাঁদের দুই পুত্র হয় মায়াবী ও দুন্দুভি। কিন্তু তাঁরা অনেক দিন ধরে একটি কন্যাসন্তান প্রাপ্তির ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। তাই তাঁরা শিবের তপস্যা শুরু করেন। এমন সময় মধুরা নামে এক অপ্সরা কৈলাস পর্বতে শিবের পূজা করতে আসেন। পার্বতীর অনুপস্থিতির সুযোগে সে শিবের নিকটে যায়। পরে পার্বতী ফিরে এসে মধুরার গায়ে শিবের গায়ের ছাই দেখতে পান। ক্রুদ্ধ হয়ে পার্বতী মধুরাকে অভিশাপ দেন বারো বছর ব্যাঙ হয়ে থাকতে। শিব মধুরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন যে বারো বছর পরে সে আবার এক সুন্দরী নারীতে পরিণত হবে এবং এক মহাপরাক্রমী বীরের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবে। বারো বছর পর মধুরা পুনরায় এক সুন্দরী নারীতে পরিণত হন। তখন তিনি কুয়োর ভিতর থেকে চিৎকার করতে থাকেন। কাছেই ময়াসুর ও হেমা তপস্যা করছিলেন। তাঁরা তাঁর ডাকে সাড়া দেন এবং তাঁকে পালিতা কন্যা রূপে গ্রহণ করেন ও মন্দোদরী নামে প্রতিপালন করতে থাকেন।
রূপযৌবনশালিনী মন্দোদরী
मुक्ता मणि समायुक्तैर् भूषणैः सुविभूषिताम् |
विभूषयन्तीम् इव च स्व श्रिया भवन उत्तमम् ||
गौरीम् कनक वर्ण आभाम् इष्टाम् अन्तः पुर ईश्वरीम् |
कपिर् मन्द उदरीम् तत्र शयानाम् चारु रूपिणीम् | (সুন্দরকাণ্ড ১০ম সর্গ )
মন্দোদরী আক্ষরিক অর্থে "কোমল উদর বিশিষ্টা"। মন্দোদরী ছিলেন গৌরাঙ্গী ও অতুলনীয় রূপযৌবনশালিনী। রাবণের অন্দরমহলে হনুমান সহস্র নারীর মধ্যে সুসজ্জিতা অপূর্ব সুন্দরী মন্দোদরীকে দেখে সীতা ভেবে আনন্দিত হয়েছিলেন এবং ইনিই সীতা কিনা এই ভ্রমে পড়েছিলেন।
পতিপ্রাণা রাজমহিষী মন্দোদরী
বৈদিক মতে রাবণ মন্দোদরীকে বিবাহ করেন। রাবণের ঔরসে মন্দোদরীর তিনটি পুত্র জন্মায় মেঘনাদ, অতিকায় ও অক্ষয়কুমার। মন্দোদরী ছিলেন পতিপ্রাণা। তিনি পতি গর্বে এত গর্বিত ছিলেন যে, তাঁর পতি যুদ্ধে নিহত তো দূরের কথা, পরাজিতও হতে পারেন একথা ছিল তাঁর কল্পনার অতীত। রাবণের বহু দোষ সত্ত্বেও মন্দোদরী তাঁকে ভালবাসতেন এবং তাঁর পরাক্রমের জন্য গর্ব অনুভব করতেন। নারীর প্রতি রাবণের দুর্বলতাও মন্দোদরী খুব ভালভাবে অবগত ছিলেন। রাবণ যখন মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক দেবগোষ্ঠী নবগ্রহকে পরাভূত করেন, তখন মন্দোদরী তাঁকে বারণ করেছিলেন। তিনি বেদবতীকে ধর্ষণ করতেও বারণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, বেদবতীই জন্মান্তরে সীতা রূপে রাবণের মৃত্যুর কারণ হন।
ধর্মপরায়ণা মন্দোদরী
ধর্মপ্রাণা নারী হিসেবে মন্দোদরী রাবণকে সঠিক পথে নিয়ে আসার নিরন্তর চেষ্টা করতেন কিন্তু রাবণ সর্বদাই তাঁর উপদেশ উপেক্ষা করতেন। রাবণ বিষ্ণুর অবতার তথা অযোধ্যার নির্বাসিত যুবরাজ রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করে আনেন। মন্দোদরী সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলেও, রাবণ তাতে কর্ণপাত করেননি। মন্দোদরী জানতেন, সীতার প্রতি রাবণের আকর্ষণ তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। রাবণ ভয় দেখিয়ে সীতাকে বিবাহে রাজি করাতে চাইছিলেন। কিন্তু সীতা তা করতে অস্বীকার করলে, তিনি তরবারি নিষ্কাসিত করে সীতার মুণ্ডচ্ছেদ করতে যান। মন্দোদরী সেই সময় রাবণকে বাধা দিয়ে সীতার প্রাণ রক্ষা করেন। মন্দোদরী বলেন যে, নারী হত্যা মহাপাপ। তাই সীতাকে হত্যা করা রাবণের শোভা পায় না। মন্দোদরী উপদেশ দেন, রাবণ যেন সীতাকে বিবাহের ইচ্ছা ত্যাগ করে তাঁর অন্যান্য মহিষীদের সম্ভোগ করেন। শান্তিপূর্ণ উপায় সীতা উদ্ধারের আশা না দেখে শেষ পর্যন্ত রাম রাবণের বিরুদ্ধে লঙ্কায় যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন। শেষ যুদ্ধের আগে মন্দোদরী শেষবার রাবণকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মন্দোদরী এক বাধ্য ও বিশ্বস্ত স্ত্রীর মতো রাবণের পাশে এসে দাঁড়ান। যদিও তিনি তাঁর পুত্র মেঘনাদকে রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার উপদেশ দিয়েছিলেন।
শেষ যুদ্ধে রাম রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। সাধারণ বাণে রাম রাবণকে বধ করতে সক্ষম হননি। তাঁকে একটি বিশেষ মৃত্যুবাণের সাহায্য নিতে হয়েছিল। বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে, ইন্দ্র রামকে এই বাণটি দিয়েছিলেন। কিন্তু রামায়ণের অন্যান্য সংস্করণে বলা হয়েছে, বাণটি মন্দোদরীর শয়নকক্ষে তাঁর শয্যার নিচে লুকানো ছিল। মন্দোদরী যখন রাবণের মঙ্গলকামনায় পার্বতীর পূজা করছিলেন, সেই সময় হনুমান ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মন্দোদরীর কাছে আসেন। তিনি মন্দোদরীর বিশ্বাস অর্জন করে সুকৌশলে রাবণের মৃত্যুবাণ কোথায় আছে, তা জেনে নেন। পরে হনুমান বাণটি চুরি করে রামকে দেন। রাম সেই বাণ দিয়ে রাবণ বধ করেন। উক্ত যুদ্ধে মন্দোদরী তাঁর স্বামী, পুত্র ও সকল নিকট আত্মীয়কে হারিয়েছিলেন।
সীতা জননী মন্দোদরী
রামায়ণের কয়েকটি সংস্করণের মতে, সীতা রাবণ ও মন্দোদরীর কন্যা ছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণে মন্দোদরীকে সীতার মা বলে উল্লেখ করা না হলেও, পরবর্তীকালে রচিত রামায়ণের কয়েকটি সংস্করণে মন্দোদরীকে সীতার মা অথবা অন্তত তাঁর জন্মের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অদ্ভুত রামায়ণের বর্ণনা অনুযায়ী রাবণ ঋষিদের হত্যা করে তাঁদের রক্ত একটি বৃহৎ কলসে সঞ্চয় করে রাখতেন। ঋষি গৃৎসমদ দেবী লক্ষ্মীকে কন্যা রূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করছিলেন। তিনি দর্ভ ঘাস থেকে দুগ্ধ সংগ্রহ করে তা মন্ত্রপূত করে একটি পাত্রে সঞ্চয় করছিলেন যাতে লক্ষ্মী সেখানে অবতীর্ণ হতে পারেন। রাবণ এই দুগ্ধ ঋষিরক্তের কলসে ঢেলে দেন। ঋষিরক্তকে বলা হয় সকল বিষের চেয়েও বিষাক্ত। মন্দোদরী রাবণের অপকর্মে মর্মাহত হয়ে তাই এই বিষাক্ত রক্ত পান করে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রক্ত পান করার ফলে গৃৎসমদ সঞ্চিত দুগ্ধের প্রভাবে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। লক্ষ্মী তাঁর গর্ভে প্রবেশ করেন। মন্দোদরী তাঁর কন্যার ভ্রূণটি কুরুক্ষেত্রে মাটির তলায় প্রোথিত করেন। রাজা জনক তা আবিষ্কার করেন এবং কন্যার নাম রাখেন সীতা।
দেবীভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে রাবণ যখন মন্দোদরীকে বিবাহ করতে চান, তখন ময়াসুর রাবণকে সাবধান করে বলেন যে, মন্দোদরীর কোষ্ঠীতে আছে, তাঁর প্রথম সন্তান তাঁর বংশের ধ্বংসের কারণ হবে। তাই এই সন্তানটিকে জন্মমাত্রই হত্যা করতে হবে। ময়াসুরের উপদেশ অগ্রাহ্য করে রাবণ মন্দোদরীর প্রথম সন্তানকে একটি ঝুড়িতে করে জনকের নগরীতে রেখে আসেন। জনক তাঁকে দেখতে পান এবং সীতা রূপে পালন করেন।
বিভীষণ ও মন্দোদরী
বাল্মীকি রামায়ণে মন্দোদরীর বিভীষণকে পতিরূপে গ্রহণ করার উল্লেখ নেই, আছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, রাবণ মাতৃতান্ত্রিক জাতির প্রতিনিধি ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর পর শাসনক্ষমতা পেতে বিভীষণ রাজমহিষীকে বিবাহ করতে বাধ্য হন। অপর একটি মতে রাজমহিষীকে বিবাহ করা সম্ভবত অনার্য সভ্যতার লক্ষণ। মন্দোদরী স্বেচ্ছায় বিভীষণকে পতিরূপে গ্রহণ করেননি। সম্ভবত মন্দোদরী ও বিভীষণের বিবাহ ছিল "রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি প্রসূত"। রাজ্যের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মন্দোদরী বিভীষণকে বিবাহ করতে রাজি হয়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের আদেশে বিভীষণ লঙ্কার সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর মন্দোদরীকে বিবাহ করেন ও শ্রীরামের আদেশ শিরোধার্য করেন বলে ধরা হয়েছে। রামচন্দ্র স্বয়ং বিভীষণের হাতে মন্দোদরীকে সমর্পণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
‘পঞ্চকন্যা’র এক কন্যা মন্দোদরী
মন্দোদরী পঞ্চভূতের মধ্যে জলের প্রতীক। তাঁর উপরিভাগ অশান্ত ও অন্তঃস্থল ছিল আধ্যাত্মিক গভীরতায় পূর্ণ । মন্দোদরীর কাছে ধর্মের পথই ছিল একমাত্র পথ। তাঁকে অত্যন্ত ধার্মিক, সরল, কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী রূপেই চিত্রিত করা হয়েছে । স্বামীর প্রতি তাঁর ভালবাসা ও আনুগত্য বিশেষ গুরুত্বের দাবি রেখেছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে স্বামীর কাজ সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেই স্বামীর প্রতি তাঁর কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। তিনি স্বামীকে জোর করে বাধা দেননি। মন্দোদরী জীবনের অধিকাংশ সময়ই দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন এবং তার জন্য বিবেচিত নির্দেশনামা ও বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করে গেছেন। তাঁর মতামত বারবার প্রত্যাখ্যাত হলেও তিনি নিজে কখনও ধর্মের পথ ত্যাগ করেননি। মন্দোদরীর এই বিশিষ্টতার জন্যই তাঁকে আদর্শ নারী, সতী-সাধ্বী ও পাপখণ্ডনকারিণী ‘পঞ্চকন্যা’র অন্যতম বলা হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র