দেবাশিস মুখোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

               এ ভরা বাদরের ফাল্গুনী 


আমি রবীন্দ্রনাথ হতে চাই না -  হতে চাই না রঘু ডাকাত
আমি ফাল্গুনী রায় হতে চাই- শুধুই ফাল্গুনী রায় ।

প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ফাল্গুনী - ফাল্গুনী রায়। তিনি এইভাবেই সোচ্চার হয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব কবিতার জগতে ।1945 এ জন্ম আর 1981 তে মৃত্যু - মাত্র পঁয়ত্রিশের এইজীবন । এই পৃথিবীর ধূলো , রোদ , বৃষ্টি , বায়ু দূষণময় নিঃশ্বাস গ্রহণ করে বেঁচে ছিলেন , শহীদ নয় , আত্মহনন ছিল তাঁর ইচ্ছা । জেব্রা - ২ প্রথম কবিতা প্রকাশনার কালানুক্রমে, তাঁর কবি জীবন মাত্র ১৩ বছর । এই ১৩বছরে তিনি রেখে গেছেন কিছু কবিতা , চিত্রনাট্য , গল্প
সমালোচনা - যা থেকে বাছাই করে প্রকাশ করা হয়েছিলো -নষ্ট আত্মার টেলিভিশন । বাসুদেব দাশগুপ্তকে ধন্যবাদ এই চটি বইটি না প্রকাশ না করলে ফাল্গুনী রায় এর লেখা সম্পর্কে পাঠক জানতেই পারতেন না।

বিবাহ সভায় বিধবার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি
আমি এক বেকার মাত্র ডালহৌসী পাড়ায়
পয়সার অভাবে বেড়ে গেল চুলদাড়ি
লোকে বল্ল নকল করছি রবি ঠাকুরকে কিন্তু
আমরা রবীন্দ্র সদন বা কোনো ভবনের বদলে
এ বছর রকে বসে পালন করেছি রাত বারোটার রবীন্দ্র জয়ন্তী

আমাদের পেটে ছিল মদ হেঁড়ে গলায় আমাদের
সম্মিলিত গানের চিৎকার শুনে যে সব
বিবাহিতা মহিলারা স্বামীর উরুর তলায় শুয়েছিল
এবং যেসব কুকরী সংগম শেষে ঘুমচ্ছিল কুন্ডলি পাকিয়ে
তারা সব জেগে উঠে আমাদের রকেতে রবীন্দ্রনাথকে
নিয়ে ছেলেখেলার প্রতিবাদে চীৎকার করেছিল যথাক্রমে
মানুষ ও কুকুরের ভাষায় ..... (কবিতা হঠাও - ক্ষুধার্ত ৫ ১৯৭৮)

ফাল্গুনীর সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় ছিল । কিন্তু ইনট্রোভার্ট ধরনের ছিলেন বলে সকলের সঙ্গে সহজ সাবলীলভাবে মেশামেশি করতে পারতেন না। সঙ্গ পরিধি বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । ফাল্গুনীর দাদা তুষার রায় , কবি হিসেবে তখন প্রচারিত , বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে তার ওঠাবসা । ফাল্গুনী ও তুষারের মাঝে চরিত্রগত ব্যবধান ছিল পাতাল - আকাশ । দুজনেই নেশাপ্রিয় , নেশার পর তুষার হয়ে উঠতেন এক্সট্রোভার্ট , ফাল্গুনী নিজের খোলসে সেঁধিয়ে । বিষন্ন , অভিমানী , নীরব , একা , নিঃসঙ্গ ,মৌনগভীর ছিল ফাল্গুনী। নারীর রহস্যময়তা ও ব্যবহারে ফাল্গুনী হয়েছিলেন বিধ্বস্ত । এমন এক কবি যার কবিতা
কেন্দ্র করে আজও লেখালেখির বিরাম নেই । , অথচ অনেকে নামও শোনে নি। কোনো সংকলনে ফাল্গুনির জন্যে একটি পাতাও বরাদ্দ হয় নি।

আমি লিখতে পারছি না লিখতে পারছি না কিছু
লিখতে পারছি না আর চারপাশের কুকুর ও বেশ্যার
চিৎকার হাসাহাসি হিজড়ের উপহাস আমি
পারছি না কিছু লিখতে পারছি না আর

মাথায় প্রখর যন্ত্রণা হলে আমি আজকাল
পিকাসোর কিউবিক ছবি দেখি স্যারিডনের বদলে
এবং সৎসঙ্গের ধ্যান ও বাণী আমার প্রতিভাহীন শান্তির
অনুকূলে নয় জেনে গিয়ে গীতা পড়তে পড়তে
হঠাৎ হস্তমৈথুন সুরু করে এক ধরনের স্বস্তি পাই
(কিছু লিখতে পারছি না আর : ১৯৬৮)

যে কোনো কবি সাহিত্যিক শিল্পী গায়ক চান স্বকীয়তা - তার নিজস্ব মাধ্যমে -ফাল্গুনী ও তাই চেয়েছিল ।মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর এই পৃথিবীর ধূলো, রোদ ,বৃষ্টি,বায়ূ , দূষণময় নিঃশ্বাস গ্রহণ করে বেঁচে ছিল সে ।মৃত্যু ৩১ শে মে ১৯৮১ । আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে তোলপাড় হয়ে যেত বাংলা কবিতা । শহীদ নয়,আত্মহনন ছিল তার অভীপ্সা।জেব্রা ২ এ প্রথম কবিতা প্রকাশনার কালানুক্রমে ,তার কবি জীবন মাত্র ১৩ বছর। এই ১৩ বছরে সে রেখে গেছে কিছু কবিতা, চিত্রনাট্য, গল্প, সমালোচনা ।

স্থানীয় কবিতা লিখিয়ে , গদ্য লিখিয়েরা শুধু যে ফাল্গুনীর লেখা নিয়ে ব্যঙ্গ - বিদ্রুপ করেছেন , তেমন নয়। অনেকেই নানাভাবে তাকে হেনস্থা করেছেন । তবে দীর্ঘকাল অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপর্যস্ত অবস্থায় মানসিকভাবে একটি আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল তার । এই আশ্রয় তার পাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই পর্যায়ে তিনি লিখেছেন 

, ' শেষ পর্যন্ত আমি দেখলুম
যে গঙ্গার জলে আমি করছি পেচ্ছাব সে গঙ্গার / জলেই
সেরে নিচ্ছি স্নান / যে মেয়েটিকে বলেছি বেশ্যা / - তার
ভেতরই খুঁজে পাচ্ছি জায়া ও জননী । ' ফাল্গুনী যখন
কবিতা লিখছেন তখন দানা বাঁধছে হ্যাংরী আন্দোলন ।
পুরনো মূল্যবোধ , ঐতিহ্যের নামে হরেক রকম প্রাতিষ্ঠানিক
শৃঙ্খল এবং অনুশাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষনার সময়
তখন । ডি- ক্লাসড হতে চেয়েছিলেন ফাল্গুনী । অথচ
আশ্রয় পাবার মতো কোনো প্লাটফর্ম খুঁজে পান নি। কবিতা
লেখার সঙ্গে রাজনীতির ভয়ানক বিরোধ আছে , এমনটি
মনে করেন নি তিনি । বরং অনায়াসে পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক
অবস্হা এবং মূল্যবোধের নামে ভন্ডামি ও ব্যভিচারের
নির্মম চিত্রগুলি বারবার উঠে এসেছে কবিতায় । ' বিপ্লবের
গান ' - 
এ ফাল্গুনী লেখেন , ' গণহত্যা ও গণটোকাটুকিতে অংশ নিতে না পারায় আমরা অনেকের কাছে বনে গেছি গান্ডু ' কবিতার তথাকথিত বিশুদ্ধতা রক্ষায় নিয়োজিত কবি প্রাবন্ধিকদের ভ্রূ কুঁচকে উঠেছে । কিন্তু ফাল্গুনীর কবিতায় অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে বাবু সংস্কৃতির বাইরে শ্রমজীবী মানুষ এবং তথাকথিত ' অশিক্ষিত - অমার্জিত ' 'সাধারণের কথ্যভাষা :-
 ' হাজার মাইল চাঁটিল - কে চাঁটি
মেরে আমি লিখি নি কোনো চর্যা নতুন শুধু / মাগীবাজ /
ছেলেদের পোদে লাথি মেরে লিখতে চেয়েছি কিছু কবিতা
যা আমার নিজের / স্বরূপ ।

 ' কবিতার নামে ' কাব্যিক' ন্যাকামি আগাগোড়া বর্জিত হয়েছে তার কবিতা ও গদ্যে।ফাল্গুনীর কোন হাতঘড়ি ছিল না , আংটি ছিল না - সব সে বিক্রি করে দিত অবহেলায় ।তারপর মদ -নেশা । নৈরাজ্য ছিল না ফাল্গুনীর মনে , অভাব ছিল বটে -আর্থিক নিরাপত্তার অভাব ,প্রেমিকার অভাব ,সুবাতাসের অভাব ,সংসার সুখের অভাব ,এসবই ছিল তার, তবে সবকিছু উপেক্ষা করার মতো দুর্দমনীয় আত্মা ছিল তার ,ব্যবহারিক জীবনে জীবিকার জগৎ বলতে কিছুই ছিল না । এইজন্য সে হতে পেরেছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধী ।

কবিতা লেখার জন্য আর কোনো কাগজ পাচ্ছি না আমি
জীবনের ঘটনা দিয়ে তৈরী করেছি নাটকের পাণ্ডুলিপি
ভালো মানুষেরা আমায় ভালো বলছে খারাপ মানুষেরা খারাপ
আমার মাথা আছে কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই কোনো
তাই রমণ-বিহার ছেড়ে ব্যস্ত মানুষেরা পাঠাগারে কিংবা পাইখানায় গেলে
তাদের পরিত্যক্ত আসনে বসে কবিতা লিখছি এখন
                    ( ব্রেনগান )
    সুবিমল বসাক ,সমীর রায় চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী , এরা চেষ্টা করেছেন হাওয়া ৪৯ থেকে ফাল্গুনীর লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশ করতে । তবুও তিনি অধরাই আজকের পাঠকের কাছে।  

কল টিপলেই জল পড়ে এরকম কলকাতা পাওয়া যায় না
সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য
ধোপার বাড়ি পাঠাতে পারলুম না জামাকাপড়
বিদেশী ম্যাগাজিনে প্রেমিকার ছবি ছাপিয়ে
হতে পারলুম না আন্তর্জাতিক ইউনিভার্সিটির ‎
চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে মণিকার যোনির উপযুক্ত হতে পারলুম না
( ক্ষুধার্ত ৭ম, ১৯৮৪)

    ‎               ‎
   ফাল্গুনী চেয়েছিলেন কবিতার মধ্যে বেঁচে থাকতে । জীবিত কালে অনেক স্বপ্নই অধরা থেকেছে তার । কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁরই কবিতারা বারবার চ্যালেঞ্জ করেছে একইভাবে -
 এই দ্যাখোবেঁচে আছি প্রবলতরভাবে । 

বাংলা সাহিত্যের নতুন প্রজন্ম খোঁজ করছেন আজ ফাল্গুনী রায়ের কবিতা । বাংলাসাহিত্যের আন্ডারগ্রাউন্ড ধারাটিতেই আস্থা রেখেছিলেন ফাল্গুনী ।স্বাভাবিক শ্বাস - প্রশ্বাস নিতে চেয়েছিলেন সেখানে দাঁড়িয়েই ।সেখান থেকেই তিনি চেয়েছিলেন 

,' আমি যেন আমার মৃত্যুর পরেও বেঁচেথাকি/ 
নারীর যৌনতা থেকে উৎসারিত সন্তানের মধ্যে নয়/
কিন্তু শব্দের শরীর থাকুক বেঁচে / আমার চেতনা / আমার
মাংসের শরীর খুব ভালো করে জানে / জীবনের মানে
বেশিদিন থাকবে না। '

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র