উপানন্দ ধবল - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

উপানন্দ ধবল


               ভারত-ভাগ্যবিধাতা 




   প্রকৃতির দিক থেকে মানুষ মোটামুটি দু'প্রধান-- এক; জড়বাদী, দুই ; অধ্যাত্মবাদী। জড়বাদীরা আত্মা-পরমাত্মায় বিশ্বাসী নয়, তাই জীবন ও জগতের মূল সত্য তথা রিয়্যালিটি সম্পর্কে তারা অজ্ঞাত, এরা ভগবৎতত্বে অবিশ্বাসী, এমনকি অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসীদেরও এরা সন্দেহের চোখে দেখেন। এরা মানুষদেহ ধারণ করেও মনুষ্যত্ব লাভে অসমর্থ হন। মোক্ষ বা জীবনমুক্তিলাভ তো বহু দূরের কথা। বিপরীতপক্ষে অধ্যাত্মবাদীরা পজিটিভ মাইন্ডের হওয়ার ফলে জগৎ জীবনের মূল সত্য জেনে বিশ্ববিধানে আস্থাশীল থাকেন, এবং তারা অর্জুনের ন্যায় মহারথী হয়ে পরমগুরু পরমাত্মা সারথী  শ্রীকৃষ্ণের দর্শানো পথ অনুসরণ করে চিরশান্তি তথা মোক্ষ লাভ করেন জীবদ্দশাতেই। জীবনযুদ্ধে জয়টীকা এদের কপালেই আঁকা হয়। একটি ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা করে প্রথমে আমরা জড়বাদী চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়ে, পরবর্তীতে প্রকৃত পথ তথা অধ্যাত্মবাদের পন্থা আলোচনা করব।
     ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ ভারতে আসছেন, সময়টা ২৭ ডিসেম্বর ১৯১১ ; তাঁকে স্বাগত জানাতে ডাকা হল ঠাকুর বাড়ির দ্য গ্রেট টেগোর রবীন্দ্রনাথকে। ঔপনিষদীয় ভাবধাারায় দীক্ষিত অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী কবি গাইলেন সেই পরমের বন্দনাগীতি : "জনগনমনঅধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা"... জড়বাদী স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু আঁতেল রবীন্দ্রনাথের পিছনে রে রে করে তেড়ে গেলেন, বললেন, কবি সুবিধাবাদী, তোষামোদকারী, পরাধীন ভারতবাসীর যন্ত্রণা অনুভব না করে, সঙ্গীতের ছলে রাজবন্দনা গেয়েছেন । কবির পক্ষ থেকেও যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করা হল। ১৯৩৭ সালের  ২০ নভেম্বর বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী পুলিনবিহারী সেনকে লেখা বিশ্বকবির একটি চিঠি হুবহু তুলে দিলাম এখানে ;--



"...সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনও বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন-অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ কোনো জর্জই কোনক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।"



    কিন্তু "চোরা কভু নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী"। আজ আমি মহাভারত ও গীতার কিছু অমৃতকথন পরিবেশন করে বিষয়টির উপর যৎকিঞ্চিৎ  আলোকপাত করব। হ্যাঁ, শিরোনামের হেডলাইটটা হচ্ছে "ভারতভাগ্যবিধাতা"। মহাভারতে পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভরত-বংশীয় প্রিয় সখা-বন্ধু-শিষ্যটিকে বেশ কয়েকবার 'ভারত' সম্বোধনে সম্বোধিত করেছেন। ভরত+ ষ্ণ = 'ভারত' শব্দটিতে ভরত বংশীয় সন্তান বোঝায়। আবার 'ভা'-তে রত অর্থাৎ প্রভা বা জ্যোতির আলোয় উদ্ভাসিত অর্থেও শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা চলে। আর 'বিধাতা' শব্দটির প্রত্যয়ার্থ হল-- বি পূর্বক ধা ধাতুর উত্তর তৃ প্রত্যয় ; যিনি বিধান করেন = ঈশ্বর। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, কার জ্যোতিতে কে ভাস্বর ? প্রশ্নটি দৈবী, এবং জবাব পেতে গেলে আপনাকে কিঞ্চিৎ আধ্যাত্মিক আলোকবৃত্তে আসতেই হয়। রবীন্দ্রনাথের এজাহার থেকেই হয়তো এবাবদ পাঠক কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন। 



   "ভারত-ভাগ্য-বিধাতা"-- সমাসবদ্ধ পদটির গীতার্থ হচ্ছে; ভরত-বংশীয় অর্জুনের ভাগ্যনির্ধাতা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। আবার ভূ-ভারতের প্রত্যেক আত্মার নিয়ন্ত্রা হলেন পরম-আত্মা বিনায়ক মহাগুরু বাসুদেব।গীতা একটি রূপক কাব্য; এখানে আত্মার (ভরত তথা অর্জুনের ) মুক্তি বা মোক্ষলাভের উপায় বাতলিয়েছেন দেব দামোদর শ্রীকৃষ্ণ। ভগবান নির্দেশিত  পথই ভক্তের কাছে আদর্শ এবং শ্রেষ্ঠ পথ, আত্মার সাথে সাথে বিশ্বাত্মার কল্যান যুক্ত হয়ে আছে তাঁর দর্শানো পন্থায়। তাঁর পথ ধর্মের কর্মের জ্ঞানের যোগের ভক্তির মোক্ষের। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ধর্ম কর্ম কর্তব্যের বিধান অনুসৃত হওয়া উচিত তাঁর বাণী শিরোধার্য করে। তাঁর পথেই ভারতাত্মার জয় এবং মুক্তি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তার একমেব প্রমাণম্। 



   "তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে, গাহে তব জয় গাথা"... ;  মহাভারতের একটি গল্প ব'লে এবার ভারতভাগ্যবিধাতার প্রসঙ্গটির ইতি টানব। অষ্টাদশঅহব্যাপী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে অর্জুন-সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু যখন দ্রোণ-রচিত সপ্তরথীর চক্রব্যূহ ভেদ করে কালানল যুদ্ধ করেও সপ্তরথীর মারে ধুলায় রক্তধূসরিত হয়ে পড়ে গেলেন, তখন অর্জুনের বামচক্ষূ নেচে উঠল। অর্জুন তখন অন্যত্র যুদ্ধে রত ছিলেন, পুত্রের মৃত্যু সংবাদ দূত মুখে শ্রবণ করে প্রতিজ্ঞা করে বসেন; তৎদিবসীয় সূর্যাস্তের পূর্বেই তিনি ব্যূহরক্ষাকারী সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের হত্যা করবেন। এদিকে, মহাকাল শিবের আশীর্বাদে অর্জুন ব্যতিরেকে মহাবাহু ভীমসহ বাকী পাণ্ডব ভাইদের একদিনের নিমিত্ত পরাস্ত করার বরে বলীয়ান জয়দ্রথ অভিমণ্যুবধে কৃতার্থ হলেন। কিন্তু অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শুনে ভয়ভীত হয়ে ব্যূহমাঝে জনারণ্যে আত্মগোপন করে থাকলেন। এদিকে সূর্যাস্ত আসন্ন, মহাখুঁজেও অর্জুন জয়দ্রথের টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পেলেন না। 



   জয়দ্রথের টিকির একটি টীকা এ প্রসঙ্গে টানা যেতে পারে। পাশা-পর্যুদস্ত পাণ্ডবরা যখন দ্রৌপদীসহ কাম্যক বনে অবস্থান করছেন, তখন তদুস্থানে বিহাররত কামসুখে বিশ্বাসী কৌরবপক্ষে যোগদানকারী  জড়বাদী  জয়দ্রথের গোচরে পড়েন অগ্নিকন্যা পাঞ্চালী। দ্রৌপদীর রূপে কামতাড়িত জয়দ্রথ তাকে বিবাহপ্রস্তাব দিলে, পঞ্চপতিগর্বোদ্ধতা নারী তা নাকচ করেন, তখন ভিলেন জয়দ্রথ তাকে পাঞ্জাকোলায় তুলে রথ ছুটিয়ে দেন আপনালয়ের দিকে। মৃগয়া-প্রত্যাগত পাণ্ডবেরা বিনে-দ্রৌপদালয় দেখে তদনুসন্ধানে জ্ঞাতব্য হন ভগ্নিপতি(দুঃশলার স্বামী) জয়দ্রথ সদ্য লুঠেরা হয়ে পথে ধাবমান। অতঃপর পঞ্চপাণ্ডবের ইমিডিয়েট অ্যাকশানে দ্রৌপদী রেস্ক্যু অপারেশন সাকসেসফুল হয়। দুষ্কৃতিকে ধরে বৃকোদর তো 'এই মারি এই রাখি' অবস্থায় । শেষমেশ বোনের  বৈধব্যকে স্মরণে রেখে দ্রৌপদীর ক্ষমাগুণে জয়দ্রথকে তারা রেহাই  দিলেও, এমন পরনারী লুণ্ঠনজনিত অপরাধে জয়দ্রথের মাথার একমুষ্টি চুল ধরে বাকি মাথায় ক্ষুর চালিয়ে সাফসুতরা করে দেন হিড়িম্বাপতি ভীম। এইভাবে পাঁচচুলিয়া হওয়াতে, জয়দ্রথ মনস্তাপে শিবের আরাধনা করে বর মেঙ্গে নিল যে, একদিনের জন্য হলেও পঞ্চপাণ্ডবকে যেন সে সম্মুখ সমরে পরাস্ত করতে পারে। শিব অবশ্য অর্জুন ব্যতিরেকে বাকি পাণ্ডবদের ক্ষেত্রে সেই বরের "তথাস্তু" দিলেন। তো কথা হচ্ছে ; চক্রব্যুহে অভিমুণ্যের রণে পড়ার দিন পার্থর ঐ ফিল্ডে হাজির না থাকার ফুল অ্যাডভান্টেজ নিল কুঁইয়া জয়দ্রথ। কিন্তু কথায় আছে ; "ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। ।



   দুর্জন দুর্যোধনের সহগামী পাপী  জয়দ্রথ পড়ল মহারথী অর্জুনের নাকের ডগায় । গল্পটা হচ্ছে, সারথীর কেরামতিতে সূর্যাস্ত হল। রহস্যটা উন্মোচন করা যাক : জয়দ্রথকে সহজে তালুবন্দী করা যাবে না জেনেই , মুরলীধর ক্রিজে 'দুসরা'- বল ফেলার আয়োজন করলেন। স্ট্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে এল জয়দ্রথ। আসলে  তখনও সূর্যাস্ত হয়নি; চক্রান্ত করে সূদর্শন চক্রের আড়ালে সূর্যটাকে কিয়ৎক্ষণ রেখেদিয়েছিলেন সর্বজ্ঞ  জগন্নাথ। আলোর অভাবে খেলা সমাপ্ত হলে ইনিংসে জয়দ্রথের জয় নিশ্চিত জেনে কুরুসেনানী যখন বিজয়োৎসবের আয়োজনে মগ্ন। অর্জুনও হতোদ্যম হয়ে পরমাত্মা কুষ্ণকে যখন আত্মার রক্ষা করতে অসমর্থ বলে দোষী ঠাওরাচ্ছেন, এবং অগ্নিতে আত্মাহুতির সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত করে ফেলেছেন; তখন পার্থসারথী বললেন, হে মহাবাহো, মৃত্যু যখন অবধারিত তখন আপন গাণ্ডীবটি ধারণপূর্বক আত্মাহুতিতে প্রবৃত্ত হও। তৃতীয় পাণ্ডব কী বুঝলেন ভগবান জানে; "যো আজ্ঞা প্রভু" ব'লে যেই গাণ্ডীব হাতে তুলে নিলেন, অমনি জগন্নাথ তাঁর সুদর্শনচক্রটিকে সরিয়ে নিলেন, সূর্যদেব হলেন প্রকাশমান। সারথী পুরুষোত্তম বললেন; উত্তিষ্ঠতে, জাগ্রতে পার্থ ! হতোদ্যম হইও না , সম্মুখে দেখো তোমার শত্রু পাপী জয়দ্রথ  সমাগত, আর মাথার উপর দেখো দিবাকরও  প্রকাশমান। এতক্ষণে যা 'সূর্যাস্ত' বলে প্রতিভাত হয়েছিল; তা সূর্যগ্রহণ মাত্র। ইত্যবসরে হে মহাবাহু , রণে হত্যা কর অপরাধীকে।



   এদিকে সূর্যাস্ত হয়েছে ভেবে, মজা দেখার জন্য গোপন ডেরা ছেড়ে জয়দ্রথ বেরিয়ে এসেছেন। এমনকি কুরুক্ষেত্রের সমস্ত যোদ্ধা জড়ো হয়েছেন; এমন মহারথীর আত্মাহুতি দেখার জন্য। ভেবে দেখুন একবার; এমন সুযোগ পুরুষোত্তম পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কে-ই বা সৃষ্টি করতে পারেন, জীবাত্মার লক্ষ্য সাধনের জন্য ? সম্মুখে অপরাধীকে পেয়ে মহাধনুর্ধর অর্জুন পাশুপত আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা জয়দ্রথের কর্তিত মুণ্ড ফেলাইলেন  সান্ধ্যজপে রত জয়দ্রথের পিতার অঞ্জলিপুটে। জপরত বৃধক্ষত্র হস্তে কর্তিত মস্তক দেখে ভয়ভীত হয়ে তৎক্ষণাৎ তা মাটিতে ফেলে দিলেন। যুদ্ধে পুত্রের মস্তক কর্তনের ভবিষ্যবাণী আগেই জানতে পেরেছিলেন ধুরন্ধর পিতা। সেই হেতু কুপুত্রের জন্মদাতা ঋষি বৃধক্ষত্র পূ্র্বেই অভিশাপ দিয়ে বসেছিলেন; "যে তার পুত্রের মস্তক ভূলুণ্ঠিত করবে, তার মস্তকও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তৎক্ষণাৎ।" সেই মতো পিতা-পুত্রের ভবলীলা সাঙ্গ হল। সঙ্গে আমার প্রবন্ধটিও। তো মহোদয় , এইভাবেই ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠলেন "ভারতভাগ্যবিধাতা"। 



    হে বিদ্বjon পাঠক !  মহাভারতকে একটি রূপক কাব্য হিসাবেই জানবেন। মহাপুরুষ ব্যাসদেব সেই অমৃতকাব্য রচনা করে ভগবানের পথ আমাদের কছে উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। আমরা জীবাত্মা অর্জুন সদৃশ , এই পৃথিবীতে এই সংসার রূপ ধর্মক্ষেত্রে করুক্ষেত্রে আমাদের কিংকর্তব্য তা গীতায় উল্লিখিত। যে-কারণেই শ্রীকৃষের মুখনিঃসৃত হয়েছে এই অমোঘ বাণী --- "সর্বধর্ম্মান্ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ"।



তথ্যসূত্র :



১) গীতবিতান -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
২) রবিজীবনী (সপ্তম খণ্ড) , প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৭
৩) জয়দ্রথবধ, দ্রোণপর্ব্ব, কাশীরামদাসের মহাভারত 
৪) শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ -- স্বামী প্রভুপাদ, ভক্তিবেদান্ত বুকট্রাস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র