পূর্বা মুখোপাধ্যায়।

মায়াজম
0
আজও রুক্মিণী


রাণী রুক্মিনী। বাসুদেব পত্নী রুক্মিণী। বিদর্ভের রাজা ভীষ্মকের মেয়ে রুক্মিণী। বিদর্ভ মানে এখন যেখানে
নাগপুর। তা সে তো মহাভারতের সময়; নাম-ধাম সব কত ঐতিহ্যপূর্ণ , গুরুগম্ভীর , সংস্কৃত অথচ
শ্রুতিমধুর , সুললিত। সেরকমই যুগটার নাম - দ্বাপর। সে কী আজকের কথা!  
কত বড় কাব্য লেখা হল সেই যুগকে নিয়ে আর তারই একটা অংশে আছেন রুক্মিণী, কিন্তু সে আর
কতটুকু? গালভরা ধর্মাধর্মের চক্করে পড়ে রুক্মিণীরা ঠিক কাব্যে উপেক্ষিতা না হলেও পুরোটা জুড়ে
থাকতে আর পারল কই?
স্পটলাইটে তো একজনই -  শ্রীকৃষ্ণ! তাঁকে আঁকতে গিয়ে যেটুকু দরকার তাতেই আছে রুক্মিণী,
আরো অন্যান্যরা। মানে সত্যভামা, জাম্ববতী, সুশীলা, লক্ষ্মণা ইত্যাদি রেজিস্টার্ড ওয়াইফ আর ষোলো
হাজার নাম না জানা ‘নট সো ইম্পর্টেন্ট’-এর দল।এবং রাধা।তার প্রসঙ্গে তো নালে ঝোলে , চোখের
জলে গড়াগড়ি আপামর কবি। তবে তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেন না রুক্মিণী। ধরার তেমন যুক্তিসঙ্গত
কারণটাই বা কী? ওটা তো না হওয়ারই ছিল।পরস্ত্রী আর বংশ গৌরবও কি আর এমন! তা ছাড়া সে
পাট চুকিয়েই তো বাসুদেব মথুরায় এলেন। পাস্ট ইস পাস্ট।  
গোকুল ছেড়ে মথুরাপতি যখন এলেন তখনই তাঁর কথা শুনেছিলেন রুক্মিণী। বিদর্ভ মানে মহারাষ্ট্র
আর দ্বারাবতী মানে গুজরাট। পাশাপাশিই । কৃষ্ণ  তো তখনই ফেমাস কি না! আট থেকে আশি সব
নারীদের কামনার কৃষ্ণ আর তিনিও হৃদয়বান। রুক্মিণী তাঁর কথা শুনেই মন-প্রাণ সমর্পন করে বসেছিলেন
আর কৃষ্ণ ঠাকুরটিও নাকি বেশ অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন । তবে এই ক্ষেত্রে পথের কাঁটা ছিল একজন
রুক্মিণীর সহোদর রুক্মী। এদিকে চেদীরাজ দমঘোষের পুত্র শিশুপালের জন্য রুক্মিণীকে প্রার্থনা করে
জরাসন্ধ খবর পাঠালেন ভীষ্মকে। বেশ একটা অ্যালায়ান্স তৈরি হচ্ছিল। বিয়ের আয়োজন চলতে লাগল।
কৃষ্ণ কি কম যান না কি? সব খবর তাঁর  নখদর্পণে।হাজির হলেন বলরাম ও দলবলসহ। হরণ করলেন
রুক্মিণীকে। কৃষ্ণকে আটকানোর জন্য রুক্মী , তাঁর ভাই, নর্মদা নদীর তীরে কৃষ্ণের সঙ্গে খুব যুদ্ধ করলেন
আর গো-হারান হারলেন। হেরে ভূত হয়ে লজ্জায় আর বিদর্ভে ফিরলেনই না, ভোজকট শহরে রাজত্ব
করতে লাগলেন।যুদ্ধে জিতে কৃষ্ণ ঠাকুর রুক্মিণীকে নিয়ে এলেন দ্বারকায় আর বিয়েটা সেরে ফেললেন।
বিয়ে তো হবারই ছিল। পুরাণের কথা শুনলে রুক্মিণী হলেন লক্ষ্মীর অবতার আর কৃষ্ণ স্বয়ং নারায়ণ।
কাজেই পেয়ার এবং বিবাহ তো হোনাই থা! দশটি ছেলেও হল তাঁদের – প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণ, সুদেষ্ণ, চারুদেহ,
সুষেণ, চারুগুপ্ত, চারুবিন্দ, সুচারু, ভদ্রচারু, ও চারু। কী সুন্দর সব নাম ! আর এক একেকজন রূপে-গুণে-
বীরত্বে অতুলনীয়। রুক্মী যদিও কৃষ্ণ বিদ্বেষী ছিলেন, তাও প্রদ্যুম্নের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের কন্যা
রুক্মাবতীর আর প্রদ্যুম্নের পুত্রের সঙ্গে তাঁর পৌত্রীর। রুক্মী মানুষটাই এমন ছিলেন, মতের ঠিক নেই।
সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রথমে যোগ দিলেন পান্ডব দলে, তারপর আবার মত বদলে কৌরবদের পক্ষে
নাম লেখালেন। এই অস্থিরচিত্তের জন্যেই দু ঘর থেকেই নাম কাটা গেল তাঁর। সে যাক গে, আসি রুক্মিণীর
কথায় - একটি পরমাসুন্দরী কন্যাও হয়েছিল তাঁর- চারুশীলা বা চারুমতী। কিন্তু তাও কি বাঁধতে পেরেছিলেন
কৃষ্ণকে? কতটুকু গুরুত্ব ছিল রুক্মিণী্র সেই পুরুষোত্তমের জীবনে?
শোনা গল্প রুক্মিণীর। তখন সদ্য বিবাহিত বাসুদেব ও সত্যভামা। একবার প্রধানা রাণীকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গে
বেড়াতে গেলেন। ঘুরতে ঘুরতে নজরে এল  সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা পারিজাত ফুল। মুগ্ধ হয়ে সেই গাছ তুলে
নিয়ে এলেন স্বর্গের বাগান থেকে একেবারে দ্বারকায়, দেবী সত্যভামার মন রাখতে। দেবরাজ ইন্দ্রই বা ছাড়বেন
কেন?অতএব যুদ্ধ।পরাজিত করলেন ইন্দ্রকে, তবে শান্তি। সে নিয়ে ভাগবতে কত কিছু বর্ণনা করে লেখা!
তা তেমন কি করেছিলেন রুক্মিণীর জন্যে?অমন শ্রীকৃষ্ণ, যাঁর কথা ছাড়া সেই ভারতে একটা গাছের পাতাও
হেলত না, সেই ভগবানও ভয় পেতেন, সমীহ করতেন সত্যভামাকেই।বড় বউ বলে কথা! আর রুক্মিণী?
তিনি না কি প্রেয়সী! এমনই তো বলে লোকে। হাসি পায় রুক্মিণীর।
তা হলে দ্রৌপদী? কৃষ্ণা? যাঁর সঙ্গে তাঁর নামেও মিল, গাত্রবর্ণেও। তিনি কে কৃষ্ণের? ও, তিনি তো সখী!  
গজেন্দ্রকুমার নামে একজন মর্ত্যবাসী হাজার হাজার বছর পরে লিখলেন – “আশ্চর্য! এ-ই দ্রৌপদী!
আরও একবার বললেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে। সঙ্গে সঙ্গে মনের কোন্‌ প্রত্যন্ত প্রদেশে এক লহমার
জন্য একটা হতাশা-ঈর্ষা মিশ্রিত ঈপ্সা জাগে যেন – এই মেয়ে যদি তিনি পেতেন! তাঁর উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী
হতে পারত – সিংহের সিংহিনী!” লেখকের অন্তর্দৃষ্টি আছে বটে। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভার কথা। গিয়েছিলেন
তো রাজনীতির মারপ্যাঁচ নিয়ে। দুর্যোধনকে শায়েস্তা করতে। পিসি কুন্তীর ছেলেদের দেখতে, সাহায্য করতে।
কিন্তু এমন জড়িয়ে গেলেন! লোকে বলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের জন্য জমি তৈরি হচ্ছিল তখন থেকেই।
ধর্মসংস্থাপনের জন্য পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইকে খুঁজছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু শলা পরামর্শ, সাহায্য সবই তো
করা যেত দূর থেকেও। অর্জুন মৎস্যচক্ষু ভেদ করলেন, জিতে নিলেন পাঞ্চালীকে, সভা লণ্ডভণ্ড হল,
পাঁচ ভাই চললেন তাঁদের অজ্ঞাতবাসের কুটীরে। কৃষ্ণও গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। কেন? পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে
দ্রুপদনন্দিনীর বিয়েতে তাঁরও একটা প্রচ্ছন্ন হাত ছিল এও বলে অনেকে। তিনি কারো একার হতে দিলেন
না দ্রৌপদীকে। দুঃখই হয় সে জন্য রুক্মিণীর। মেয়েরাই বোঝে মেয়েদের এই কষ্ট।
হিসেব করে দেখেন রুক্মিণী কাছে তিনি কতটুকু সময় আর থাকতেন! তখন থাকতেন দ্বারকায়। ওই ওঁদের
কাছেই তো সর্বক্ষণ! কখনো মিটিং, কখনো খেতে, কখনো গ্রাম ভিক্ষা, এমনকি গৃহপ্রবেশে সবার পাদুকা
খুলে পা ধুইয়ে দেবার কাজ করা। সবকিছুর মধ্যেই তাঁর কোনো না কোনো উদ্দেশ্যসাধন। তাঁকে কি জানে
না কেউ? এমনকি সেই কুখ্যাত পাশাখেলা। ছিলেন না বুঝি সেখানে? মনে প্রাণে ছিলেন। অন্তর্যামী যে!
তাই সখী কৃষ্ণার লজ্জা ঢাকার ব্যবস্থা করলেন মধুসূদন আড়াল থেকেই।সন্দেহ হয়, ননদ সুভদ্রার সঙ্গে
ইচ্ছে করেই অর্জুনকে জুড়ে দিলেন প্রখর বুদ্ধি স্বামীটি তাঁর। ষড়যন্ত্রের রাজা তো! তাই ব্রাহ্মণদের বাঁচানোর
জন্যে যুধিষ্ঠির আর দ্রৌপদীর ঘরে ঢুকলেন অর্জুন, ব্যস, নির্বাসন! দ্রৌপদী প্রথম থেকেই অর্জুনের প্রতি
একটু বেশি দুর্বল। হবেনই না কেন? সেই তো জয় করে এনেছিল সেই আগুনের মতো নারীকে। নইলে পারত
আর চার ভাইয়ের কেউ?এই জন্যেই কি কৃষ্ণের মাথাব্যথা?অর্জুন যেন নারীর প্রেমে মজে গিয়ে আবার
যুদ্ধ-টুদ্ধ ভুলে না যায়, শুধু কি এটাই ছিল তাঁর চিন্তা? না কি ফাল্গুনীর প্রতি কৃষ্ণার যে প্রেম তা কোথাও
ঈর্ষায় বিদ্ধ করত পুরু্যোত্তম  কৃষ্ণকে?
সখী! ভাবলেই মোচড় লাগে মনে। সব সম্পর্কেরই একটা নাম লাগে। একটা আড়াল লাগে – চিরসখা।আচ্ছা,
স্বামী কি সখা নয়? চিরকালের নয়? সেই শেষবেলায় যখন ইচ্ছামৃত্যু ডাকছে তাঁকে কাছেই ছিলেন তো
রুক্মিণী। কী করে ছেড়ে গেলেন তাঁকে? কী হল রুক্মিণীর তারপরে? খবর জানে কেউ? দেশের জন্য ,
যাদবদের জন্য দুঃখ হচ্ছিল শ্রীকৃষ্ণের, চাইছিলেন পতন, স্বেচ্ছাচারে, বিলাসে, মদে , মেয়েমানুষে ডুবে
থাকা তার আপনজনদেরই। কিন্তু হে কৃষ্ণ, কতটুকু সময় দিয়েছ তাদের তুমি, যাদের তুমি রাজা?
তোমার সব কিছুই তো ব্যয়িত কৃষ্ণার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য? সেই যে বেদব্যাস ঠাকুর
পাতার পর পাতা শ্লোক লিখে দিলেন কৃষ্ণার বর্ণনায় যখন সে রাগে, অভিমানে ফেটে পড়ছে, ভেঙে
পড়ছে পাণ্ডবদের সন্ধি প্রস্তাবে? তাঁদের গান্ধীগিরিতে?কৃষ্ণা বলছেন – কৃষ্ণ তুমিও? ওই একটি কথাই তো!
এরকমভাবে ভেবেছ কখনও রুক্মিণীর জন্য? হ্যাঁ, হিংসে  হয় তার। সমস্ত আভিজাত্য ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে দিতে
ইচ্ছে করে। সেদিনের সব কথা আজ লিখতে বসেন রুক্মিণী। হাতির দাঁতের কাজ করা বাক্সো থেকে বের
করেন চুনির মিনাকারি পাড় বসানো রেশমী কাপড় আর হীরে বসানো সোনার কলম। মুক্তোর মতো অশ্রূবিন্দু
জমা করা ছিল স্ফটিকের পাত্রে। সেটাও খোলেন।তারপরই ভাবেন , কী হবে লিখে? কে পড়বে? যে পড়লে
তার সব পাওয়া হত সেই তো নেই। সে তো সবার হয়ে গেছে, তাঁর একার নয়। ভালোবাসার লোককে ভাগ
করে নেওয়া যে কী যন্ত্রণার!
ভাবনাগুলো আবার হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন রুক্মিণী। লক্ষ কোটি বছর পরে সেগুলো গিয়ে পড়ল পৃথিবীর
মাটিতে। দু হাজার উনিশের রুক্মিণীরা সেগুলো হাতে তুলে নিল, ছুঁয়ে দেখল কিছুই তো বদলায় নি।
বলেছিলেন না কাশীরাম দাস – যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে! আরো অনেক অনেক বছর পরে
প্রিয়দর্শী এক কবি , তিনিও মায়ের অষ্টম গর্ভের সন্তান, লিখেছিলেন -
যদি আর কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও , আমি যত দুখ পাই গো...
এটাই সমস্ত রুক্মিণীদের ভালোবাসার শেষ কথা।  
                    ‘                                                                ~





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)