পীযূষকান্তি বিশ্বাস - মায়াজম

Breaking

১৪ জুন, ২০১৯

পীযূষকান্তি বিশ্বাস

 গাভ্যুতি





কুতুব মিনারের উপর চাঁদ উঠেছে । ঘাসের উপরে ঘাস জেগে থাকে সেই ভাবে  চাঁদের গায়ে চাঁদ । অথবা পিচের উপরে পিচ, রাতের গায়ে জেগে থাকে মিশকালো রাত।  বুকের উপর দিয়ে যখন চলে যায় ক্রেটা, ডিসায়ার, আই-টেন , হোন্ডা অ্যামেজ । নিযুত কিলোমিটার যাত্রার পরে ঘেমে ওঠা ইঞ্জিন জানতে চায় সড়কের নন্দনতত্ত্ব , বাড়ি ফিরতে চাওয়া  মানুষের সৌন্দ্যর্যবোধ , রাস্তার পাশ দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া বিজ্ঞাপনের বোর্ড, শতাব্দী পার করা অশ্বত্থের ঝুরি, ইংরেজ জামানায় লাগানো নিভে যাওয়া ল্যাম্পপোস্ট । সব পাখি ঘরে আসে । সব গাড়ি । সব নদী ? নাহ । নদী পড়ে থাকে নদীতেই ।  যার কোথাও যাবার থাকে না ।

এই এতোটা জল পেরোনোর পরও মনে হলো, কোন গন্তব্য ধারে কাছে নাই । একের পর এক ছুটে যায় কোশমিনার ।  নদীর পাশ বরাবর ব্যস্ত সড়ক । মাইলস্টোন । দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনপদ, আর ধুসর ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি । এখানে একসময় তৃণভূমি ছিলো, গোচারণ ভূমি । এখন  তৃণ নেই, ভূমি দখলে চলেগেছে হোমোসেপিয়েন্সের হাতে । যেখানে ক্রোশ ক্রোশ পথে দূর থেকে যে আওয়াজ আসে, তার স্বর বোধ হয় ঘুরে আসে কয়েক শতাব্দীকাল । কোন গাভী যদি ডেকে ওঠে আর তা নির্দিষ্ট দূর থেকে শোনা যায় আমরা তার রাস্তা মেপে নিই ।  এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে । নদীও চরে মাইলস্টোন বাই মাইলস্টোন। কত ক্রোশ হেঁটে চলে আসে এই নদী ? পরিমাপ করা যায় কি ?

যায় ।  চারটে গরু যদি পরপর দাঁড়িয়ে যায়,  তো আমরা বলবো এক যোজন । মানে দুহাজার ধনুষ দিয়ে যদি একটা গরুর গলার আওয়াজ মেপে নেওয়া যায়, তবে এক একটা মাইলস্টোন পার করে যাওয়া যায় ।  কিভাবে ? ব্যাপারটা বলছি । একটু গৌরচন্দ্রিকা থেকে কণ্ঠ সরে যায় । স্বর ভেসে আসে । গরু মানেই গোমাতা নয়, আর তিনু, মাকু, চাড্ডির গল্প তো নয়ই ।  গরু একটি একক ।

সেটা আবার কি ? একক কি ? কোন একাকী নিষঙ্গ কবি ? নাকি  গ্রাম, সেন্টিমিটার, লিটারের মতো কিছু পরিমাপ যোগ্য ? এই যদি ছুটে যাওয়া থাকে,  এক লক্ষ আশি হাজার মাইল বেগে, আমরা বুঝতে পারি কিছু তার আপেক্ষিকতা । যে গতি আমরা কোনদিন পাবো না । হাত দিয়ে যা আমরা কোন দিন নাগালে পাইনাই । তবুও...এই ব্যস্ত হাইওয়ের বিস্তীর্ণ দুপারে অজস্র তৃণভূমিকে আমরা ন্যাড়া করে দিয়েছি কতকাল, আর গাভ্যুতিকে [১] ।  তাকে সমাধি করে পুতে দিয়েছি মাইলস্টোন ।

যদি সত্যিই ধরে নেওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক । রাজা বিজয়পাল দেবের রাজত্বে দূর মথুরাবাসীরা উৎসব করছেন হোলিতে । রং ধরেছে রাজ্যে, গ্রামসভায়, খাপ পঞ্চায়েতে । বিস্তীর্ণ তৃণভূমি জুড়ে সবুজ,   গোশালায় ছিলো লক্ষাধিক গরু । রাজ্যে তখন সুশাসন, দূর দূর গ্রামে তাদের রাজকর্মচারীরা তুলে আনছেন খাজনা । ধান, গম, ভুট্টা । যমুনার স্রোতে তখনো রং ধরেনি কালো । আগ্রা নামের কোন শহর গড়ে ওঠেনি , সেখানে তখনও কোন তাজমহল নেই । মথুরা থেকে একটি বজরা পানিপথের রাজবাড়ি উপলক্ষে যাত্রা করা । বজরাতে রাজপরিবার ।  পুত্র, কন্যা ও দাসদাসী,রক্ষী ,মাঝিমাল্লার । খাদ্য দ্রব্য , প্রসাধন, উপহার নিয়ে চললেন উত্তরের দিকে । লক্ষ্য ইন্দ্রপ্রস্থ পার করে পানিপথের রাজবাড়িতে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া । রাজা ভীমসেনের রাজ্য সভায় তাদের বিশেষ অতিথি হিসাবে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে । দুলকি চালে চলেছেন তাদের বজরা । নিয়ম মাফিক যমুনার দৈর্ঘ্য প্রস্থ মেপে , নক্ষত্রের বিন্যাস দেখে তাদের যাত্রা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়
তাদের পৌঁছাবার কোন তাড়া নেই । শীত শেষ হয়ে গেছে আগেই ।  সূর্যের প্রখর কিরণ মধ্যগগনে । গরমে চৌচির পরিপার্শ্বের জনপদ ত্রাহি ত্রাহি অথচ যমুনার জল বেমানান স্বচ্ছ থৈ থৈ ।  গ্রামগুলি শুয়ে আছে সবুজ বিছিয়ে । নিস্তেজ, খুসওয়ালি, দিনের আলোয় পাখনা মেলে বজরা জল কেটে বয়ে চলে । বেলা পড়ে এলে রাতের দিকে বজরা বাঁধা থাকে মধ্য-যমুনায় ।  আরোহীদের তার ভিতরেই খাওয়া, নাওয়া বা প্রাতঃকৃত্য । এমন একটি চিত্রকল্পে, প্রকৃতিরই খেয়ালে একদিন আচমকা আকাশে ঈষৎ-কালো মেঘ । এমন একটা সন্ধ্যায় হটাত দমকা হাওয়ায় ক্যানভাস ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ঝড় উঠলো ভয়ংকর ।

হাওয়ার গতি কিছু বেশীই । উত্তপ্ত ধুলোঝড় উঠে যায় আকাশে । কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে, নদীর জলও উছলে ওঠে । বজরা বাঁধা আছে, তবুও যেন ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় । কোনকিছুই নজরে আসে না । আরোহীদের ভিতর স্ত্রী ও শিশুদের কান্না শোনা যায় । ভীত সন্ত্রস্ত । যে কোন সাহায্যের জন্য তারা ঈশ্বরের করুণ কৃপার প্রার্থনা করতে থাকেন । বজরার চালক ও সংরক্ষীগণ আশ্বস্ত করেন ঝড় থেমে যাবে ।  যমুনার জল ভয়ংকর হয়ে ওঠে । ততটাই কান্নার রোল পড়ে যায় ভিতর মহলে । ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে ছই ,পাল । বৃষ্টির ঝাপটায় ভেঙে পড়েছে মাস্ত্তল ।


কতক্ষণ পরে  ঝড় থামলো তার খেয়াল নেই, চারিদিকে অন্ধকার । ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে পাওয়া যাচ্ছে না ।  এখন কটা বাজে , কোন দিক কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না । আকাশে তখনো মেঘ । দিক নির্ণয় করা দুর্বিষহ । কোন নক্ষত্র দেখা যায় না । পুব পশ্চিম ঠাহর হয় না ।  কতদূরেই বা জনপদ ? অনিশ্চিত । দুজন রক্ষীও বেপাত্তা । দুজন মাঝির একজন বৃদ্ধ রাভিষ চন্দ্র, একজন তরুণ মুকেশ কুমার । বজরা ঘাটে লাগানোর চেষ্টা করছেন ।  বৃষ্টি থেমে গেছে । কিন্তু সেই অন্ধকার । বজরার ভিতর ছিন্নভিন্ন, বাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না । রাত যেন আর শেষ হতে চায় না । কতদূরে লোকালয় ?  নদীর নিজের কোন মাইলস্টোন থাকে না ।

বৃদ্ধ মাঝি রাভিষ চন্দ্র বললেন, এখান থেকে কাছাকাছি জনপদ দু ক্রোশ দূর হবে । তরুণ মাঝি মুকেশ কুমার মাথা হেলান । মাথাও ভালো দেখা যায় না । বলেন, দু  নয় এক ক্রোশ হবে । অন্ধকারে কে কাকে পথ দেখাবে ? বয়স নাকি তারুণ্য । যদি দেখা যায় বৃদ্ধও একদিন তরুণ ছিলেন ?


ঠিক ঠাহর হয় না মথুরা এখান থেকে কত দূর, পানিপথই বা কতদূর । নিঝুম যমুনা যেন কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে । কোন জ্যোৎস্না নাই আজ ।  শুধু ভোরের অপেক্ষা নিয়ে রাজা বিজয়পাল দেব আন্দাজ করছেন কাছাকাছি কোন জনপদের কথা । বুঝতে চাইছেন মাঝি মল্লারদের কথাবার্তা । একটি শিশু বুঝি আওয়াজ করে এই কেঁদে উঠলো । যমুনার বুকে যেন কোন হু হু  । ঢেউ সেই আওয়াজ নিয়ে প্রতিধ্বনি করে । না ঠিক ঢেউ নয়, মনে হয় দূরে কোন গাভী ডাকছে । হাম্বা । হাম্বা । বৃদ্ধ মাঝি মাঝি কান খাড়া করেন । মুকেশকে ডেকে বলেন কান খাড়া করতে । ঠিক কোন গরু ডেকে উঠেছে । মানে কোন জনপদ আছে কাছাকাছি । ঠিক কতটা দূরে আছে জনপদ ? নদীর তো কোন মাইলফলক হয় না । কি করে জানা যাবে ?

বৃদ্ধ মাঝি রাভিষ চন্দ্র বললেন, দূরত্ব জানা যাবে । আলোর প্রয়োজন নাই।  পূর্বপুরুষদের কাছে শেখা উপায় আছে । যদি কোন গরু ডেকে ওঠে , তার ক্ষীণতম আওয়াজ যতদূর থেকে শোনা যাবে তাকে বলা হবে গাভ্যুতি  [১] । আমাদের দূরত্ব মাপের একক হলো হলো তাই । এটাই তার মাইলফলক । দূরত্ব মাপার এই হলো পদ্ধতি ।

গরুর আওয়াজ শুনে গণনা করা হলো কাছাকাছি জনপদ থেকে  তারা এক ক্রোশ দূরে অবস্থান করছেন । অর্থাৎ ২০০০ ধনুষ দূরত্বে তাদের বর্তমান অবস্থান । চারটি গরু দাঁড় করিয়ে দিলে তা হবে এক যোজনা । বর্তমান মাইল ফলকে এক গাভ্যুতি দূরত্ব হবে ১২০০০ ফুট বা ৩.৭ কিলোমিটার । মাঝি ঘাট-বরাবর বজরা লাগায় । উত্তরের লালকোট রাজত্বের সীমানা থেকে গরু ডাকার আওয়াজ আসে ।  বজরার আরোহীগণ ভীত সন্ত্রস্ত , যমুনায় ঝড়ে পর্যুদস্ত । বড়ই ভরসা ও সাহায্য প্রয়োজন । দ্রুত ভোর হয়ে আসছে রাত । গরু ডাকছে, হাম্বা, হাম্বা । আছি, আছি । কালিন্দিকুঞ্জের উপকণ্ঠে এসে বজরা ভিড়েছে । যমুনা এখন শান্ত । চারিদিকে আলো ফুটেছে । বজরার ঘাটে লাগার খবর পৌঁছে গেছে দিল্লিরাজ চৌহান রাজের রাজবাড়িতে । দেহালিজের নগরদ্বারে অতিথি হিসাবে আজ অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধুরাজা রাজা বিজয়পাল দেবের আগমন । বহুদিন পর আজ তাদের প্রাতরাশ এক প্রাঙ্গণে হবে ।  রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের রায় কিলা পিথোরার রাজবাড়িতে সেজে উঠেছে অতিথি দেবভব এবং সাজ সাজ রব ।



-------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র