দেবীপ্রণাম
- বপ্রক্রীড়া- পরিণত- গজপ্রেক্ষনীয়ং- দদর্শ
অপর্ণার তেজী ধারাভাষ্যে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সুমি। একে একে এত জরা জড়িয়ে ধরেছে অপর্ণার শরীর, মন। তবুও তেজ বা জেদের অব্যাহতি নেই। সুমি যত দেখে অপর্ণাকে ততই বিস্ময়ের ঘোর লেগে যায় ওর মনে। রায়পুরের রাজবাড়ি যা আজ শুধু ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আঁকড়ে, চারিদিক থেকে সবুজ জংলায় ঘিরে রিয়েছে এ বাড়ির কঙ্কাল, সেখানেই শুধু দীপ্ত দুটো চোখ নিয়ে অপর্না পড়ে রয়েছে কোনমতে। শত বুঝিয়েও তাঁকে সরানো যায়নি এ বাড়ি থেকে। অথচ রোজ চাঁই খসে পড়ছে যত্রতত্র। সাপখোপ, চোর ডাকাত, দিনদুপুরে মদ গাঁজার আড্ডা কিছুই বাদ নেই এ মসনদে। তবে সূর্যের আলো নিভে এলে এ’পথ মাড়ায় না কেউ। প্রেত্মাতার কান্না, হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ সব ধেয়ে আসতে থাকে রাজবাড়ির আনাচে কানাচে থেকে। কখনো টিম টিম করে জ্বলা মোমবাতি আবছা আলোয় দেখা যায় অপর্ণা, স্থবির হয়ে বসে রয়েছে, সহ্য করছে সমস্ত অসহায় কান্না। অনেকসময় লোকজন ভুল করে অপর্ণাকেই প্রেতাত্মা ভেবে বসে, কিম্বা তন্ত্রসাধনকারী কোন সাঙ্ঘাতিক ডাইনী।
- এ তুমি কী আওড়ালে অপু ঠাকুরমা?
সুমি বিস্ময় কাটিয়ে জিগেস করেই বসল।
- মেঘদূতকাব্য দিদি, মহাকবি কালিদাসের অসামান্য রচনা
অপর্ণাকে যত দেখে সুমি, তত অদ্ভুত লাগে
- তুমি কবে পড়েছ এসব? মনে রাখো কী করে?
- ঐ ওপরের বারান্দায় বসে চিৎকার করে পড়তাম, তারপরেই মেঘ জমত আকাশে, ঝড় আঁচড়ে পড়ত রাগে দুঃখে। সেসব ভুলি কী করে দিদি।
অপর্ণার চোখদুটো যেন পেছনে চলে যাচ্ছে।
- কাল কর্পোরেশনের লোক এসেছিল বাবার কাছে। জিওলজিক্যাল সার্ভে থেকে এসে পরীক্ষা করে গেছে যেকোনদিন এ ইমারৎ পুরোপুরি ধ্বসে পড়বে। তোমায় নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে বলেছে।
সুমি জানে বলে কোন লাভ নেই। তাও চেষ্টা করে যায়।
- দ্যাখ দিদি প্রমত্ত হাতির মত মেঘ ধেয়ে আসছে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে, গ্রামটাই নিরাপদ নেই। তুই এখন যা তো দিদি, আমার মেলা কাজ। শেষ চেষ্টা আমি করবই। আমায় সব বাঁচাতেই হবে।
সুমি কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে পা চালায়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অপর্ণার চাহনির কাছে সে অতি ক্ষুদ্র।
.....................................................................................................................
সুমি এই রায়পুর রাজবাড়িরই মেয়ে। বহু শরিক, বহু বংশধর, তেমনই লতায়পাতায় জুড়ে আছে সুমি নিজেও। অপর্ণা সম্পর্কে সুমির বাবার জেঠিমা হন। কী এক অমোঘ আকর্ষণে সুমি বারবার আসে এই রাজবাড়িতে। অপর্ণার সংস্পর্শে এলে সুমির মধ্যে একটা অদ্ভুত তরঙ্গ খেলে যায়। যদিও সুমির এই আসাযাওয়া বাড়িতে বা পাড়া-প্রতিবেশীদের কারোরই তেমন পছন্দ নয়। প্রথম প্রথম সেসব শুনে নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারেনি সুমি, এখন আর তেমন আমল দেয় না ক্লাস টুয়েলভে পড়া সুমি।
মঙ্গলবার। সকাল থেকে বেশ ভিড় নিশির দোকানে। এক চিলতে দোকান। চা, বিস্কুট, পাঁউরুটি, ঘুগনি, অমলেট। পাশেই মহাদেবের মন্দির। বাবার পুজো দিয়েই লোকজন ঢুকে পড়ে নিশির দোকানে উপবাস ভঙ্গ করতে। শনি, মঙ্গলবারে একটু বেশিই আসে পাপীতাপীর দল। নিশি এদের পাপীই বলে। এই যেমন রাজুদা, সারা সপ্তাহ ক্ষমতা দেখিয়ে এর চাল, ওর ফল, তার মাছ এমনকি নিশির এই গরীব দোকানের চা পর্যন্ত ফ্রিতে মেরে যায়। সেই রাজুদাই সপ্তাহান্তে বাবার মাথায় জল ঢেলে পাপ হনন করে। প্রতি সপ্তাহে পাঁচশ এক টাকার পুজো চড়ায়। পার্টির কেষ্টবিষ্টু। এদিকটায় এমনিতেই রাজনৈতিক গন্ডগোল লেগেই আছে। অশান্তির ভয়ে সব রাজুদার ছত্রছায়াতেই থাকতে চায়। প্রতি দু’দিন অন্তর খুন, রাহাজানি চলতে থাকে। কোন যেন অভিশাপে গ্রাস করে নিয়েছে গ্রামটুকু।
বিল্টু আজও একটা গ্লাস ভেঙেছে। এই নিয়ে তিনটে হল। ছোট ছেলে বেশি কিছু বলতেও পারে না নিশি, তবে রাগে গা রি-রি করে। আগে মাটির ভাঁড় ছিল। তাতে বেশি খরচ হচ্ছিল। একবারই ব্যবহার। কাঁচের গ্লাসের ব্যবস্থা হল। একবারই ইনভেস্টমেন্ট। তাও যদি ছোঁড়া ভেঙে ফেলে। মাটির ভাঁড়ের ব্যবস্থাও কিছু রাখতে হয়। ট্যুরিস্ট আসে রাজবাড়ি দেখতে, শ্যুটিং পার্টিও। তাদের আবার ভাঁড়ে চা পছন্দ। যত্তসব আঁতলামো।
‘অ্যাই কী করছ কী?
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বুড়িটাকে দেখতে পেল নিশি। দোকানের পাশে রাখা কার্টুনগুলো থেকে আঁকুপাঁকু করে কিছু যেন খুঁজছে। নিশির চেঁচামেচিতেও বুড়ির কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
- কানে শোন না নাকি? কী চাই?
একজোড়া অস্ত যাওয়া সূর্যের রশ্মি ছড়িয়ে পড়া আকাশের মত চোখ এবার চাইল নিশির দিকে। নিশির গা শিরশির করে উঠল। রাণী অপর্ণা রায়। সেই চোখ, সেই ব্যক্তিত্ব । নিশিকে একলাফে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তেত্রিশ বছর আগের এক অতীতে। রায়পুর রাজবাড়ির দুর্গোৎসব। গোটা গ্রাম উপচে পড়েছে রাজবাড়ি জুড়ে। ঠাকুরদালানে কুড়িজন ঢাকির বাজনায় বুক থেকে উছলে পড়া আনন্দধ্বনি। নিশির বাবাও ঢাকের কাঠির তালে আত্মহারা। ছোট্ট নিশি বাবার সাথে এসে এত আড়ম্বর দেখে আত্মহারা। বাড়ির মেয়েদের গায়ে আভিজাত্যের অলঙ্কার। অপর্ণা রায় বাড়ির সেঝো বৌ। দাপটের সঙ্গে সামলিয়ে চলেছে অতিথি অভ্যাগত, পুজোর কাজ। কোন দিকই তার নজর এড়িয়ে যায় না। ছোট্ট নিশিকেও থালা ভর্তি ফল মিষ্টি এগিয়ে দিতে ভোলেননি তিনি। দুপুর দু’টো থেকে শুরু হয় সন্ধিপুজো। একশ মাটির প্রদীপ সাজিয়ে, একে একে জ্বালাতে লাগল অপর্ণা। নিশি গুণছিল। গোটা তেইশ বাকি আর। একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে কিছু বলল অপর্ণার কানে। প্রদীপ জ্বালানো মাঝ অবস্থাতেই ছেড়ে অপর্ণা দৌড়ে ওপরে অন্দরমহলের দিকে চলে গেল।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সমস্ত বাড়ি নিঝুম হয়ে গেল। অপর্ণা একমাত্র মেয়ে ন’বছরের সুভাগার দেহ নিয়ে নেমে এল মস্ত দালানে। সুভাগার শরীর জুড়ে পাশবিক ধর্ষণের চিহ্ন। রায়বাড়ির রাজপুরোহিত অপর্ণার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে আগেই অভিশাপ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, দেবীর এই অসমাপ্ত পুজোর জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে এই পরিবার, এই গ্রাম। অপর্ণার স্বামী দেবজ্যোতি রায় রাগে অন্ধ হয়ে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেন। গ্রামবাসীও প্রতিহিংসায় খুন লুঠপাথ চালাতে থাকল রায়পুরের রাজবাড়ি। কিছুজন পালিয়ে গেলেন, কিছু প্রাণ দিলেন। অপর্ণাকে সরানো গেল না সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে। তেত্রিশ বছর ধরে এই রাজ্যপাট সামলে বসে আছেন তিনি একইভাবে।মনে আশা সুভাগাই সব নিয়ে গেছে, সুভাগাই সব ফিরিয়ে দেবে।
- ডাক এসেছে, অভিশাপ লঙ্ঘনের ডাক। আজ সকালের মেঘে লেখা ছিল সে কথা। সুভাগার চিঠি এসেছে। তোকে বায়না দিলাম ঢাকের।
নিশির আর কথা বলার মতো শক্তি নেই। কার্টুন থেকে ভাঙাচোরা চায়ের ভাড়গুলো একটা কাপড়ের পুঁটলিতে ভরে এগিয়ে গেলেন অপর্ণর। বাবা চলে যাওয়ার পর বংশপরম্পরায় চলে আসা এই ঢাকি জীবিকা বর্জন দিয়েছিল নিশি। ঢাক বাজলেই সেই দুপুর, সেই বিকেলবেলার তান্ডব তার চোখে ভাসতে থাকে। কোনরকমে বাবার হাত ধরে পালিয়ে বেঁচেছিল ওরা। আজও যন্ত্রণায় চোখ বুজে ফেলল নিশি।
অষ্টমীর সকাল। সুমি কমলা লালে তসর পরেছে। হাতে দুটো পদ্মফুল নিয়ে পা চালাল রাজবাড়ির দিকে। নিশি দাঁড়িয়েছিল খানিক দূরেই । সাহস হচ্ছিল না রাজবাড়িতে ঢোকার। বেতালে কাঁসর বাজার আওয়াজে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল রাজবাড়ির দিকে। ঠাকুর দালানে একী দৃশ্য! তেইশ টুকরো চায়ের ভাঁড় দিয়ে বানানো হয়েছে মা দূর্গার প্রতিকৃতি। তেইশ প্রদীপ সাজানো হয়ছে সামনে, অপর্ণা নিজেই বাজিয়ে চলেছেন থালা বাটি। নিশি যন্ত্রের মতো কাঁধ থেকে নামাল ঢাক, হাতের কাঠি আপনাআপনিই পড়তে থাকল ঢাকের ওপর। অপর্ণা নিজেই দুর্গামন্ত্র আওড়াচ্ছেন। সুমি পদ্মফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে, একচুলও পা নড়ছে না তার। ভয়ানক জোরে বজ্রপাত হল। সুমি কান দুটো চেপে ধরল।
- সন্ধিপুজোর সময় হয়েছে, ঢাক বাজাও, উলু দাও
অপর্ণার চোখ দিয়ে অঝোরে বর্ষার জল গড়িয়ে পড়ছে। তড়িঘড়ি সব প্রদীপ জ্বালাচ্ছে অপর্ণা। মুষলধারে বৃষ্টি নামল। ঠাকুরদালান থৈ থৈ। সুমি কমলা শাড়িতে ভিজে চুপসে, আধ বোজা চোখে দেখতে পেল এত বৃষ্টিতেও তেইশখানা প্রদীপ না নিভে জ্বলজ্বল করছে। নিশি ঢাকের তালে উন্মাদের মতো নেচে চলেছে। আশপাশ থেকে সবাই ছুটে এসে এ দৃশ্য দেখে শিউড়ে উঠল। অসম্পুর্ণ তেইশ শিখায় কেটে যাচ্ছে রায়বংশের অভিশাপ।
দশমীর সকাল থেকে মিডিয়া, গ্রাম, শহর, সরকারী আমলা, রাজুদার দল সব ভেঙে পড়ছে রায়পুরের রাজবাড়িতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল আগেই। রাজবাড়ির সব শরিক যোগাযোগ করছে, কেউ কেউ এসেও পড়েছে। সুমির বাবাও তদারকি করছেন, হেরিটেজ বিল্ডিং হবে। প্রচুর ফান্ড স্যাংশন হয়েছে। রাণিমা অপর্না রায়ের সব দায়দায়িত্বও সরকার নেবে। গ্রামের মানুষ আবার একজোট হয়েছে, যেন এ বাড়ির সাথে কোন হিংসা-বিবাদ ছিলই না কখনো। সিঁদুরে মাখিয়ে বরণ করা হয়েছে মাটির ভাড়ে সজ্জিত দেবীকে। অপর্ণা গনগনে উনুনের আঁচের মত লাল টিপ, সাদা জীর্ণ শাড়িতে উপুড় হয়ে পড়লেন দেবীর পায়ে।
অপর্ণা। তাঁর তেত্রিশ বছরের তপস্যাকালে কোন সবুজ পাতা জাতীয় কিছু আহার করেননি। এ তথ্য শুধু সুমিরই জানা। সুমির আনা সাদা মুড়িই শুধু জল দিয়ে খেতে দেখেছে। বলেছিলেন, ‘যেদিন অভিশাপ লঙ্ঘন হবে সেদিন সুমি আমায় একটু সবুজ শাকশব্জি খাওয়াস’। কিন্তু সে সুযোগ হল না। বিসর্জনরর বাদ্যে অপর্ণাও সামিল। রাণীর মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। মা দুর্গা সেজেছে সবুজ পত্রবস্ত্রে। সুমি নিজে হাতে সাজিয়েছে তাঁকে। রায়বাড়ির আনাচ কানাচ থেকে রঙিন প্রজাপতিরা বেরিয়ে এসে তাঁকে ঘিরে আছে।
সমস্ত দেওয়ালের ফুটিফাটা থেকে সূর্যের আলোর মত ঐতিহ্য ঠিকরে পড়ছে অপর্ণার পায়ে।
দেবীপ্রণাম!
- সমাপ্ত -
সুচিন্তিত মতামত দিন