যা দেবী সর্বভূতেষু
(এক )
"ব্যক্তিগত কালিমায় তখন বাতাস মলিন
স্মৃতিগন্ধে ছড়িয়ে আছে দেবীপক্ষের ঘ্রাণ
মৃত প্রদীপের আলোয় মাখা বিন্দু বিন্দু ঘাম
দুলে ওঠা ছায়াশরীর নিদ্রার ভারে নিঝুম "
------------------------
বাড়ি থেকে রওনা দিতে আজ বেশ দেরি হয়ে গেল হরিদাসের| আকাশ আজ বেগড়বাই করছে সারাদিন | তবু প্রায় দু বছর পর চৌধুরী বাড়ি থেকে বড়ো কুটুমের ডাক এসেছে দেখে ঝড় জল কিছুই বাধ সাধতে পারেনি | হরিদাস রওনা দিয়েছে | গায়ে আধময়লা ধুতি, কাঁচাপাকা চুল আর চেহারার দীনতা তার ঈষৎ ঘোলাটে চোখ দুটোকে বড়ো মলিন করে রাখে সবসময় | এসব সে জানেনা | বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে কিন্তু দেখলে মনে হয়ে ষাট পেরিয়ে গেছে | বংশপরম্পরায় এরা মৃৎশিল্পী কিন্তু হরিদাস কেবলই প্রতিমা তৈরীর কারিগর | বছরের এই সময়টার জন্যই তার অপেক্ষা, তার জন্ম যেন | প্রতিবছর চৌধুরী বাড়ির দূর্গাপূজায় মায়ের মূর্তি বানাবার দায়িত্ব হরিদাসের পরিবারের ওপরেই থাকে, কিন্তু গত দুই বছর কি জানি কোন দুর্ভেদ্য কারণে বাবুরা হরিদাস কে ডাকেননি | আর না ডাকলে হরিদাস হত্যা দিয়ে পরে থাকার লোক মোটেই নয় | সে যাই হোক, বাবু খবর দিয়েছেন এবারের মূর্তি আবার সে-ই গড়বে, তবে মা এবার স্বপ্নে নাকি আদেশ দিয়েছেন তাঁর রূপ হবে অনেকটা গৃহস্থ হিন্দু বাড়ির গৃহলক্ষ্মীর মতো অথচ তাঁর হাতে থাকবে ত্রিশূল ও পদ্মফুল.. দেখতে অনেকটা হবে কমলাকামিনীর মতো আবার চোখের আগুন বলে দেবে তিনিই অসুর বিনাশিনী |তাই হরিদাস কে ডেকে পাঠিয়েছেন একটা আলোচনার জন্য |
কাল সারারাত ঘুমাতে পারেননি হরিদাস| কি এক উত্তেজনার বশে| অমাবস্যার রাত্রি, তার উপরে অঝোরে বৃষ্টি| তার মনও আলোকিত এক অন্ধকারের মধ্যে সিক্ত হতে থাকে এসময় |ধীরে ধীরে এক নিবিড় একাকীত্ব তাঁকে গ্রাস করতে থাকে| তিনি নিজেকে একজন ক্লান্ত বিপন্ন মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন | অসহায় একাকীত্ব তাকে পুরোপুরি দখল করে নেবার আগেই তাঁর স্ত্রী জেগে ওঠেন |জেগে ওঠে কন্যা মৃন্ময়ী, তাদের কোলাহলে হঠাৎই বাড়িটা বাঙময় হয়ে ওঠে|
বস্তুতঃ তার স্ত্রী কন্যার চোখেও ঘুম ছিল না সারারাত| বহুদিন পর হরিদাস আবার মাটিতে হাত দেবেন পরতের পর পরত মাটি লেপে গড়ে নেবেন অপরূপা মাতৃমূর্তি |
অন্যদিন ভোরে কাক ডাকার আগেই তার ঘুম ভাঙ্গে |বিছানায় শিরদাঁড়া সোজা করে বসেন তিনি |চোখ বন্ধ করে পূর্বমুখী হয়ে স্তব্ধ বসে থাকেন খানিক, তারপর খাট থেকে নেমে দাঁড়ান| তখন গাছের পাতায় মৃদু আলো এসে পড়ে গতরাতে যে জোনাকিরা এসে বাসা বেঁধেছিল তারা কোথায় যেনো হঠাৎই লুকিয়ে পড়ে, পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়াল দেবার প্রস্তুতি নেয়|
(দুই )
"সেই থেকে দেবীমুখে ঈশ্বরের চুমুদাগ
লোলজিহ্বা ছুঁয়ে গেলেও গড়িয়ে পড়েনা লুকানো অভিলাষ
জলকে এড়িয়ে গিয়ে দিব্যি শিকড় ছুঁয়ে বাঁচি
ঢিবির উইয়ে খেয়ে যায় চুল
ঝাঁপ দিতে না চাইলেও কারা যেন জোর করে অশ্রুবিন্দু ভাসিয়ে দেয় জলে
আমি ‘করালকামিনী’ ভুলে যায় পুরুষ পূজারী ।"
-----------------
"ফালতু বকিস না তো" রান্না ঘরের পিছনে যে জায়গাটা নদীর দিকে নেমে গেছে সেখানে দাঁড়িয়ে হারু মৃন্ময়ীর হাত ধরে টেনে বললো |
মৃন্ময়ী ইতঃস্তত মুখে হাত ছাড়িয়ে যেতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লো কাদায় |
"ও মা, মাগো "
চিৎকার শুনে ছুটে এলো হরিনাথের বৌ| এই ফাঁকে হারু লুকিয়ে পড়লো টুক করে |
আজ কিছুদিন হারু মৃন্ময়ীকে কুপ্রস্তাব দিচ্ছে আড়ালে আবডালে | নিজের জন্য নয়, বন্ধু করিম শেখ এর জন্য, বলছে "মিনু, করিম তোকে বিয়ে করতে চায় রে |সেই ছোট্ট থেকে তোর জন্য ও বসে আছে, আজ তু্ই ডাগর হয়েছিস| ও আর তর সামলাতে পারছেনা "
হতবাক মৃন্ময়ী প্রথম প্রথম গা দেয়নি এ কথায় | প্রেম পীরিতির বিয়ে এই গ্রামে গঞ্জেও এখন চলে কিন্তু হিন্দু মেয়ের বিয়ে হবে পাশের গ্রামের মুসলমান ছেলের সাথে, এ তো এখনো আকাশ কুসুম কল্পনা | করিম ছেলেবেলার সহপাঠী ছিল তার কিন্তু তার মনে এসব ছিলো তা মৃন্ময়ী ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি কখনো তবে আজ কেনো হারু এসব বকছে !
তাঁর বাবা এসব জানলে মরেই যাবে অকালে | আর কোনোদিন তার ঠাকুর গড়া হবেনা | বহুদিন বাদে বাবা তার আবার কাজে হাত দেবে সেই প্রতীক্ষা তাকেও চঞ্চল করে রেখেছে সবসময় |
তাই হারুকে শাসায় মৃন্ময়ী, বলে গ্রামের বড়দের বলবে কিভাবে সে মৃন্ময়ীকে উত্যক্ত করে |
হারু হাসে হো হো করে বলে 'যা বল গিয়ে '|
তারপর খাবি কি ! তোদের পুকুর জমির দলিল কিন্তু আমার বাবার কাছে, আর কোনোদিন তোদের হবে ভেবেছিস এসব?
বাড়ির উত্তর পাশের খালি জায়গাটাতে এসে বসে মৃন্ময়ী |এদিকটাতে রবি শস্যের চাষ করে মা | কিছু শাকসবজি লাগায় |আম, সুপারি কাঁঠাল গাছে ঢাকা জায়গা টুকুর পাশে এই একফালি জমিতে সামান্য শাকসবজি চাষ করে তা দিয়েই জীবন কাটছে তাদের | বাবা তো আপন ভোলা মানুষ | এটুকুও চলে যাবে তাঁদের ! এসব ভাবতে ভাবতে দেখে হরিদাস আসছে... পরনের ধুতি কাদায় মাখা.. মা এগিয়ে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে | নাহ ! এবারে বৃষ্টি যেন থামছেইনা | জানতে ইচ্ছে হচ্ছে বাবা কি খবর নিয়ে এসেছে, তবু সে বসে থাকে বহুক্ষণ সেখানে, যেন এই মুহুর্তটুকুই সত্যি..বাকি আর কিছুই নয় |
(তিন )
গ্রামের হিন্দু পাড়ার দুদিকে সরকারি রাস্তা |একটা দিক সোজা চলে গেছে নদীর ঘাটের দিকে আরেকটা দিক জমিদার বাড়ির দিকে |এই অঞ্চলের এককালের জমিদার নগেন্দ্র চৌধুরীর জীর্ণ অট্টালিকা রয়েছে সে পাড়ায়| কেউ থাকেনা এখন সেখানে, কেবল গ্রামের উঠতি ছেলেদের আড্ডা এখানে | এখানে প্রায়ই হারু আর করিম তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মদ ও গাঁজার আসর বসায়| এই আড্ডা বন্ধ করার জন্য গ্রামের শিক্ষিত ভদ্র মানুষেরা কত জায়গায় নালিশ জানালো কিন্তু কোনো ফল হলোনা | অন্ধকার নামলে এ পথ এখন মেয়ে বৌদের হাঁটার উপযুক্ত নেই |হিন্দু পাড়ার উত্তর ও পূর্ব দিক জুড়ে বয়ে গেছে ইছামতি | হরিদাসের বাড়ির সবাই এ পথেই যাতায়াতের কাজ সারে কিন্তু আজ বৃষ্টিতে কোনো কোনো জায়গা ভুখা ইছামতি তার পেতে চালান করে দিয়েছে তাই আজ তাকে ঘুর পথেই আসতে হলো, তখনই দেখা করিম শেখের সাথে পিছনে একটু দূরে হারু | বললো কাকা, চলেন আপনাকে বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে আসি, ইস আপনি তো দেখছি পুরাই কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আছেন, চলেন চলেন |
হরিদাস কিছু বলার আগেই তাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে বাইকে উঠিয়ে নিলো তারা তারপর পৌঁছে দিলো বাড়িতে |
খেতে বসে মৃন্ময়ী বলল, বাবা পুরুত কাকা এসেছিলেন, বললেন তুমি চাইলে কালই মায়ের কাজে হাত দিতে পারো | কালকের দিনের যোগ ভালো | হরিদাস হাসেন, বলেন মন চাইলে সব দিনই ভালো দিন মা | তবে তিনি যখন বললেন তবে তাই হবে তবে কি জানিস তো মা প্রতিমা তো গড়ব কিন্তু বৃষ্টি না থামলে চৌধুরী বাড়িতে মা কে পৌঁছে দেব কি করে বলতো !
মৃন্ময়ী বাবার পিঠ চুলকে দিতে দিতে বলে তুমি কাজে হাত দাও বাবা, সব ঠিক হবে দেখো |
আজ বহুদিন এ বাড়িতে ইলেকট্রিকের আলো নেই | কেরোসিনের কুপির দপ্ দপ্ আলোর মধ্যে মৃন্ময়ীর মুখটাও মায়ের মুখের মতোই লাগলো | নিজের অজান্তেই হরিদাস হাত জোর করে উঠলেন | মৃন্ময়ী তখন বাবার বিছানা করে দিয়ে বন্ধ দরজার দিকে এগুচ্ছে | সে এসব খেয়াল করেনি কিছুই |
(চার )
"আধখাওয়া লাশ হয়ে ভাসতে থাকে গোধূলি তরঙ্গে
ফুটে থাকে আধ্যাত্ম চরাচর, ঈশ্বরপ্রেম
শতাব্দীপ্রাচীন অন্ধকারে খিন্ন মাঝি বাড়িয়ে দেয় হাত
অসহভাসানে তার চোখে চিকচিকে আলোখেলা স্রোত
হরিয়ালকিশোরী শরীরে ব্যবসায়ী সুখী হাত
খড়,ছন সরিয়ে কাঠামো পূজার আয়োজন করে আলোকিত আর্তনাদে"
--------------------------
সকালের নদী এখন অনেক শান্ত |কাছে দূরের নৌকার পাল দেখা যাচ্ছে | গত রাতের বৃষ্টিতে হরিহরের সমস্ত অস্তিত্ব টলে গেছে | গতকাল মধ্যরাতে অদ্ভুত গর্জন করে এই নদীই এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে হরিনাথের সবজি ক্ষেত, রান্না ঘরের সাথে থাকা আটচালার ঠাকুর মঞ্চ যেখানে একটু একটু করে কাঠামোর গায়ে খড়-শনের আস্তরনের ওপর মাটির প্রলেপ লেগেছিলো, যেখানে মাটির মূর্তি ধীরে ধীরে মা হয়ে উঠছিলেন | কিন্তু এখন সেখানে তার কিছুটি নেই আর | যেন পৃথিবীর মানচিত্রে ওই স্থানটিই ছিলোনা কখনো |
বোবা হয়ে বসে আছেন হরিনাথ | হাতে আর তিনদিন| কিভাবে তিনি তার কথা রাখবেন, কিভাবে তিনি এই আকুল পাথার থেকে তুলে আনবেন সমাধান জানেননা | চৌধুরী বাড়ির পুজো আটকে যাবে কেবল তার কারণে? এই আয়োজন সব বৃথা হয়ে যাবে কেবল তারই কারণে ! এর চেয়ে যে মৃত্যুও ভালো | পরিশ্রান্ত হরিনাথ দুহাত জোর করে আকাশের দিকে চেয়ে কাকে যেন বলে চলেছেন 'এ মরণ বৃষ্টি তুমি থামাও, তুমি পারো মা, এ একমাত্র তুমিই পারো' |
মৃন্ময়ী বুঝেছিলো এভাবে চললে তার বাবাকে আর ধরে রাখা যাবেনা | চারপাশে রাতের আলো নিভলে মৃন্ময়ী ধীরে এসে দাঁড়ালো বাবার দরজার সামনে | উন্মুক্ত দ্বার তার, মৃন্ময়ী এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়, কিন্তু এসব কোনোকিছুই তার দৃষ্টির সীমানায় নেই | মৃন্ময়ী এসে বাবার পাশে বসলো |
মৃদু স্বরে ডাকলো 'বাবা, একবারটি আমার দিকে দেখো '
ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে ফিরেই চমকে উঠলেন হরিদাস | গায়ে সোনার গহনা, সামান্যই | নাকে নোলক আর একঢাল খোলা চুলে এ কে? দেখা মাত্রই মনে হলো একি !! এ যে কমলাকামিনী, দশমহাবিদ্যার অন্যতমা| চৌধুরীরা তো এই দেবীকেই চেয়েছিলেন | হরিদাসের খর চোখে নেমে এলো অশ্রুধারা আর মৃন্ময়ীর চোখে সমাধানের বিদ্যুৎ ঝিলিক |
হরিনাথের পায়ের কাছে বসে পরে মৃন্ময়ী বলে, 'চৌধুরী বাড়ির দূর্গা তো একদিনের অতিথি বাবা | নবমীর রাত্রে তাঁর পূজা এবং সন্ধিপূজার শেষেই তার বিসর্জন | পরদিন মা কে যখন ঢাকঢোল বাদ্যি বাজিয়ে নদীর ঘরে দিয়ে আসবে তারা আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে বাবা | এই নদীতেই তো কত সাঁতার কেটেছি তোমার সাথে, কতো লুটোপুটি কত হুটোপাটি জলের সাথে সেসব মনে নেই তোমার? তুমি কিচ্ছুটি ভেবোনা বাবা, কেউ কিচ্ছু জানবেনা |তুমি মাটি নিয়ে এসো প্রলেপ দাও আমার শরীরে |মনে করো মা তার অসহায় সন্তানের পাশে এভাবেই এসে দাঁড়িয়েছেন| '
এরপর আর কোনো কথা থাকেনা | কপালে হাত ঠেকিয়ে হরিদাস শুরু করলেন তার দেবী অর্চনা | বাপ্ বেটিতে জানলো কেউ জানবেনা তারা ছাড়া এ খবর | কিন্তু তাদের অলক্ষে দুটি ছায়া সরে গেলো আঁধারে সেটা ওরা খেয়াল করলো না |
(পাঁচ )
নবমীতে অবশেষে বৃষ্টি থেমেছে | আশ্চর্য সুন্দর রোদ উঠেছে আকাশে | শরতের অকাল বর্ষণে কালো হয়ে যাওয়া মুখগুলোতে আনন্দ ফুটেছে |চৌধুরী বাড়িতে খুশির আমেজ | যারা সারাবছর খোঁজটুকুও রাখেনা তারাও সবাই এসেছে | এসেছে আশপাশের গ্রামের মুসলমান হিন্দু সবাই | সবার নিমন্ত্রণ আজ | অঢেল তাই আয়োজন |
স্বপ্নাদেশ পেয়ে চৌধুরী মশাই 'মা 'কে বাড়ির ধানের গোলার সামনেই স্থাপন করেছেন, দেবী নাকি বলেছেন তাতে দেশের মড়ক দূর হবে | সম্পদে পূর্ণ হয়ে উঠবে চরাচর |
যদিও একপক্ষকালের বৃষ্টি কিন্তু অন্য কথা বলছে | সে যাই হোক,দেবীর আদেশ বলে কথা |
মা কে স্থাপন করা হয়েছে বেদীতে | পিছনে ধানের গোলা | রূপে লক্ষ্মী অথচ আয়তচোখ দুটির অসম্ভব আগুন দেখে সবাই ভয় ও ভক্তিতে হাত জোর করতেও ভুলে যাচ্ছে |
চৌধুরী মশাই মূর্তি দেখে খুব খুশি | তিনি হরিদাসের সব ধারবাকি মিটিয়ে দেবেন জমিজমা, পুকুর সব ছাড়িয়ে দেবেন কথা দিয়েছেন | কিন্তু হরিদাসের মুখে হাসি নেই একটুও | ভীত সন্ত্রস্ত হরিনাথ পূজা বেদীর এক কোণায় বসে চুপটি করে চেয়ে আছেন ভূমির দিকে, যেন উনি কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন | ক্ষমা চাইবার মুখটুকুও তার নেই মায়ের কাছে | মা কিন্তু নিশ্চল | সন্তানের যন্ত্রনার উপশম করতে তার মুখ আরও প্রশান্ত, আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে |
(ছয় )
"সলতে জ্বললে মায়াময় রূপে মজে গেছে কৃষ্ণকায় পুরুষ
কুঞ্জকামিনী দেহে তখনও প্রথমপক্ষের রেশ
কালরাত্রি না মেনেই অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করে
বলে গেছে সে’জন
“জয়ং দেহি রূপং দেহি যশো দেহি দ্বিশো জহি”'
---------------
পূজা শেষ | ধুপ ধুনোর গন্ধে বাতাস ম ম করছে |বাড়ির মেয়েরা পরের দিনের সিঁদুর খেলার আয়োজন করে নিজের নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এসময় হারুর মতো কাকে যেন হরিনাথ দেখলেন মায়ের কানের কাছে কিছু ফিসফিস করে বলতে |
হই হই করে উঠলেন তিনি | হারু এগিয়ে এসে ঝুপকরে প্রণাম করে ফেলল , পাশেই কোথা থেকে করিমও এসে দাঁড়িয়েছে | পায়ে হাত দিতে যেতেই হরিনাথ বাধা দিয়ে বলল, মায়ের বিসর্জনের আগে বিজয়া হয়না বাবারা, তোমরা কিছুই তো জানোনা দেখছি | মুচকি হেসে করিম তবু বলল ' শুভ বিজয়া '
এসময় তীব্র এক আলোর ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো হরিনাথের, মায়ের মূর্তির দিকে চেয়ে বুক কেঁপে উঠলো তার...চিৎকার করে সে বলে উঠলো আগুগুগুন ... মৃন্ময়ী.. মিনু মা আমার নেমে আয় মা, আগুন লেগেছে |
ততক্ষণে হুড়োহুড়ি লেগেছে চারিদিকে, বড়ো বাড়িতে আগুন লেগেছে | সকলে সেই আগুন নেভাতে ব্যস্ত, মাতৃমূর্তি রক্ষা করার চিন্তা তখন কারো নেই,চিৎকার করছেন হরিনাথ | ও হারু, ও করিম কোথায় গেলি বাপ্ তোরা !দেখনা মা আমার পুড়ে যাচ্ছে যে |জনে জনে ধরে বলছে মায়ের মূর্তি এভাবে পুড়ে যেতে নেই, এতে অমঙ্গল হয়| একে তোমরা এখনই ভাসিয়ে দাও জলে |
পূজার শেষে পুরোহিত ঘট নাড়িয়ে দিয়ে গেছে, এ মূর্তিতে আর প্রাণ নেই | এমনই বলতে শোনা গেলো কাউকে |
উথাল পাথাল হরিনাথ আকাশের দিকে দুহাত তুলে বৃষ্টি চাইছেন তখন, চারপাশের হইহই শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে তার বুকফাটা আর্তনাদ| সে বলে চলেছে 'আকাশের ঘট ঢেলে জল দে পাষাণী ' কিন্তু নিশ্চল মৃন্ময়ী | সে অনুভব করছে পুড়ে যাচ্ছে তার পরনের বস্ত্র, চুল, চিবুক| তবু বাবার সম্মান তাকে রাখতেই হবে | তাছাড়া সে যে এখন কমলা| শক্তির আর এক রূপ, তার তো বিনাশ নেই | সে এখন 'শক্তি রূপেণ সংস্থিতা '
----------------------------
"নক্ষত্রপোড়া ছাই ভেসে বেড়ায় হাওয়ায়
আবারও স্রোতজর্জর ভেলায় নিত্য ভাসানের প্রতীক্ষায়,তৃতীয় প্রহরে বেজে ওঠে যাদু স্তোত্র
“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা
সুচিন্তিত মতামত দিন