সবর্না চট্টোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২৬ সেপ, ২০১৯

সবর্না চট্টোপাধ্যায়


আশ্চর্য প্রদীপ



ত্রিনয়ন আঁকা দুর্গা মায়ের হাতে বিরাট এক ত্রিশূল, এমনই ছবি ঘোরে ফেরে পূজাবার্ষিকীর কভার পেজ জুড়ে।এই সময়টাকে যদি পুজোর পূর্বাভাস বলা যায়, তবে সে কাউন্টডাউন বোধহয় অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। তবে দেবীর আগমন এখন নানান অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের মাধ্যমে। একসময় যেমন ছিল পুজো মানে শুকতারা, আনন্দমেলা পত্রিকার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা, আর বই পাওয়ার সাথে সাথে বইয়ের পাতাটুকু খুলে একনিঃশ্বাসে খানিকটা নতুন পাতার গন্ধ নিয়ে নেওয়া, এ আবেগ হয়ত আজও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি । কিংবা আবার ফিরে দেখা সত্যজিতের পথের পাঁচালীর সেই দৃশ্য। অপু দুর্গা আর কাশবন। পুজো মানে অবশ্যই ফেলুদা। জয়বাবা ফেলুনাথের মতো একেবারে জমজমাট রহস্য নিয়ে আফ্রিকার রাজার দরবারে হাজির হওয়া। পুজো মানে ঋতুপর্ণ ঘোষের উৎসব, হীরের আংটি কিংবা সৃজিতের উমা।
যদিও বাল্মীকি রামায়নে কোন অকালবোধনের উল্লেখ নেই অযোধ্যায় তবুও প্রচলিত আছে রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার হেতু রাবনকে পরাস্ত করার বর পেতেই দেবীর আরাধনা করেন।
বহু শাস্ত্রে ও পুথিতে দেবী দুর্গাকে প্রজননের, উদ্দাম যৌবনের ও অবাধ মদ্যপানের দেবী বলে বর্ণনা করা হয়েছে৷ তার একটি নিদর্শন তামিল মহাকাব্য শিলপদ্দিকারম। মদ, যৌনাচার এ পুজোর সাথে বহুকাল হতে যুক্ত। পণ্ডিত শূলপাণির লেখা অন্যতম গ্রন্থ 'দুরগোৎসববিবেকে'ও বলা আছে দুর্গা পুজোয় আমোদ-প্রমোদই প্রধান, মদ্যপান বিধেয়৷
মার্কণ্ডেয় পুরাণ এর অংশ শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুযায়ী দেবী নিজেই মহিষাসুর বধের আগে ‘তিষ্ঠঃ তিষ্ঠঃ ক্ষণং তিষ্ঠঃ’ বলে ‘মধু’পান করেন। লোকসংস্কৃতির গবেষক সনৎ মিত্র জানিয়েছেন, এই মধুপান আসলে মদ্যপান ৷ ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ অংশে পণ্ডিত সোমদেব ভট্ট বলেছেন, রাজা যশকেতুর রাজ্যে মহিষের কাটা মুণ্ড-র উপর নৃত্যরতা আঠারো হাত বিশিষ্ট এক দেবীর কথা, দস্যু ও ডাকাতরা যার কাছে নরবলি দিত। শাস্ত্র মতে এই দেবীর নাম ‘পাতালভৈরবী’। একই সঙ্গে লিখেছেন দেবীর পুজোয় অবাধ যৌনাচারের কথাও। তবে এই হিসাবে দেবীকে যৌনতার দেবী ভেবে নিলে ভুলই হবে। আসলে তিনি ফসল ও মানব প্রজননের প্রতীকি দেবী৷ মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার যুগে ভারতীয় সভ্যতায় পৌরাণিক সব দেবীই এই প্রজননের প্রতীক৷ দুর্গা মূর্তি তৈরিতে যৌনকর্মীর ঘরের মাটির ব্যবহার আবশ্যিক করার পিছনেও সম্ভবত এই যুক্তিই গ্রাহ্য হয়েছে ৷
দুর্গা পুজোর রীতি ও অনুষঙ্গেও আছে প্রজননেরই প্রতীকিকরণ৷ পুজোর আবশ্যিক উপকরণ জলভরা ঘট ও সশীষ ডাব মাতৃগর্ভের প্রতীক – যার ভিতরে বীজ বপন হয়, সন্তান বাঁচে ও বাড়ে৷ তার উপরে থাকে রক্তবস্ত্র, যা ‘রজস্বলা’ নারীর প্রতীক৷ দেবীর বোধনে নবপত্রিকার প্রবেশ ও স্থাপন, বেলগাছের সঙ্গে জোড়া বেল বেঁধে দুর্গার স্তনদ্বয়ের প্রতিরূপ গঠন করা হয়। তার চার পাশে লালসুতোর ঘেরা চতুষ্কোণ-এ সেই ঘটস্থাপন অর্থাৎ সূতিকাগৃহ নির্মান। আর থাকে চিৎ করা কড়ি যা জন্মদ্বারের প্রতীক৷ তবে এই যৌবনের স্বাভাবিক উল্লাসকেই এখন বদলে দেওয়া হচ্ছে যৌনতার অনাচারে ৷ উৎসব বদলে যাচ্ছে অশ্ললীতায়। একসময় মুসলিম শাসনে ধর্মীয় গোঁড়ামীর কারণে বাংলায় যৌনতার উপর চেপে বসেছিল কড়া বিধিনিষেধ। ইংরেজ শাসনে সেই নিষেধ অনেকটাই লাগামছাড়া হয়ে পড়ল। সেই পথে তৎকালীন পয়সাওয়ালা বাবুসমাজেও ঢুকে পড়ল যৌনতার অনাচার। ইংরেজদের আমলে বাঈজীদের গান, নাটক ইত্যাদি মনোরঞ্জনের পদ্ধতি ছিল পুজার অঙ্গ। লর্ড কার্জন নিজে শোভাবাজার রাজ বাড়িতে এভাবে পুজো উপভোগ করেছেন।
তবে সে যাই হোক, আসলে এই উৎসব কিন্তু আদপে একটা মজা। সব জটিলতার সাময়িক নিবৃত্তি। ছোটবেলায় পুজো মানে নতুন জামা থেকে নতুন জুতো। পরীক্ষা শেষের মজা। বিরাট একটা ছুটি আর হোমটাস্ক সঙ্গে নিয়ে মামাবাড়ি বা দেশের বাড়ি যাওয়া। পুজোর চারদিন চুটিয়ে ঠাকুর দেখা, আনন্দ তার সাথে ভালোমন্দ খাওয়া। বাড়ির ছোট বাচ্চারা বহুদিন পর একসাথে হলে যা হয়। সেই ব্যাঙ চুকচুক, লুকোচুরি, বাড়িময় দাপিয়ে বেড়ানো, দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, সারা দুপুর জেগে থাকা, চুরি করে এটা সেটা খাওয়া এই আর কি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বদলাতে থাকে পুজোর রঙ। পুজোর গন্ধটা কেমন ফিকে মনে হয় ছাতিম আর শিউলিফুল ছাড়া। নতুন জামার অপেক্ষা, অপেক্ষার কাশফুল। তুলো ছড়ানো সাদা নীল আকাশ আর হালকা হাওয়ায় একমুঠো শিউলি ছুঁড়ে দেওয়ার আনন্দ। ট্রেনে করে যেতে যেতে কুড়িয়ে নেওয়া ধানক্ষেত, সবুজের হাতছানি কিংবা বাঁশের প্যান্ডেল। কোথাও ত্রিপল ঝুলে আছে ও কোথাও কাপড়ে পেরেক ঠোকা বাকি। কোথাও বা ঝাড়বাতি জ্বালানোর প্রস্তুতি। সব যেন পাই টু পাই ক্যামেরাবন্দী করার মুহূর্ত। তার ওপর দেশের বাড়িতে বা মামাবাড়িতে অপেক্ষা করছে হাজারো রোমাঞ্চে ভরা সময়। নতুন বন্ধু, অঞ্জলি, লাল টিপ, হলুদ পাঞ্জাবী, পঞ্চপ্রদীপ, কাঁসরঘন্টা, গাঁদাফুল আর শান্তিরজল সব যেন বয়ঃসন্ধির কাটানো এক একটা অধ্যায়।
"পুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলিঃ নমঃ দক্ষযঞ্জ বিনাশিন্যে মহাঘোরায়ৈ যোগিনী কোটিপরিবৃতায়ৈ ভদ্রকাল্যৈ ভগবত্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ"
মাইকের সামনে যখন বারবার বেজে ওঠে এই মন্ত্র বাঙালী হয়ে নিজেকে আটকে রাখাটা বোধহয় খুব কষ্টকর হয়। যেখানেই থাকি নতজানু হই। মায়ের ত্রিনয়নে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। কি স্নেহ কি মায়া অথচ এক অদ্ভুত তেজস্বীতায় স্নিগ্ধ মাতৃরূপ আবির্ভূত হয়েছেন ধরনীতে। এই আগমনের বার্তাবাহক হিসাবে আজও বেজে ওঠে, "বাজল তোমার আলোর বেণু।" প্রতি মহালয়ায় ভোর চারটের সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে বাণীকুমার রচিত মহিষাসুরমর্দিনী’, শোনাটা যেন এক মিথ। অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় সারা শরীর ও মন জুড়ে। তবে এই প্রচলিত মহালয়া কিন্তু প্রথমে বসন্তকালেই প্রচারিত হত, ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে, শরতে নয়৷
এরপর বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝলাম, পুজোটা বোধহয় সবার জন্য শুধু আনন্দ নয়। অসংখ্য মানুষ যাদের কাছে পুজো মানে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে কাঙালী ভোজন, বস্ত্রবিতরণ এর মতো অনুষ্ঠানের দিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা। কারো কারো ভাগ্যে তাও জোটে না। ফুটপাতে শুয়ে কোনমতে ভাত ফুটিয়ে যারা নির্বাহ করে দিন, তাদের কাছে পুজো মানে ভিড় আর কোলাহল। এক বিপুল অসুবিধার মধ্যে জীবনযাপন।
তবে এই পুজো একটা সিস্টেম তো বটেই। যার ওপর নির্ভর করছে ব্যবসার অনেকটা অংশ। ডেকরেটার্স হোক বা খাদ্যবিক্রেতা, জামা কাপড় জুতো হোক বা দশকর্মা, খেলনা হোক বা শিল্পকলা ব্যবসা তো সর্বত্রই। কত মানুষ যে দূর থেকে আসেন শহরাঞ্চলে শুধু ব্যবসার সূত্রে তার খবর উল্লাসপ্রিয় বাঙালী বোধহয় খুব একটা রাখে না। সারা শহর সেজে ওঠে আলোয়। অথচ এই লাইটের বড় বড় কাঠামো তৈরীর কাজ চলে সারা বছর ধরে। নানান এক্সপেরিমেন্ট ও আবিষ্কার চলতে থাকে। চন্দননগরের লাইট যেমন সারা ভারতে ব্যবসা করে তেমনই কুমারটুলির প্রতিমা বিদেশেও পাড়ি দেয়। প্রতিমাকে ঘিরে ডাকের সাজ, ঢাকি সবকিছু যেন এক অভিনব আয়োজন। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে দেখেছি ঢাকিদের সমাবেশ। তারা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে স্টেশন চত্বরে জমা হন। সেখানে ঢাক বাজতে থাকে নিজের ছন্দে। এরই ফাঁকে কোন বারোয়ারী এসে আগাম টাকা দিয়ে পাকা কথা করে নেয় তাদের সাথে। তবে এও জিজ্ঞাসা করে দেখেছি এখন তাদের কাজের বাজার মন্দা। শুধু ঢাক বাজিয়ে সারা বছরের রুজিরুটি অসম্ভব। তাই এর পাশাপাশি তারা যুক্ত থাকেন অন্য পেশায়।
আমাদের বাড়িতে একসময় চল ছিল পুরোনো জামাকাপড় জমিয়ে রেখে এই পুজোর সময় ঢাকিদের হাতে সেগুলো তুলে দেওয়া। পুজো শেষে তারা ফিরে যাওয়ার সময় নির্দিষ্ট বারোয়ারীর অন্তর্ভুক্ত নিকটবর্তী বাড়িগুলিতে কিছু উপার্জনের আশায় যেত। তখনই খুশিয়ালি, খাবার, বা এইসব জামাকাপড় তাদের দেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে বর্তমানে ফ্ল্যাট কালচারে সবই যেন অবলুপ্তির পথে।
পুজো মানেই একটা জাঁকজমক। সাজগোজ করে চারদিন ধরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, জমিয়ে আড্ডা, পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা বা আত্মীয়দের সাথে গেটটুগেদার। তবে এর মাঝেও কি থাকে না মনকষাকষি? হয়ত থাকে। তবে এই শরতের ম্যাজিক্যাল বিউটি বোধহয় ফুরফুরে করে তোলে হারানো স্মৃতি। সব কিছু ভুলে বাঁচার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে ঢাকের কাঠি নেচে উঠলে। ধুনুচি নাচের তালে বাঙালি মনও দুলে ওঠে সারা বছরের ক্লান্তিকে একপাশে ফেলে।
"জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী | দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোস্তু তে || "

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র