পৃথা দাস

মায়াজম
0
                    অন্য  রঙের পুজো 


-----------------------------------------
 ক  সময়ে  জানতাম  বাঙালির  বারো  মাসে তেরো পার্বণ । না, বোধহয়  ভুল বললাম ।  এখন  জ্ঞানের  পরিধি  বেড়েছে। অতীতের কলকাতার বাঙালিরা    অন্য   ভাষাভাষীদের  মেড়ো, খোট্টা,  উড়ে,  পাঞ্জু  বলত বটে কিন্তু  আমরা নিজেরাই এখন  দেশ ছেড়ে  অন্য  মাটিতে  শিকড় গেড়ে  নিয়েছি। এখন আমাদের পুরো বছর জুড়েই উৎসবের আবহ । সত্যিই  কি মাটি আর আবহাওয়া  বদলের সাথে  পুজোর  ধুনোর গন্ধ  বদলে গিয়েছে? না তা নয়।  বর্ষার শেষে যখন ভাদুরে মেঘেরা ছুটি নিয়ে হাল্কা মত  নীলাম্বরী শাড়ি পরা মেঘ বালিকাদের  আদুরে আকাশের মহল্লায় বেড়াতে পাঠায় , সেই কনে দেখা মায়াময় লজ্জাবতী  আলো যখন গাছের পাতার ডগায়  একটু চুমু দিয়ে বলে যায় ---- সময়  এসে গেছে ,  এবার শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলির দিন তার ভোরের মন মাতাল শিউলি ঝরা মাদক গন্ধ  নিয়ে  শারদোৎসবের সূচনা করবে। আকাশে বাতাসে আগমনীর  আবাহনে  শঙ্খধ্বনি। যত সহজে কথাটা বলি , ততটাই কি সব কিছু  সহজ ? না কি জীবন অন্য  গল্প  শোনায়? কে বলতে পারে ?  

শরৎ মানে সপরিবারে  দুগ্গো  ঠাকুরের পুজো। সেই যে রথের দিনে ঘটা করে অনন্ত ভট্টাচার্যের সন্ধ্যা  পুজোর পরে হরির লুঠ দিয়ে  কাঠামো  বরণ?  হ্যারিকেনের  আলোতে  কাঁপা কাঁপা  হাতে  অনন্ত জেঠুর  প্রতিমার কাঠামোয় গোলামাটির লেপ  লাগানো , সাত সমুদ্রের জল, সাত নদীর পলিমাটি, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা ---সব , সঅঅঅব লাগে দুগ্গা  প্রতিমা তৈরি করতে । এই ছিল আমাদের ছোটোবেলা --- সাদামাটা । তখন শরৎ মানে পূজোর ছুটি , ভোরের শিউলির গন্ধ,  মাঠ-ঘাটে  ছড়িয়ে   কাশফুলের বাহার। পাড়ার প্রোগ্রাম একটি নাটক ।  তাতে লেখক রবিঠাকুর  থেকে  বিধায়ক ভট্টাচার্য; যে কোনো কেউ হতে পারেন-- কিন্তু  নাটক হতে হবে । অবশ্য  রবিঠাকুরের অনেক ছাড় ছিল । কারণ পাড়ার  চুনোপুঁটিদের বীরপুরুষ   কিংবা  পূজারিণীর থিয়েটারি ঢঙে আবৃত্তি করা  ছাড়া আর বিশেষ  কিছু  করে ওঠা ক্ষমতার বাইরেই ছিল ,  বলতে গেলে অধরা। তবুও  পুজো স্পেশাল  তো বটেই। তাতেই আনন্দ ।
তখন পথের পাঁচালি  কাকে বলে জানতাম  না । তাই  অপু-- দুর্গার কাশবনের মধ্যে  দিয়ে  উধাও  দৌড়ও দেখি নি । পুজো মানে দূর থেকে ধোঁয়া  উড়িয়ে  কু -ঝিক ঝিক করে দার্জিলিং  মেলের দক্ষিনেশ্বর স্টেশন ছাড়িয়ে রেল ট্র্যাক ধরে শিয়ালদা  স্টেশনের দিকে এগিয়ে  যাওয়া--- হারিয়ে যাওয়া  বাতাসিয়া  লুপ। পুজোয়  চাই নতুন জুতোর বাটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন  আর দেব সাহিত্য  কুটিরের  পুজো সংখ্যা । পুজো মানে মেয়ের বাপের বাড়ি  আসা --হোক না সে  মাত্র  চার দিনের জন্য । আম বাঙালির  সাধারন  আকাঙ্ক্ষা দুর্গাকে ঘিরে । 

      মশারীর ভিতরে  অঘোর ঘুমে কাদার তালের মতো এলিয়ে পড়ে থাকা মেয়েটার  ঘুমের চটকা হঠাৎ  ভেঙে  যেত । পাড়ার  মধ্যে  যাদের বাড়িতে তখনকার দিনে রেডিও ছিল না  ততক্ষণে  সদলবলে তারা এসে পৌঁছে  গিয়েছেন ওদের বাড়িতে। বড়ো জেঠিমা  অ্যালুমিনিয়মের  ডেকচিতে জল বসিয়ে  দিয়েছেন ---চা তৈরি হবে যে ! তিনবার শঙ্খধ্বনির পরেই ভোর চারটেয় শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের   সেই ব্যারিটোন ভয়েস--- আশ্বিনের  শারদ প্রাতে " মহিষাসুরমর্দিনী-"--- শোনা গেল। সব  প্রতীক্ষার অবসান ।আর কি ?  এবার ঘড়ির কাঁটা যেন খুব স্লো চলছে।সেই  থেকেই পুজোর দিন গোনা শুরু হয় গেল --- now the count down begins. কবে আসবে পুজো ?  দিন কাটেনা ।মহালয়ার ভোরে পিতৃপুরুষের  তর্পণ শেষে মাতৃ আরাধনার সূচনা হয় । পাড়ায় আগমনী গান গাইতে আসতেন নদীয়া , চাকদহ থেকে একদল  শাক্ত ভক্ত। তাঁরা থাকতেন মহামিলন মঠের অতিথিশালায়। ঢাকিরা অনেকে ডায়মন্ডহারবার, টাকি অঞ্চল  থেকে চলে আসত। তাদের সবার থাকার ব্যবস্থা  করা হত লাহা বাবুদের নাটমন্দির  সংলগ্ন বিতান বাগিচায়--- মানে বাগানের কোনে অবস্থিত আশ্রয় গৃহে ( এর আর আধুনিক  নাম এখনো জানিনা ) চতুর্থীতেই  প্যান্ডেলে মুখ ঢেকে ট্রাকে করে সপরিবারে দুর্গা  প্রতিমা  চলে আসতেন। মাইকে তারস্বরে  ""ময়না বলো তুমি  কৃষ্ণ রাধে " বেজে চলেছে । তখন পুজোর  গান একটা  আইটেম  নম্বরের মতো --- সারাদিন শ্রান্তিহীন বাজতেই থাকত। হাঁক ডাক, নাটকের মহড়া, ম্যাজিক লন্ঠনের শো , শান্তিগোপালের যাত্রা, আরো কত কি ? ম্যাজিক দেখাতে আসতেন জাদুকর পলাশ কুমার । সে একবারে সাংঘাতিক  অভিজ্ঞতা ।ষষ্ঠীতে মায়ের ডিজাইন করা ঊষা সেলাই মেশিনে বানানো নতুন   ফ্রক --- প্রতি বছর একই  রকম। হ্যাঁ , অষ্টমীতে অঞ্জলি  দেওয়ার  সময় ।ম্যাগিয়ার হাতা  একটু অন্য  স্টাইলের আকর্ষণ। কি দারুণ সে ফ্রীল দেওয়া হানিকোম্ব  করা গোলাপী জামা । আর রাতে ঘন নীল রঙের হাকোবা লেসের  গোল ঘেরের ফ্রক-- নাচের ছন্দে হেঁটে গেলে তাতে ঢেউ  দিত। ষষ্ঠী  থেকে নবমী  কেমন যেন ঘোরের মধ্যে  কেটে  যেত। নবমীর বিকেলের সূর্যাস্ত  একটা মন খারাপের  রেশ নিয়ে  আসত। নবমীর  সন্ধ্যা আরতির ঢ্যাম  কুড় কুড় ঢাকের সমবেত বাজনার তাল যেন বলে যেত "ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ , ঠাকুর যাবে বিসর্জন "। গভীর  রাতে তখন হারমোনিয়ামে গেয়ে উঠতেন ভক্তদলের  মোহন জেঠু "ওরে ও নবমী নিশি , না হইওরে অবসান । তুমি অস্তে গেলে নিশি , অস্তে  যাবে ঊমাশশী, হিমালয়  আঁধার করে " । বোকা মেয়েটা কিছু না বুঝেই ঠাকুমাকে জড়িয়ে  ধরে  ফুঁপিয়ে  কেঁদে উঠত।
         
 সময়  কি আর বসে থাকে ? না কি সে কারো জন্য  অপেক্ষা  করে ? বিসর্জনের  বাজনা এখন  অন্য অনেক কিছুর সাথে মিশে বিচ্ছেদকে অন্য  রঙে ভরে  দিয়েছে। চোখের জলের কোনো রঙ হয় না । শুকিয়েও  যায় । কত পুজো এল , গেল । কতজনের ছবি  বুকের  মাঝখানে স্মৃতি  হয়ে থেকে গিয়েছে । জীবনের অনেকটা  বছর  পেরিয়ে  এসে মেয়েটা জানে ওর  সুখের নীলকণ্ঠ পাখিটা সেই শৈশবেই কোন অচিন দেশে উড়ে গিয়েছে । বলে গিয়েছিল কানে কানে জোড়াপানি, ফুলেশ্বরী,  ইছামতীর  পাড়  ঘেঁষে  আবার ফিরে আসবে। কিন্তু  পাখিও কথা রাখেনি । অঞ্জলি দেওয়ার সময়  কে যেন মেয়েটিকে পিছু ডাকে। অঞ্জলি মানে তো নিজের ভক্তি উজাড়  করে মা দুর্গার কাছে কিছু  চাওয়া । কি চাইবে ? জ্ঞান , বুদ্ধি ? না কি বৈরাগ্য ? সেই যেবার মহালয়ার  পরের  দিন বৃষ্টির জলে 
ভেসে গেল মাঠ ঘাট , গ্রাম, শহরতলি? বন্যায়  ডুবল চরাচর ? ইস্কুল বাড়িতে ঘরছাড়া  মানুষগুলো ঠাঁই  নিল, তখনি তো জানা গেল ঐ যে টাকির থেকে ঢাকি মদন  কাকুর সাথে  কাঁসর বাজাতে  আসত  কিশোর নামের বাচ্চা  ছেলেটা ? ওকে না কি মা মনসার পুষ্যিতে কেটেছে। জলজ্যান্ত  ছেলেটাকে ওঝার কাছে ঝাড়াতে নিয়ে  যাওয়ার  আগেই কোথায়  হারিয়ে গেল । আর কোনো দিনই  কিশোর আসবে না , কাঁসর বাজাবে না । মেয়েটার মন খারাপ । গত বছর কিশোর ওর জন্য  কুলের আচার নিয়ে  এসেছিল দেশের থেকে।  বৃষ্টি  থামে  না ।ইস্কুলের ঘরগুলো  খুলে দেওয়া  হল পাড়া প্রতিবেশীর  জন্য । দুবেলা খিচুড়ি  চলছে। তার মধ্যেই  কোনোমতে  নমো  নমো  করে পুজো সারা হল। বাবা ,কাকা সহ পাড়ার সবাই তখন নিজেরাই ভলান্টিয়ার। দিন রাত এক করে সবাই ঝাঁপিয়ে  পড়েছে বন্যার  মোকাবিলা  করতে। মানুষ  মানুষের  জন্য  এতটাই করে ? করতে হয় --- মেয়েটা শিখছে জীবন ধারা । খালি পেটে সবাই । একবেলা খিচুড়ি, অন্যবেলা  জাউভাত । তাতেই কি মজা। 
           অষ্টমীর  সকালে চলে গেলেন রমেন কাকু। মানুষ  চলে যায়  কি করে ? কেন যারা চলে যায়  আর ফেরে না ? কেউ সেদিন অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে পারল না । খালি আটচালায়  মা কেমন যেন করুন  চোখে দাঁড়িয়ে আছেন। পুরোহিত বৈকল্য  দাদু কোনোমতে  পুজো  সারলেন । সন্ধিপুজো হচ্ছে, রমেন কাকু নিঃশব্দে চার  কাহারের  কাঁধে চড়ে চলে যাচ্ছেন। রমা কাকীমার আছাড়ি পিছাড়ি কান্নায় মেয়েটা মনে মনে বড় হয়ে যাচ্ছে।  অঞ্জলি কি আর দেওয়া  যায়?  শৈশব, কৈশোর ছাড়িয়ে  পূর্ণাঙ্গ  মানুষ হওয়ার  পথ চলায়  কতগুলো পুজো কাটাল মেয়েটা? আজও অঞ্জলি দিতে গিয়ে  টুকরো টুকরো  হারানো ছবির কোলাজ মনে পড়ে যায়  ওর। মন থাকেনা অঞ্জলির  মন্ত্রে । 
    বড় অভিমান  হয়।  অব্যক্ত রক্তাক্ত মন তিলে তিলে নিজেকে  ক্ষয় করে চলে ।  এখন শরীরে মনে শরৎছায়া  ক্ষীয়মান । তখন  দিওয়ালি  সবে  শেষ  হয়েছে । ভাইদুজ, গোবর্ধন পূজার ভিড়ভাট্টা  খানিকটা  কম। তড়িঘড়ি  নেহরু প্লেসের ফুটব্রিজ  পেরিয়ে "এপিকিউরা" যাওয়ার  পথেই  সিঁড়ির একদম নিচের ধাপে ঝুঁকে  পড়া  ন্যুব্জ  শরীরের  ভিখারি বুড়িটা বসেছিল । শতচ্ছিন্ন কাপড়টা দেখিয়ে থরথর কাঁপা গলায়  একটা  ছেঁড়া  চাদর চেয়েছিল ।  বাতাসে  বেশ জোর হেমন্তের শীতেল টান ।অতশত চিন্তা  না করে তখন  দশ টাকার নোট ধরিয়ে নাগরিক কর্তব্য  পালন করে সে চলে গিয়েছিল নেহরুপ্লেস  আইনক্সে সিনেমা দেখতে । ভুলেও  গিয়েছিল বুড়িকে । কয়েকদিন পর জগদ্ধাত্রী  পুজোর  দিন হঠাৎ  মনে পড়ে গেল সেই জরাজীর্ণ  মানুষটার চেহারা।  বিবেক বড় কঠিন  শিক্ষক। সেই তাড়নায়  পরের দিন বাজেট শপ থেকে একটা গায়ে দেওয়ার চাদর কিনে আবার ফুটব্রিজ অভিমুখে। কিন্তু  নাহ। কেউ অপেক্ষায় ছিল না।  খোঁজ  খবর করে জেনেছিল বুড়িটা ঐ রাতেই মারা গেছে।অসহায়  যন্ত্রণায়  কুঁকড়ে  গিয়েছিল মেয়েটি। না এখন সে মধ্য বয়সিনী,  সংসারের  আগুনে পুড়ে  পোক্ত হয়ে গিয়েছে । 

          ব্যস্ততার   জগতে কে ই  বা কার  কড়ি ধারে? এমনি করেই তো হারিয়ে  যায়  কত দুঃখ । তাই বোধহয়  বছর বছর মায়ের আগমনের প্রতীক্ষায়  বসে  থাকেন কত মানুষ । একটু অঞ্জলি  দিয়ে   যদি  সেই  কষ্টের  বোঝা থেকে মুক্তি  পাওয়া  যায়?  মুক্তি  কি অতই সহজ? আমাদের অঞ্জলির মন্ত্রে দেখি  সবখানেই  "দেহি --- দেহি "।।সর্বদা চাহিদা পূরণ করার বাসনা ।  শুধুমাত্র  একবার আমরা বলে উঠি ---"দ্বিষো  জহি"।  হিংসা  দ্বেষকে জয় করতে সাহায্য  করো মা। সবার মাঝে , সবার সাথে সেই মেয়েটাও এখন প্রাণ ভরে অঞ্জলি  দিতে  চায়। দুই হাত জোড়  করে মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা  করতে চায় --- আমার হারিয়ে  যাওয়া  শৈশবের সারল্য ফিরিয়ে দাও মা,  কেড়ে নেওয়া  সেই একান্ত  আপন মানুষদের জন্য  কষ্টটা যেন আর না থাকে। তাদের কি আর ফিরে পাব মা গো ? সুখ না দাও তুমি  আর  দুঃখ দিও  না।  সবাইকে  ভালো রেখো মা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)