অষ্টমীর সন্ধ্যা
কি হলো রিমলি বিটিয়া , পুজোর দিনটাতে অমন গুস্সা মুখ করে বসে আছো কেন ? দেখো আমি রিমলি বিটিয়ার মনপসন্দ আলুপরাঠা বানিয়েছি । জলদি জলদি হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নেবে এসো । তারপর নতুন ফরক পরে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাব হামি হামার রিমলি বিটিয়াকে ।
ধুর কিচ্ছু ভালো লাগছে না রিমলির । আজকে পুজোর দিনেও মামমামকে কাজে যেতে হলো !!!! সারাবছর তো কাজ নিয়েই থাকে , মামমাম যে বলেছিলো পুজোর কদিন কোন কাজ করবে না । শুধু রিমলি আর মামমাম মজা করবে-আনন্দ করবে । ওকে তাহলে মিথ্যা কথা বলেছিল মামমাম ? অভিমানে চোখ দুটো জলে ভরে আসে রিমলির । ওর তো এখানে থাকতে একটুও ভালো লাগেনা , শুধু মামমাম কষ্ট পাবে বলে কখনো সেকথা মুখেও আনেনি রিমলি । ঘর থেকে গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে রিমলি । ওকে কাঁদতে দেখলে লছমিমা আবার কষ্ট পাবে । লছমি মাকেও ভীষণ ভালোবাসে তো রিমলি । ওদের বর্ধমানের বাড়ি ছেড়ে মামমাম যেদিন থেকে এই পাহাড়ি গ্রামে আছে , লছমিমাও ওদের সাথেই থাকে । রিমলি প্রথম প্রথম আন্টিই বলতো লছমিমাকে । কিন্তু সেই যেদিন লছমিমা মায়ের কাছে খুব কান্নাকাটি করছিল আর হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে কিসব বলছিল , তারপর থেকে মামামাম-ই বলেছে লছমি আন্টিকে "লছমিমা" বলে ডাকতে ।
লছমিমার এই রিমলি বিটিয়া ডাকটা দারুণ মিষ্টি লাগে রিমলির । ব্যাস এটুকুই , এখানকার আর কিচ্ছু ভালো লাগেনা রিমলির । না না বারান্দায় দাঁড়ালে ঐ যে দূরের পাহাড়টা দেখা যায় , ঐ পাহাড়টাকেও ভালো লাগে রিমলির ।
ওখানে কি সুন্দর স্কুলে যেত রিমলি মামমামের সাথে । এখানে নাকি অত ছোটদের স্কুল নেই , তাই স্কুলেও যাওয়া হয়না আর । আগে বেশ মামমাম কোন কাজ করতো না । সারাদিন বাড়িতেই থাকত রিমলির সাথে । বাবাই অফিস যেত আর ফিরত রাত করে , কতদিন তার আগেই ঘুমিয়ে যেত রিমলি । তবে ছুটির দিনে ওরা তিনজনে সারাদিন একসাথে থাকত , কতো মজা করতো , বেড়াতে যেত কত জায়গায় । বাবাই এর কথা মনে করতেই বুকটায় কেমন যেন কষ্ট-কষ্ট হচ্ছে । কতদিন বাবাইকে দেখেনি !!!!
মামমাম আর বাবাইএর ঝগড়াটা কেন যে শুরু হলো কে জানে !!!! রোজ রোজ তখন দুজনে শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া । রাতে মিছিমিছি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকত রিমলি , দুজনকে অমন ঝগড়া করতে দেখে ঘুম আসতো না কিছুতেই । তারপর কখন যে ঘুমিয়ে যেত কে জানে । সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেও বাবাইকে পেত না , এমনকি বাবাইএর বালিশটাও থাকতো না বিছানায় । মামমাম যেদিন জানালো রিমলি নিয়ে ওবাড়ি ছেড়ে চলে আসবে , সেদিন ভীষণ ঘাবড়ে গেছিল । মামমাম অবশ্য শক্ত গলায় বলেছিল , তুমি ইচ্ছা করলে তোমার বাবাইএর সাথেও থাকতে পারো ।
বাবাই চুপিচুপি মামমামের আড়ালে বলেছিল , তুমি মামমামের সাথেই যাও রিমলি । তুমি তো এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছো , নতুন জায়গাতে গিয়ে মামমামের খেয়াল রেখো ।
দুজনের কেউ বুঝতে চায়নি , ওদের দুজনের কাউকে ছেড়েই রিমলি থাকতে পারবে না , ওর কষ্টটা হবে সেটা কেউ বুঝতে চায়নি । ধুর আবার দুচোখ দিয়ে জল আসছে ।
লছমিমা কষ্ট পাবে বলে কোনরকমে একটা আলুর পরোটা জল দিয়ে গিলে গিলে খেলো রিমলি ।
একটু দূরে একটা দুর্গাপুজো হয়েছে , সেখান থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে । রিমলি মনে মনে হিসাব করে , কালকে সপ্তমী ছিল তারমানে আজকে অষ্টমী । কুচি দেওয়া নীল রঙের নতুন জামাটা সোফায় রাখা আছে , মামমাম আলমারী থেকে বের করে দিয়ে গেছে । চাইনা রিমলির নতুন জামা , ও কিছুতেই আজ ঠাকুর দেখতে যাবেনা । আজ লছমিমার কথাও শোনেনি রিমলি । সারাদিন বিছানার ওপর খাতা আর রঙপেন্সিল নিয়ে বসে ছবি এঁকেছে , দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে মামমাম আর বাবাইএর মাঝখানে রিমলি ।
দুপুরে জোর করে চান করে দুটো ভাত খাইয়ে দিলো লছমিমা , আজ কিচ্ছু ভালো লাগছে না রিমলির ।
দুপুরের খাওয়ার পর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারানোর সময় গল্প রোজ বলে লছমিমা । আজ সেটা শুনতেও মন চাইছে না রিমলির । লছমিমা তবু এটাসেটা বলেই চলেছে , আজ বিকালেই নাকি মায়ের আসলি পুজো-খ্যানের পুজো ।
খ্যানের পুজো আবার কি !!!! রিমলি তো জানে না ......
খ্যানের পুজোতে কি হয় গো ?
দুগ্গামা তো তখনি ঐ মোষাসুরকে বধ করেছিল.....
খিলখিল করে হেসে ওঠে রিমলি । মোষাসুর না গো মহিষাসুর , তুমি কিচ্ছু বলতে পারোনা ।
সারাদিন পর রিমলি বিটিয়াকে হাসতে দেখে বুকটা জুড়িয়ে যায় লছমির ।
জানিস বিটিয়া তখন দুগ্গামাকে মন দিয়ে ভক্তিসে কুছ চাইলে মা সেটা পুরা করেন ।
ধড়ফড় করে উঠে বসে রিমলি , যা চাইব তাই পূরণ হবে ?
হুম হবে তো , সব পুরা হবে ।
বিটিয়াকে হামি নিয়ে যাব মা দুগ্গার কাছে । সাম হোবার আগে
মেমসাব ও এসে যাবে ।
মামমাম না ফিরুক , লছমিমার সাথেই পুজো দেখতে যাবে রিমলি ।
কখন ঘুমিয়ে গেছিল বুঝতেই পারেনি । ঘুম ভাঙতেই খুব ভালোলাগা সেই গন্ধটা পেল রিমলি । চোখ বন্ধ করেই একবার জোরে নাকটা টানে , হুম এটা তো মামমামের গন্ধ !!!!
সারাদিনের জমানো অভিমান মুহুর্তে হাওয়া রিমলির ।
একলাফে বিছানা থেকে নেমে পড়ে , মামমামের গলা জড়িয়ে একটু আদর খাওয়ার জন্য ।
চমকে ওঠে রিমলি , ছুট্টে গিয়ে দুহাতে বাবাইএর গলাটা জড়িয়ে ধরে ।
বাহ সব আদর বুঝি এখন বাবাই পাবে , মামমাম বাদ !!!!!! চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মামমাম হেসে হেসে কথাগুলো বলে ।
ঠিক অমনটাই তো ছিল আগের দিনগুলো ।
রিমলি ছুটে গিয়ে মামমামের কোমর জড়িয়ে ধরে । মামমামও চায়ের ট্রেটা নামিয়ে কোলে তুলে নেয় রিমলিকে । তারপর অনেক অনেক আদর করে ।
বাবাইকে ছাড়া থাকতে তোর কষ্ট হচ্ছিল তাই না রে ?
মামমামের বুকে মুখ গুঁজে ঘাড় নাড়িয়ে উত্তর দেয় রিমলি ।
মামমামের কোল থেকে ওকে বাবাই কোলে নিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে ।
আমিও তো আমার রিমলি মা'টাকে ছেড়ে থাকতে পারছিলাম না । কাল সকালেই আমরা বর্ধমান ফিরে যাব , আমরা আবার আগের মতো একসাথে থাকব ।
মনটা খুশিতে ভরে ওঠে রিমলির । মা-বাবার ঝগড়াটা মিটে গেছে তাহলে ।
জোরে জোরে ঢাকের আওয়াজ আসছে প্যান্ডেল থেকে । নিশ্চই সেই পুজোটা হচ্ছে এখন , ঐ যে তখন বলছিল লছমিমা । খনের পুজো নাকি যেন , মনে পড়ছে না রিমলির । যাহ যাওয়া হলো না তো মা দুর্গার কাছে । মনে মনেই মা দুর্গাকে প্রণাম করে রিমলি । বাবা-মাকে একসাথে কাছে পেতেই তো পেয়েছিল রিমলি ।
লছমিমার মোষাসুর কথাটা মনে পড়ে যায় রিমলির .....
জানো মামমাম লছমিমা না আজকে মহিষাসুরকে মোষাসুর বলছিল ।
মামমাম-বাবাই একসাথে হেসে ওঠে রিমলির কথা শুনে । লছমিমাও হাসছে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে....
খুশি খুশি রিমলির মনটা হঠাৎ করে দুঃখ দুঃখ হয়ে যায় । ছুটে গিয়ে মামমামের আঁচলটা চেপে ধরে , মামমাম লছমিমা যাবে না আমাদের সাথে ????
রিমলির ছলছলে চোখটা মামমামের নজর এড়ায় না । মেয়েটা সত্যি বড্ড নরম মনের ....
রিমলি বিটিয়ার লছমিমা যাবে তো হামাদের সাথে ....
লছমিমার মতো করে কথা বলে মামমাম ।
খিলখিল করে হাসতে থাকে রিমলি .....
এতো সুন্দর অষ্টমীর সন্ধ্যে আগে কখনো আসেনি রিমলির জীবনে ।
শুধু রিমলির জীবনে নয় , এতো সুন্দর অষ্টমীর সন্ধ্যে মামমাম-বাবাই-লছমিমা সবার জীবনেই হয়তো এই প্রথমবার......
সুচিন্তিত মতামত দিন