উত্তম বিশ্বাস

মায়াজম
0
                        মৎস্যগন্ধা

-‘নলিনীকান্ত বাড়ুজ্জের উঠোনে আজ মেলা লোক জড়ো হয়েছে দেখলাম। মা দুগগার মাচায় ওঠার তিথি বোধহয়?”
-“তুমি পাতা ভাঙতে যাওনি?”
-“না। কুকচির গোড়াটা কদিন ধরে খুব চুলকাচ্ছে। বোধহয় র‍্যাশট্যাশ…!”
-“গোটা একটা দিন কাবার করে ঘরে ফিরলে। কী দেখছিলে ওখানে?”
-“কী আর দেখব! ... ঠাকুর বানানোর কী ছিরি!”
-“অমন একখান মুরোদ তোমার আছে?”
-“শোনো, ওই ঢ্যামনা পশুপতির সাথে আমায় গুলিয়ে ফেল না। আহা রে!.... পলবিচালিতে পাকানো দেবীর দেহটি ছুঁচালো বাঁশের আগায় বসিয়ে যেভাবে জোরসে চাপ দিচ্ছিল হাহাহা…
-“ছিঃ!”
-“ছিঃ কেন?..... এখনো ভালোই বেগ আছে বলতে হয়। জাপটে ধরে ঠাসুনি যা একখান দেলে না!... অমনি যোনিধনি ফেটে এক্কেবারে কলিজা পর্যন্ত সেঁধিয়ে গেল! আর অসুর বাবাজীও চওড়া একখান কপাল নিয়ে এসেছে বলতে হয়!...এইবার বুঝলাম দাঁত বার করে অমন হাসির আসল রহস্য!.... নীচ থেকে সব...!”
-“তোমার মুখে কিছুই বাধে না দেখছি। তোমরা পুরুষ মাত্রেই না এক একজন পাপাত্মা বহনকারী।”
-“শুধু আমি একা না। তুমি যাদেরকে পুণ্যাত্মাদের দলে ফ্যালো, তারাও হাঁ করে গিছিল এমন দৃশ্য। শোননি মরদমুখো মাগীগুলো আবেগে গলা কাচিয়ে ক্যামন উলুধ্বনি দিচ্ছিল! …. তোমার এঁড়ে ঢাকি,… সেও কিন্তু কমে যায় না!... বৃদ্ধা তারামণি চোখের কোণা মুছে ভেউভেউ করে কাঁদছিল! ... বাবুর বাড়ির দাসীবাঁদীদেরও আজকাল ঢং কতো!... কোলের কাপড় কাঁধে পেঁচিয়ে হৈহল্লা করে জয়ধ্বনি দিল দেখলাম! আর বাড়ুজ্জে বাবুরও বলিহারি!.... মন্দির তো না!.... যেন মেয়েমানুষের একেকখান আখড়া বানিয়ে রেখে গেছেন!”
-“তা হঠাৎ এইসময় এসব গল্প?” বাসনা বুঝতে পারে উদয়ভানুর ভেতরের গলন গরম… উজানে বইছে। সে আরও খানিকটা নিবিড় হবার চেষ্টা করল, “কোই কোথায় র‍্যাশ বেরিয়েছে দেখি?”
-“আঃ! গন্ধে গা গুলাচ্ছে।.... ঘাড়ের ওপর থেকে নামো বলছি!”
বাসনার হাতদুটো অবশ হয়ে আসে। সে উদয়ভানুর শরীরের ওপর থেকে নেমে যায়, “কী যা তা বলছ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনে।”
-“বলছি তো! …. আঁশটে গন্ধ আসছে, সরে শোও।”
অনেকক্ষণ আর কেউ কারো দেহের পারদ পরীক্ষায় আগ্রহ দেখায় না। একসময় চাঁদ গড়িয়ে শুকতারার কোলে ঢলে পড়ে। রাতের পারা পাতলা হয়ে আসে। দূরের রেললাইনের ধারের জলাশয়ে বাসনাদের একফালি পদ্মবন। এতক্ষণ সেখানে হয়ত গাঢ় সবুজ পাতার থালায় ভূমা সম্ভোগকারী নিশিপুরুষের বীর্য পতনের মতো এক দুফোঁটা করে শিশির বিন্দু ঝরতে শুরু করেছে। আগে এসব গল্পও শুয়ে শুয়ে শুনত বাসনা। কিন্তু আজ আর কিছুই শুনতে ইচ্ছে করে না ওর। সে চুপচাপ পড়ে থাকে বিছানার এক কোণায়। দলা দলা কান্না বাসনার তলপেট ঘিরে পাক খেতে থাকে। আগে নন্দর সাথে পুজো পার্বণে ঢাকের সাথে কাঁসর বাজাতো বাসনা। কাঁচা বয়েসের কাঁচা আবেগ।… তখন তো কতোই না কাঁচাচামড়া ঘেঁটেছে। মুচিপাড়া থেকে মহিষের পশমওয়ালা মোটা চামড়া এনে এঁদো পুকুরের কালোজলে পচিয়েছে। পশম উঠে নরম হলে, ডাঙায় তুলে রোদে দিয়ে ট্যান করে, নিজের হাতে বায়াও বেঁধেছে বাসনা। অনেকসময় হাতে হাতে সাহায্যও করেছে উদয়ভানু। বাসনা ভাবে,‘কোই তখন তো এমন ব্যামো ছিল না! তবে কি পদ্ম চাষ করতে নেমে এমন উপসর্গ দেখা দিল? সব ফুলচাষীর মনেই কি তাহলে এমনভাবে পোকায় বাসা বেঁধে বাস করে? সেইজন্যেই কি বিষ্টুকাকার বউ সেধে সেধে জলাটা আমাদের কাছে এতো সস্তায় লিজ দিল?’ কিছুই হিসাব মেলাতে পারে না বাসনা। পাশ থেকে মাঝে মাঝে গোখরো সাপের মতো আওয়াজ আসে। বাসনা ফস্‌করে দেশলাই ঠুকে কুপি জ্বালে। মশারীর চারপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দ্যাখে। তারপর ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে আবার গোটোমোটো হয়ে শোয়।
-“কী, পেলে কিছু?....ছুঁচোটুচো নিশ্চয়?”
-“না গন্ধগোকুল।…. মেয়ে মানুষের প্রতি এত্তো ঘেন্না তা সংসার পাতবার কী দরকার ছিল শুনি?”
উদয়ভানু বঁড়শিবিদ্ধ বকের মতো খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠল, “ওই যে বললাম বাঁশের আগায় আস্ত একটা মেয়েলোক গেঁথে রাখব বলে!”
উঠোনে কাশফুলের আঁটি বাঁধতে বসেছে নন্দ ঢাকির বৌ। শরৎ এলে অনেক দূরের রেললাইনের ধার কাঁচিয়ে ওগুলো সংগ্রহ করে ওরা। নন্দ বাসনাদের উঠোনে ঢাকের চামড়া শুকোতে দিয়ে বৌয়ের সাথে সেও কাশফুলের গুচ্ছ বানাতে হাত লাগায়। সামনের শুক্কুরবার কলাকাটা আমাবশ্যে, আর তারপরই মহালয়ার গঙ্গাতর্পণ। এর মধ্যেই হুড়দ্দাড়িয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে নন্দ ঢাকির। তা নাহলে বাবুর বাড়ির বাঁধা বায়নাটা ফস করে ফসকে যাবে। কাঁধের ফিতের সাথে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশ বেঁধে ঢ্যাং কুড়কুড় কুড়ুৎ করে বাজাবে। আর ধুনুচির ধোঁয়ার মধ্যে ঘুরে ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচবে নন্দ। পুজোর কটা দিন ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা মনেই থাকে না নন্দর। ধূপ ধুনো আর রসটুপটুপে কাটা ফলের গন্ধে নিজেকে অসুর দলের দেবতা দেবতা লাগে ওর। পঞ্চমী থেকে বিজয়া ভাসান এই পাঁচটা দিন কীভাবে যে কেটে যায়, কিছুই বুঝতে পারে না নন্দ ঢাকি। এই তো বছর খানেক আগেও বাসনাকে সঙ্গে নিয়ে বায়না ধরত নন্দ। বাসনা পাতলা কোমর দুলিয়ে নন্দর ঢাকে তাল তুলে দিতো। মুহূর্তে বাজনার মেজাজে তেতে উঠত নন্দ। এখন কেবলমাত্র বাইরের উঠোনটুকু ছাড়া ভেতরের আর সব সম্পর্কের জোড় ছিন্ন হয়ে গেছে ওদের। উদয় আর নন্দের প্রায় চালেচালে ঘর। আজ উদয়ভানু নন্দর ফুরফুরে মেজাজ দেখে বড়মুখ করে বলেই ফ্যালে, “আচ্ছা নন্দ, তুই যে বাড়িতে বাজাস, পদ্মের জুগান দেয় কারা জানিস?”
-“ক্যান বাচ্চু ব্যাপারী আসছে না?”
-“ওই আসে। বেশ কয়েকটা বিয়ের মাস গেল। গাড়ি ভর্তি পাতা ভেঙে দিলাম। নিয়ে দাম দেলে কত শুনবি?... মাত্র দুশো বিয়াল্লিশ টাকা।”
-“তোর জলার সাদাফুলের সাইজ শুনেছি বড়ো। কতকরে দেয় রে বাচ্চু?”
-“একপদ্মে একসিকি। …. পোকায় ছুঁলে পাঁচ পনে বারো বারো টাকা।”
-“এমা! এতে কি পাঁক ঘাঁটার দাম ওঠে? এখন তো দেখছি জলের চেয়ে ডাঙায় জোঁকের দাপট বেশি!... ইস! এগুলো বাবুদের নজরে একবার আনতে পারলে--!”
-“তাই তো বলছিলাম। বাবুদের সাথে একটু কথা বলতে পারলে… তোকেও নাহয় কিছু দিতাম।”
-“তুই যাবি? তা পাতা ভাঙবি কখন?”
-“না। বাসনাকে পাঠাতাম। এখন রোজ একটা করে ওয়াগান ঢুকছে। বালি, মাটি, পাথর বোঝাই করে এনে ঢেলে দেচ্ছে জলে। যাও বা পাঁক ঘেঁটে দুমুঠো ভাতের মুখ দেখতাম, সেটাও আর ওঠবে কি না কিছুই বলা যাচ্ছে না।”
-“ডাবল লাইন আছে না? ছিল একফালি নালাখালা, সেটুকুও রেল কোম্পানীর না নিলে চলছে না?”
-“চিন্তা তো ওইখানে! কেন্দ্রে, রাজ্যে সবখানেই ওরা আরবী ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে রেখেছে। কে লড়াই দেবে ওঁদের সঙ্গে!”
কিন্তু নন্দর বউ চায় না বাসনা আবার তার স্বামীর পেছন পেছন ঘুরঘুর করুক। বাসনার কিশোরী বেলার অনেকটা কেটেছে নন্দর সাথে। বাসনা কেবল ভালো কাঁসর বাজায় না, সে দারুণ নাচতেও পারে। বাবুর বাড়িতে বায়না পেলেই বাসনাকে সঙ্গে নিতেই হতো নন্দ। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে কোমর বিছা পরে ঢাকের তালে তালে কাঁসর পিটিয়ে পাহাড়ি ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে নাচত বাসনা। … এইখানেই নন্দর বউয়ের ভয়! তাই তো সে মনে মনে ভাবে, ‘বিয়ের আগে যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে!... এখন আর না!’ এবার সে সরাসরি অবজ্ঞার সাথে জানায়, “শিয়ালদার ফুটপাতরে বাজনা বাজাতি বাজাতি মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে। তখন কি আর খেয়াল থাকে, কোন পথে পতিমা আসছে, কোন পথেই বা পদ্ম আসছে!”
ঘরের ভেতর থেকে বাসনা খেকিয়ে ওঠে, “এখন আর চামড়ার গন্ধ নাকে লাগছে না? নাকি পরের কলসিতে আতর উপচে পড়ে?”
উদয়ভানু ব্যাকুব বনে যায়। নন্দ বাসনার উঠোন থেকে ঢাক উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। নন্দর বউ সেও কমে ছাড়বার পাত্রী? খোঁপায় গুঁজে রাখা কাশ নাচিয়ে পানের পিক ফেলে চিমটি কেটে বলে, “শহরে কি যেতেই লাগবে ঠাকুরপো? ব্যাপারী তো আজকাল শুনছি লাগজুনা পড়ে থাকে তুমার জমির আলে।…. তাতেও এতো আহিংকে?”
বাসনা বুঝতে পারে নন্দর বউ কী বলতে চাইছে। সে দুপদাপ করে পা ফেলে উঠোনে নামতেই নন্দর বউ কথা ঘুরিয়ে বলে, “দ্যাখ বাপু আমাকেও লোকে কম কিছু শোনায় না। আমার তাতে ছ্যাকা খাওয়ার কিছুই নেই। এই যে ও শহরে যায়। বাজায়। আরতিতে.... ভোগে ... বিসর্জনে... ওর গা ঘেঁষে কারা কোমর দুলিয়ে নাচে, কাদের নাচায় ....আমি কি দেখতে গেছি? আমার বাপু দুমুঠো পাওয়া নিয়ে কথা!” কাশআঁটি কাঁচিয়ে নিতে নিতেও আবারো বলে গেল, “মরে যাই মরে যাই! শেতল পদ্মপাতার ওপর চিৎ হয়ে শুয়েও দেখি মানুষের সুখ নেই। …. সুখ যে আসলে কীসে সেটাই বুঝলাম নাকো! আমি বাপু মরে গেলেও ব্যাটাছেলের গা ঘেঁষে নাচতে পারব না!” বাসনা চোকলাওঠা চোখ নিয়ে উদয়ভানুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ভালোকরে দেখলে মনে হয় কতকাল ঘুমায় নি সে। ভেতরের জলাশয়ও যেন বাষ্প হতে হতে কোথায় কোন শুষ্ক দিকচক্রবলয়ের দিকে উড়ে গেছে। উদয়ভানু বাসনার ব্যথায় আর বাতাস দেয় না। সে পাতার বাণ্ডিল নিয়ে মিহিরপুরের আড়তের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
বাড়ুজ্জে বাড়ির একচালির ঠাকুর নিয়ে ইদানীং তাঁদের বউ ছেলেমেয়েদের মধ্যে তেমন কারো আগ্রহ নেই। যেদিন কলাবউ স্নান করানো হয়, সেদিন ওঁদের বাড়ির বউরা গাদাগুচ্চার গয়না পরে ভুঁইকুমড়োর মতো গড়াতে গড়াতে বড়পুকুরের সিঁড়িতে পা ভেজায়। কিম্বা বিসর্জনের ঘাটে একমুখ সিঁদুর লেপ্টে ধেইতাধিনা করে নাচবার অছিলায়, …. কেউ বা দশহস্তার সাথে সেলফি তোলার হিড়িকে হুড়মুড়িয়ে বাইরে আসে। বাসনার মতো আরও দু’পাঁচজন উড়ুক্কু মন পালক ছাড়া সারামাস মন্দিরমুখো কেউই তেমন একটা ফিরে তাকায় না। এমনকি কাঠামোপুজোর পর থেকে নাড়াপল পাকানো, মাটি লেপা, জলন্যাকড়া বুলোনো, খড়ি দেওয়া, ন্যাকড়ার পট্টি লাগানো… কেউই আর আগের মতো আগ্রহ নিয়ে দ্যাখে না। নির্জন মন্দিরে পশুপতি পাল একাএকাই সারাবেলা মাটিমজুরের কাজ করে চলে। কিন্তু কেন জানিনা আজকাল বাসনার মন পড়ে থাকে মন্দিরে। উদয়ভানু পাতা ভাঙতে দুপুরবেলা যখন দূরে লাইনপাড়ের পাঁকে নামে, অমনি ফাঁক বুঝে বাসনা মাদীমার্জার চলনে নিঃশব্দে মন্দিরের দুয়োরে এসে দাঁড়ায়। আজ পরম আগ্রহ নিয়ে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির কাজ দেখছিল বাসনা। পশুপতি যখন পরম মমতায় দেবীর গালে... নিতম্বে... বুকে... বিভাজিকায় জলন্যাকড়ার আদর বুলিয়ে বুলিয়ে হাতখানি সঞ্চালন করছিল, তখন বাসনার বহুকালের অতৃপ্ত আত্মা যেন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠতে চাইছিল। কতকাল হল উদয়ভানু তার বুকে হাত রাখে না। ভালোবাসার কথা উঠলেই বলে, “খাওয়া দাওয়া পাচ্ছ ব্যাস! চুপকরে পড়ে থাকো।….মেয়ে মানুষের জন্যে এর চেয়ে আর কী হতে পারে। দ্যাখো না আছোলা বাঁশের আগায় দুগগাকে কীভাবে গেঁথে রাখা হয়?” বাসনার শুকনো চোখ ছাপিয়ে চারদিক ঝাপসা হয়ে আসে।
-“কী হে কাঁদছ? ঘরে অশান্তি করেছ নাকি? জামা কাপড় কেনা হয়নি নিশ্চয়?”
-“না না অশান্তি কেন! এই ভাবছি আর দুদিন পরেই দেবীর গায়ে কাপড় উঠবে। ডাকের সাজ পড়বে। হাত ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। পায়ের তলা আলো হয়ে থাকবে একশ আটটা পদ্মে! জমিদার থেকে শুরু করে ঝি চাকর দাসদাসী লুটিয়ে পড়বে এই মাটির প্রতিমার পায়ে!... শঙ্খ বাজবে... মেয়েরা উলুধ্বনি দেবে। আর উনি মহিষাসুরের কাঁধে পা তুলে দিয়ে মোহিনী হাসি হাসবেন। দশ হস্ত টান করে বরাভয় দেবেন। …. তাই তো? অথচ একটি বারের জন্যেও উনি জগৎবাসীকে বলতে পারবেন না,… তাঁর নাভিদেশ অবধি একটা যন্ত্রণার বল্লম গাঁথা আছে। তিনি যেখানে বসে আছেন সেটা মোটেও সুখকর নয়। মোটেও আরামের নয়। তাঁকে যে যে উপাদানে নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলি নিতান্তই আদাড় কাঁচানো উপকরণ মাত্র।… পল পচলে গন্ধ নেই।… পাঁকের মাটিতে দোষ নেই। শত হোক তিনি তো দেবী। অথচ….!”
-“অথচ কী?”
বাসনা কথার খেই হারিয়ে ফ্যালে, “আচ্ছা ভাস্কর তোমরা সব পুরুষরাই কি এক ধাঁচের? ঘরের মেয়েলোককে শূলের ওপর চড়িয়ে রাখাটাকেই পৌরুষ বলে মনে করো?”
-“হঠাৎ এসব কথা?”
-“বলো না। মেয়েদের শূলে বিদ্ধ করাটাই কি তোমাদের একমাত্র দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?”
-“হাহাহা শূল নয়, বলো ত্রিশূল। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের একমাত্র ধারক এই অস্ত্রখানা। আর বিধাতা পুরুষ একদিন আমাদেরকেই যোগ্য মনে করে এর ভারবহনের অধিকার দিয়েছিলেন। তাকে তোমরা যদি এভাবে ব্যাখ্যা কর হবে ক্যানো?”
বাসনা বেপরোয়া হয়ে উঠল। বুকের কাপড় খসিয়ে সে ভাস্করের চোখে অন্য ছুরিকা গেঁথে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “মাটিতে খামোখা এত দরদ মাখিয়ে কী লাভ শিল্পী? কাঁচা রক্ত-মাংসের শরীরে কী দিতে পার, তাই দ্যাখাও দেখি!”
পশুপতি ভয় পেয়ে গেল। দৌড়ে মন্দিরের চাতালে নেমে এল। এদিক সেদিক উঁকি মেরে দেখে নিয়ে আবার ভেতরে গিয়ে দেখল বাসনা নিজেকে আরো উন্মুক্ত করে ফেলেছে। এবার পশুপতি ওর বুকের ওপর কাপড় তুলে দিতে গেলে বাসনা ওকে জাপটে ধরে বলে উঠল, “কোথায় আমার গায়ে গন্ধ? শুকে দেখো তো শিল্পী!”
-“কে বলেছে?.... উদয়ভানু? কীসের গন্ধ পায়?”
-“জানিনে। রান্নাবাড়ায় দোষ নেই। ঘরকন্যায় দোষ নেই।….. সারাদিন খেটেকম্মে ওর গার কোলে গেলেই বমি করে।…. বলে গন্ধ! আমাকে ছুঁলেই নাকি ওর পেটের নাড়ি উল্টে আসে!”
-“তা হবে না! সারাদিন এত্তো এত্তো ফুল আর পরাগ ঘাঁটলে যা হয়! তখন ঘরে এসে কাঁচা রক্ত-মাংসের শরীর ছুঁয়ে গন্ধ একটু লাগে বইকি! আর তা থাকলই বা…!”
-“না না থাকলে চলবে না। আমার গায়ের গন্ধ মুছে দাও শিল্পী। আমাকে দেবী করে দাও। যে হাতে পচা পাঁকের গন্ধ চাপা দিতে পার, সেইহাতে এই কাজটুকু তুমি অবশ্যই পারবে।….তা নাহলে এখানেই আজ দেহ রাখব বলে দিলাম!” পশুপতি থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। বাসনার হাত থেকে কিছুতেই সে নিজেকে ছাড়াতে পারল না। পশুপতির মাটিমাখা দেহে তলপেটে... গণ্ডদেশে.. দাঁড়িতে... ধারালো গোঁফে বাসনা রাক্ষুসীর মতো চুমু খেতে লাগল।
এসময় পশুপতির হঠাৎ মনে পড়ল, পুরাণে একটি কথা কথিত আছে, নিরস্ত্র নারীর বিপক্ষে পুরুষের মোটেই যুদ্ধ চলে না। এতে তাঁদের পৌরুষ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। পশুপতি চিন্তা করল, অতীতের রথীমহারথীগণও মহারথী প্রথাকে অনুসরণ করে এসেছেন। তাহলে পশুপতিও কি এবার বাসনার কাছে নিজেকে সঁপে দেবে? কিন্তু বহুকালের যে জাগ্রত দেবী সাক্ষী আছেন,… তাঁর চোখের সামনে আর একটা দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হোক তিনি কি মেনে নেবেন? বাসনার শরীরের সমস্ত লোমকূপ থেকে অপূর্ব তাজা ফুলের গন্ধ বের হতে লাগল। অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করতে লাগল পশুপতি। হঠাৎ চোখের ওপর আলো এসে পড়ল। কী সর্বনাশ!... এ বাড়ির ছোট জেঠিমা আসছেন। হাতে প্রদীপ। এখন উপায়? হঠাৎ ওর মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। সে তাড়াতাড়ি বালতি ভর্তি মাটির গোলা বাসনার মাথার ওপর ঢেলে দিল।
-“একটু সরে দাঁড়াও বাপু। সন্ধ্যেটা দিয়ে নিই।”
পশুপতি খুলে যাওয়া ধুতির খুঁট এঁটে নিয়ে খানিকটা সরে দাঁড়াল। বাসনাকে আড়াল করতে চেয়েছিল, কিন্তু পুরোটা আড়াল করা গেল না। ছোট জেঠিমার কী জানি কী খটকা লাগতে উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “সন্ধ্যা কতোটা হয়েছে, সে খেয়াল আছে পশুপতি? এই অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে কী করে কাজ করছ?”
-“মা ঠাকরুন, আকাশ কদিন ধরে খুব মেঘলা। মোটে মাটি টানছে না। কাঁচা শরীরে কী করে যে রং চাপাব বুঝতে পারছি নে!”
ছোট জেঠিমা প্রদীপ শিখাটি উঁচু করে ধরতে যাচ্ছিলেন, অমনি পশুপতি বাধা দিয়ে বলল, “ঠাকরুন, দেবীর চক্ষুদানের আগে প্রদীপ দ্যাখানো কি ঠিক হবে?” বলতে বলতে জ্বলন্ত ব্লু বার্নার উঁচিয়ে ধরল। সরু নলের মুখ ঠেলে হুসহুস করে আগুন বেরোতে লাগল। নীল আলোর ধাক্কা খেয়ে প্রদীপটা দপকরে নিভে গেল। হয়ত সে ইচ্ছা করেই প্রদীপটা নিভিয়ে দিল। ছোট জেঠিমা অন্ধকারে বাসনার পায়ে গড় হয়ে প্রণাম করলেন। কাঁচা মূর্তির ধুলো সিঁথিতে ছুঁইয়ে ঘরে গেলেন। এরপর অন্ধকারে বাসনার গায়ের কাদা কাঁচাতে কাঁচাতে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “কী সত্যি সত্যি দেবী হয়ে গেলে কিন্তু!... কী সত্যি বলছি তো?”
বাসনা বাধা দিয়ে বলল, “এ মাটি আর মুছে দিও না শিল্পী। এবার ব্লুবার্নার দিয়ে পুড়িয়ে নাও। রং ঢেলে দাও।… অঙ্গ থেকে এই পাঁক ঘাঁটা কাপড় খসিয়ে দিই। এতে ধবধবে ডাকের সাজ পরিয়ে দাও। ….. আমার চক্ষু দান করো। এরপর আমি যখন ত্রিশূল হাতে মহিষের পিঠে দাঁড়াব, উদয়ভানুকে খবর দিও। সে তার জলাশয় থেকে বোঝা বোঝা পদ্ম এনে আমার পায়ের কাছে ফেলুক। সারাবেলা বসে একটা একটা করে সাজাক। অঞ্জলি দিক। দেখুক আমি ওর মতো কাপুরুষের ঠ্যাকনা ছাড়াই ক্যামন দাঁড়াতে শিখেছি। আমাকে আর একটু জড়িয়ে ধরো। আমার নারী জনম সার্থক হোক!”
-“শুনেছিলাম তুমি ট্যানারির কাজ জানো? কে শিখিয়েছিলেন?”
-“বাবা। উনি ভালো ঢাক বানাতেন। নন্দদা বাবার শিষ্য।”
এবার পশুপতির হাসিতে মন্দির মুখরিত হয়ে উঠল, “উদয়ভানু যখন এমন অসভ্যতামো করে, তখন ওর ওই মোটা চামড়াটা খুলে এনে দিতে পার? …. দেখতাম ও আদতে কী বলতে চাইছে!” বাসনার মুখে আর কথা নেই। সে তৃষিত নয়নে চেয়ে থাকে পশুপতির মুখের দিকে।
পশুপতি সান্ত্বনা দিল, “শোনো তবে দেবীভাগবতপুরাণের এক মন্দভাগ্য নারীর গল্প বলি। নাম মৎস্যগন্ধা। অপ্সরা আদ্রিকার কন্যা। মাতৃগর্ভ থেকে সেও কিন্তু একবুক আঁশটে গন্ধ নিয়ে জন্মেছিল। কালেকালে সেও কিন্তু ঋষি ভোগ্যা হবার সৌভাগ্য লাভ করেছিল। তবে এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল জানো?”
বাসনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে রইল।
পশুপতি আবার বলতে শুরু করল, “এটা জানতে গেলে সবার আগে তোমাকে আকাশ অন্তরীক্ষ ব্যেপে আগে মায়াজাল বোনা শিখতে হবে। কুহকের কুয়াশায় আগে নিজেকে নিমজ্জিত করতে হবে। ওর মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজ অঙ্গ সঞ্চালন করে দেখে নিতে হবে আদৌ কিছু দেখা যাচ্ছে কি না। তারপর ব্রহ্মকে ডেকে নগ্ন হতে হয়। নচেৎ নয়!”
-“কিন্তু উদয়ভানুর মনে যে পোকা তাকে তাড়াব কীসে ভাস্কর?”
-“চোখ দুটো বন্ধ করো। যা বলছি শোনো। উদয়ভানু তো শিশু!... এবার স্বয়ং ব্রহ্মাও টাল খাবে!”
ধীরে ধীরে দশদিক ব্যেপে কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দেয় যামিনী। মন্দিরের চুড়োয় পেতলের শূন্য কলসীর কানায় টুপটুপ করে দুএক ফোঁটা নিশির পড়তে শুরু করল। দূর থেকে অজানা ব্যাথার মতো ভেসে এল সদ্য ফোটা শিউলির গন্ধ! বাড়িঘরের কথা মনে করে শিল্পী পশুপতি ব্যাকুল হয়ে উঠল।
হোটেলে হোটেলে পাতা সাপ্লাই দেয় উদয়ভানু। ওর পদ্মখেত থেকে মেদিনীপুর স্টেশান অনেকটা দূর। পায়ে হেঁটে স্টেশানে আসে উদয়ভানু। ঠাঠা রোদ ঠেঙিয়ে হোটেল ফুটপাথের গুমটি দোকানগুলোর দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় ওর। এই পাঁকপূর্ণ জলাজমিটুকু ছাড়া কিছুই নেই ওর। আজ গরমও পড়েছে ব্যাপক। আশ্বিনেও এতো গরম আগে কখনো দ্যাখেনি উদয়ভানু। বাড়ি ফিরে উঠোনে এসে দ্যাখে দুয়োরে তালা ঝুলছে। পায়ের শব্দ শুনে নন্দ ঢাকির বউ ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে। উদয়ভানু জিজ্ঞাসা করল, “বৌদি, বাসনা কনে গেছে জানো কিছু?”
-“সকালে তো দেখলাম মন্দিরের চাতালে বসে চুল শুকোচ্ছে। দেখো ভেতরে আছে কিনা।”
উদয়ভানুর বুকের ভেতরটা ধক্‌ করে উঠল, “না না। আজ মন্দিরে কাজ হচ্ছে না তো। আমি ওই পথ হয়েই এলাম। কপাট দেওয়া দেখলাম।”
নন্দর বউ আখার কোলে হেসে লুটিয়ে পড়ে, “আন্দাজ যা করেছি তাই… আমার কথা মিছে না সত্যি, বাসনা তো রোজই এইসময় বেরিয়ে যায়। দেখো গিয়ে এতক্ষণ চক্ষুদান হয়ে গেল বোধহয়!”
পোড়ানো পুতুলের মতো নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসে উদয়ভানুর। মনে মনে অভিমান ঝরে পড়ে খুব,“একটা দিনও কি ঘরে থাকতে নেই? কোথায় যায় তবে বাসনা?” নন্দর বউয়ের কথায় নিমপাতা মেশানো আছে বটে, কিন্তু বাসনা কোথায় যায় সেটা তো একবার জানা দরকার। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর নন্দর বউয়ের কথামত মন্দিরের দরজায় উঁকি দিতে ইচ্ছে হল না উদয়ভানুর। পাশের পুকুর থেকে হুপাহুপ দুটো ডুব দিয়ে জামাকাপড় পাল্টে হন্তদন্ত হয়ে লাইনপাড়ে জলার দিকে ছুটল। কেননা ঠিক এইসময়, অর্থাৎ গোধূলির আলো যখন পশ্চিমদিদন্ত থেকে সরু সরু সোনার কাঠি হয়ে তার পদ্মবনে ঠিকরে পড়ে, তখন অচেনা অজানা এক বিদেশিনী এসে নামে সেই জলাশয়ের ধারে। এক একদিন এক এক রূপে আসে। কোনও দিন ডিঙিতে বসে টাল খায়, কোনও দিন বা কালো জলে লালটুকটুকে পায়ের পাতা ডুবিয়ে বসে থাকে। কখনও বেণী খুলে চুল ভেজায়। এক একসময় জল ছেটায়। সময় সময় আবার টুঙিতে উঠে দুহাত বাড়িয়ে আকাশকে ধরার ছল করে। খেয়াল চাপলে ডিঙিটার খোলে শুয়ে গড়াগড়ি খায়। আর উদয়ভানু তখন ওর মর্জি মতন একটার পর একটা কুঁড়ি তুলে এনে ওর পায়ের কাছে রাখে। উপহার দেয়। দুএকদিন সাথে পুরুষ সঙ্গীও আনে। লোকটি শ্যুটিং ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘোরে। উদয়ভানুর চোখ মোটামোটা হয়ে আসে। মনেমনে ভাবে, নিশ্চয় মেয়েটি উর্বশীর দেশ থেকে এসেছে। তা না হলে এক অঙ্গে এত রূপ আদৌ কি কোনও মর্ত চারিণীর হতে পারে?... বাপরে বাপ! চাহনিতে একেকদিন এমন এমন ঢেউ ওঠে.. ..বাড়ুজ্জে বাবুদের সাতখানা দিঘি সমান জলের গভীরতা একত্র করলেও যার সমান হয় না! অঙ্গের পোশাক যেন তুঁতপোকারা নিজেরাই এইমাত্র বুনে রেখে গেল.. এমনই পাতলা। ঠোঁটের নিচে লাল তিল। অধরে সন্ন্যাসিনীর হাসি। কোমর যেন গুপ্তযুগের একখানি শাণিত তরবারি। আর চলন?... মিশরের রাজপথে ইদানীং যে সকল অপরূপা মেয়েরা হাতে খঞ্জনী আর মুখে কৃষ্ণনাম নিয়ে নাচতে নাচতে পৃথিবীর ধনকুবেরদের মুখের ওপর যেভাবে উপেক্ষার উত্তরীয় উড়াতে থাকে… ঠিক সেইরকম। কিন্তু আজ উদয়ভানু তার জলাজমির ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর বুকের ভেতরটা দুমড়ে উঠল। দেখল একটা সাদাঘোড়া একা একাই চরে বেড়াচ্ছে ডাঙা বরাবর। লগিটা নিয়ে ঝপকরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডুবিয়ে রাখা টিনের ডিঙিটা পায়ের আন্দাজে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোত্থাও পেল না। হঠাৎ দেখল অনেকটা দূরে উঁচু উঁচু পাতার আড়ালে তার ডিঙিটা ভাসছে। উদয়ভানু বুনো মহিষের মতো জল শ্যাওলা ঠেলে ডিঙিটার কাছে ছুটে গেল। দেখল ওর খোলে পাঁকের পলি তুলে ভিজে গায়ে বসে আছে মৃৎশিল্পী পশুপতি। মুহূর্তের মধ্যে মাথায় খুন চেপে গেল উদয়ভানুর। সে ডিঙিটা সুদ্ধ ওকে পাঁকের মধ্যে পুঁতে ফেলতে চেষ্টা করল। দুই মরদের লড়াই লেগে গেল। মুহূর্তে সবুজ পাতা থেঁতো হয়ে জল আর কাঁদার রং কালচে সবুজ হয়ে উঠল। একসময় পশুপতির মুঠো আলগা হয়ে এল। সে নিজেকে এলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল, “তোমার বাসনাকে সেই যে সেদিন দেবী বানিয়ে দিলাম, মন্দিরে আর আমার মাটির কাজ দেখতে আসে না। একদিন ঘুমের মধ্যে দেখলাম তোমার বাসনা দশ-অবতারিনী রূপ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই পদ্মবনে। দেখব বলে ছুট্টে এলাম। এসে দেখি তোমারই মতো একজন ঘোড়ার পিঠে বসে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাকে ডেকে বলল, ‘কাকে খুঁজছেন?.. এই মেয়েলোকটাকে নিশ্চয়?’ কাঁচের ওপর চোখ রেখে দেখলাম বাসনা। কিন্তু সে কী মোহিনী রূপ! যেন শতদলে বিভাজিত। আমি জানতে চাইলাম কোথায় বাসনা? লোকটি জলের পাঁকের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা টুঙিটার দিকে নির্দেশ করল। আমি জলে ঝাঁপ দিতেই লোকটিও ঘোড়া ফেলে কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল! … ঘোড়ার পিঠে কে ছিল?... তুমি না?”
উদয়ভানু থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল, “সত্যি করে বলো আমার বাসনা কোথায়?”
পশুপতি আবারো বলতে চেষ্টা করল, “বিশ্বাস হচ্ছে না তো? অবিকল তোমার মতো দেখতে! বিশ্বাস না হলে ওই ঘোড়াটা আটকাও। যাও ওর জিনে ক্যামেরা বাঁধা আছে। … পালিয়ে গেলে পস্তাতে হবে বলে দিলাম।”
বাসনার ব্যাথায় উদয়ভানুর বুকের মধ্যে হুহু করে উঠল। একবার গলা ফেড়ে ‘বাসনাআআআআআআ’ বলে ডাকল। কোনও সাড়া এল না। বহুবার ডাকল। ডাক একসময় প্রতিধ্বনিত হতে হতে পাতায় পাতায় আন্দোলিত হয়ে ঝড় উঠল। জলের ওপর ন্যাড়াবোচা টুঙিটার ওপর উঠে খুঁজবার চেষ্টা করল। কিন্তু সত্যি সত্যি আজ বাসনাশূন্য জগৎসংসার! এবার ওখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে ঘোড়াটাকে ধরবার জন্যে বুক দিয়ে জল ঠেলে এগোতে লাগল।… ‘দেবী হয়ে কোথায় গেল উদয়ভানুর বাসনা? ...শহরে? ...বাবুদের মন্দিরে? ...নন্দর সাথে শেয়ালদার ফুটপাথে?... কোথায় গেল সে?’ এবারও কোনও উত্তর এল না!
এমনসময় ওই লাইনে সবুজ পতাকার সংকেতে দূরে একটা দূরপাল্লার ট্রেনের হর্ন বেজে উঠল। ওর ওই দানবীয় হর্ন কানে যেতেই ঘোড়াটি লেজ উঁচিয়ে জোর ছুট লাগাল। মাঠ পেরিয়ে জনপদ পেরিয়ে ট্রেনটি আজ আলেয়ার মতো কোথায় যে কোন সর্বনাশের শহরের দিকে ঘোড়াটাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে,… তা কেউই বলতে পারে না। এখন পাথরের ওপর পদ্ম ফোটাতে ফোটাতে ছুটে চলেছে উদয়ভানু। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত গভীর হয়। খালি কামরাগুলো থেকে ঢুপঢাপ আওয়াজ ভেসে আসে। সবকিছুই নেশার মতো শোনে উদয়ভানু। সে আরও জোরে ছুট লাগায়। খানিক খানিক থমকে দাঁড়ায়। কান খাড়া করে শুনে নেয়, ‘নন্দর ঢাকের আওয়াজ না?... হ্যাঁ তো ঘোড়ার গলায় বাঁধা ঘণ্টিটাও বাসনার ঘুঙুরের মতো শোনাচ্ছে না?’ আর একটু গেলেই বাবুদের বাড়ির সিংদরজা দেখতে পাবে সে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)