পারমিতা চক্রবর্ত্তী

মায়াজম
0
জোকার



#The astonishing courage of one of the ladies, Miss Sushila makes the spectators sit spell bound when she enters with easy grace a cage of two large tigers and makes them all growling, display their open jaws, stand up, sit and lie down, while she reclines by their side using one of them for a pillow… Daily Telegraph,1901
"সার্কাস " ইংরেজি শব্দ। ১৪শ’ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রথম এর ব্যবহার হয়। আবার এই ইংরেজি ‘সার্কাস’ আসলে ল্যাটিন Circus থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই ল্যাটিন শব্দটি আবার গ্রীক শব্দ Kirkos থেকে এসেছে, যার মানে একটা গোলাকার ক্রীড়াচক্র, যাকে ঘিরে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা থাকবে। সার্কাস মূলত একদল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম দ্বারা নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলে এবং নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের দিন তাদের দক্ষতা জাহির করে।
সার্কাসের ইতিহাস ও কিন্তু বেশ পুরনো। বহু প্রাচীন কাল থেকে রোম, মিশর ও গ্রিসের বিভিন্ন শহরে সার্কাসের খেলা দেখানো হত। তখন যদিও একে সার্কাস বলা হতো না ৷তবে মূল বিষয় ছিল একই। সেই সময়কার সার্কাস এখনকার মতো এত আড়ম্বড়পূর্ণ ছিল না।খুব সাধারণ ভাবে হত ৷
সম্রাট জুলিয়াস সিজার এর আমলে রোমে প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে সার্কাস প্রদর্শন করা শুরু হয়। আর এই সার্কাস পরিচালনা করে তখনকার বৃহত্তম সার্কাস দল ‘ম্যাক্সিমাস’। দুই লক্ষের বেশি লোকের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন চত্বর পাথর দিয়ে ঘেরাও করে নির্মাণ করা হয় সার্কাসের প্রাঙ্গণ। এরপর থেকে সার্কাসের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে আঞ্চলিক মেলাগুলোতেও সার্কাস প্রদর্শনী শুরু হয়। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সার্কাস সকল দেশগুলোতে ৷
১৮৭২ সালে ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ঐতিহাসিক বাড়িতে নবগোপাল মিত্রের জাতীয় সভার আয়োজন হয়। তিনি ন্যাশনাল পেপার,ন্যাশনাল সোসাইটি, ন্যাশনাল স্কুলের সঙ্গে তৈরি করেন প্রথম বাঙালী সার্কাস – ন্যাশনাল সার্কাস।১৮৮১ সালে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে তৈরি হয় ভারতের দ্বিতীয় সার্কাস। (মহারাষ্ট্র – সাংগলিতে ১৮৮০ সালে প্রথম সার্কাস তৈরি করেন চাত্রে) পরিকল্পনা ও অর্থের অভাবে সে উদ্যোগ অচিরেই শেষ হয় বটে কিন্তু বীজটা রয়ে যায়৷ সেই বীজ মহীরুহের আকার নেয় প্রিয়নাথ বসুর হাত ধরে৷ ১৮৮৭-তে মৃতপ্রায় ন্যাশনাল সাকার্সের জিনিসপত্র ও জন্ত্ত-জানোয়ার কিনে নেন প্রিয়নাথ বসু৷ শুরু করেন গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। এর মধ্যে গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস বলে আর একটি সার্কাস তৈরি হয় ।রাজা রামমোহন রায়ের পৌত্র হরিমোহন রায় গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস পরে কিনে নেন এবং এই দল ”প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস ১৮৮৭ থেকে ১৯২০খ্রিস্টাব্দ অবধি খেলা দেখিয়েছিল । প্রফেসর বোস ছিলেন প্রথম বাঙালী যিনি পিরামিড অ্যাক্ট, জাগলিং অ্যাক্ট, প্যারালাল বার, হরাইজন্টাল বার, ও ঘোড়ায় চড়া খেলায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন । তাঁর সার্কাসে বাঙালি পরিচালক, ক্রীড়াবিদ, অশ্বারোহী, পশু-শিক্ষক এবং বাঙালী মেয়েরা ঘোড়ায় চড়া, বাঘের খেলা, ট্র্যাপিজের খেলা দেখান শুরু করেন । ভারতের প্রথম মহিলা সার্কাস খেলোয়াড় সুশীলা সুন্দরী এবং তাঁর বোন কুমুদিনী ৷ এই সার্কাসে তারা খেলা দেখাতেন ৷ বাঙালী মেয়ে মৃণ্ময়ী হাতির পিঠে বসে বাঘের খেলা দেখাতেন। হরিমোহনের দল ” হিসাবে খেলা দেখান হত।
সার্কাসের সাথে জড়িত সকল কলাকুশলীরা একে একে বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে ৷ সকল বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা মানুষ নিযুক্ত হন ৷ যেমন - কেউ বাঘের খেলা দেখায় ,কেউ রিং মাস্টার ,কেউ জিমনাস্টিক , কেউ আগুনের খেলা দেখায় ৷ সার্কাসে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা যার, সে হল - জোকার ৷ সার্কাসের প্রথম থেকে শেষ অবধি তার অবাধ বিচরণ ৷ আমরা সার্কাস দেখতে যাবো ভাবি টাকা দিয়ে টিকিট কেটে তার মূল লক্ষ্যই থাকে বিনোদন ৷ ব্যস্ততম সময়ে নিজেকে কিছুটা হাল্কা করা ৷ সেই কাজটির মূলত কান্ডারী জোকার ৷মুখে রঙ ,চঙ মেখে আমাদের হাঁসিয়ে চলে সময়টুকু৷ আমরা ভেসে যাই ৷এখানে নেই কোন বয়সের বিধিনিষেধ ৷ ছোট থেকে বড় সবাই একসাথে হেসে চলে ৷জোকারের আকৃতির বিশ্লেষণ করলে তাহলে দেখা যাবে , তাকে দেখতে আর পাঁচটা সাধারণের মত নয় ৷ কিছুটা ছোট আকৃতির কিংবা চ্যাপ্টা নাক ৷ চলায় ফেরায় একটা হাস্যকৌতূক ভাব ৷এই ভাবকে জিইয়ে রাখতে তাদেরকে অনেকটা চোখের জলও লুকিয়ে রাখতে হয় ৷ সার্কাস কোম্পানীগুলি অন্য সকল কর্মীদের পিছনে যে অর্থ ,সময় ব্যয় করে তার কখনই করে না জোকারদের ক্ষেত্রে ৷ অথচ এরা সার্কাসের মূল স্তম্ভ ৷ এদের সব ধরনের খেলা শিখে রাখতে হয় ৷ আর এই খেলা দেখানোর মধ্যেও থাকে অসম্ভব হাস্যকৌতূক ৷
জোকারের পোশাক আশাকও হয় বিচিত্র ৷ দেখলেই আমদের হাঁসতে ইচছা করে ৷ সব রকমের কাপড় মিলে জোড়াতালি দিয়ে তৈরী করে ৷ সার্কাস মানেই একটা চাকচিক্ক ব্যপার ৷সকলের পোশাক একটা আলাদা মাত্রা বহন করে ৷সেখানে সব থেকে আলাদা জোকারের পোশাক ৷সব রঙ শুধু কাপড়ে নয় মুখেও থাকে l
প্রকৃত অর্থে সার্কাসে জোকারের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮০৫ সালে। সার্কাসের ইতিহাসে প্রথম জোকার হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ব্রিটিশ অভিনেতা জোসেফ গ্রিমালদির নাম৷। আর ট্রাপিজের খেলার জন্মদাতা বলা হয় ফরাসি অ্যাক্রোব্যাট জুলস লিওটার্ডকে।





খোলা মাঠে সার্কাস চলে এসেছে বিনোদনেও ৷থিয়েট্রিক্যাল উপস্থাপনা, শারীরিক কসরত, অভিনয়, ভাঁড়ামো, স্যাটায়ার, মিউজিক, ব্যালে, ভেলকি, স্টান্ট—এসব মিলিয়ে সার্কাসের আয়োজনের পরিধি অনেক ব্যাপক ৷তাই বিনোদনের এই জগৎ স্বাভাবিকভাবেই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হয়ে উঠেছে ফিল্ম ন্যারেটিভের আধার। কিংবা বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে সিনে-ন্যারেটিভ এগিয়েছে সার্কাসের হাসিকান্না-হীরাপান্নার মায়াজগৎকে কেন্দ্র করেই। ১৯২৮ সালে চার্লি চ্যাপলিনের নির্দেশনায় তৈরি হয় ‘দ্য সার্কাস’ ছবিটি। সাইলেন্ট এই ছবির কাহিনি ও চিত্রনাট্য চ্যাপলিনেরই। মুখ্য চরিত্রে ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ইতালিয়ান পরিচালক ফেদিরিকো ফেলিনি তৈরি করেন ‘লা স্ত্রাদা’ নামক ক্ল্যাসিক সিনেমাটি। এই ছবির ন্যারেটিভের আধার হয়ে ওঠে সার্কাস। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি হয় জর্জেই আলেকজান্দ্রভ ও ইসিদোর সিমকভ নির্দেশিত এক্সেন্ট্রিক কমেডি ফিল্ম ‘সার্কাস’। চ্যাপলিনের ছবি ছাড়াও হলিউডে সার্কাসের ওপর নির্মিত সিনেমার সংখ্যা প্রচুর। চ্যাপলিনকে দেখে হাঁসে নি এমন মানুষ সারা পৃথিবীতে নেই ৷ সার্কাসের এই চরিত্রকে রূপায়ন দিয়েছে তাই চলচ্চিত্র নির্মাতারা ।
বাংলাতে এমন চরিত্র এবং কাহিনী আছে ৷ যেমন
গুপী গাইন বাঘা বাইন”, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচিত । গল্পের দুই নায়ক গুপী ও বাঘা সঙ্গীতের অনুরক্ত, অথচ সাংগীতিক প্রতিভাহীন। এই কারণে গুপীর গ্রাম আমলকী ও বাঘার গ্রাম হরতুকী থেকে তারা বিতাড়িত হয় এবং পরে তারা ভূতের রাজা দেওয়া বর পেয়ে সঙ্গীত প্রতিভা দিয়েই সকলকে জয় করেন। সত্যজিৎ রায় " গুপী বাইন ,বাঘাবাইন " এই চরিত্রদুটো হাস্যকৌতূক এবং শিক্ষামূলক করে তুলেছিলেন ৷ সিনেমায় গুপি ও বাঘার চরিত্রায়ণ ,জামাকাপড় সব কিছুর মধ্যে রয়েছে ব্যঙ্গমূলক I সেখানেও কিন্তু জোকার চরিত্রটিকে সুন্দর, সুচারু ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ৷
পরিষেশে বিনষ্ট হতে বসেছে এই শিল্প ৷ বহু জোকার খেতে পাচ্ছে না , কাজ পাচ্ছে না ৷ এর কারণ কিছুটা হলেও আমরা ৷আমরা এই সংস্কৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি নি ৷ এত সুন্দর একটা বিনোদন মূলক সংস্থান উঠে যেতে বসেছে ৷শীতকালে তেমন ভাবে সার্কাস আসে না আর I নেই কোন খোলা প্রাঙ্গণ ৷ নেই হাসির খোরাক ৷
তর্থসূত্র - অন্তর্জাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)