কয়েকটি সার্কাস
-
জেমিনী সার্কাস
১।
এত কাছাকাছি যে পশুপাখির দাঁত, নখ, মাংস ইত্যাদি থাকবে, তা তুমি বোঝ নি। নিটোল একটা প্রেমের গল্প মিস করে আমরা ভ্যানিলা আইসক্রিম খেতে খেতে ঢুকে গিয়েছি তাঁবুর ভেতরে। রিংমাস্টার অগোছালো। ইনি পূর্বজন্মে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পিনোজার দৃষ্টিসৃষ্টিবাদ পড়াতেন। একটি হিংস্র পশু আইন-অমান্য করে আমাদের গোঁড়ালির হাড় কামড়ে ধরতেই তিনি অদৃশ্য হলেন। আমাদের রঙ বদলে দিলেন মঞ্চের আলোকশিল্পী।
২।
আকাশের মিথুনরাশি থেকে পোলাক্স আর ক্যাস্টর নেমে এলেন তোমার নাভিতে। সার্কাসের শাদা ঘোড়া চমকে উঠল। ইলেকট্রিক হার্পের তীব্র শব্দ থেকে সুর বাছতে বাছতে আমি একটু একটু করে পাগল হয়ে গেলাম দৃশ্যকাব্যের উপরিপাতে। একটু পরে রিংমাস্টার দৃশ্যমান হলেন। তখন আমাদের খিদের ওপর এসে বসেছে একাধিক রঙবেরঙয়ের পাখি। চারপাশে নরম হয়ে উঠেছে অন্ধকার।
৩।
অন্যান্য প্রাণীরা আমাদের খিদের অর্থ বোঝে নি। জ্বলন্ত রিং-এর ভেতর থেকে আমাদের একের পর এক প্রতিবিম্ব ছিঁড়ে ফেলল ওদের খিদে। অবশিষ্ট তৃষ্ণাটুকু নিয়ে আমরা তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেখানে তখন তীব্র বৃষ্টির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা ছুটতে শুরু করলাম অন্য এক ছায়াপথের মৌনতার ভিতরে। সে ছায়াপথের নক্ষত্রেরা মরে গিয়েছে বহুকাল আগে।
৪।
স্বপ্ন ভাঙার পরে আমি তোমার অসুখ থেকে সেই মৃত সার্কাসের তাঁবু খুলে ফেলি। ঠান্ডা অশ্ব, হস্তী, শ্বাপদের কঙ্কাল অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমাদের দিকে। সেই রিংমাস্টার পরজন্মে হাসপাতালের গাইনোকলজিস্ট হয়েছেন। শব্দোত্তর ছবির প্লেট দেখতে দেখতে তিনি পাগলের মত হাসতে থাকেন। আমরা রঙ বদলে নতুন সার্কাসের টিকিট কেটে নিই।
স্করপিও সার্কাস
১।
আকাশে তার নাম বদলানোর আগেই আমরা তাঁবুতে ঢুকে পড়ি। বৃশ্চিকের বিষ আমাদের জিজ্ঞাসা করে, কোন খেলায় আমরা আগ্রহী? আমাদের নতুন রিংমাস্টার পূর্বজন্মে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আমরা বাধ্য হয়ে মৃত পশুর আড়ালে লুকোচুরি খেলি। আমাদের খিদে হঠাৎ করে কমে যায়। বৃষ্টি নামে অসময়ে।
২।
উপকথায় ততক্ষণে কালপুরুষের শিরদাঁড়ায় বিষ ঢেলে দিয়েছে স্করপিও। আমরা চোখ বন্ধ করে আছি। একে একে সরে যাচ্ছে স্মৃতিহীন কোষপর্দা, আলো-ছায়া-পথ ও পাথেয়। খেলা দেখাতে দেখাতে চরম ক্লান্ত হয়ে মৃত্যুভিক্ষা চাইছে কালপুরুষের কুকুর। আমরা চোখ খুলে দেখছি, আমাদের সুখ ও অসুখ সেরে গিয়েছে।
৩।
শাদা কবুতর ঢুকে পড়েছে উদাসীনতার ভেতরে। ম্যাজিকের চরম শূন্যতার মধ্যে তুমি-আমি ঘুরেই চলেছি। ক্যালাইডোস্কোপের রঙিন কাঁচের টুকরোর মত নিজেই বিন্যাস পাল্টাচ্ছে খিদে। আমাদের দেখছে না। স্মৃতিহীন এক অধিকারবোধ অগণন কবুতরের চিৎকার ভরতে ভরতে বৃত্তাকারে উড়ে যাচ্ছে দৃশ্যের বাইরে। আমরা নতুন ওরিগ্যামি শিখছি।
৪।
দৃশ্যের বাইরে থেকেই রিংমাস্টার আমাদের পুনর্মৃত্যুর ওপর রক্তাক্ত ছুরি রাখেন । প্রেম আস্তে আস্তে ফাঁদ-খাঁচা-সেতু ছেড়ে নেমে আসে। আমাদের খন্ড খন্ড করে ফেলে দেয় সদ্যমৃত পশুর তিরতির করে কেঁপে ওঠা চামড়ার ভিতর। নতুন মাংসের ভেতর অফুরান মাংস কাটে সুখ। ঐশ্বরিক মাছিদের তাড়াতে থাকেন রিংমাস্টার।
অ্যাকুয়ারিয়াস সার্কাস
১।
জলের শব্দটার দিকে স্থির চেয়ে আছে পাখি। পাখির বিফল ডিম চুরি করেছে সাপ। রিংমাস্টার পরজন্মে সর্পবিশারদ হবেন। তার চোখে অদ্ভুত নীল রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছেন গগনেন্দ্রনাথ। তাঁবুর ভেতরে আমাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে। বাইরেও অতল অন্ধকারের নীচে ছটফট করছে দু’টি মহাপ্রাণ শব্দ।
২।
অন্যরকম আলো নড়াচড়া করে জলের ভিতর। ক্ষুধার্ত মাছের শরীর থেকে চমকে ওঠে অন্ধকার। কাঁটা বাছতে বাছতে আমাদের বয়স বেড়ে যায়। তাঁবুর স্বচ্ছতা ভেঙে আবার ভেসে ওঠে অতিকায় সাপের মাথা। বাঁশির সুর কিছুতেই শুনতে পায় না সাপ। আমাদের সামনেই রক্ত চেটে ফিরতে থাকে মৃত্যুগুহায়। দংশনচিহ্ন স্পষ্ট হতে থাকে আমাদের পায়ের পাতায়।
৩।
নিভন্ত সার্কাসের আলোর ভেতর দিয়ে হাঁটছি আমরা। প্রতিরূপে অন্ধ এক যন্ত্রণা আমাদের খুঁজছে। আমাদের ছদ্মবেশের কাছে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছেন রিংমাস্টার। চোখের ভেতরে চোখ ভয় লুকোচ্ছে। তুমি আবার মেক-আপ বক্স খুলেছো। তার ক্ষুধার্ত আয়নায় দুলছে সংসার, তোমার শরীর ও আমার ইতিহাস।
৪।
ইতিহাসের তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমরা হঠাৎ এসে পড়লাম অ্যানিমেশনের জগতে। সব আলো আমাদের দেখে হাসল। সব শব্দের প্রতিধ্বনি হল। অন্য এক ছায়াপথের শূন্যতা কেঁপে উঠল বৃদ্ধ রিংমাস্টারের কাশিতে ‘আজকাল আর কেউ কাজ দেয় না’।
সুচিন্তিত মতামত দিন