জয়তী অধিকারী - মায়াজম

Breaking

১৭ এপ্রি, ২০২০

জয়তী অধিকারী

দামিনী






প্রতি বছর শীত আসার আগেই এসে পড়ে ওরা। বিয়ের পর থেকে পাঁচ বছর ধরে রিস্মিতা দেখে আসছে। প্রথমে বাঁশ, ত্রিপল, লোহার রেলিংগুলো আসে। তারপর সবকিছু তৈরী হয়ে গেলে একদিন বড় বড় লরিতে করে নিয়ে আসে জীবজন্তুগুলোকে। প্রথমদিকে রিস্মিতার খুব কষ্ট হত। আহা রে! কত কষ্টই না হয় ওদের! মনে পড়ত নিজের পোষা পমেডিয়ান, রুশির কথা। বিয়ের আগেরদিন পর্যন্ত ওর কোলের কাছেই তো শুয়ে ঘুমোত রুশি। রিস্মিতার খুব ইচ্ছে ছিল ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসে এ’বাড়িতে। কিন্তু শ্বাম্ব’র প্রবল আপত্তিতে সেটা আর হয়ে উঠল না। ওদের বাড়িতে সারাক্ষণই ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে যেন একটা প্রবল প্রহসন চলতে থাকে।
অষ্টমঙ্গলায় গিয়ে রিস্মিতা শাম্ব’র গায়ের কাছে ঘন হয়ে বসে যখন আদর খাচ্ছিল, শাম্বর রোমশ বুকে নাক ঘষতে ঘষতে বলেছিল, “অ্যাই, শোনো না। এবার যাওয়ার সময় রুশিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাব?”
মুহূর্তের মধ্যে শাম্ব’র বদলে যাওয়া রূপ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল রিস্মিতা। পারলে সে যেন রিস্মিতাকেই তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে!
“নিয়ে যাবে মানে? কোথায় নিয়ে যাবে?”
রিস্মিতা অবাক চোখে শাম্ব’র দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমাদের বাড়ি। দেখো না, আমাকে ছেড়ে থেকে বেচারা এই ক’দিনেই কেমন রোগা হয়ে গেছে”।
উত্তরে শাম্ব’র কিছু নোংরা কটুক্তি আর ততোধিক কদর্য ইঙ্গিতে রিস্মিতা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এই মানুষটার সঙ্গেই তাকে সারাটা জীবন কাটাতে হবে! এত নোংরা মানসিকতা একটা শিক্ষিত মানুষের হতে পারে! চোখের জল মুছতে মুছতে বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল সে। মা-বাবার সামনে গেলে দু’মিনিটেই ধরা পড়ে যেত না হলে। আর মায়ের প্রশ্নের মুখে কোনদিনই কি সত্য গোপন করতে পেরেছে সে!
“ভালো আছেন ম্যাডাম?”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সার্কাসের তাঁবুর মাথায় আলো লাগানোর দিকে তাকিয়ে ছিল বটে, কিন্তু মন যেন অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল রিস্মিতার। নীচ থেকে ছেলেটার গলার আওয়াজে চমকে তাকালো সে। আরে! এই ছেলেটা তো গত বছরও এসেছিল। রিস্মিতার খুব ভালো মনে আছে। তাঁবুর এই দিকটায় সার্কাসের জন্তুদের খাঁচাগুলো থাকে। রিস্মিতার খুব ভালো লাগত জলহস্তী’র খাওয়া দেখতে। বিশাল হাঁ-মুখে ছুঁড়ে দেওয়া বাঁধাকপিগুলো নিমেষে খেয়ে ফেলত। ভয়ে ভয়েই দেখত কেমনভাবে ছেলেটা বাঘকে মাংস খাওয়াচ্ছে। একদিন বাঘটা খাঁচার কোণে বসে ছিল। কিছুতেই খাচ্ছিল না। এই ছেলেটাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে মুখের কাছে মাংস তুলে ধরছিল। রিস্মিতা অবাক হয়ে দেখছিল। হঠাৎ তার দিকে ছেলেটার চোখ পড়তে একটু হেসে হাত নেড়েছিল।
“আজ ও খুব মার খেয়েছে। তাই রাগ হয়েছে বিবির। খাচ্ছে না”
রিস্মিতা আর থাকতে না পেরে বলেছিল, “আপনার ভয় লাগছে না? যদি আরও রেগে গিয়ে আপনার উপর হামলা করে?”
ছেলেটা আবার হেসে বলেছিল, “করবে না। জন্তুরাও জানে কে ভালোবাসে, কে খেতে দেয়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা ম্যাডাম!”
রিস্মিতা ভেবেছিল, ছেলেটা নিজেও জানে না কত দামী একটা কথা সে অবলীলায় বলে দিল।
এখন ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসল রিস্মিতা, “হ্যাঁ। আপনি ভালো আছেন? আর আপনার দামিনী?”
“ভালো আছে। একদিন আসবেন সার্কাস দেখতে। দামিনী খুব ভালো খেলা দেখাতে শিখেছে”
ঘাড় হেলিয়ে একটু হেসে রিস্মিতা ঘরে ঢুকে এসেছিল।
ছেলেটাকে খুব অন্যরকম লেগেছিল তার। দেখে মনে হয় ভদ্রঘরের শিক্ষিত ছেলে। কিন্তু সার্কাসে কেন? সেটা আর জানা হয়নি রিস্মিতার।
“মা, আমরা একদিন সার্কাস দেখতে যেতে পারি?”
খাওয়ার টেবিলে রিস্মিতার কথা শুনে হেসে উঠেছিলেন তার শাশুড়ি।
“কচি খুকী নাকি! নাতি-নাতনী হলে তাদের নিয়ে যাব’খন”
শ্বশুরের সামনে লজ্জায় মুখ নামিয়ে কোনরকমে খেয়ে উঠে গিয়েছিল সে। ভাগ্যিস দুপুরবেলা কথা হল! রাত্রে হলে তো শাম্বও থাকত। এমনিতেই সে জানে আড়ালে শাশুড়ি ছেলেকে বলে, “হ্যাঁ রে খোকা, বউটা বাঁজা নাকি রে?”
শাম্ব কয়েকদিনের জন্য অফিস ট্যুরে গেছে বলে রিস্মিতাও বাপের বাড়ি যেতে চেয়েছিল। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। এ’যেন সার্কাসের ওই বাঘিনীটার মতই কয়েদ হয়ে থাকা! তার যদিও পেটের দায়ে থাকা নয়, কিন্তু বাবা-মায়ের সম্মান বাঁচানোর জন্য থাকা।
শাম্ব না থাকলে রিস্মিতা অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়ে। অন্য সময় তো আলো জ্বেলে বই পড়াও যায় না। আজও বই পড়তে পড়তে একটা ঠং করে আওয়াজ হতেই চমকে উঠল রিস্মিতা। প্রথমেই তার মাথায় এল বাড়িতে চোর ঢুকেছে। কিন্তু এত রাতে ভাল করে না দেখে চিৎকার করাটা বুদ্ধির কাজ হবে না। সেটা বুঝেই রিস্মিতা পা টিপে টিপে বারান্দায় গেল। সার্কাসের তাঁবুর মাথায় লাগানো এলইডিগুলো নেভানো বলে চারপাশ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু নীচে খসখস শব্দ হতেই রিস্মিতা রেলিং থেকে একটু ঝুঁকে মুখটা বাড়ালো।
সেই ছেলেটা এত রাতে দামিনীর খাঁচায় কেন? খুব অবাক হল রিস্মিতা। থামের আড়ালে সরে গিয়ে দেখতে লাগল সে। প্রত্যেকটা জন্তুর খাঁচাতেই একটা করে বাল্ব জ্বালানো থাকে। খুব উজ্জ্বল নয়, কিন্তু হলদেটে আলোয় চারপাশ পরিষ্কার দেখা যায়।
ছেলেটা দামিনীর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরল। তারপর ওকে বসার ইঙ্গিত করতেই দামিনী বাধ্য মেয়ের মত বসে পড়ল। ছেলেটা খাঁচার দরজার দিকে আসতে আসতে বার দুয়েক তাকালো দামিনীর দিকে। তারপর মাথা নীচু করে বেরিয়ে এসে খাঁচার দরজাটা বন্ধ করতে যেতেই দেখে দামিনী দরজা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে।
রিস্মিতাকে যেন কোন অশরীরী আত্মা ভর করেছে। সে সদর দরজা খুলে বাগানের পেছন দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো দামিনীর খাঁচার কাছে।
“এ’সব কী হচ্ছে?”
রিস্মিতার গলা শুনে চমকে উঠল ছেলেটা। তখনও দামিনীর একটা থাবা তার বুকের উপর রাখা।
“আমাকে আজ বরখাস্ত করেছে মালিক। তাই এখন যাওয়ার আগে দামিনীর সাথে একবার…”
রিস্মিতা অবাক হয়ে গেল। প্রিয় পোষ্যকে ছেড়ে আসার ব্যথা সে খুব ভালোই বোঝে। তাও ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল, “বরখাস্ত করল কেন?”
“দামিনীর জন্যই। আজও রিং-মাস্টার ওকে নতুন খেলা শেখানোর জন্য ইলেকট্রিক শক্‌ দিচ্ছিল। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। তার জন্য আমাকেও কয়েক ঘা খেতে হয়েছে। কিন্তু আমার তাতে দুঃখ নেই। এই হতচ্ছাড়ীকে ছেড়ে যেতেই কষ্ট হচ্ছে”।
রিস্মিতা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বলে উঠল, “ওকে নিয়ে চলে গেলেই তো পারো!”
চমকে উঠল ছেলেটা।
“মফঃস্বল হলেও ওকে নিয়ে আমি বেরিয়ে যেতে পারব না তো। দু’জনেই ধরা পড়ব। আমার জেল হবে চুরির দায়ে আর দামিনীর উপর হয়ত আরও অত্যাচার হবে”।
রিস্মিতা একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কী ভাবে ছেলেটা দামিনীকে আদর করে আবার খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর একবার রিস্মিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসি। আর কোনদিন দেখা হবে না। আপনিও ভালো থাকবেন”।
ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে ছেলেটার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে রিস্মিতার খুব ইচ্ছে করছিল ওর সাথেই সেও নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু মুক্তি বোধহয় সবার কপালে লেখা থাকে না। তার কপালেও নেই, দামিনীর কপালেও নেই। মুখ বুঁজে অত্যাচার আর অপমান স’য়ে যাওয়াই তাদের ভবিতব্য। হয়ত কোন একদিন দামিনীও হুংকার ছাড়বে, হিংস্র দাঁত বসিয়ে দেবে রিং-মাস্টারের চাবুক ধরা হাতে। হয়ত কখনও রিস্মিতার মতই রাতের অন্ধকারে চোখের জল ফেলবে খাঁচার ঘেরাটোপে। কিন্তু একবার অন্তত হাসবে দিনের শেষে। ভাগ্যিস সে বাঁজা! না হলে পৃথিবীর বুকে আরও একটা স্বার্থপর বংশ আরও কয়েক পুরুষ শারীরিক বা মানসিকভাবে বধূ-নির্যাতন করে চলত।
চোখের জলে বালিশ ভেজাতে ভেজাতে রিস্মিতা অস্ফুটে বলে উঠল, “অ্যাই ছেলে! একদিন ফিরে এসো প্লিজ। দামিনী তোমার অপেক্ষাতেই থাকবে। মুক্তি দিও তোমার দামিনীকে”।
(শেষ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র