এক "
কালো কফির তলানি, শুঁয়োপোকার পিঠ আর বাবার মুখ যখন একই রঙের হয়ে যায় সোনু বোঝে বাবার আবার দাদার কথা মনে পড়ছে।
আর মায়ের জানালায় যখন কুয়াশা নেই, অথচ মা গীতবিতান খুলে রেখে আঁচলের খুঁট দিয়ে চশমার কাচটা বারবার মুছতে থাকে, সোনু মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, "মা, আমার দাদার কথা বলো। "
মা শিশু ভোলানাথ কতবার পড়েছেন, কতবার কর্ণ কুন্তী সংবাদ চোখের জলে ধুইয়ে দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
সোনু জানে বাবা বা মা যখন তাকে বুকে চেপে ধরে আদর করে, অর্ধেকটা দাদার ভাগের সে পায়।
-----------------------------------------------------------------------
উত্তরের ঘরে নাকি দাদা থাকতো। তিন দেয়াল জুড়ে অজস্র আঁকিবুকি। পাহাড়, ছাগল, ডুবন্ত সূর্য, নীল নদী, ভেড়ার মত থোপা থোপা মেঘ। তাদের মাঝ মাঝেই কোথাও লেখা, "বিসরি অসুরত্রাসে /বিনয়ী অতনুপ্রাসে /স্পাইডারম্যান উড়ি যাও লো "।আবার কোথাও মায়ের কোলে ছেলের মাথায় আলোর গোলা। তার কমলা কমলা রং। বালিশের খোলের ভিতরে কাগজের বুগনভলিয়া।
নীল নাইসিল পাউডারের কৌটোর ভিতর কয়েকশো মার্বেলের বাস। কালো ঢাকনা খুললেই তারা জীবন্ত হয়ে ওঠে। আলো ঝলসে ওঠে রঙের আড়মোড়া ভেঙে। টুংটাং শব্দ হয়। নিটোল গায়ে যেন ওরা সোনুর স্পর্শ পায়।
রঙের কার্ডবোর্ডের বাক্সজুড়ে আধখোলা টিউব থেকে বেরিয়ে আসা রঙে চিত্রবিচিত্র ছোপ। যেন তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য ছবি এঁকেছে। তুলি, গ্রাফাইট পেন্সিলের ডাঁই, আধভাঙা আধখাওয়া রাবার ইরেজারের পলটন।
যত্নসহকারে অযত্নে ছড়ানো ঘরটা সোনুর রঙমহল। এ ঘরে এলে দাদার ছোঁয়া পায় ও।
আর ঘরে কাঠের টেবিলের ওপর রাখা তিনটি স্টীলের নিরেট গোলা। পাশাপাশি একটি ত্রিভুজ সৃষ্টি করে তারা শুয়ে থাকে। অনড়। অচল।
কখনো কখনো উত্তরের জানালা দিয়ে পশ্চিমা দিনান্তের ঘোষক রশ্মি হয়ে তাদের ওপর পড়লে হয়তো ওরা আকাশের স্মৃতিচারণায় ঝলসে ওঠে।
সোনুর মনে নেই দাদার কথা। দাদা তার জন্মের প্রায় পনেরো বছর আগে থেকেই নেই। এগারো বছরে সোনু একবারও দাদার কথা শোনেনি।
কিন্তু মাঝে মাঝেই কফির তলানি আর শুঁয়োপোকার পিঠ একরকম হয় আর মায়ের গীতবিতান ভিজে যায়।
"দুই "
কালো পীচের রাস্তাটা সাঁ করে কালো দেহ নিয়ে চলমান ট্রাকের উল্টোপথে ছুটে পলাশী দেবগ্রাম ছাড়িয়ে চলে যায় বহরমপুরের দিকে।
বাঁপাশের মাঠে সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। লাল বর্ডার দেওয়া সাদা সাটিনের গায়ে সূর্যের আলো তেলতেল করে।
পুরু টিনের সীমানা। কোলাপসেবল্ গেট। টিনের গায়ে গাঢ় নীল রঙের পোঁচ। তার উপর সাইকেলে সায়ামিজ কুকুরের ছবি। তার কাঁধে ম্যাকাও। পালোয়ানের বুকের ওপর রোড ইঞ্জিন।রঙবেরঙের তাপ্পি দেওয়া ঝলমলে পোশাক পরা লালবল নাকে বসানো ক্লাউন।
জমকালো ব্যাপার একটা।
হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হাত মাস্টার ঝিমনের। তাঁবুর পিছনের একটি কুঠুরিতে মুড়ি খেতে খেতে দেখলো একটা ছোট্ট মুখ উঁকি মারছে।
হাত নেড়ে তাকে ডাকলো ঝিমন। ছেলেটারও ভয়ডর নেই একফোঁটা। একদম ঝিমনের পাশে সবুজ ট্রাঙ্কের ওপর বসে পড়লো।
-কি নাম তোর?
-সোনু। স্কুলে বাঁশি ডাকে সবাই। ঠাকুরমাও ...
-আমি মাস্টার ঝিমন। জাগলিং করি..
-তোমার স্কুল নেই..?
-পাগল নাকি? স্কুলে মাস্টারমশাইরা যেসব বই পড়তে বলেন, ও আমার ভালো লাগেনা। স্কুলের নামের খাতায় আমার নামটা কি বিচ্ছিরি শক্ত!
-কি নাম গো?
-আর বলিস না, স্যমন্তক। দন্ত্য স'য় য 'ফলা...দুর্..
-তোমার বলগুলো দেবে আমায়?
-যাঃ, কি করবি তুই ও দিয়ে? দুধ আর আমসত্ব মেখে খা গা।
জিভ ভেংচে দিয়ে সোনু চলে যাচ্ছিল। স্যমন্তক ডাকলো পিছন থেকে,
-সন্ধ্যেবেলায় আসিস। আজ একটা নতুন আইটেম দেখাবো।
-টিকিট পাবো কোথায়?
-আমার নাম করিস। না বুঝলে,তোর স্টিলের বলগুলো দেখাস ঢুকতে দেবে। আমি বলে রাখবো।
-ঝিমনদা, আমি তোমায় দেখেছি কোথায় যেন। আর, তুমি জানলে কি করে আমার স্টিলের বল আছে?
-আরে আন্দাজে বললাম। তুই সিংহ টিংহ বাদ দিয়ে সটান আমার চলে এলি, ভাবলাম তোরও কালেকশন থাকতে পারে। বলছি,একদম কাঁটায় কাঁটায় সাতটা। দেরি করলেই ফাঁক।
তিন "
ঘুরছে ঘুরছে। ঝলসে যাচ্ছে চারটে বল। ঘূর্ণায়মান আলো ঝলসে উঠছে যেন তাদের আরশিদেহে। প্রতিফলিত হচ্ছে কখনও বিস্ময়ে নিঃশব্দ বালকের মুখ। আবার কখনো বা বিস্তৃত এরেনা।
মুহুর্মুহু হাততালি। বাহবা। "সাবাস ","নাজুক ","খলিফা "...বিশেষণের ঝড়।
বলগুলো নামিয়ে রাখলো ঝিমন। এবার ছুরির খেলা। আজকের নতুন সংযোজন।
সাতটা ছুরি একসঙ্গে ওপরে ছুঁড়ে দেবে ঝিমন। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুয়ে পড়বে মাটিতে। ছুরিগুলো অভিকর্ষবর্তী হয়ে নেমে আসবে মাটিতে অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আর...
ম্যানেজার ঘাম মুছতে মুছতে উদ্বিগ্ন মুখে কিছু বললো ঝিমন মাস্টারকে। উচ্চগ্রামে বাজতে থাকা মাইক্রোফোনের আওয়াজে সে কথা চাপা পড়ে গেল।
দ্বিতীয় মঞ্চে তখন সর্বভূকের শো। ক্যাম্বিস জুতো, টেনিস বল, তাঁবু, বার সোপ, -যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে।সঙ্গে চলছে ঘোষকের ধারাবিবরণী,-
"লরি লরি আতিছে /তড়িঘড়ি খাতিছে /চাল চুলা গুষ্টি /হ্যার প্যাটে যাতিছে।"
বিস্ফারিত চোখে শ'দুয়েক লোক চেয়ে আছে দর্শকাসনে। ঝিমন একবার বাও করেই ছুরিগুলো ছুঁড়ে দিল ওপরে।
সামনের সারিতে বসে থাকা সোনু চোখ বুজে ফেললো।
হাততালি আর তুমুল বাহবার উল্লাসে পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। সোনু চোখ খুললো। ঝিমন মাস্টার তিনদিকে অভিবাদন করতে করতে পিছিয়ে পর্দার পিছনে চলে গেল।
---------------------------------------------------
নিজের কুঠুরির পর্দা সরিয়ে ঢুকতে গিয়ে ঝিমন টের পেলো পিছনে লঘু পায়ে কেউ আসছে। সজাগ চামড়া দিয়ে কিছু বুঝে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-আয়
-তোমার বলের খেলা আমিও পারবো।
-প্রথম কথা, সামনের রো তে বসে চোখ বন্ধ করলে নেক্সট টাইম কানচাবি খাবি। ওতে শিল্পীর অবমাননা হয়। আর, তারপরের কথা, তুই যে পারিস, সে আমি জানি। ও তোর রক্তে আছে...
-তবে ছুরির খেলাটা শিখিয়ে দাও।
-—-----------—--------------------
মগ্ন হেমন্তের আর্শসায়াহ্নে উত্তরের বনের সবুজ রঙ আলোর রেখা বেয়ে ঘরে ঢুকলেন। মা ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে ছেলের বড় বড় চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ছেলে উঠে বসে বললো,
-মন খারাপ করছে নাকি মা?
-না রে, তবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ও পারবে তো? ছোট যে।
-ছুরির খেলা শিখে গিয়েছে তো। ও আমার চেয়েও ভালো জাগলার।
বাবা তিনটে ঝলমলে বল হাতে লোপালুপি করতে করতে ঘরে ঢুকলেন। হাসতে হাসতে তালে তালে বলতে লাগলেন,
"লাগ লাগ লাগ ভেলকি
দমাশ ঘুষির পাল্লা দে,
ছবির ফাঁকের জানলা আছে
প্রাণহরি তুই পাল্লা দে,
ও দাদা গো ভেল্কি কুসুম
বাঘের ডিমে কি তামাশা,
তিন কিলো রাত লেবুর রসে
জোছনা স্রোতের কি আম..(এই না থুড়ি থুড়ি)
মঞ্চ 'পরে শরৎ ঠাকুর
কপ্পুরেতে দ্যান বাতাসা .."
হো হো হো করে একরাশ হাসি ছড়িয়ে পড়লো ঘর জুড়ে খইয়ের মত।
--—---------------------------------
দুরে নীল টিলার নিচে আরেক মগ্ন হেমন্ত ঝলসে উঠতে লাগলো চারটি স্টিলের বলে, সাতটি ঝকঝকে ছুরির ফলায়।
আর জুনিয়র মাস্টার ঝিমনের দুইচোখেও।
সুচিন্তিত মতামত দিন