শিবানী শর্মা - মায়াজম

Breaking

১৭ এপ্রি, ২০২০

শিবানী শর্মা

বিগত শতকের একটি ছবি...অমলিন আজও



ছবিটির নাম 'দ্য সার্কাস'। রচনায়, প্রযোজনায়, নির্দেশনায়, সঙ্গীত পরিচালনায় ও অভিনয়ে...বিশ্ববন্দিত, কিংবদন্তি অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। হলিউডের এই অন্যতম সেরা নির্বাক ছবি 'দ্য সার্কাস চার্লি চ্যাপলিনকে এনে দিয়েছিল তাঁর প্রথম একাডেমী পুরস্কার । পুরস্কারটিকে তখনও 'অস্কার' বলা হত না। ১৯২৯ সালে একাডেমীর প্রথম উপস্থাপনা অনুষ্ঠানে চার্লি চ্যাপলিন ‘দ্য সার্কাস’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও নির্দেশকের জন্য মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হননি, কিন্তু জুরি বোর্ড নির্দেশনা, প্রযোজনা, অভিনয়, চিত্রনাট্য রচনা ও সর্বোপরি বহুমুখী অবদানের জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান করেন। 'দ্য সার্কাস' ছিল নির্বাক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সপ্তম সর্বোচ্চ উপার্জনকারী ছবি। এই বহু চর্চিত, বহু প্রশংসিত ছবিটির বিষয় ও ছবিটি নির্মাণকালীন চার্লির তিক্ত অভিজ্ঞতাই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়।
ভবঘুরে 'দ্য ট্র্যাম্প' !
চার্লি চ্যাপলিনের প্রকৃত নাম ছিল ‘চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন'। ১৯১৪ সালে চলচ্চিত্রের পর্দায় চার্লি এক ভবঘুরে 'দ্য ট্র্যাম্প' চরিত্রের সৃষ্টি করেন। যার পরনে জরাজীর্ণ কোট-টাই, ঢিলেঢালা মলিন প্যান্ট, মাথায় কালো রঙের ডার্বি হ্যাট, হাতে একটি ছড়ি, পায়ে পুরনো এক জোড়া বুট এবং ঠোঁটের উপর খাটো অথচ প্রশস্ত একটুখানি টুথব্রাশ গোঁফ । চার্লির এই কালজয়ী কমেডি চরিত্র ‘ট্র্যাম্প’ তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের গুণে অল্প সময়ের মধ্যেই সাড়া জাগায় সারা বিশ্বে।
চার্লির শৈশব কাটে দারিদ্র ও ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে। তাঁর শৈশব ছিল দুঃসহ। চার্লির বাবা তার মাকে ত্যাগ করেছিলেন। মা কখনো নাটকের দলে গান গেয়ে, কখনো সেলাই করে চালিয়েছেন সংসার। তারা না খেয়ে থেকেছেন বহুদিন। শৈশবের সেই বঞ্চনা আর অপমানকেই যেন চার্লি ফুটিয়ে তুলেছেন তার প্রতিটি ছবির মধ্যে দিয়ে। আবার প্রবল বঞ্চনার ভেতর থেকেও পৃথিবীকে ভালবাসতেও শিখেছিলেন চার্লি। ১৯১৪ সালে সিনেমায় প্রবেশ এবং পরবর্তীকালে আমেরিকায় কিস্টোন ফিল্ম কোম্পানিতে যোগদান করার পর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। ১৯১৬ সাল থেকেই পেলেন বিশ্বজোড়া পরিচিতি, হয়ে উঠলেন নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তারকায়।
নির্বাক চলচ্চিত্র তাই ভাষার সবরকম সীমা পেরিয়ে চার্লি তাঁর ট্র্যাম্প চরিত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে গেলেন। তিনি তাঁর প্রতিটি ছবির আভ্যন্তরীণ আবেদনও খুব সহজেই পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। বিশ্বের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চার্লি চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয়, সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সঙ্গীত পরিচালনা পর্যন্ত করেছেন। ১৯১৮ সালে তিনি বিশ্বের অন্যতম পরিচিত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন।
'ছবি' তৈরির দিনগুলি !
চার্লি চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনীতে 'দ্য সার্কাস' ছবিটির কোন উল্লেখই করেননি। খুব সম্ভবত আত্মজীবনী লেখাকালীন তিনি তাঁর সেই শোচনীয়, দুর্বিষহ সময়টুকু সম্পূর্ণভাবে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন । ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ 'দ্য সার্কাস' ছবির নির্মাণ-কালীন এই দুই বছর চার্লির জীবন ছিল ভয়ংকর ভাবে বিপর্যস্ত। চার্লি তাঁর জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময় ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। নানা সমস্যা চার্লিকে ডুবিয়ে দিয়েছিল প্রবল মানসিক বিষণ্ণতায়, এনে দিয়েছিল তার ক্যারিয়ারের সর্বাধিক দুঃসময়।
মার্কিন অভিনেত্রী ও চার্লির দ্বিতীয় স্ত্রী 'লিটা গ্রেয়ে'র সাথে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হলিউডের সেই সময়ের সর্বাধিক চাঞ্চল্যকর একটি খবর ছিল। চার্লি তখন তাঁর খ্যাতি ও ক্যারিয়রের শীর্ষে। লিটার উকিলেরা সেই খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করার জন্য প্রবল চেষ্টা করেছিলেন। মামলা চলাকালীন কোর্টের আদেশে লিটা গ্রে প্রায় ৮লাখ,২৫হাজার ডলার সেটেলমেন্ট পেয়েছিলেন। আমেরিকার ইতিহাসে সেই সময়ের অধিকতম বলে মনে করা হয়। স্টুডিয়োর সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ছবির শুটিং আট মাসের জন্য পুরোপুরি থেমে যায়। চার্লি তাঁর ছবির শুটিং করা অংশ নিরাপদে লুকিয়ে রাখার অন্যত্র কোথাও পাচার করতে একরকম বাধ্য হন।
শুধু বৈবাহিক ও পারিবারিক নয় চার্লি সম্মুখীন হয়েছিলেন আরও নানা ধরণের বিপর্যয়ের। শুটিং শুরুর আগেই বিশাল সার্কাস তাঁবুটি যা ফিল্মের প্রধান সেট ছিল, প্রবল ঝড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিনের শুটিংয়ের পর ইউনিটে ফিরে দেখেন পুরো সার্কাস ট্রেনটি নিখোঁজ হয়ে গেছে। ম্যারাথন বনফায়ারে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করে কিছু শিক্ষার্থী সেটি চুরি করেছিল তবে ভাগ্যক্রমে চ্যাপলিন ঠিক সময়ে সময় এসে পরায় এই বিপর্যয় রোধ করতে পেরেছিলেন। চার সপ্তাহের চিত্রগ্রহণের পরে যে ল্যাবরেটরিতে ছবির কাজ চলছিল চার্লি হটাতই আবিষ্কার করেছিলেন তার এযাবৎ করা সম্পূর্ণকাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এরপরে আরও চরম বিপদের সম্মুখীন হলেন চার্লি। শুটিংয়ের নবম মাসে স্টুডিওতে লেগে যায় আগুন, ধ্বংস হয়ে যায় পুরো সেট ও শুটিংয়ের সমস্ত সাজসরঞ্জাম। সেই সময়েই হয় বকেয়া করের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব দাবিসহ মামলা দায়ের হয় চার্লির উপর , হয় তাঁর মায়ের মৃত্যু, এই ভাবে অসংখ্য সমস্যা নানাভাবে বিলম্ব ঘটিয়েছিল ছবির কাজে এবং একসময় শুটিং পুরোপুরি বন্ধ হয় যায়। কিন্তু এত মানসিক চাপের মধ্যে থেকেও সৃষ্টি হয়েছিল চার্লির একটি অনন্য শিল্পকর্ম, উদ্ভব হয়েছিল একটি চিরকালীন আনন্দদায়ক নির্বাক চলচ্চিত্রের যার নাম "দ্য সার্কাস"।
রূপালী পর্দায় 'দ্য সার্কাস' !
১৯২৮ সালে মুক্তি পায় 'দ্য সার্কাস' । নির্মল বিনোদনের ছবি 'দ্য সার্কাস'। নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও সেই ভালবাসার মানুষের জন্য আত্মত্যাগের ছবি 'দ্য সার্কাস'। সহজ-সরল ভঙ্গিতে সেই গল্পই বলেছেন পরিচালক চার্লি চ্যাপলিন তার চলচ্চিত্র জীবনের অবিস্মরণীয় এই ছবিটিতে।
চার্লির অন্যান্য প্রতিটি ছবির মতই এই ছবিটিও তাঁর অসাধারণ সৃজনশীলতার একটি দৃষ্টান্ত। যদিও সমসাময়িক সমালোচকদের দৃষ্টিতে চার্লির অন্যান্য ছবি 'দ্য গোল্ড রাশ', 'দ্য কিড' ইত্যাদি ছবিতে চার্লির যে গভীর জীবনবোধ ও ব্যক্তিগত চিন্তাধারার প্রতিফলন হয়েছে, সেই তুলনায় 'দ্য সার্কাস' বেশ হালকা ও মূলতই হাস্যরসাত্মক। ১৯২৭ সালে 'পিকচার শো'' পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যায় চার্লির এই ছবির বিষয়ে লেখা হয়, "Chaplin describing 'The Circus' as "making no attempt at great drama but...intended purely and simply as a laugh-provoker." এই ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন চার্লি চ্যাপলিন, অ্যাল আর্নেস্ট গার্সিয়া, মার্ণা কেনেডি, হ্যারি ক্রোকারহেনরি বার্গম্যান। এই ছবির সরল হাস্যরসাত্মক গল্প, কিছু কমিক থ্রিল ও অভূতপূর্ব অভিনয় সব মিলেমিশে এক সর্বজনীন ভাষা তৈরি করেছে, যা দর্শককে সব সময়েই অগাধ আনন্দ দেয়।
'দ্য সার্কাস ছবির গল্পে ট্র্যাম্প অপ্রত্যাশিত ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে একটি সার্কাস কোম্পানির সাথে। পুলিশের তাড়া খেয়ে হটাত করেই সার্কাসের রিংয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল ট্র্যাম্প। অন্যান্য ক্লাউনদের ভাঁড়ামি দেখে দর্শক তখন ভীষণ বিরক্ত ট্র্যাম্পের সেই সময়ের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত মজার কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয়, দর্শক স্বাভাবিকভাবেই এটি সার্কাসের একটি অঙ্গ বলে ধরে নেন এবং দর্শকের মধ্যে প্রবল হাসির আলোড়ন বয়ে যায়। সার্কাসের মালিক ও রিংমাস্টার ট্র্যাম্পকে তৎক্ষণাৎ তার দলে ক্লাউন হিসাবে নিযুক্ত করেন। ট্র্যাম্প কিন্তু এইসব কোন কাজেই পারদর্শী ছিলেন না। সার্কাসে তাঁকে বার বার নানা কাজের তাকে সুযোগ দেওয়া হলেও ট্র্যাম্প সর্বদাই ব্যর্থ হন। সার্কাসের মালিক বুঝতে পারেন যে ট্র্যাম্প কেবল তার অজান্তেই ও অনিচ্ছাকৃতভাবেই কিছু হাস্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, তাকে নির্দেশ দিলে বা শিখিয়ে দিলেও সে কিছুই পারে না।
সার্কাসের মালিকের কন্যা মার্ণার প্রেমে পড়েন ট্র্যাম্প । মার্ণার সাথে তার সৎ পিতা অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করতেন। তিনি শাস্তি হিসাবে মার্ণাকে মাঝে মাঝেই অভুক্ত রাখতেন। মার্ণার দুরবস্থা দেখে ট্রাম্পের নরম হৃদয় মার্ণার প্রতি করুণায় ও ভালবাসায় ভরে ওঠে। তবে চার্লি হৃদয় উজাড় করে ভালবাসলেও মার্ণা প্রেমে পড়লেন সার্কাসের দলেরই এক অত্যন্ত সুদর্শন ও পারদর্শী এক টাইট-রোপ ওয়াকারের, যার নাম ছিল 'রেক্স' । এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে এসে দাঁড়ালেন ট্র্যাম্প। ক্লাইম্যাক্সের গল্প সার্কাসে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। যেখানে রেক্সের আকস্মিক অনুপস্থিতে ট্র্যাম্পকে
দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। শুধু মার্ণাকে খুশী করার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করেও চার্লি এই ভয়ানক চ্যালেঞ্জ নেন। দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা কালীন তাকে বেশ কিছু বাঁদর আক্রমণ করে এমনকি তার কাপড় অবধি খুলে দেয়। দর্শক এই পুরো পরিস্থিতিকে সার্কাসেরই অংশ মনে করে অসম্ভব মজা পায় এবং সার্কাসের এই প্রদর্শন আশাতীত সফল হয়। পিতার অত্যাচারে জর্জরিত মার্ণাকে বাঁচাতে ট্র্যাম্প মালিকের সাথে ঝগড়া করেন ও সার্কাস থেকে বিতাড়িত হন। মার্ণাও সার্কাস ছেড়ে ট্র্যাম্পের কাছে চলে যান। কিন্তু নিজের প্রেম গোপন রেখে ট্র্যাম্প মার্ণা আর রেক্সের বিবাহ দেন। সার্কাস কোম্পানি কাজ শেষ করে অন্য দেশে পাড়ি দেয় । বন্ধনহীন, ভবঘুরে ট্র্যাম্প পাড়ি দেন দূর দিগন্তের দিকে, কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে।
হাসির আড়ালে বিষাদের রঙ !
ব্যক্তিজীবনে চ্যাপলিন সুখী ছিলেন না কখনোই। শৈশবের দুঃসহ স্মৃতি কোনদিন তাঁর পিছু ছাড়েনি।
'দ্য সার্কাস’ ছবিটি দেখে তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের মনে হয়েছিল 'চ্যাপলিন কখনোই দর্শককে তাঁর দিকে চেয়ে স্মিতভাবে হাসতে দেন না, হয় তারা হাসিতে একেবারে ফেটে পড়বেন নয়তো ভীষণ দুঃখিত হয়ে যাবেন’। যথার্থই চার্লি চ্যাপলিনের একক ও নির্বিকল্প উপস্থিতি, সাধারণ মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা, আনন্দ, ভালবাসা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প নিয়ে তাঁর প্রতিটি ছবি দর্শককে কখনো হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দেয়, কখনো তাদের হৃদয় বেদনায় আর্দ্র হয়ে ওঠে।
চার্লি চ্যাপলিনের কর্মজীবনের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় ৭৫ বছর। প্রভূত প্রশংসার পাশাপাশি প্রচুর সমালোচনা ও বহু বিতর্কিত কাণ্ডকারখানা তার পেশায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিলো। ১৯৭৭ সালে সুইজারল্যান্ডে বড়দিনের দিন ঘুমের মাঝেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এইভাবে অবসান ঘটে চার্লি চ্যাপলিনের ঘটনাবহুল ৮৮ বছরের জীবনের ।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চার্লি চ্যাপলিনের রয়ে গেছে অসামান্য অবদান, তাঁর বহু ছবি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র:
  • বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগ

1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র