সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায়

মায়াজম
0

ভানুমতী




……………

ফিকে হয় দিন, শীতের বিকেলে জ্বলে ওঠে সার্কাসের আলো …
একের পর এক মার্চ করতে করতে আসে ছোট্ট হাঁসের দল থেকে হাতীর দল …
তারপর রং বেরং এর পোশাকে একে একে বিভিন্ন সাইজের মানুষ …ছোট্ট ডিসুজাদাদা থেকে রণপা পড়া লম্বা মাধুকাকা…বাচ্চাদের অবাক চোখের আলোয় শুরু হয় খেলা…
বাঘ,সিংহের আগুনের রিং এর কসরতের পর শুরু হয় ভানুমতীর খেলা…

মোমের শরীর উড়ে যায় এক ট্র্যাপীজ থেকে আর এক ট্র্যাপীজে…একটা বিশ্বাসের হাত কখনও লুফে নেয় মোমের দুটো হাত কখনও আঁকড়ে ধরে কোমল দুটো পায়ের পাতা…কখনও ছুঁড়ে দেয় তাকে অন্য একটি হাতের ভরসায়…
বাতাসে ভাসতে ভাসতে কেন যেন ভানুর হঠাৎ সেদিনের ভয়ের গন্ধটা নাকে আসে …
মনে পরে আট বছর বয়সের হাতবদলের গল্প…
ঘর তাদের কোনকালেই ছিল না…ওরা মাদারী…রাস্তাই ওদের ঘরবাড়ী…
সারাদিন ছোট্টো পায়ের আঙুলে মোটা দড়িটাকে কামড়ে মাটির অনেক ওপরে হেঁটে যাওয়া যায় সেই কসরত তার মাদারী বাপ তাকে শিখিয়েছিল…
প্রথম প্রথম ভয় করত খুব …সাঁঝবেলার ফুটপাথে তোলা উনুনের আঁচে যখন মায়ের কালো মুখটা আলো আলো …ভানুয়া কোল ঘেঁষে গুনগুন সুরে তার কাছে ভয়ের নালিশ জানাত …
বাজরার রুটি বেলতে বেলতে মা বলত …
-ভয় কী রে বেটি তু তো পঞ্ছী আছিস …পঞ্ছীকো উড়ণে কা ক্যা ডর…
দু হাত মেলে উড়ে যা ভানুয়া …ও দড়িটাকে বশ কর…
এভাবেই একদিন বাপের ডুগডুগির তাল আর মায়ের দোহাতি গানের সুরে সে যখন পাখীর মত বাতাসে উড়ছিল গোয়ানিজ রবীনের চোখ খুঁজে পেল তাকে …
বাতাসে তখন শীতের আমেজ …কলকাতায় শীত…
পার্ক সার্কাসের ময়দানে তাঁবু পড়েছে…সেদিন ছিল সার্কাসের ছুটির দিন …শহরের এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে রবীন দেখল ভানুয়াকে…বদলে গেল একটা আট বছরের জীবন …

ফুটপাথের পলিথিনের জীবন থেকে সার্কাসের তাঁবুর জীবন…ভানুয়া হয়ে গেল ভানুমতী…
ভানুমতীর উড়ন্ত পলকা শরীরটাকে দুটো শক্ত হাত তুলে নিল শূন্যের চৌকো প্ল্যার্টফর্মে …
অন্ড্রের গায়ের পুরুষালি গন্ধে মুছে গেল ভয়ের পুরোনো গন্ধ…

ভানুমতীর চোখ ছোঁয় অন্ড্রের শরীর …মন ছুঁতে চায় মন…কত কথা থাকে …
ভানুয়ার ঠোঁটের টকটকে লাল লিপস্টিকে লেগে থাকে শুধুই চুপকথা…

শূন্যে কোমড় জড়িয়ে প্রিয় হাত,চোখে চোখ …তবু কত দেখা থেকে যায় নকল আইল্যাসের ঘেরাটোপে…
অস্থির আঙুল জড়াতে চায় অন্ড্রের আঙুল …
না বলা কত নিভৃত আলাপ না বলাই রয়ে যায়…

ট্র্যাপিজের তলায় পেতে রাখা কারো মনের অন্তরজালে তবু ফুটে ওঠে…
এক অপরাধ …

সস্তার ঝলমলে পোশাকের আড়ালে ,ছেঁড়াফাটা তাপ্পিমারা তাঁবুর রাতজীবন কেউ দেখতে পায় না…
নিত্য যাপনের ক্লাউনের মুখে আঁকা থাকে দুঃখের হাসি আর চোখের নিচে একদানা কান্না ফোঁটা…
রোজ রাতে বুড়ো রবীনের বিকৃত ফ্যান্টাসীর চাবুক ছিন্নভিন্ন করে ভানুমতীর মোমের শরীর…
সার্কাসের জাগলিং এ একের পর এক জুড়েছে লাল,নীল স্বপ্নের মায়াজাল....
অথচ আসল জীবনে তৈরী হয় নি কোন ইন্দ্রজাল…

ঘুরন্ত চাকায়, এক অসহায় ঈভের মাথায় জীবন বৃক্ষের টুকটুকে লাল আপেল…
ব্লাইন্ড ফোল্ডেড রবীনের তীক্ষ্ণ ছুরির ফলায় লক্ষ্যের চারপাশে ফুটে ওঠে আট বছরের আবছা অবয়ব …

রিং মাষ্টারের হাতের চাবুক উপেক্ষা করে বলা হয় না
“অন্ড্রে আমি তোমাকে ভালবাসি”…
বলা হয় না ,দেখো ! দিনের পর দিন কী নির্বিকার মুছে ফেলছি চাবুকের দাগ শুধু তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে…

আসলে অমন কপাল তার কখনই হবে না…এই তাঁবুর বাইরে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন রবীণ কখনই মেনে নেবে না…
অন্ড্রের বিশস্ত হাতে নিজের পলকা শরীরটা ছেড়ে দিয়ে ভাবনার মায়াজালে ডুবে থাকে ভানু…
দূর থেকে তীব্র সন্দেহের দুটো চোখ তাকে লক্ষ্য করছে বুঝতে পারে না…
হঠাৎ সম্বিত ফেরে…খেলা শেষ…দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে ভানু …
এবার ঘরন্ত চাকায় ঘুরবে তার পলকা শরীর …চোখ বাঁধা রবীণ তীক্ষ্ন ছু্রির ফলায় আঁকবে তার অবয়ব… একেবারে শেষে গেঁথে ফেলবে তার মাথায় রাখা লাল আপেল…

বিগত তেরো বছর রবীণের দক্ষ হাত চোখ বাঁধা অবস্থায় অবলীলায় লক্ষ্যভেদ করে চলেছে…
আজও তীক্ষ্ন ছুরির ফলা এঁকে চলেছে ভানুমতীর অবয়ব…

ভানুমতীর ক্লান্ত চোখ বুঁজে আসে …
রবীণের দক্ষ হাতের শেষ ছুরি ভানুতীর মাথার আপেল না ছুঁয়ে নির্বিকার গেঁথে ফেলে ওর নরম হৃদয়…













একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)