জয়ীতা ব্যানার্জী

মায়াজম
0
কালবৈশাখী
---------------------------------



মাঠের ঠিক পশ্চিম দিকটাতেই বাজটা পড়েছে। দশ-বারো হাত মাটির ঘাস একেবারে কালো হয়ে হয়ে আছে। তালপাতা পোড়ার গন্ধ,গাছে আর একটাও পাতা নেই। বাসন্তী-মেলা থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল কাল। বিকেলের আগেই আকাশ কালো হয়ে এল যখন, সার্কাসের ম্যাটিনি-শো শুরু হয়েছে সবে। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তাঁবু উথাল-পাথাল হয়ে ঝড় উঠেছে। মুহূর্তে আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে । মেলা জুড়ে লোডশেডিং। গিজগিজে মানুষের হট্টগোল দমে যাচ্ছে হুহু বাতাসের শব্দে। তাঁবুর ভেতরে বাঁশের থামে থামে লন্ঠন জ্বলে উঠলো গোটাকতক। ছেঁড়া-তাপ্পি মারা তার ছাদ থেকে হলুদ আলোর বিন্দু ফুটে উঠছে। খুব ছোটবেলায় তারাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বাবাকে জিগেস করতাম ,"ওগুলো কী?" বাবা বলতেন আকাশের ওপারে সার্কাস চলছে,তাঁবুর ফাঁক থেকে তারই আলো দ্যাখা যাচ্ছে। এরকম বিশ্বাস নিয়ে তখন-ও দাঁড়িয়ে আছি ঝড়ের মুখে।
একে একে সাইকেল পড়ছে ভেজা মাটিতে। দোকানের ঝাঁপ ফেলে ভেতরে ঢুকে পড়া মানুষগুলোর মধ্যে থেকে শিশু কান্নার রোল ভেসে আসছে। কটকটি,নতুন কেনা বাঁশি-ও বেজে উঠছে। এমন সময় টিকিট কাউন্টারের ফোকরে ছেঁড়া বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হল। দুদিকে ঝুলে থাকা মস্ত পর্দাটা তিন-চারজন মিলে টেনে বেঁধে দিলেন। হাওয়ায় ফাঁক হয়ে এলে যতটুকু দ্যাখা যায়,দেখছিলাম। মা-হাতির শুঁড়ে শুঁড় পেঁচিয়ে খাঁচায় ঢুকে পড়লো বাচ্ছা হাতি-টা। একটা কাকাতুয়া ডানা ঝাপটা দিয়ে আড়ালে চলে গেল। আমরা বাকি কয়েকজন এককোণে সরে এলাম। ঝড়-কে জায়গা করে দিতে লাগলাম। তীরের ফলার মতো বৃষ্টি এসে পড়ছিল চোখে,মুখে,গায়ে। অপুর রাজায় রাজায় যুদ্ধ মনে আছে? আমারা-ও তখন যুদ্ধ দেখছি আকাশের ওপারের। হাজার হাজার বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধ। এ তান্ডবের মাঝেই কখন ঝুপ করে সন্ধে নেমে এল,কেউ জানলো না। সেদিনের মতো সার্কাস-শো স্থগিত। তাঁবু ছিঁড়ে লুটিয়ে রইলো বাজে পড়া শালিখের মতো। ফেরার পথে দেখলাম নাগরদোলার পায়ের কাছে একটা-দুটো করে লোক জড়ো হচ্ছে আবার। মাঠের পেছনদিকে জেনারেটর চালু হয়েছে। প্রিয় কেরোসিনগন্ধ নাকে এসে লাগছে। একশ ওয়াট বাল্বের হলুদ আলোয় দেখে দেখে মুক্তোর মালা কিনছে কিশোরীর দলটি। বহু দরদামে কেনা স্টিলের বাসন ঢুকে পড়ছে গৃহস্থর হেঁসেলে।
মেলার গেট থেকে নেমেই বাঁ-দিকে মোরামের রাস্তা আমাদের। লন্ঠন,টর্চ ঝুলিয়ে একের পর এক সাইকেল পেরিয়ে যাচ্ছে। চাকা ভর্তি লাল কাদা। গরুর গাড়ি দেখলে নেমে পড়ছে বাঁদিকের কাঁটা ঝোপে। সপ্তমীর সন্ধ্যা আরতি শুরু হল আটচালায়। লাল নীল টুনির আলোয় সেজে উঠেছে বাসন্তী-মন্দিরে যাবার রাস্তাটা। মা বলছিলেন এবছর ক্যানেল কাকারা ঢাক বাজাবার বরাত পেয়েছেন। ওরা চারভাই মিলে ঢাক বাজান,আর একটা কী যেন বাজনা,আমরা বলি চিরিপিটি। সঙ্গে সানাই-ও। ভাসানের দিন মাইক লাগে না,ওতেই জমে যায় সবটুকু। এসব দেখে ফিরে আসার সময়ই ক্ষণেকের জন্য সবদিক আলো হয়ে গেল! তারপরই তো সেই বিকট শব্দটা!
আজ অষ্টমী। এদিকে মাধদা-র মা বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। মা-কাকিমারা যে যখন পারছেন জল দিচ্ছেন মুখে । বাবা ঘুরতে ফিরতে বলে যাচ্ছেন কেবল," উফ,তখনই পুকুর যেতে হল হতভাগাকে!" সদর হাসপাতাল থেকে গাড়ি ফিরছে নিথর মাধবদাকে নিয়ে। এদিকে কাঠের বন্দোবস্ত হয়েছে কিনা জানতে এসে কালো জমিটার উপর দাঁড়িয়ে আছি। দূরে পুরুতদাদু অষ্টমীর মন্ত্র পড়ছেন। ঘন ঘন শাঁখ,কাঁসর,ঘন্টা বেজে উঠছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)