রিংমাস্টার----------
এখন এই গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে থাকতে, আমার খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। তখন আমি খুবই ছোট। পাঁচ, ছ বছর বয়স হবে মনে হয়। ক্লাস ওয়ান। স্কুলে একদিন জানতে পারলাম যে, রহিম পুরে পানামা সার্কাস এসেছে। স্কুল থেকে লিখিয়ে নিয়ে গেলে, টিকিটে কনসেশনও পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল ওই রহিমপুর। 40-45 মিনিট যেতে হয় বাসে করে। কী যে প্রচণ্ড ভিড় হত,ঐ বাস গুলোতে। দলে দলে লোক সার্কাস দেখতে যেত। বাসে করে, সাইকেলে করে। আবার শুনেছি কেউ কেউ নাকি হেঁটেও ওখানে পৌঁছে যেত। আমার মনে আছে, আমি যেদিন প্রথম সার্কাস দেখতে গিয়েছিলাম বাসে উঠতে পারিনি,এতো ভিড় ছিল। বাসের ছাদে চড়ার যে সিঁড়ি তাতে উঠে গিয়েছিলাম। মাকে (ঠাকুমা কে),আর আমার ছোট ভাইকে বাসের ভেতর কোন রকমে ঠেলেঠুলে উঠিয়ে দিতে পারলেও,আমাকে পারে নি।কন্ডাকটর কাকু আমাকে নিজের সঙ্গে বাসের ছাদে চড়ার সিঁড়িতে নিয়ে উঠে গিয়েছিল। একটু পরে আমাকে বাসের ছাদে উঠিয়ে দিয়েছিল। আমার বেশ মজাও লাগছিল, আবার যে একটু একটু ভয় করছিল না তাও নয়। কাকু বলেছি্লো বীরাঙ্গনাদের ভয় করতে নেই। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বীরাঙ্গনা মানে কি। কাকু বলেছিল "যে সমস্ত মেয়েদের একটুও ভয় করে না, তাদের বীরাঙ্গণা বলে। এই যে তুমি এখন সার্কাস দেখতে চাচ্ছ দেখবে, সেখানে কত তোমার মতন ছোট ছোট মেয়ে আছে, তোমার থেকে বড় মেয়েরা আছে। তাদের খুব সাহস! তবেই তারা সার্কাসে খেলা দেখাতে পারে! তুমি ভয় পেলে চলবে কেন?তাহলে তো ওরাও ভয় পেয়ে যাবে। ভয়টা তো খুব ছোঁয়াচে।আর, তুমি যদি খুশি হয়ে ওদের খেলা দেখে হাততালি দাও, তাহলে ওরা খুব আনন্দ পেয়ে ভালো করে খেলা দেখাতে পারবে। বুঝতে পেরেছ?" তখন কাকুর কথা কতটা বুঝেছিলাম, জানিনা। কিন্তু এখন বুঝি, ভয়টা খুব ছোঁয়াচে। আর কোন সময় ভয় পেলে চলবে না।যাই হোক, রহিমপুরে বাস থেকে নামার পর মায়ের কাছে কাকু আমাকে পৌঁছে দিয়ে টিকিট কাউন্টারটা দেখিয়ে দিল।বাপরে , সে কি প্রচণ্ড ভিড়।কোনমতে ভিড় ঠেলে টিকিট কেটে আমরা সার্কাসের গোল ছাউনির মধ্যে ঢুকে গ্যালারিতে গিয়ে বসলাম। তখন অলরেডি প্যাঁপো প্যাঁপো করে মিউজিক শুরু হয়ে গেছে। গ্যালারিতে বসে, সে আমাদের কি টানটান উত্তেজনা। সার্কাসের ওই রিং টার মধ্যে যেখানে খেলা দেখানো হয়, সেখানে তখন দেখি কয়েকটা জোকার টুপি নিয়ে খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে। কিছুই না। দর্শকের মধ্যে তারা টুপি গুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে।আর দর্শকরা আবার তাদের টুপি ছুঁড়ে ফেরত দিচ্ছে,আর তাতেই হাসির হুল্লোড়। আমাদের পাশের গ্রামের একজন হাবুল বলে এদের গ্রুপে ছিল। তাকে দেখে সকলের কি উল্লাস। আর সে ও পরিচিতজনদের দেখে দ্বিগুণ উৎসাহে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে যাচ্ছিল। এরপরই শুরু হল ট্রাপিজের খেলা। কখনো এদিক থেকে দুলতে দুলতে ওদিকে চলে যাচ্ছে আবার কেউ বা ওপ্রান্ত থেকে দুলতে দুলতে এদিকে আসছে। কখনও একা, কখনও আবার দুজন, কখনো হাত ধরাধরি করে কখনো হাত ছেড়ে। সে কী উত্তেজনা। এখনো ভাবলেও যেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। সেদিন যে সার্কাসে কত রকমের খেলাই না দেখিয়েছিল। আমারই মতন ছোট ছোট মেয়েরা সব একই রকমের ড্রেস পড়ে কাপ ডিশের খেলা দেখাতে শুরু করলো। কি সুন্দর একটার পর একটা মাথার উপর তুলে যাচ্ছিল। স্বপ্নের মত আমার এখনো চোখের সামনে ভাসে।এরপর সাইকেলের খেলা। কখনও একা, কখনও বা দুজন, কখনো অনেকে মিলে কাঁধ ধরাধরি করে সাইকেল চালাচ্ছিল। একে অন্যের কাঁধের ওপর ও চড়ে যাচ্ছিল। কী করে যে ওরা এসব করছিল,আমার ভাবলেও অবাক লাগে। বাঘ-সিংহের খেলা, হাতি ও কুকুরের ফুটবল খেলা, টিয়া পাখির কামান দাগা, কাকাতুয়ার সাইকেল চালানো, আগুনের রিং এর মধ্যে দিয়ে গলে যাওয়া,জোকার দের নানা রকম খেলা। একজন জোকার বলল,"দেখো এইবার আমার বুকের উপর দিয়ে হাতি চলে যাবে!" আমরা সবাই বসে আছি কখন হাতি যাবে তার বুকের উপর দিয়ে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তার বুকের উপর দিয়ে একটা রামছাগল চলে গেল। সারা গ্যালারি জুড়ে সে কি হাসির ধূম! তারপর মোটরবাইক নিয়ে খেলা। ঘুরে ঘুরে উপরে ওঠা, আবার ঘুরে ঘুরে নিচে নামা। দেখতে ইচ্ছেও করছিল আবার ভয়ের চোটে মায়ের কোলে মুখও গুঁজছিলাম। তিন ঘন্টা সময় যে কিভাবে টানটান উত্তেজনা, ভয় আর আনন্দে কেটে গিয়েছিল, তা বুঝতেই পারি নি। স্বপ্নের ঘোরেই মনে হয় বাড়ি ফিরেছিলাম। তারপর কদিন আমার মুখে শুধু সার্কাস আর সার্কাস। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধু সার্কাসের চিন্তা। সার্কাসের ওই মেয়েগুলোর সঙ্গে আমি সারা দিন মনে মনে কথা বলতাম, ওদের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম। ওদের সঙ্গে কাপ ডিশের খেলা দেখাতাম, সাইকেল চড়তাম, ট্রাপিজের খেলা দেখাতাম! আরো কত কি! একদিন মা উনুনে আঁচ ধরিয়ে, চায়ের সরঞ্জাম গুছিয়ে রেখে চান করতে গেছে, আমি সেই সময় পায়ে করে কাপ ডিশ ছুঁড়ে ছুঁড়ে প্র্যাকটিস করতে লাগলাম। ফল যা হবার তাই হল। মা এসে দেখে, সারা ঘরে কাপ ডিশ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে,পা কেটে রক্তারক্তি। কপালে জুটল প্রচন্ড বকুনি। তাতেও হতোদ্যম হবার পাত্রী তো আমি ছিলাম না, পরেরদিন উঠোনে বাঁশের খুঁটি পুঁতে দড়ি টাঙিয়ে যেখানে মা কাপড় শুকোতে দেয়, সেই বাঁশের খুঁটির উপর চড়ে দড়ি টানাটানি করতে গিয়ে বাঁশের খুঁটি উপড়ে দড়ি ছিঁড়ে হাত-পা ছড়ে আবারও একাকার কান্ড। রোজই আমি নিত্যনতুন কান্ড করতাম।এক দিন দোলনায় হাত ছেড়ে দুলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মাথা ফুলিয়ে,আলু করে ফেললাম। আরো একদিন সাইকেলের পেছনে কেরিয়ারে চড়ে, আমাদের বাড়িতে যে ছেলেটা কাজ করত, তাকে বললাম খুব জোরে জোরে প্যাডেল গুলো ঘোরাতে। সেও আমার কথা শুনে জোরে প্যাডেলঘোরাতে শুরু করল আর আমি কিভাবে জানি না সাইকেলের স্পোক এর মধ্যে পা ঢুকিয়ে দিয়ে পা কেটে ফেললাম। মা আমার এই সব কাণ্ডকারখানা দেখে, চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিল," এই দস্যি মেয়ে কে আমি কি করবো রে বাবা? রোজ কিছু না কিছু কান্ড ঘটাচ্ছে! পাড়ায় তো এত বাচ্চা আছে! তারা তো সকলেই সার্কাস দেখে গেছে তারা কি এরকম কাণ্ড করে?" আমার অন্য ভাই বোন হলে এতক্ষণে তাদের পিঠে দু ঘা পড়ে যেত। কিন্তু আমি ছিলাম বাড়ির সকলের আদরের দুলালী। বিশেষ করে আমার ঠাকুমার। ঠাকুমাকেই আমি মা বলতাম। মা(ঠাকুমা), আমার পায়ে ব্যান্ডেজ করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল," তুমি রোজ রোজ এসমস্ত কান্ড কেন করছো বলতো? হাত পা কেটে ফেলছ? সর্বাঙ্গ তো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে? যদি হাত পা ভেঙে যায় তাহলে কি হবে বুঝতে পারছ?" আমি কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে বললাম --"কিন্তু আমি যে সার্কাসে খেলা দেখাতে চাই"! মা( ঠাকুমা) বলল," সে তো খুব ভালো কথা! কিন্তু এইভাবে কি খেলা দেখানো যায়? তার জন্যতো ট্রেনিং নিতে হয়।?" বললাম," কার কাছে ট্রেনিং নিতে হবে?"মা বলল", বারে ওদের ট্রেনার আছে না?
প্রচন্ড প্র্যাকটিস করলে তবেই ওভাবে খেলা দেখানো যায়! বুঝেছ?এখন একদম চুপ করে দুদিন শুয়ে থাকবে. কোন রকমে দুষ্টুমি করবে না!"মা চলে যাবার পর আমি ভাবতে বসলাম কিভাবে ট্রেনিং নেওয়া যায়?
সত্যি আমি দু দিন চুপচাপ ছিলাম কিছুই করিনি। তারপর একদিন সকালবেলা, চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের বাস স্ট্যান্ড থেকে রহিমপুর যাবার জন্য যে বাসটা যায়, সেই বাসের ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে চলে গিয়ে শুয়ে পড়ে ছিলাম। ওই সময় বেশী ভিড় থাকে না বলে কনডাকটার কাকু ছাদে ওঠেনি। তাই আমাকে কেউ দেখতে পায়নি। রহিমপুরে বাস থামার পর সবাই নেমে যাবার পর আমি লুকিয়ে নেমে পড়ে সার্কাসের ছাউনির কাছে চলে গিয়েছিলাম।ওই বড়ো ছাউনিটার পাশে অনেক ছোট ছোট তাঁবু ছিল। তাঁবুর ভেতরে অনেক লোক ছিল আবার বাইরে ও নানান লোক নানান রকম কাজে ব্যস্ত ছিল। আর একটু দূরে ছিল বাঘ-সিংহের খাঁচা। আরো কিছুটা দূরে হাতিগুলো বাধা ছিল। আমাকে ওখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখে একজন লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো", তোমার কি চাই খুকি?" আমি বললাম, "আমি তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই! খেলা দেখানো শিখব!" তার মুখের যা করুণ অবস্থা হয়েছিল, এখন আমার মনে পড়লে হাসি পায়।সে তার হাতের জিনিসপত্র ফেলে রেখে ছুটে তাঁবুর ভেতর ঢুকে গিয়ে একজন বয়স্ক মহিলাকে ডেকে নিয়ে এলো। একটা ময়লা আটপৌরে শাড়ি পরা,চুল খোলা,মহিলা মনে হয় চান করতে যাবে বলে মাথায় তেল মাখছিল। খুব আদর করে জিজ্ঞাসা করলো "হেথা কেন এয়েছিস মা? কি চাই তোর?" আমি বললাম, "মাসী আমি এখানে থাকতে চাই.! আমি ওই যে, ওই মেয়েগুলোর সঙ্গে আমি খেলা দেখাবো! আমাকে একটু খেলা দেখানো শিখিয়ে দাও না গো!" ভদ্রমহিলা হাসবে কি কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। বলল "আচ্ছা আচ্ছা সে হবে খন। আচ্ছা মারে, তোর ঘরের নোকেরা জানে যে তুই হেথা চলে এয়েছিস? তুই কি নুকিয়ে চলে এয়েছিস মা।? তোর ঘরের নোকেরা তো কাঁদবে রে মা।" আমি বললুম, "দুপুরবেলা অনেক লোক সার্কাস দেখতে আসবে তাদেরকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দেবো, এখন তুমি আমাকে খেলা শেখাও তো।" "রিং মাস্টার খেলা শেখায়, তাকে খপর দিই।সেই তোমাকে খেলা শেখাবে। এখন আমরা সবাই ফুলুরি দিয়ে মুড়ি খাচ্ছি।চলো, খাবে আমাদের সঙ্গে?" আমি তো মহানন্দে এই নতুন মাসির হাত ধরে তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেলাম ফুলুরি দিয়ে মুড়ি খাওয়ার জন্য। ওখানে গিয়ে দেখি আমার মত এবং আমার থেকে বড় ছোট অনেক মেয়েরাই রয়েছে ওখানে। কেউ মুড়ি খাচ্ছে, কেউ চুল আঁচড়াচ্ছে, কেউ তেল মাখছে আবার কারা বসে লুডো খেলছে! আমাকে দেখে,অনেকে এগিয়ে এলো। মাসী বললো, এই দেখো তোমাদের সঙ্গে খেলা শেখার জন্য এখানে এয়েছে গো" ওদের মধ্যে থেকে একটা বড় মেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, "কি করো তুমি স্কুলে যাওনা?" আমি বললুম, "হ্যাঁ যাইতো!" আমার মাথার চুলটা ধরে একটু নাড়িয়ে দিয়ে বলল," জানো আমরা কেউই স্কুলে যেতে পারিনা বলেই এখানে এসেছি। এবং আমরা কেউ এখানে ইচ্ছে করে আসিনি। আমাদের বাবা মায়েরা আমাদের ঠিক মতন করে খেতে দিতেই পারত না। স্কুলে পাঠাবে কি করে? সেই জন্যই আমাদের এই খানে রেখে গেছে যাতে আমার এখানেই খেলা শিখে খেলা দেখিয়ে নিজেরাও দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারি আর বাড়ি তে ও একটু টাকা পাঠাতে পারি আর কিছু না। আর কয়েকজন আছে, ওদের বাবা মারা দুজনেই এই সার্কাসের খেলা দেখায়।তোমার যেমন সার্কাসে এসে খেলা দেখাতে ইচ্ছে করছে, আমাদের ও তেমনি ইস্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে আমি ক্লাস ফোর অবধি পড়ছিলুম, জানো। তারপর আমার আর স্কুল যাওয়া হয়নি। আমাদের সবার প্রায় একই অবস্থা!" কথা বলতে বলতেই তাঁবুর ভেতরে ঢুকে এলো একজন খুব লম্বা চওড়া লোক কাঁচা পাকা চুল,ইয়া তাগড়াই গোঁফ। মাসী বলল," এই দেখো মাস্টার এই ছেমড়িটা খেলা শিখবে বলে বাড়ি থেকে চলে এয়েছে।"উনি হেসে বললেন,"বাহ ভালো খুশির খবর তো!বাইরে এসো খুকি!" আমি তো নাচতে নাচতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে বললেন,"খেলা তো তোমায় শিখিয়ে দেব, কিন্তু বাড়ির লোকেদের না জানিয়ে এলে তো হবে না। আচ্ছা তুমি এখানে এলে কি করে?" আমি বললুম , "বাসে করে এসেছি।" "বাঃ বেশ বেশ। চলো,বাসস্ট্যান্ডে একটু যাই। ওখানে একটা লজেন্সের দোকান আছে। লজেন্স কিনে আনি। তুমি লজেন্স খাও তো?" আমি তো মহা খুশি। রিং মাস্টার কাকুর হাত ধরে
লজেন্সের দোকানে পৌঁছে গেলাম। পাশেই ছিল একটা সাইকেলের দোকান। হঠাৎ দেখি, সেখানে আমার বাবার বন্ধু গৌর কাকু সাইকেল সারাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কিরে তুই এই সময় এখানে? কি করছিস? কার সঙ্গে এসেছিস?"আর আমি কিছু বলার আগেই রিং মাস্টার কাকুর চোখ আনন্দে ঝকঝকে হয়ে উঠল। বলল," আপনি একে চেনেন নাকি? খুব ভালো হল" গৌরকাকু বলল, "আমি ওর বাবার বন্ধু!" রিং মাস্টার কাকু বললো," বাহ তাহলে তো খুবই ভালো হয়েছে! ভগবান আপনাকে এখানে এনে দিয়েছেন! আসলে ও আমাদের কাছে সার্কাসে খেলা শেখার জন্য এখানে এসেছে। আমি বলেছি, আমার শেখাতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাড়ি থেকে তো একটা পারমিশন নিয়ে আসতে হবে।
বরং এখন আপনার সঙ্গে বাড়ি চলে যাক।।তারপর আবার ফিরে আসবে।" আমি তো হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে বসে গেলাম।
"আমি যাবনা!আমি খেলা শিখব! আমি খেলা শিখব!" রিং মাস্টার কাকু বললো," নিশ্চয়ই শিখবে! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে শেখাবো! কিন্তু বাড়ির পারমিশন ছাড়া কিচ্ছু হবে না সোনা। জানো তো কেউ যখন সন্ন্যাসী হয় তখনও তার বাড়ি থেকে পারমিশন নিতে হয়। খেলাটাও তো সাধনা। তাই তোমাকে বাড়ির লোকের কাছ থেকে একটা মত নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া, তুমি এখন বড্ড ছোট। তোমার বাড়ির জন্য মন খারাপ করবে। বাড়ির লোকেরাও তোমার জন্য কান্নাকাটি করবে। বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। তারপর নিশ্চয়ই তোমাকে শেখাবো। এমা, বোকা মেয়ে কাঁদতে আছে নাকি? মুঠোভর্তি লজেন্স পকেটে ভরে নাও! আর কেঁদো না! আচ্ছা তুমি কি সাইকেল চালাতে জানো? এই কাকু তোমাকে সাইকেল চালানো শিখিয়ে দেবে! কি পারবেন না?" গৌরকাকুর সঙ্গে মনে হয় রিং মাস্টার কাকুর চোখে চোখে কোন কথা হয়ে গেল। কাকু বললো," হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই আমিতো সাইকেল চালানো ওকে শিখিয়ে দেব। একটু বড়ো হোক। তারপর ও নিজেই সাইকেলে করে এখানে চলে আসবে কেমন?"রিং মাস্টার কাকু বললো, "বাঃ তাহলে তো খুবই ভালো হয়! তাহলে ওই কথাই থাক! এখন আপনি ওকে নিয়ে বাড়ি চলে যান! তারপর ও সাইকেল চালানো শিখে এখানে চলে আসবে।" আমার চোখ দিয়ে তখন টপ টপ করে জল পড়ছে! নিজের গামছার খুঁট দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে রিং মাস্টার কাকু বলল "আচ্ছা আমি তোমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি! এই দেখো কান্না পেলে চোখের জল মুছে হা হা করে হাসবে। আর কোন কিছুতেই ভয় পাবেনা। ভয়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেই ভয় কিন্তু তোমাকেই ভয় পেয়ে যাবে। সবকিছুর মধ্যেই একটা ব্যালেন্স দেখে চলার চেষ্টা করবে খুব সাবধানে চলতে হবে। আর মন খারাপ করলে একটা গান করবে! 'কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা' রবীন্দ্রনাথের গান শিখে নিও বড়ো হয়ে। আমার মুখের অবস্থা দেখে রিং মাস্টার কাকু বুঝে গিয়েছিল আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। গৌর কাকুর কাছ থেকে একটা নোট বই চেয়ে নিয়ে এই গানের কথাগুলো লিখে দিয়েছিল আর লিখে দিয়েছিল ভয় কে ভয় না পেতে, কান্না ভুলে হাসতে সবকিছুর মধ্যে ব্যালেন্স করে চলতে। বলেছিল এখন আমি না বুঝতে পারলেও বড় হয়ে ঠিক বুঝতে পারব। একটু বড় হওয়ার পর আবার যেতে বলেছিল। আমি কাকুর গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম যদি তোমাকে আর খুঁজে না পাই। তাহলে আমি খেলা শিখবো কি করে? বলেছিল ঠিক খুঁজে পাবে। আর একজন রিং মাস্টার সবসময় তোমার হাত ধরে আছে সব সময় তোমার কাছে কাছে আছে তুমি চাইলেই তাকে দেখতে পাবে।"
আমি বললাম কোথায় থাকে সে? আকাশের দিকে হাত উঁচু করে বলেছিল, "ঐতো ওপরে।" তখন সত্যি বলছি কিছু বুঝিনি। ঐদিন রিং মাস্টার কাকুর গলা জড়িয়ে টকাস করে একটা চুমু খেয়ে গৌরকাকুর সাইকেলে উঠে পড়েছিলাম। আর কেন জানিনা গৌড় কাকু আর রিং মাস্টার কাকু দুজনের চোখেই জল-ছল-ছল করছিল।
গৌর কাকুর সঙ্গে যখন বাড়ি পৌঁছলাম তখন বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। প্রথমে বাড়ির লোকেরা ভেবেছিল আমি কাছেই আমার ছোট পিসিমার বাড়িতে হয়তো খেলতে চলে গেছি। এখন খোঁজ করে পাওয়া যায়নি তখন সত্যিই বাড়ির লোকেদের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বেশি খোঁজাখুঁজি করার আগেই আমি বাড়ী ফিরে এসেছিলাম। গৌর কাকু বাড়িতে সব কিছু বলার পরে আমার মা আমাকে টানতে টানতে দোতলার ঘরে নিয়ে গিয়ে তালা চাবি দিয়ে বন্ধ দিলো।
বলল "এত দুরন্ত ডাকাত মেয়েকে নিয়ে আমি আর কিছুতেই পারব না ঘরে বন্ধ থাকুক।" বেশিক্ষনের জন্য নয় অবশ্য খুব বেশি ঘন্টাখানেক হবে। তার মধ্যে এমন আমি এমন চিৎকার শুরু করেছিলাম। একটু পরেই আমাদের বাড়িতে প্রচুর লোকের সমাগম শুরু হয়ে গেল আমার সমস্ত কীর্তিকলাপ জানতে পেরে। সবার মুখেই এক কথা কি ডাকাত মেয়েরে বাবা! বাড়ি থেকে চলে গেছে সার্কাসে যোগ দেবার জন্য!" কিছুক্ষণ পরে মা ঠাকুরমা দরজা খুলে দিয়ে গেল। আর বলল, "কোনদিন এরকম করোনা আমাদের কষ্ট হয়। যা করবে আমাদের বলে করবে কখনো তোমাকে বাধা দেবো না" তখন মায়ের কথা বাধ্য মেয়ের মতো মেনে নিয়েছিলাম। তারপর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সার্কাস দেখতে যেতাম ঠিকই কিন্তু সার্কাস চলে যাবো এই ভাবনাটা তে মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির সবাইকে কথাও দিয়েছিলাম যে বাড়ি থেকে কোথাও না বলে আর চলে যাব না। গৌর কাকু রিং মাস্টার কাকুর লেখা নোট বইটা বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। বড় হয়ে যখন দেখেছি লেখাগুলো তখন বুঝতে পেরেছি সেদিন আমাকে রিং মাস্টার কাকু ঠিক কী কী কথা বলতে চেয়েছিল। সংসারটা আসলে ট্রাপিজের খেলা। ব্যালেন্স করে চলতে না পারলে কিছুই করা যাবে না। কান্নাহাসির-দোল-দোলানো গানটার ভাবার্থ আমি এখন জানি। সবথেকে বড় কথা ওই যে আমাদের সবার উপরে যে রিং মাস্টার আছেন যার নির্দেশে আমরা এই খেলাগুলো খেলছি। তার ওপর যেন সবটুকু ভর্সা করতে পারি। তবেই আমরা সব খেলাতে জিততে পারব। সব দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে পারব।
সুচিন্তিত মতামত দিন