ঝর্না বিশ্বাস

মায়াজম
0
জীবন খেলা



ট্রাপিজের খেলাতে প্রথম আলাপ। লাফাতে গিয়ে আরেকটু হলে ফসকে যেত মেয়েটা।
  • নতুন বুঝি?
  • হ্যাঁ, এক সপ্তাহও হয়নি।
ওদিক থেকে রাজু খেলা শুরু করার জন্য সমানে হাত নাড়াচ্ছে। ওদিকে নীচে মাস্টারের চিৎকার।
পরদিন বেরোল না মেয়েটা। ওদের দলেরই একজন বলল,
কাল সারারাত কেঁদেছে।
বাপি আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
  • কেন, বাড়ির জন্য?
ছোটকি উত্তর দিল,
  • না রে। বাড়ি কই…ওই তো দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে মানুষ।
রাতে খাবার টেবিলে আবার দেখা।
চোখের তলায় যেন মস্ত ব্যাগ ঝুলছে…মুখ ভার – তবু ঠোঁট দুটোতে লাল ক্যাটকেটে লিপস্টিক।
বাপি নিজেই এগোল।
  • শুনলাম মনখারাপ।
মেয়েটা উমহু করে দুটো শশাকুচি চিবোতে চিবোতে প্লেটে অল্প ভাত আর ডাল তুলল।
এখানে সবাই আমরা এক পরিবারের মত। বলে, মিঠুদি হাত রাখল মেয়েটার কাঁধে। আর বাপি ওনাকে দেখেই সরে পড়ল।
মিঠুদির সাথে সবার জমলেও বাপির ঠিক হয় না। এত বেশি জ্ঞান দেয়, যে কান ঝালাপালা হয়ে যায়।
যদিও ম্যানেজারের ডানহাত মিঠুদি। তাই একটু সমঝে বুঝে চলা।
কাল প্র্যাকটিস আছে সকালে। একদম পাঁচটায়, বলে গট গট করে ম্যানেজার হাঁটা দিলেন। এই মস্ত চেহারার লোকটার যে অত সুন্দরী একটা মেয়ে থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হত না কারো…
মেয়ের নামেই এ দল…অজন্তা সার্কাস।
ও মাঝে মাঝে আসে মায়ের সঙ্গে। এক ঝলক চোখ বোলায় কাজে কর্মে, আলাপ পর্ব সারে ও তারপর আবার বেশ কদিন আতাপতা নেই।
একটু একটু করে অন্ধকার কাটছে বাইরে আর মিঠুদির ঘর থেকে আসছে রেডিও মির্চি… সকালটা ভালো হয়ে গেল পুরনো হিন্দি গানে।
মিঠুদিরও এখানে অনেক বছর হলো…সেই কবে - বিয়ে সব ঠিকঠাক…পরে ছেলেটা বেঁকে বসল। ওনার নাকি আরো শিক্ষিত, সুন্দরী বউ চাই। মিঠুদিও স্পষ্টবক্তা বরাবর…তাই না, করে সোজা এসিস্টেন্টের চাকরি নিয়ে এ সার্কাসে।
এখন নতুনদের গাইড করা থেকে শুরু করে মানসিক সমস্যা বা হোমিওপ্যাথির গুলি, সবই তাঁর ঝুলিতে। কিন্তু প্রথম দিন বাপির সাথে কথাকাটি হয়ে গেল। বাপিও থামবার মানুষ কই!
সেও বলল…
তুমি থাকো তোমার জ্ঞানগম্মি নিয়ে…আমায় দিতে এসো না।
তবে মিঠুদি স্নেহ করেন খুব। যেবার ওর ধুম জ্বর, নিজে না এলেও লোক পাঠিয়ে খবর নেওয়া, ওষুধ দেওয়া সবই করেছেন উনি।
আলুথালু চুলে, ব্রাশ হাতে এগোচ্ছিল মেয়েটা…বাইরে পাতা খাটিয়ায় তখন এপাশ ওপাশ করছিল পল্টু। শো-তে ওর রিংএর খেলায় হাসির রোলে ফেটে পড়ে দর্শক।
ওইটুকু হাইট হলে কি হবে…বেচারার বুদ্ধি জম্পেশ…বেলা হিসেব করে বলে দিতে পারে আজ মোটামুটি কত লোক হবে।
বাপি মেয়েটাকে এগোতে দেখেই কসরত শুরু করে দিল…হাত পা ছুঁড়ছে এদিক ওদিক…
মেয়েটা মুচকি হাসল একবার। বলল,
  • সত্যি কাল আপনি না থাকলে পড়েই যেতাম।
বাপি খপ্‌ করে ধরে বসল, “আপনি” শব্দটা…এখানে আপনি টাপনি চলে না…হয় তুমি নাহলে তুই…কোনটা পছন্দ ভেবে নিও…
আচ্ছা। বলে মেয়েটা চলে গেল। আর পল্টু চোখ ডলতে ডলতে বাপির দিকে তাকিয়ে –
  • সক্কাল সক্কাল শুরু করে দিয়েছিস…
তাঁবুর ভেতর থেকে ছোটকির আওয়াজ আসছে।
  • কতক্ষন লাগবে রে তোদের, বেরো বলছি।
বাপি, রাজু, পল্টু ততক্ষণে জমায়েত হয়ে গেছে দল নিয়ে…শুধু বাইক খেলা দেখানো অজয় বাবুর পাত্তা নেই।
শোনা কথা অবশ্য, বেশ বড় বাড়ির ছেলে হলেও পড়াশুনা লাট করে উনি যখন চাকরি খুঁজছিলেন, তখন অজন্তা সার্কাসের বিজ্ঞাপনেই চোখ আটকে যায়। আর এরাও অমন একজনকেই খুঁজছিল, যে বাইক চালানোয় পটু…
অজয় বাবুর একমাত্র নেশা বলতে বাইক। সুতরাং খাপে খাপে মিলে গেল সব।
লম্বা চওড়া, রোগা এই মানুষটা যখন বাইক নিয়ে পাক খায় “মৎ কা কুঁয়া”য়, তখন বেশ কিছু দর্শক - আসনে বসে দাঁত দিয়ে ঠোঁট বা ঠোঁট দিয়ে দাঁত চেপে থাকেন। বাইকের ভ্রুম ভ্রুম শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় কাচ্চাবাচ্চার দল।
কিন্তু বড় খামখেয়ালি…এত বেশি ভাবুক প্রকৃতির যে খুব ভয় হয় মিঠুদিরও…ওরকম সাঙ্ঘাতিক খেলায় হাত ফসকানো মানেই বড়সড় দূর্ঘটনা…
উনি এলেন যখন এদের চা পর্ব শেষ।
বাপিকে দেখা গেল গার্লস গ্রুপে বসে আড্ডা মারছে…ওদের তিনটে মেয়ে উত্তর বঙ্গের, দুজন পুরুলিয়া…ও সুহাস একা, ফ্রম বিহার। ওর গোটা হিন্দি আর আধো বাংলায় সার্কাসের দলে জম্পেশ হাসির রোল ওঠে…
এদের সবাই যখন সাইকেলে খেল দেখায়, দর্শক জুড়ে তখন হাততালি আর হাততালি…খেলার লিড করে সুহাসই…
তবে বাপি ওদের খুব পছন্দের …তাই মজাও করে বাপিকে নিয়ে…
সুহাস তো বলেই দিল আজ –
  • নয়ী চিড়িয়া সে বাৎ হুয়া!
আর বাপি একপ্রকার গম্ভীর হয়েই…
  • কোশিশ মে হু, দোস্তো…
  • এই শোনো…
পেছন থেকে ডাক দিল, বাপি।
মেয়েটা দাঁড়ায়…দেরী হয়ে গেছে খুব। জলদি বলুন…ওহ সরি, বলো…
  • কি নাম তোমার…
  • পিয়ালি…
ও আচ্ছা…এখন ঠিক আছ…মানে মনটন কেমন…
হ্যাঁ বলে এগিয়ে গেলো মেয়েটা…আর বাপিও সামলে নিল নিজেকে… এবার ওকে তৈরি হতে হবে…আজ শো-তে সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশন ট্রাপিজই…এমনটাই বললেন ম্যানেজার বাবু।
পাখি নিয়ে খেলা দেখানো শ্যামসুন্দর অসুস্থ…বড্ড কাশি হচ্ছে…বুকে ব্যাথা…তাই ওকে রেস্ট দিয়ে আরো দুটো খেলা ড্রপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে…পল্টু আর ওর দল থাকবে…থাকবে সুহাস ও টিম…মাঝে ছুরির খেলায় রাজুকে লাগানো যায়…
শো সেদিন জমজমাট…মস্তানা দারুন খেলা দেখিয়েছে…
বাপি মস্তানার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতেই ও চোখ বন্ধ করে শুঁড় তুলে নমস্তে করল।
পিয়ালিও এখন দলের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে…
সুহাসের বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে…দিদির বিয়ে ঠিক, কিন্তু ম্যানেজার কি ছুটি দেবে?
মিঠুদি ওকে আশ্বাস দিল…আমি দেখব ব্যাপারটা…তোরা শুধু শো জমা।
এদিকে পরদিন অজন্তার আসার কথা…তাই সকাল থেকে বাপিকে আর দেখা গেল না…দাড়ি কামিয়ে সে এখন মুখে হলদি চন্দনের প্যাক লাগিয়েছে, বলেই খ্যাঁক করে হেসে ফেলল পল্টু।
যদিও সবাই জানে সে গুড়ে বালি…জলে আর আগুনে কি মেলে…!
এখন মিঠুদিকে খুব দেখা যায় অজয়বাবুর খেয়াল রাখছেন…পিয়ালি ও রাজুতে মিলে জম্পেশ খেল দেখাচ্ছে…শো পরপর সুপারহিট…

তবে দুটো মানুষের কিছুই বদল হয়নি…পল্টুর বালিশের নীচে থাকা শ্রদ্ধা কাপুর…আর বাপির ভাঙা গলার গান…“কি করে বলব তোমায়…”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)