সিরাজুল ইসলাম

মায়াজম
1
রঙিন প্রজাপতি



সার্কাস! সার্কাস!! সার্কাস!!!
" সুপ্রিয় এলাকাবাসী, আপনাদের চিত্তবিনোদনের জন্য আবারও এসেছে আনন্দ-সার্কাস! আজ সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হবে মিস কৌশিকীর শ্বাসরুদ্ধকর আর মন মাতানো কলানৈপূন্য! "
মফস্বল শহরের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় তিনচাকার রিক্সায় "আনন্দ সার্কাস"এর প্রচার দিতে দিতে এগিয়ে যায় কন্ঠটা। অদূরে জলাভূমিতে কৃষিকাজে ব্যস্ত বিপিন। শব্দযন্ত্রটায় ভেসে আসা কথাগুলো শুনে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ টের পায় বুকের ভেতর। মিস কৌশিকীর নামটা শোনার পর থেকেই তার সব এলোমেলো হয়ে যায়।

মতিগঞ্জে বিপিনের মাসীবাড়ী। সেবার স্কুলের লম্বা ছুটিতে বিপিন বেড়াতে যায় মাসীবাড়ী। কিশোরী বয়সের কৌশিকীর সাথে সেখানেই পরিচয়। কৌশিকী সবেমাত্র ফ্রক ধরেছে। পুরুষ্ট বুকের টানটান খাঁজগুলো প্রবলভাবে আকর্ষন করে বিপিনকে।
"মনের ভেতর ধূ ধূ বালুচর, নীলডুরে আসমানী শাড়ী
স্বপ্ন দুপুর ভাঙা মন্দির, পড়ে আছে পোড়ো ঘরবাড়ী।
যেন শত-জনমেরও আগে-
সোহাগী মন স্বেদ-চুম্বন দিয়েছিলো কত না অনুরাগে!
নাভীমূল থেকে পথ একেবেঁকে চলে গেছে পথের বাঁকে-
বুকের ঘর জোড়া কবুতর, হাতছানী দিয়ে শুধু ডাকে!
বিবসনা নারী,শিপ্রানদী তল থইথই জল-
শোকশান্ত দুঃখ নেভানো শীতার্ত রাত্রীর কোলাহল! "

কী এক দুঃসহ যন্ত্রনা কুঁরেকুঁরে খায় বিপিনের বুকে। সারারাত কৌশিকীকে ভেবেভেবে কাটে তার নির্ঘুম রাত। ভোরসকালে পুকুরঘাটলায় মুখ ধুতে যেয়ে দেখা হলো দু'জনের। চঞ্চলামন প্রজাপতির মত। ফিক করে হাসি হাসে কৌশিকী। ভালো লাগার অনুরণ পরতে পরতে ছড়িয়ে যায়।
এভাবেই শুরু।

যে ক'টা দিন মাসীবাড়ী ছিলো,সকাল দুপুর দু'জনের ভালোলাগার ডালপালা ছড়িয়ে বেশ ঝাঁকড়া হয়ে গেছে ততদিনে। আন্দাজ করতে পেরেছিলো কৌশিকীর বউদি। ব্যাপারটা ভালো চোখে নেয়নি বউদি। বউদির মনে স্বপ্ন ছিলো তার মাসতুতো ভাইয়ের সাথে কৌশিকীর একটা ব্যবস্থা করে দেবে। যে ভাইটা শহরে থাকে। এবং বখে গেছে।
পুরোপুরি বিগড়োবার আগেই দু'জনকে এক করার চিন্তা ছিলো বউদির। পাখি যে ডানা মেলতে শুরু করেছে বুঝতে দেরি হয় না বউদির।

মতিগঞ্জ থেকে ফেরার সময় কৌশিকী বিপিনের দু'হাত জড়িয়ে ধরে বলেছেঃ,"আমি সারাটা জনম তোমার হয়ে থাকলাম। অপেক্ষা করবো তোমারই জন্য! "
নাহ্! কৌশিকীকে আর অপেক্ষায় থাকতে হয়নি।
বউদি তার মাসীবাড়ী বেড়াতে নিয়ে যায় কৌশিকীকে। দু'দিনের পরিচিত বউদির সেই বখে যাওয়া ভাই প্রস্তাব করে বসে কৌশিকীকে নিয়ে পাকসার্কাস ময়দানে জেমিমি সার্কাস দেখতে যাবে। উৎসাহে ইন্ধন জোগায় বউদি।

মাঝরাতে সুনশান পাড়া নিঝুম! ফিরে আসে বখে যাওয়া ভাই। ফেরেনি কৌশিকী!
ফিরবে সে কি করে? বখে যাওয়া ভাইয়ের নিয়মিত যাতায়াত সোনাগাছিতে। সেখানেই সে পাড়ার মাসীর জিম্মায় ছেড়ে এসেছে কৌশিকীকে। চুক্তিবিনিময়ে স্বেচ্ছাচারিতায় মৌজ করতে পারবে যে কোন সময় মর্জিমাফিক।
বাড়ীতে হায় হায় কান্নার-রোল গড়ালো ক'দিন। সবাই জানলো জনসমুদ্রের কোলকাতার ভিড়ে হারিয়ে গেছে কৌশিকী নামে মেয়েটি। থানা পুলিশ করেও কোন লাভ হয়নি। মেয়ের জন্য গোপনে দীর্ঘশ্বাস ঝরে কৌশিকীর বাবা-মায়ের।
আর বৈশাখী ঝড়ের উন্মত্ততায় ভেঙে গেছে বিপিনের মন, যখন সে জেনেছে সেসব।

সময় থেমে থাকেনা।
সোনাগাছির মাসী কৌশিকীকে কিশোরী থেকে নারীতে পরিনত করে দেয় মাত্র দু'দিনে। বন্দিপাখির মত গুমরে কাঁদে কৌশিকী। আস্তেআস্তে থিতু হয়ে আসে চোখের জল। বদলে সেখানে জমা হয় প্রতিহিংসার আগুন। সে আগুনের লেলিহান শিখা উত্তপ্ত বিষলক্ষ্যার ছুরি হয়ে আমূল বিঁধে যায় একদিন সেই বখে যাওয়া ভাইয়ের বুকে ; যখন সে পাড় মাতাল হয়ে এসেছিলো কৌশিকীর ঘরে।
নরহত্যার দায়ে প্রথমে থানা-হাজত! তারপর বিজ্ঞ আদালতে সওয়াল জবাব! কিশোরী বয়সের কারণে কয়েক ক'বছর কারাদন্ডে দন্ডিত করলো মহামান্য আদালত।

সেদিন আলিপুর জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে সুবিশাল আকাশের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে উদাস হয়ে যায় কৌশিকী।
কোথায় যাবে দিশা খুঁজে পায় না সে।
উদ্ভ্রান্তের মত পথ চলতে চলতে হাওড়া প্লাটফরমে চলে আসে। সেখানেই পরিচয় হয় আনন্দ-সার্কাসের অধিকারীর সাথে। সবকিছু শুনে অধিকারী কাকু ঠাঁই দিয়েছিলো তার দলে।

এভাবেই সময় গড়িয়েছে গঙ্গাজলের স্রোতের মতন। অনেক পথের বাঁক ঘুরে কৌশিকী এখন সুদক্ষ। বলা চলে আনন্দ-সার্কাসের প্রাণ। পুরুষ্ট-যৌবন, স্বল্পবসনা কাঁচুলীর বাঁধ মানেনা। উন্মাদনায় ভেসে যায় উন্মত্ত দর্শক। শুধু এই ক্রীড়ানৈীপুণ্য দেখেই সোল্লাসে ফেটে পড়ে ভক্তসমাবেশ। উপচে পড়ে মানুষ।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, চেষ্টাচরিত্র করে কৌশিকীর সাথে দেখা করার সুযোগ পায় বিপিন। প্রথম দেখায় চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নেয় কৌশিকী! ফিরিয়ে দেয় সে বিপিনকে না চেনার অজুহাতে!
নিজেকে প্রবোধ দেয় কৌশিকীঃ,"এ অপয়া দেহটাকে সে কী করে পুজোর নৈবেদ্যয় সাজাবে? "

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন