রাখী সরদার - মায়াজম

Breaking

১৭ এপ্রি, ২০২০

রাখী সরদার

আত্মপীড়ন ও জীবন

..এবার আমাকে টগবগে ভাতের ফ্যানে জীবনের
উষ্ণ ফুল ফোটাতে দাও।হে জীবন এতদিন
অলক্ষ্য যাদুকরের মতো তুমি সুতো ছেড়েছো
আবার সুযোগ বুঝে কৌশলে সুতোয় দিয়েছ টান।
আর আমি নিয়ত হেরে যাওয়া মানুষ রূপে কাটা
ঘুড়ির মতো শূন্য ঘূর্ণির মধ্যে পাক খেতে খেতে
উচ্চারণ করেছি-'ওহ জীবন,এ যাদুখেলা কতদিন?'
প্রায়শই আমার মনে হত জীবন যেন এক কুণ্ডলী
পাকানো স্টেশন ---- সেখানে কত রঙচঙে পোশাক
পরা নারী পুরুষের ভিড়।তারা হাতে হাত রেখে
প্রবল বাসনায় ব্যালেন্সের খেলা শেখার জন্যে
ট্রেন ধরতে আসে।প্রচণ্ড ভিড়ে কিছুজন
উঠতে পারে ,কিছুজনের হাত ছেড়ে মুহূর্তে
আত্মপীড়নে দলা পাকিয়ে পড়ে থাকে।আর যারা
খানিক ভেঙে চুরেও উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে
তুমি তাদের ভাঙা ঘাড়ে এত পাথরের বোঝা
চাপিয়ে দাও যে তারা আবার মুখ থুবড়ে পড়ে।
আমি এতদিন ওইসব রঙিন নারী পুরুষের ভিড়ে
চূর্ণ প্রত্যাশাকে হাতে নিয়ে ট্রেনের কামরায়
কামরায় ধূসর কাঙাল দেহে ঘুরে বেড়িয়েছি,
হাতজোড় করে বলেছি --'জীবন রে একটুকরো
আলো ভিক্ষা দে।'তুমি সুটেড বুটেড দর্শক রূপে
ব্যঙ্গ করেছো,আমার খিদেকে খিদে না ভেবে
ছলনা ভেবেছ।আমাকে লোভ দেখিয়ে নেমে
গিয়েছ পরের স্টেশনে।আর আমি ট্রেনের গতি,
গন্তব্য কিছু বিচার না করেই তোমার পিছু পিছু
নামতে গেছি, ফলস্বরূপ বেসামাল বাতাস
আছড়ে ফেলেছে এবড়ো খেবড়ো কালো পাথরে।
আমি থ্যাঁতলাতে থ্যাঁতলাতেও বলছি ---
' জীবন,এবার অন্তত হাত ধরো ...'
মাটিতে মিশে যেতে যেতেও ঘাড় বাঁকিয়ে উঠতে
চেষ্টা করি,যেমন পাথরের খাঁজে আটকে থাকা
বৃক্ষ বীজ অতি কষ্টে অঙ্কুর ঠেলে চোখ মেলতে
চেষ্টা করে।তুমি যাবতীয় কৌশলে আমার হাত ,
পা,এমন আছাড়ি,পিছাড়ি করে বাঁধলে যে
এক্কেরে শব্দহীন হয়ে কিছুকাল আড়ষ্ট হয়ে
শুয়ে র‌ইলাম।একজন বিপন্ন,নিস্তব্ধ মানুষকে
দেখে তখন তোমার সে কী উল্লাস! খুশীতে
নাচতে নাচতে টিমটিম জ্যোৎস্নায় বাবুদের
বাগান বাড়িতে লাল মদের কাচপাত্র নিয়ে বসে
গেলে ।একটু করে চুমুক মারতে লাগলে আর
আড়চোখে আমার যন্ত্রণায় ফুলে ওঠা চোখের
দিকে তাকাতে লাগলে।এমন ব্যবহারে সেদিন
বুঝেছিলাম -- 'জীবন তুমি একটা দৃশ্যভুক
ভয়ঙ্কর উন্মাদ।'
আমি যত মাটি থেকে ওঠার চেষ্টা করছি ,শরীরে
কেটে কেটে বসে যাওয়া বাঁধন গুলোকে আলগা
করার চেষ্টা করছি তত বেশি অবাধ্য জোঁকের
মতো বাঁধন এঁটে বসছে,দেহের নরম মেয়েলি
কোষের রক্ত শোষণ করে বাঁধন ফুলে ঢোল হচ্ছে।
এই পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা আর শোষণ করার দুর্মর
মানসিকতার অসম লড়াই দেখে তুমি উন্মাদের মতো হাততালি দিচ্ছো।
আমি রাগে,দুঃখে,পীড়নে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছি।একে
তাকে দোষারোপ করছি,আমার মূল লক্ষ্য থেকে
সরে গিয়ে নিজের চোখের ভিতর সারি সারি
লোভ - হিংস্রতা সাজাচ্ছি,নিজেকে ভিতর থেকে
খনন করছি এই সুযোগে তুমি নিজস্ব ম্যাজিক
দেখাতে শুরু করেছ।বাঁধন খুলে সেই একরৈখিক
দড়ির উপর আমাকে তুলে দিয়ে নিচ থেকে ম‌ইটা
সরিয়ে নিলে।আমার দিকে আমার চেনা পরিজন
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে তাকিয়ে ।কি হয়!কি হয়!আমি নীচে
অবনত জীবনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে দুলতে
থাকি।না আছে ম‌ই,না আছে আলোর খুঁটি।
হঠাৎ আকাশ অন্ধকার।এক ক্রোধী কালো মেঘ
গর্জন করতে করতে আমার দিকে তেড়ে আসে।
ঠেলে দেয় অতল অন্ধকারে।কেউ নেই কিছু নেই
শুধুমাত্র আমার একাকীত্ব দুমড়ে মুচড়ে
পঙ্গুরূপে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।নিরুপায় কণ্ঠ
আর্তনাদ করতে করতে বলছে - 'জীবন...
তুমি ভয়ানক!কাতরক্লিষ্ট মুখ তুমি ভালোবাসো।'
কুচকুচে কালো অন্ধকার ক্রমশ কুণ্ডলী পাকায়।
আমি একা একা নিশ্চুপে শুয়ে থাকি।
ভীষণ অন্ধকারে কতকগুলো বিষ পিঁপড়ে
আমার তর্জনী কেটে ইঙ্গিত করে --আশেপাশে
কাল কেউটে ঘুরছে।তার লেজে কালো ফিতেয় 
মোড়া কুটিল অভিসন্ধি ।সাবধান... সাবধান।
কাটা আঙ্গুলের যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে অবাক
হ‌ই,ভাবি এই ছোট্ট বিষধর প্রাণী নিজেই রক্তপাত
ঘটিয়ে আমাকে সাবধান করছে!এমন বাড়াবাড়িতে
আমার না পসন্দ।ভীষণ বিরক্ত লাগে।তেষ্টায় আর
ব্যথায় ককিয়ে উঠি তাও প্রবল আলস্যে এক‌ই
জায়গায় এক‌ই ভাবে শুয়ে থাকি।আমার এই
নিরবে নির্ঝঞ্ঝাট থাকাটা তোমার সহ্য হলোনা।
কুটিল সাপুড়ের মতো একেবারে পাশের গর্তের
মুখে সাপধরা মন্ত্র পড়তে লাগলে।আর যায় কোথায়।
মাটির আড়াল ছিঁড়ে ছুটে আসছে ফণার
শিস।আমিও ভয়ে সিঁটিয়ে।কিছুতেই শরীরের
সেতু ভেঙে পালাতে পারিনা।অগ্যতা বিষ দাঁত
ছুঁয়ে দিল আমার আত্মচিন্তায়।কী তীব্র জ্বালা
ব্যথা টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে গড়ায়।আর
তুমি সকৌতুকে উপভোগ করতে থাকো আমার
মরণ বাঁচন খেলা।প্রাণপণে শ্বাস নিতে নিতে
ককিয়ে উঠি --'জীবন তোকে ডিঙিয়ে কোথাও
পালানো যায়না।'
এত বাধা বিপত্তি, হাত ,পা ভাঙা,ফুসফুস ফুলে
ওঠার খেদ,তাও আমার বুকের স্পন্দনে ডুগডুগ।
মঞ্চের নীল পর্দা সরিয়ে রাসলীলা দেখি।আমার
আজন্ম প্রয়াসীর কমলা ঠোঁটের চুকচুক শব্দ
শুনি।বুকের ডালিম গন্ধে রক্ত নেচে ওঠে।ভিতরের
যাবতীয় দুঃখ বন -পিঁয়াজের কলির ঝাঁঝালো গন্ধে
আমার যাবতীয় আকাঙ্খা গাছ থেকে ঝুলে থাকা
লাল আপেলের মতো ঝুলিয়ে রাখি।যেকটা
হাতের নাগালে পাবো সযত্নে পেড়ে নেব।যে কটি
পাবোনা ভুলে যাব -দুঃখ করবোনা।এমন
মনের জোর দেখে তুমি বিরক্ত হয়ে ওঠো।তোমার
এই রাগী অভিব্যক্তি দেখে আমি ছেলে মানুষের
মতো লাফঝাঁপ শুরু করি।আত্মপীড়নে ছেড়ে গর্জে উঠি।
আকাশ ভাঙার মতো শব্দ করি।দৃপ্ত কণ্ঠে
বলি -'তুমি যে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে রেখেছ,একদিন
কোন বাদামী কেশরযুক্ত তেজী ঘোড়া লাফ দিয়ে
তা পার হবেই।এবং আমাকেও তার বলিষ্ঠ পিঠে
স‌ওয়ার করে নেবেই।'
এখন আর কোন ভণিতা নয়,কোন অজুহাত নয়।
এক নাগাড়ে অনেকদিন শাসন করেছ,পীড়ন
করেছো,স্বতন্ত্র রোমাঞ্চে পিষে গেছ,এবার উঠে
দাঁড়াব।তুমি স্বয়ং আমার হাত ধরবে,শ্রী চন্দনে
কপালের কালশিটে মুছে দেবে।আর ঝিমধরা
ধূসর অধ্যায়ে শুকনো ঘাসফুল খুঁজবোনা। 
একেবারে টগবগে ফ্যানভাতে উষ্ণ জীবন ফুল
ফোটাব।
------*------

1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র