গৌতম দত্ত - মায়াজম

Breaking

১৭ এপ্রি, ২০২০

গৌতম দত্ত

ঝলমলে তাঁবু’র ভেতরে

খুব বেশিদিন নয়। সন ২০১২। “লাইফ অফ পাই” (Life of Pi) নামে একটা সিনেমা সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই উপন্যাসটার লেখক একজন কানাডিয়ান, নাম ইয়ান মার্টেল। এ বইটা প্রায় দশ মিলিয়ন কপি বিক্রির রেকর্ড করেছিল সেসময়। সিনেমাটির পরিচালক ছিলেন এ্যাং লি (Ang Lee)।
আপনাদের মনে থাকার কথা এই কারণে বললাম যে
(১) এই সিনেমাটি বক্স অফিসের সাফল্যের চুড়ায় উঠে ব্যবসা করেছিল আর
(২) আমাদের রাজধানী দিল্লী শহরে ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রাতে ২৩ বছরের এক
ছাত্রী তার পুরুষ বন্ধুর সাথে এই ‘লাইফ অফ পাই’ সিনেমাটা দেখতে গেছিল। সিনেমা
দেখে দুই বন্ধু বাসে করে বাড়ি ফিরছিল। আর তারপর কি হয়েছিল তা আমরা এখনো
রোজকার সংবাদপত্রে পড়েই চলেছি।
‘লাইফ অফ পাই’ এর গল্পটা খুব সংক্ষেপে এই রকম –
সন্তোষ প্যাটেল। পণ্ডিচেরি’র মানুষ আর এক চিড়িয়াখানার মালিক। ভারতে সত্তর দশকের মাঝামাঝি একটা রাজনৈতিক সংকটকাল চলছিল। তা সেই সময় সন্তোষ প্যাটেল তার চিড়িয়াখানা বিক্রি করে কানাডা চলে যাওয়া স্থির করেন। স্ত্রী গীতা, ছেলেরা আর কিছু জন্তু-জানোয়ার নিয়ে একটা মালবাহী জাহাজে চড়ে বসেন। মাঝ সমুদ্রে এক ভয়ানক ঝড়ে গোটা জাহাজটির সলিল সমাধি ঘটে। এক ছেলে ‘পাই’ আর এক রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ বেঁচে যায় অবিশ্বাস্য ভাবে। খোলা আকাশের তলায় গভীর সমুদ্রে একটা বাঘ আর একটা ছেলের বেঁচে ওঠার সংগ্রাম নিয়ে এ সিনেমা। দুজন দুজনকে বিশ্বাস করে ফিরে আসার গল্প।
সার্কাসের কথা লিখতে গিয়ে চিড়িয়াখানা, সিনেমা ইত্যাদি ইত্যাদি কেন যে লিখে চলেছি কে জানে। তবে এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, সার্কাস মানেই ছিল একটা ছোটোখাটো চিড়িয়াখানা। বাঘ, সিংহ, হাতি, জলহস্তি, উট, ঘোড়া, কুকুর, ম্যাকাও, কাকাতুয়া এমন আরো কতো কি। আর এই পশুপাখীদের সাথে মানুষের খেলা দেখতে চায় ছোটো থেকে বুড়ো সব্বাই। বাড়ির পোষা কাকাতুয়া কিংবা টিয়া যখন কথা বলে তখন চমকে উঠতেই হয়। এখন অবশ্য কাকাতুয়া পোষা আইনতঃ শাস্তিযোগ্য।
📷
এই মানুষটার নাম ফিলিপ অ্যাশলে। একে বলা হয়ে থাকে আধুনিক সার্কাসের জনক। ইংরেজ। ছিলেন সেনাবাহিনীতে ঘোড়াদের ট্রেনার। ঘোড়াদের নিয়ে নানা রকম খেলা দেখাতে পারতেন। এর পরে অবসর জীবনে লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজের কাছে একটা অশ্বারোহণ শেখার স্কুল খোলেন। সেখানে সকালবেলা তিনি ঘোড়ায় চড়া শেখাতেন আর বিকেলে খেলা দেখাতেন। ঘোড়ায় চড়া আর খেলা দেখানোর জন্য তিনি মাঠের মাঝখানে গোলাকার একটা মঞ্চ তৈরি করেন। এই মঞ্চই পরবর্তী সময় সার্কাসের রিং নামে পরিচিতি পায়। ১৭৭০ সাল তখন।
অ্যাাশলে তার খেলার মধ্যে ব্যায়াম, দড়ির উপর হেঁটে যাওয়ার খেলা, জাগলিং, নাচ-গান এসব যোগ করতে থাকেন। দুটি খেলার বিরতির মাঝে ক্লাউনের এর প্রথম আবির্ভাব ঘটান অ্যাাশলে। থিয়েটার শোগুলোতে তখন ক্লাউন থাকতো। তাদের মূল কাজ ছিল দৃশ্যান্তরের মধ্যে দর্শকদের মনোরঞ্জন করা। সেখান থেকে ভাড়া করে নিয়ে এলেন তাদের। পথ চলা শুরু হ’ল আধুনিক সার্কাসের।
📷
Astley's Amphitheatre in London, c.1808
সার্কাসের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো। বহু প্রাচীনকাল থেকেই রোম, মিশর ও গ্রিসের বিভিন্ন শহরে সার্কাসের খেলা দেখানো হতো। তখন যদিও একে সার্কাস বলা হতো না, তবে মূল বিষয় ছিল একই। সেই সময়কার সার্কাস এখনকার মতো এত আড়ম্বড়পূর্ণও ছিল না। তখনকার দিনে সার্কাস বলতে ছোটখাট আগুনের খেলা, লাঠি ঘোরানো, দড়ি খেলা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, ভারোত্তোলন ইত্যাদি দেখানো হতো। এর পাশাপাশি ছিল কিছু জন্তু-জানোয়ারের প্রদর্শনী, যা আজকের দিনের চিড়িয়াখানার চাইতে বেশি কিছু নয়।
ফিলিপ অ্যাসলো’র হাত ধরেই আধুনিক সার্কাসের যাত্রাপথ শুরু হয়। বর্তমান সার্কাসের অনেক জনপ্রিয় খেলা ছিল তার সৃষ্টি।
আধুনিক সার্কাস মানেই হ’ল ক্লাউন, অ্যাক্রোব্যাট, প্রশিক্ষিত প্রাণী, ট্র্যাপিজ, মিউজিশিয়ান, নৃত্যশিল্পী, জিমন্যাস্ট, জাগলার, যাদুকর, সাইক্লিস্ট এসবের সম্মিলিত খেলা।
ইংরেজিতে সার্কাস (circus)শব্দটি লাতিন সার্কাস (circus) থেকে এসেছে, যা গ্রীক শব্দ “κίρκος” (kirkos বা ক্রিকোস) যার অর্থ (circle or ring) "বৃত্ত" বা "রিং"। খ্রিস্টান লেখক টেরটুলিয়ান (Tertullian) তাঁর বই ‘দ্য স্পেকটাকুলিস’ (De Spectaculis) এ দাবী করেছেন যে পৃথিবীতে প্রথম সার্কাস দেখিয়েছিলেন তাঁর পিতা হেলিওস- সূর্যের দেবী সিরেসে’র (Circe) সম্মানে।
প্রাচীন রোমে ঘোড়া ও রথের ঘোড়দৌড়, অশ্বারোহী অনুষ্ঠান, মঞ্চ যুদ্ধ, গ্ল্যাডিয়েটরিয়াল লড়াই এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রাণীদের প্রদর্শন ও প্রদর্শনীর জন্য একটি বিশালাকার জায়গা থাকতো। এই সমস্ত রোমহর্ষকর খেলারই আধুনিকিকরণ হ’ল সার্কাস।
সার্কাস ম্যাক্সিমাস (Circus Maximus) বলে একটা বিশালাকার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল
রোমার অদূরে প্যালাটাইন এবং অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায়। এতে আড়াইলাখ লোক বসে খেলা দেখতে পারতো। পাথরের তৈরি চারশ মিটার দীর্ঘ আর নব্বই মিটার প্রশস্ত ছিল সার্কাস ম্যাক্সিমাস। এর পরে গুরুত্বপুর্ণ ছিল সার্কাস ফ্লামিনিয়াস (Circus Flaminius) এবং সার্কাস নেরোনিস (Circus Neronis)। সম্রাট নিরো’কে এসব সিরসেনীয় আনন্দ (Circensian pleasures) দিত। চতুর্থ সার্কাস ম্যাক্সেন্টিয়াস দ্বারা নির্মিত হয়েছিল; এর ধ্বংসাবশেষ প্রত্নতাত্ত্বিকদের রোমান সার্কাস পুনর্গঠনে সহায়তা করেছে।
📷
Trapeze artists, in lithograph by Calvert Litho. Co., 1890
স্কটসম্যান জন বিল রিকিটস প্রথম আধুনিক সার্কাস যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসেন। তিনি তাঁর নাট্যজীবন ১৭৮০ তে লন্ডনে হিউজেস রয়্যাল সার্কাসের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। ১৭৯২ সালে তিনি লণ্ডন থেকে আমেরিকা যান এবং ফিলাডেলফিয়ায় প্রথম সার্কাস স্থাপন করেন।
১৭৯৩ এর ৩’রা এপ্রিল ফিলাডেলফিয়ায় প্রথম সার্কাস-গৃহ’র উদ্বোধন হয়। আর এই স্টেজেই আমেরিকাকে প্রথম সার্কাসের শো উপহার দেন রিকিটস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এই সার্কাস দেখেছিলেন।
ক্যাথারিন দ্য গ্রেটের শাসনামলে, সার্কাস রাশিয়ার এক অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একসময় দেশটিতে সার্কাসকে অপেরার সমতুল্য এক শিল্প মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হতো। চার্লস হিউজেস নামের এক ব্যক্তির হাত ধরে রাশিয়ায় সার্কাস জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর তৎকালীন শাসকেরাও সার্কাসের জনপ্রিয়তা দেখে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে একে স্বীকৃতি না দিয়ে পারেননি।
১৯২৭ সালে সার্কাসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। এ সময় মস্কো শহরে গড়ে তোলা হয় সার্কাসের স্কুল। রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সার্কাস বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। এভাবেই রাশিয়ান সার্কাসের খ্যাতি বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও রাশিয়ান সার্কাসের মর্যাদা বিন্দুমাত্র খাটো হয়নি। আজও রাশিয়ার মস্কো শহরে ‘মস্কো স্টেট সার্কাস’ নামে রয়েছে এক বিশ্ববিখ্যাত সার্কাস দল।
‘সার্কাস অফ দ্য সান’ বা সির্ক জু সোলাই সার্কাসের খ্যাতি জগৎজোড়া। ১৯৮৪ সালের ৭ জুলাই কানাডার খুবই পরিচিত এই সার্কাস কোম্পানিটি খোলেন দুই বন্ধু গাই লালিবার্টি এবং জিলি স্টে ক্রোইক্স। কোম্পানিটি খোলার আগে এই দুই বন্ধু কানাডার পথে পথে জাগলিংয়ের খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন। বর্তমানে এই সংস্থায় বিশ্ব জুড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি কর্মী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫০০ জন হলেন সার্কাসের শিল্পী। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের শো আয়োজন করে থাকে। এদের এক-একটি শো এক থেকে দেড় ঘণ্টার হয়ে থাকে।
ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সার্কাস দলগুলোর মধ্যে অন্যতম সোয়াম্প সার্কাস। ১৯৮৬ সালে স্থানীয় শেফিল্ড অঞ্চলের কয়েকজন জিমন্যাস্ট এবং নৃত্যশিল্পী মিলে এই দলটি তৈরী হয়। এই সার্কাসের বিশেষত্ব হচ্ছে, তাদের প্রত্যেকটি শো-তে সমসাময়িক ভাবনা লেজার শোয়ের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়। ভূত নিয়ে খেলা এই সার্কাসের আরও একটি জনপ্রিয় খেলা । ভূত বা ‘স্পিরিট’ ইংল্যান্ডের মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় একটা বিষয়।
আধো-অন্ধকার রিঙে 'ভূতেরা' নেমে আসে মানুষদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। এই আত্মাদের সাহায্য করার জন্য আসে ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ার। শুরু হয় ভয়ানক যুদ্ধ। লাইভ মিউজিক আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে পুরো পরিবেশটা করে তোলা হয় রোমহর্ষক। শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে ভূতেদের পরাজয় ঘটে। পুরো গল্পটা এমনভাবে নির্মাণ করা হয় ছোট-বড় সবধরনের দর্শক ভয় এবং আনন্দ নিয়ে উপভোগ করতে থাকে এই ভূতুড়ে খেলা।
ফ্লাইং ফ্রুট ফ্লাই সার্কাস, অস্ট্রেলিয়ার এই সার্কাস কোম্পানি ৮-১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নির্মিত। ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষে এই স্কুলের জন্ম। এ সময় আলবেরিতে, স্থানীয় কয়েকজন সার্কাস শিল্পী এবং ‘মুরে রিভার’ নামের এক পারফরমিং গ্রুপের সহায়তায় ছুটির দিনগুলোতে শিশুদের জন্য সার্কাস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তারা ছ' সপ্তাহে ৮০ জন স্কুলপড়ুয়া শিশুদের প্রশিক্ষণ দেন। আর এই শিশুদের নিয়ে ‘মুরে রিভার’ পারফরমিং গ্রুপের আর্থিক সহায়তায় গড়ে তোলা হয় ফ্লাইং ফ্রুট ফ্লাই সার্কাস প্রতিষ্ঠান।
এবার ভারতের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ভারতে সার্কাসের প্রবর্তন হয় মহারাষ্ট্রের আনকাখোপ গ্রামের বাসিন্দা দক্ষ অশ্বারোহী বিষ্ণুপন্থ ছাত্রের হাত ধরে। তিনি ছিলেন রাজা কুর্দুওয়াদির আস্তাবলের দেখভালের দায়িত্বে। তবে, ভারতীয় সার্কাসের জনক বলা হয় কিলেরি কুনহিকান্নানকে। তাঁর জন্ম কেরলের থালাসেরিতে। তাই, কেরলকেই বলা হয় ভারতীয় সার্কাসের ধাত্রীগৃহ। ১৭৭৪ সালে প্রথমবার ভারত সফরে (তদানিন্তন বম্বেতে) এসেছিল গিউসেপ্পি চিয়ারিনির রয়্যাল ইতালিয়ান সার্কাস। তাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৮৮০ সালের ২০ মার্চ প্রথম শোয়ের আয়োজন করে বিষ্ণুপন্থের গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস। জানা যায়, কেরলে প্রথম সার্কাস দল তৈরি করেন বিষ্ণুপন্থের ছাত্র পারিয়ালি কান্নান। দলের নাম দেন গ্র্যান্ড মালাবার সার্কাস (১৯০৪)। কুন্নিকান্নান প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্কুল খুলেছিলেন। তার নাম চিরাক্কারা সার্কাস স্কুল। সেই স্কুলের ছাত্ররা পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি সার্কাস দল তৈরি করেছিলেন। যেমন হোয়াইটওয়ে সার্কাস, গ্রেট রেমন সার্কাস, গ্রেট লায়ন সার্কাস, ফেয়ারি সার্কাস, ইস্টার্ন সার্কাস, ওরিয়েন্টাল সার্কাস, জেমিনি সার্কাস, গ্রেট বম্বে সার্কাস, কমলা থ্রি রিং সার্কাস প্রমুখ।
বাঙালির সার্কাসে প্রথম হাতেখড়ি হিন্দুমেলা-র প্রতিষ্ঠাতা নবগোপাল মিত্রের হাত ধরে। তাঁর ভারী ইচ্ছে, একটা মেলার সূত্রে গোটা জাতিকে এক করে তোলা। হাড়ে-মাপে একটা স্বদেশী মানুষ। তার যা কিছু ভাবনা সব স্বদেশীয়ানাকে কেন্দ্র করে। বাঙালী ছেলেদের নিয়ে ভলেন্টিয়ার বাহিনী করতে হবে, তাহলে বাঙালীর ছেলেরাও বীরের মতো যোগ দিতে পারবে সেনাদলে, এই ভাবনা প্রথম মাথায় আসে নবগোপাল মিত্রেরই। এর জন্যে চাই ভাল স্বাস্থ্য। তাই খুলে বসলেন স্বাস্থ্যচর্চার আখড়া। এবং এই উদ্যোগের জন্যে তাকে বলা হয়ে থাকে ‘ফাদার অব ফিসিক্যাল এডুকেশন’। এ তো গেল শরীরের দিক। এ ছাড়া চাই মনের উন্নতি। তার জন্যে দরকার জাতীয় মেলা, জাতীয় রঙ্গালয়, জাতীয় সংবাদপত্র এমনকি জাতীয় সার্কাস। নবগোপাল একে একে সব কিছুই গড়ে তুলতে লাগলেন।
নবগোপালবাবুর 'ন্যাশনাল সার্কাস' প্রথমে খেলা দেখাত ঠনঠনিয়ায়। পরে তা নবগোপালবাবুর বাড়িতে উঠে যায়। সেখানে জন্তু-জানোয়ার বলতে ছিল একটি মাত্র টাট্টু ঘোড়া।
নবগোপালবাবুর সেই সার্কাসে বিভিন্ন ধরনের জিমন্যাস্টিকসের খেলা দেখানো হত, যেকারণে অনেকেই ‘সার্কাস’ বলতে নারাজ।
এরপর দু-চারজন ইংরেজ ও ইউরোপীয়কে সঙ্গে নিয়ে নবগোপাল মিত্রের জামাই রাজেন্দ্রলাল সিংহ ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’ নামে একটি সার্কাস দল তৈরি করেন। মির্জাপুরে শামিয়ানা টাঙিয়ে এই দল সার্কাস দেখাত।
আজকাল কলকাতায় কত রকমের মেলা হয়। কলকাতায় এই মেলা জিনিসটার প্রথম পত্তন করলেন যিনি তার নাম আগে একবার বলেছি। নবগোপাল মিত্র।
১৮৬৭। এপ্রিলের ১২ তারিখে বেলগাছিয়ায় ডনকি সাহেবের বাগানবাড়িতে প্রথম শুরু হল হিন্দু মেলা। প্রথম বছরে তেমন জমলো না। দ্বিতীয় বছরের মেলা একদম সরগরম।
১৮৭২। তৈরি হল ন্যাশনাল থিয়েটার। তার পরেই সার্কাস। ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই নিয়ে মজা করে লিখেছেন—“কতক-গুলো মড়াখেগো ঘোড়া লইয়া নবগোপালবাবুই সর্বপ্রথম বাঙালী সার্কাসের সূত্রপাত করেন। আজ যে বোসের সার্কাসের কৃতিত্ব এবং নানা প্রশংসাবাণী শুনা যায়, উহা তাহারই পরিণতি এবং নবগোপালবাবুর অনুষ্ঠিত সেই প্রথম বাঙালী সার্কাসেরই চরম ক্রমোন্নতি বলিতে হইবে।”
তবে বাঙালীর সার্কাস রূপ পায় শ্রী প্রিয়নাথ বসুর হাতে। প্রিয়নাথ বসু চব্বিশ পরগনার ছোট জাগুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর পিতা মনমোহন বসু হিন্দুমেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন। পড়াশোনায় মন নে‌ই দেখে মনমোহন বসু ছেলেকে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেন্, কিন্তু সেখানেও প্রিয়নাথের মন বসে না । তিনি কলকাতায় সার্কাস এলে‌ই দেখতে যেতেন আর মনে মনে নিজের সার্কাস দল খোলার স্বপ্ন দেখতেন।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রিয়নাথ বসু’র গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করে । প্রথমে বাংলার নানা জায়গায খেলা দেখিয়ে ,ধীরে ধীরে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে খেলা দেখতে শুরু করে। ১৮৯৬ সালে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস গোয়ালিয়রের মহারাজার জয়বিলাস প্যালেসে খেলা দেখায়। সে‌ই বছরই নভেম্বর মাসে রেওয়ার মহারাজা সার্কাস দেখে খুশী হযে দুটি বাঘ উপহার দেন। তার আগে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে বাঘ ছিলো না।
প্রিয়নাথ বসু’র আপন ভাই মতিলাল বসু পরবর্তীকালে এই সার্কাসে যোগ দেন। হিসাবপত্র থেকে যাবতীয় ব্যাপারে তিনি প্রিয়নাথকে প্রভুত সাহায্য করতে থাকেন। এই প্রসঙ্গে একটা মিষ্টি গল্প বলার লোভ সামলানো গেল না।
১৮৯৭ সাল। গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস খেলা দেখাতে গেছিল লাহোরে। মতিবাবুর কৈশোরের বন্ধু নরেন্দ্রনাথ দত্ত তখন চিকাগো ধর্ম মহাসভায় বিশ্ববিজয়ী হয়ে দেশে ফিরেছেন। সেই সময়েই লাহোরে দেখা হ’ল দুই বন্ধুর।
মতিবাবু স্বভাবতই স্বামীজিকে দেখে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত। কাঁচুমাচু মতিবাবু নরেনের দিকে চেয়ে খুব করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন – ‘ভাই তোমায় এখন কি বলে ডাকবো ?’
স্বামীজি তৎক্ষণাৎ মতিবাবুকে জড়িয়ে ধরেই বলে উঠলেন – ‘হ্যাঁরে মতি, তুই কি পাগল হ’লি নাকি ? আমি কি হয়েছি ? আমিও সেই নরেন আর তুইও সেই মতি’।
বাঙালীর এহেন কর্মকাণ্ডের কথা শুনে স্বামীজি অত্যন্ত খুশি হয়ে বলেছিলেন - “Mati was doing greater work than perhaps any Bengalee Worker in setting an example in organisation and proving Bengalee nerve and pluck which was
more effective than articles and lectures.”
১৮৯৯ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস কলকাতায় এল খেলা দেখাতে। শীতের দাপট তখন শুরু হয়েছে। গড়ের মাঠে বিরাট সার্কাসের তাঁবু। কলকাতাবাসী, বিশেষত: বহু গণ্যমান্য ও পদস্থ লোক গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের খেলা দেখতে এলেন।
📷
এই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্র নাথ বসু মহাশয়ের লেখা থেকে কিছু অংশ না লিখে পারছি না – “
সে সময়ে গড়ের মাঠে ‘বোসের সার্কাস’ দেখিবার জন্য যে বিপুল জনসমাগম হইত, তাহা দেখিলে মনে হইত যে, দর্শকরা শুধু খেলা দেখিবার জন্যই সেখানে সমবেত হয়েন নাই ; তাহারা প্রত্যেকে পয়সা খরচ করিয়া, যেন এক অভিনব জাতীয় মেলায় অভিনব জাতীয় অনুষ্ঠানে—সম্মিলিত হইয়া দেশমাতৃকার চরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করিতে আসিয়াছেন। তাহার উপর খেলার অবকাশে প্রোফেসার প্রিয়নাথ বসু যখন স্বয়ং ক্রীড়াচক্রে (Ring) আবির্ভূত
হইয়া স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ ওজস্বিনী ভাষায় গুরু গম্ভীর স্বরে জনমণ্ডলীকে সম্বোধন করিয়া জাতীয় ভাবসূচক উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা দ্বারা স্বদেশী-ব্রতকে দৃঢ়তর করিবার জন্য অনুরোধ করিতেন ও বক্তৃতাশেষে তিনি যখন “বন্দেমাতরম্” শব্দ উচ্চারণ করিতেন, তখন দর্শকমণ্ডলীর
সমর্থনসূচক “বন্দেমাতরম” রব ‘বোসের সার্কাসের বিশাল তাম্বু ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলিত ; বুঝি সেই স্বদেশীয় মল্লক্ষেত্রের তটভূমিতে জাতীয় ভাবের উদ্দেল সমুদ্র উছলিয়া
পড়িত”।
১। র‍্যাম্বো সার্কাস
২। জেমিনি সার্কাস
৩। গ্রেট রয়েল সার্কাস
৪। জাম্বো সার্কাস
৫। গ্রেট বম্বে সার্কাস
৬। গ্রেট গোল্ডেন সার্কাস
৭। অমর সার্কাস
৮। রাজকমল সার্কাস
৯। এশিয়াড সার্কাস
১০। কোহিনুর সার্কাস
১১। মুনলাইট সার্কাস
১২। অজন্তা সার্কাস
১৩। অ্যাপেলো সার্কাস
১৪। অলিম্পিক সার্কাস
১৫। ফেমাস সার্কাস
১৬। নটরাজ সার্কাস
১৭। রেমন সার্কাস
১৮। গ্রাণ্ড সার্কাস
১৯। রিহনো সার্কাস
২০। এম্পায়ার সার্কাস
২১। রাজমহল সার্কাস
২২। গ্রেট ইণ্ডিয়ান সার্কাস
২৩। চাম্পিয়ন সার্কাস
২৪। প্রভাত সার্কাস
২৫। ক্রাউন সার্কাস
২৬। মারিয়াম সার্কাস
২৭। ওউবল সার্কাস
২৮। মহারাজ সার্কাস
(উপরিউক্ত কোম্পানিগুলির মধ্যে বর্তমানে ১০-১২টি কোম্পানিই সচল)
সার্কাস মানেই ছিল এক যৌথ একান্নবর্তী পরিবার। একটা বড় তাঁবুকে ঘিরে অসংখ্য ছোট ছোট তাঁবু, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি। তার মধ্যেই জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে। এক শহর থেকে আরেক শহরে সারা বছরের পরিক্রমা। সার্কাসের চিড়িয়াখানা মানেই বাঘ, সিংহ, হাতি, জলহস্তি, উট, ঘোড়া, কুকুর, ম্যাকাও, কাকাতুয়া, টিয়া, পায়রা এমন কতোরকম পশুপাখি। আমাদের ছোটোবেলায় চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম দেখতে যাওয়ার পাশাপাশি , গ্যালারিতে বসে সার্কাস দেখার উন্মাদনা এখনো স্মৃতিতে বিহ্বল।
ক্রমশঃ উন্নত হয়েছি আমরা। আমাদের শিক্ষা–চেতনা–জীবনবোধ এর উত্তরণের ফলে মানবিকতা এসেছে অনেকখানি আমাদের জীবনে। বিভিন্ন পশুপ্রেমীদের উদ্যোগে সারা বিশ্ব জুড়েই তৈরি হয়েছে বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন। আর এই আইনের জোরে পশুপাখিরা আজ অনেকাংশেই মুক্ত। আমাদের বিনোদনের জন্য তাদের ব্যবহার করা কমেছে অনেক। যুক্তি আর আবেগ এক্ষেত্রে দুভাগ হয়েছে আমাদের। যুক্তি বলছে যে পশুপাখিদের যত্নে রেখে ব্যবহার করলে ক্ষতি কি ! একটা শিল্প অন্ততঃ বাঁচতো। অনেকগুলো পরিবারের অন্নের জোগাড় হ’ত। আবার হৃদয় বলছে যে পশুপাখিদেরও অধিকার আছে স্বাভাবিকভাবে বাঁচার। এমনিতেই মাফিয়া আর ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীদের দৌলতে অরণ্য হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক বনভূমি। জঙ্গলের আদিবাসীরা উৎখাত হচ্ছে নিয়ম করেই। পশুপাখিরা তাই সত্যিই আজ বিপন্ন।
সার্কাস এখন তাই মানুষের ব্যক্তিগত নৈপুন্যের প্রদর্শনী। তার মধ্যেও বন্ধ হয়ে গেছে অনেক খেলাও। উদাহরণস্বরূপ বদ্ধ গোল বলয়ের ভেতর বিপজ্জনকভাবে মোটবাইক চালানোর খেলা আজ অতীত। দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের রিং এর মধ্যে দিয়ে বাঘ আর লাফ দেয় না। তাই সার্কাসের সেই জৌলুসভরা তাঁবুগুলো ক্রমশঃ শতছিন্ন হয়ে পড়ছে। আমাদের ছেলেমেয়েদের আগ্রহও। জানিনা এর থেকে বেরিয়ে আসা যাবে কি না ! হয় সার্কাসের সব্বাইকেই অন্য রুটিরোজগারের ধান্দার দিকে চলে যেতে হবে অথবা আবার সেই পুরোনো দিনের নোংরা অনেক পেশাই টেনে নেবে এঁদের।
বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া কিশোর কিংবা রেডলাইট এলাকায় পাচার হ’তে হ’তে বেঁচে যাওয়া কিশোরীদের আশ্রয়স্থল ছিল এই সার্কাস। তারা খেলা দেখিয়েছে। উপায় করে সংসারও চালিয়েছে। সার্কাসের মধ্যেই হয়েছে প্রেম-পরিণয়-বিয়ে। সন্তান এসেছে সার্কাসের তাঁবুতেই। এ সব হয়ে যাবে ইতিহাসের সম্পদ।
শীতকাল আসবে বাংলায়। কিন্তু প্রাণহীন সার্কাসের তাঁবু ক্রমশঃ হারিয়ে যাবেই অন্ধকারে।
“এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।
শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে-
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।
এদিকে কোকিল ডাকছে- পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।
সিংহ হুঙ্কার ক’রে উঠছেঃ
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির এক সিংহ- আফিমের সিংহ- অন্ধ- অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে
যায় সব।
সিংহ অরণ্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মতো খ’শে-খ’শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ,- তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর”।




  • ( শীতরাত – জীবনানন্দ দাশ)
(সমাপ্ত)



কৃতজ্ঞতা :
১ – সত্যজিৎ রায় – ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’।
১অ - অবনীন্দ্রকৃষ্ণ বসু'র বই - ‘বাঙালীর সার্কাস’-১৩৪৩ (প্রকাশক - পাবলিসিটি স্টুডিও) (বর্তমানে ‘গাঙচিল’
প্রকাশনা এই বইটি পুনর্মুদ্রণ করেছে)
বিভিন্ন ওয়েব সাইট থেকে : -
২ - প্রকাশ নাথ - দেশ বিদেশের কয়েকটি জনপ্রিয় সার্কাস দলের ইতিকথা।
৩ - অনিরুদ্ধ সরকার - বাঙালির প্রথম সার্কাস দল ও একজন ‘প্রফেসর’।
৪ - সুমিত বর্ধন - বাঙালীর সার্কাস।
৫ - রঞ্জু প্রসাদ মণ্ডল - বাঙালির প্রথম সার্কাস অভিযান – সাহস ও দেশপ্রেমের এক আশ্চর্য সংমিশ্রন।
৬ - রানা চক্রবর্তী - বাঙালীর সার্কাস - কালের বিবর্তনে হারাতে বসা এক বিনোদন মাধ্যমের ইতিকথা।
৭ - অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় - পোষ মানানোর খেল
৮ – উইকিপিডিয়া

৯ – বর্তমান পত্রিকা - শনিবার ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র