ফাল্গুনী ঘোষ

মায়াজম
0

ছন্নছাড়া গল্প




গ্রিণরূমের ত্রিপলের ছেঁড়া পর্দা সরালে চোখে পড়ছে রানীর ছিপছিপে বেতসলতা, শরীরের অঙ্গসঞ্চালন। সে মুখে রঙ মাখছে। তার ফর্সা পিঠে আড়াআড়ি হালকা দু চারটে শুকিয়ে যাওয়া খয়েরি লম্বা লম্বা দাগ। সে দাগ ঢাকার জন্য চামড়ার রঙে রঙ মিলিয়ে স্ল্যাক্স গলিয়ে নিলো রানী। ওপাশ থেকে ম্যানেজারের তাড়া। বাইরে তখন কয়েকশ জনতার উদ্দাম হাততালি, তার সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের তাল, লাল-নীল- হলুদ-সবুজ আলোর মাঝে স্বল্পবাস রানী এসে দাঁড়ালো ছন্দে ছন্দে, তালে তাল মিলিয়ে। তুমুল সিটি আর হাততালি উড়ে এলো। বক্ষবন্ধনীর চুমকি জরি ঝিকিয়ে উঠে জানান দিলো উদ্ধত যৌবন, সাহসী যৌবন! উৎশৃংখল নয় তা কোনোভাবেই।
এরপরেই শুরু নানারকম কসরত করে নেচে, গেয়ে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, দৌড়ে, ঝুলে, লোকের মনোরঞ্জন। দর্শক উল্লসিত শরীরি উদ্দামতায়। কিন্তু এই মেয়ে শরীর বিলোতে আসেনি, এসেছে পারফরম্যান্স বিলোতে। রানী সত্যিই রানী। অন্তত এই সেটের বসে থাকা কয়েকশ মানুষের কাছে তো অবশ্যই। রানী ট্র‍্যাপিজের খেলা দেখাবে। জলন্ত অগ্নিগোলক রিং এর ভিতর দিয়ে পেরিয়ে আসবে যাবতীয় শরীরি বিভঙ্গ। উত্তাল হয়ে উঠবে মানুষের দল। চঞ্চল হাতে ঝটপট তালি বাজবে। সিটি পড়বে।
সিটি পড়লেই রানীর মুখ চোখ থমথমে হয়ে যায়। বিদ্রোহী হয়ে পড়ে তার মন। সে তো পারফরমার। খেলোয়াড় খেলা দেখাতেই এসেছে। তাহলে তার হাড়-মাংস- পেশি- কঙ্কাল- কাঠামোর মানুষী উপস্থিতিকে ক্রমশঃ ঢেকে দিয়ে মেদ বা মেদহীনতা, উন্মুক্ত ত্বক স্বল্পবাসের ফাঁকফোকর কেন জায়গা করে নেয়! একসময় শো শেষ হয়। আলো নিভে যায়। আলোর রানী এখন রাতের অন্ধকারে সার্কাস মালিকের মনোরঞ্জনকারিনী। রানীর স্বামী আছে। আছে বালিকা কন্যা। স্বামী এই সার্কাসেরই এক ম্যাজিশিয়ান। দুজনের রোজগার সম্মানের সাথে চলে যাওয়ারই কথা তাদের। চলে যায় সংসার। কিন্তু সম্মান কই!
শো শেষে সন্তানের সাথে একটু খেলা করে, খাওয়া দাওয়া সেরে মালিকের তাঁবুতে যাওয়াটাই তার প্রতি রাতের রেওয়াজ। ইচ্ছে করে না অসম্মানিত হতে প্রতি রাতে। রাজি না হওয়ার ফলাফল পিঠে শুকিয়ে যাওয়া খয়েরি দাগ। আজও প্রতিদিনকার রুটিন শেষে তাঁবুর পিছনের অন্ধকার কোণে এসে দাঁড়াল রানী। একটু দূরে হাতি, বুড়ো সিংহ, বুনো কুকুর, সাদা কাকাতুয়া, লালমুখো বাঁদরদের একজোট বিচিত্র গন্ধ হাওয়ায় ভেসে আসছে। এসব গা সওয়া তার। নিজের মতো একলা সময় পেলে সে তাঁবুর কোণে এসে রাত্রের আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।
নিয়মমাফিক আজও এসে বসেছে। বিষণ্ণ আত্মজীবনের কালো স্রোত তার চোখ বেয়ে নামছে।
"কি গো মেয়ে! অমন করে কাঁদছ কেন? তুমি না সার্কাসের মেয়ে। "--- অবাক চোখে তাকায় রানী। চোখ মোছে। আবার দ্যাখে, কই কেউ নেই তো! তাহলে আশেপাশে কার গলা শোনা যায়!
" নিজেকে অত ছোটো ভাবো কেন গো? সার্কাসের মেয়েদের গ্ল্যামারই আলাদা! একটু ডাঁট নিয়ে তাদেরকে থাকতে হয়!" রানী চোখ কচলে স্পষ্ট দ্যাখে, আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল দুই নারী। পরনে টাইট সার্কাসের পোশাক! অবাক হয়ে যায় রানী। এরা কারা! মালিকের নতুন আমদানি নাকি! তাহলে তো তাদের ভাত উঠে গেলো এখানে! পেটের জন্যই এত কিছু সহ্য করা! অগত্যা রানীর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে কিছু তেতো কথা--
" শোনো, কে হে তোমরা! আমাকে উপদেশ দিতে এসেছ এই রাতদুপুরে!
কোথায় বাড়ি? ম্যানেজারকে পটালে কিকরে? "
খিলখিলে হাসির সাথে ছিটকে আসে প্রশ্ন-- "সুশীলা সুন্দরীর নাম জানা আছে?"
অবাক রানীর মুখে বিস্ময়-- "কে সে?"
পাশের হাট্টাকাট্টা মহিলা তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে বলে--- " আরে ইনি হচ্ছেন সেই বিখ্যাত মহিলা, যিনি সব প্রথা ভেঙে সার্কাসের মহিলাদের দাপট কতদূর হতে পারে তা দেখিয়েছিলেন! বাঘকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছিলেন দাপটের সঙ্গে!
অবাক রানীর মুখের হাঁ বন্ধ করে সুশীলা সুন্দরী শুরু করে তার জীবনের আখ্যান---
"তাও তোমার মতো কোনো বাবা মায়ের ঠিক ছিল না আমার। কলকাতার লালবাতি এলাকার রামবাগানের অভাগী পতিতা ছিল হয়ত আমার মা । তোমাদের মত ট্রপিজের খেলা, আগুনের রিং-এ ঝাঁপানো সোজা সোজা খেলা নয়! কবরের গর্ত খুঁড়ে ওঠা, বাঘের খাঁচায় ঢুকে কুস্তি করে মাতিয়ে রেখেছিলাম দর্শককুলকে। তবু কারো কাছে হার স্বীকার করিনি। গ্রেট বেঙ্গলের ম্যাজিশিয়ান গণপতির সাথে মন দেওয়া নেওয়া হলেও সম্পর্ক টেকে নি। প্রিয়নাথ না গণপতি কে বেইমানি করেছিলো তা বোঝার অবসর আসেনি আর আমার জীবনে।
পাশ থেকে হাট্টাকাট্টা মহিলাটি বলে ওঠেন-- " সম্মানের কথা বলছিলে না! এই যে আমি বুকে হাতি তুলেছি! আমি রেবা রক্ষিত। ছোটো থেকে শরীর চর্চার নেশা আমার। সেজন্য মিস বেঙ্গল ফর বডি বিল্ডিং খেতাবও জুটেছে। আমার সখ ছিলো সার্কাসে হাতির খেলা দেখানো। ভারত সরকার দিয়েছিলেন পদ্মশ্রী, আর হায়দ্রাবাদের নবাব দেবী চৌধুরানী।
রানীর মুখে ক্ষোভ উগরে এলো-- " তোমার বাড়িতে নিশ্চয়ই অভাব ছিলো না। পেটের টান থাকলে দেখতে বাবা-মা কোন ছোটোবেলায় বিক্রি করে দিত! তারপর হাত বদল হতে হতে সার্কাস খেলোয়াড় কোনো পুরুষের সাথে ঘর বাঁধা! সন্তান জন্মালে সেও সার্কাস দেখাবে এই তো জীবন আমাদের! "
সার্কাস জগতের দুই নামী মহিলা গর্জে ওঠে--- "তোমার সন্তানকে নিয়ে তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে! যেভাবে তাকে বড় করতে চাও, তাই করবে! সার্কাসের ম্যানেজারের তোয়াজ করে একদম চলবে না! তুমি খাটো! খাও! কেউ দয়া করে তোমাকে খেতে দেয় না!"
বলতে বলতে মহিলা দুজন কোথায় যেন ধীরে ধীরে সরে গেলো। অস্থির হয়ে উঠল রানীর মন। এরা কারা ছিলো! তার মনের ভুল নাকি! স্বামীর কাছে একবার কোনো এক সার্কাসের মেয়ের গল্প শুনেছিলো বটে। এটা বাস্তব না ভুতুড়ে বুঝে উঠতে পারে না রানী। সংশয় জন্ম নেয় মনে। আরো জন্ম দিয়ে যায় একরাশ প্রশ্ন। সে সার্কাসের মেয়ে হলেও তারও অধিকার আছে সমাজের আরো পাঁচ-দশটা মেয়ের মতোই মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার! সে নাচে, কসরত করে পেটের জন্য, মনোরঞ্জন করে কিন্তু যৌনকর্মী তো নয়! তাহলে হাততালি আর উচ্ছ্বাসের সাথে লোলুপ দৃষ্টি উড়ে আসে কেন! ম্যানেজার যতই অত্যাচার করুক সে তার মেয়েকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। তার মেয়ের বড় সখ ডাক্তার হওয়ার! কেন সমাজের অকথা কুকথা সে শুনবে!
ঠিক এই প্রসঙ্গের রাশ টেনে আমাদের মতো শিক্ষিত সমাজের এবং মানুষের ভাবার সময় এসেছে। যে সার্কাস আমাদের শীতকালীন আনন্দের গ্র‍্যান্ড ইভেন্ট, শীতের দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় প্রিয়জন বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কচি কাঁচাদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগের মাধ্যম, সেই সার্কাসের কলাকুশলী নারীরা ঠিক কতটা আনন্দ বা হাসিমুখে জীবন কাটায়! আসলে তো সার্কাস শিল্প। নাচ, গান, জোকারি, জিমন্যাস্টিকস, জাদু সব মিলিয়ে জীবন বাজি রাখার ঝুঁকি। যে সব নারীরা এই জীবনবাজির লড়াই এর খেলায় নেমে পড়ে তারা সবাই কি হাসিমুখে তা করে! না কি তাদের হাসির আড়ালে লুকানো থাকে কান্না, বঞ্চনার কথা, তাদের পেটের ক্ষুধা, তাদের অনিশ্চিত আগামীর কথা! সত্যি, সবাই তো হয়ে উঠতে পারে না সুশীলা সুন্দরী বা রেবা রক্ষিত। অজস্র গরীব ঘরের মেয়েরা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এসে যোগ দেয় সার্কাসের ঘেরাটোপে। ভারতবর্ষের অন্যতম সার্কাস ইন্সটিটিউট কেরালার তথ্য অনুযায়ী অল্প বয়সে অনেক মেয়েরাই আসে ট্রেনিং নিতে। মাননীয় সরকারের উচিত নজর রাখা এদিকে। যাতে এই প্রশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিতদের জীবনের নিরাপত্তা থাকে। নারীত্বের বঞ্চনা ও অপমান থেকে তারা বাঁচে। সমাজের মানুষের কাছে এই বার্তা যাক যে এরাও অন্য শিল্পক্ষেত্রের কলাকুশলীদের মতোই কর্মী। বড় বড় ফিল্মস্টার, টিভি সিরিয়াল, স্টারদের মতোই প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সমাজের এক বৃহত্তর অংশের মনোরঞ্জনকারী এরাই। তাই এদের কাছে এসে মানবতা আর বিবেক যেন থমকে না যায়। সুস্থ মানুষ হিসেবে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও আছে। এটা উপলব্ধি করার সময় এসে গেছে। এদেরকে বিছিন্ন করে রাখলে এরা মূলস্রোতে ফিরতে চাইবে। এভাবেই একদিন হয়ত কালের ক্ষয়ে সার্কাস নামক সংমিশ্রিত ও উৎকৃষ্ট শিল্পটি ধ্বংসের অতল গর্ভে তলিয়ে যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)