গালের ওপর তাগড়া পাঁচ আঙুলের সপাটে চড়টা পড়ার পর হাত না দিয়েই মাম্পি টের পায় রক্ত গড়াচ্ছে । কিছুটা নোনতা স্বাদ তার মুখের ভেতর জানান দিচ্ছে । রক্তটা মোছে না সে । বরং দাঁতে দাঁত চেপে পরের মারটার জন্য অপেক্ষা করে ।
এটা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা । মাম্পিরও কেমন জেদ চেপে গেছে । তার মন বলে, চেষ্টা করলেই সে পারবে । কিন্তু না, তার জেদ কিছুতেই এক পাও এগোতে দেয় না । বরং দিনের পর দিন জিমি মাস্টারের মার আর মাম্পির সহ্যক্ষমতা রীতিমত পাঞ্জা কষে চলেছে ।
‘কেন এরকম করছিস মাম্পি ? তুই পারবি । তোর মধ্যে সেই ক্ষমতা আছে । জিমি মাস্টারের এতদিনের জহুরির চোখ কখনো ভুল দেখবে না ।’
ভয়ঙ্কর জিমি মাস্টারের এই রকম শান্ত গলার স্বর আগে কখনো শোনেনি মাম্পি । আর এমন কথা তো নয়ই । তাও না না করে মাম্পি এই সার্কাস দলে এসেছে প্রায় মাস চারেক । জিমি মাস্টার এই দলের শেষ কথা । যদিও এই ইলোরা সার্কাস দলের মালিক একজন আছে । তাকে এই চারমাসে চারদিন দেখেছে মাম্পি । এসেই সোজা তার জন্য নির্দিষ্ট করা তাঁবুর খোপে চলে যায় । তখন জিমিও যায় তার পিছু-পিছু, পোষ্যর মতো । তারপর বাকিরা এক-এক করে যায়, তারপর থুতু, টাকা আর আঙুল এক করে বেরিয়ে আসে । মাম্পি বোঝে আজ এই দলের মাইনের দিন । তবে প্রকারান্তরে জিমি মাস্টারই পুরো সার্কাস দলের সর্বেসর্বা ।
মাম্পি কিছুটা অবাক চোখে তাকায় জিমির দিকে । তারপর থুঃ করে একদলা থুতু ছিটিয়ে তাঁবু থেকে বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে যায় । হাতের লাঠিটা ছুঁড়তে গিয়েও থমকে যায় জিমি । এতটুকু একটা মেয়ে, কতই বা বয়স, বড় জোর দশ কী এগারো, সে এত স্পর্ধা, সাহস পায় কী করে ! যেখানে পুরো ইলোরা সার্কাস টিম জিমি মাস্টারের নামে ভয়ে কাঁপে ।
বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না মাম্পি । ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ।
‘তুমি আমায় ছেড়ে কেন চলে গেলে মা ! আমার একা-একা খুব ভয় করে । আমাদের ছোট্ট ঘরটায় তুমি আর আমি খুব ভাল ছিলাম । আমি এখানে একদম ভাল নেই মা । তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও মা ।’
‘এই, আকাশের দিকে তাকিয়ে কী বিড়বিড় করছিস ? শিগগির তাঁবুতে চল । জিমি মাস্টার তোকে এক্ষুণি যেতে বলেছে ।’ মাম্পির মাথায় হাত রাখে যতীন জোকার । এই গোটা সার্কাস তাঁবুতে যত মানুষ থাকে, তার মধ্যে যতীনদাদাকে একমাত্র আপন বলে মনে হয় মাম্পির । সবার ওপর খুব মায়া যতীনদাদার । কেউ না খেলে তাকে জোর করে খাইয়ে দেয়, কারোর মনখারাপ হলে তার সঙ্গে মজার কথা বলে মন ভাল করে দেয় । অথচ যতীনদাদার মনে অনেক দুঃখ তা মাম্পি জানে । জোকার বলে দলের অনেকেই তাকে কটু কথা বলে, যখন তখন ঠ্যালা মারে, আবার কেউ-কেউ মাথায় চাঁটিও মেরে দেয় । তবে যতীনদাদাকে এই চার মাসে কখনো মন খারাপ করে থাকতে দেখেনি মাম্পি । বরং যতীনদাদা যেখানে মন ভাল থাকে সেখানে ।
‘আমি কিছুতেই যাব না ।’
‘জেদ করিস না মাম্পি । চল আমার সঙ্গে । নাহলে আরো মারধর খাবি । ওই পাষন্ডটার মনে কোন মায়াদয়া নেই ।’
‘এত খারাপ কেন গো লোকটা যতীনদাদা ?’
‘লোকটা এমন ছিল না রে । খুব হাসিখুশি ছিল । আজ থেকে বছর ন’য়েক আগে ভূমিকম্পে একসঙ্গে বউ আর মেয়েকে হারিয়ে ফেলার পর থেকে লোকটা এত নিষ্ঠুর, বদমেজাজি হয়ে গেছে । আর তা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে ।’
মাম্পিরও তো কেউ নেই । বাবাকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেনি । ছিল সে আর তার মা । তবে খুব আনন্দে ছিল । মা লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করত । ভাল-মন্দ খাবার-দাবার কিছুই প্রায় জুটত না । শুধু স্বাতীদিদির মা মাঝেমাঝে তার জন্য মায়ের হাতে কিছু ভাল খাবার দিয়ে দিত । অবশ্য এখন মাম্পির মনে হয়, খাবারগুলো মাকেই খেতে দিত । মা নিজে না খেয়ে তার জন্যে নিয়ে এসে বলত, তাকেই দিয়েছে স্বাতীদিদির মা ।
তবে মাম্পি কোনদিন কিছুর জন্য বায়না করেনি মায়ের কাছে । মা সবসময় বলত, “মাম্পি আমার ঘর আলো করা মেয়ে” । মাম্পি মায়ের গলা জড়িয়ে বলত, “আমার সোনা মা” ।
মা একদিন ঘরে ফিরল না । বস্তির বাসন্তীমাসি ছুটতে-ছুটতে এসে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিল । ফিসফিস করে বলেছিল, ‘মন শক্ত কর মাম্পি । তোর মা আর আর ফিরবে না ।’
আট বছরের মেয়েটা মন শক্ত করতে হয় কীভাবে না জানলেও আজ দশ বছরের মাম্পির মন আপনা থেকেই শক্ত হয়ে গেছে । লেভেল ক্রসিং উপেক্ষা করে তাড়াহুড়ো করে মাম্পির কাছে ফিরতে চেয়েছিল তার মা । কিন্তু কী হল ? চিরজীবনের জন্য মাম্পির “মা” ডাক হারিয়ে গেল ।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । বাসন্তীমাসি আর তার মেয়ে রাস্তায় দড়ি টাঙিয়ে ব্যালান্সের খেলা দেখাত । মাম্পিও একটু-একটু করে শিখছিল । পেটের দায় যে বিষম দায় । একদিন রাস্তায় নানারকমের কসরতের খেলা দেখাচ্ছিল মাম্পি । চোখে পড়ে গেল জিমি মাস্টারের । তার মতামতের তোয়াক্কা না করে বাসন্তীমাসির হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে তাকে সোজা নিয়ে এসে ইলোরা সার্কাসে তুলল জিমি মাস্টার ।
সেইদিন থেকে জিমি মাস্টার মাম্পির শত্রু । বস্তিতে পেটভরে খেতে না পেলেও নিজের মতো করে ঘুরতে-ফিরতে পারত । সব থেকে বড় যা ছিল মাম্পির কাছে, তা হল, তার চিরকালের মত চলে যাওয়া মায়ের গন্ধ । বস্তির কোণায়-কোণায় সে তার মাকে অনুভব করতে পারত । কখনো তার মায়ের পরার কাপড় নাকে-মুখে জড়িয়ে মায়ের ঘ্রাণ পেত । এইসব থেকে তাকে বঞ্চিত করে টেনে নিয়ে আসার জন্য জিমি মাস্টারকে ক্ষমা করতে পারেনি মাম্পি ।
‘কী হল রে, তোকে কখন ডেকেছি, আসার নামগন্ধ নেই দেখছি ।’
আজ যেন মাম্পি মরিয়া । যেটুকু ভয়-ডর ছিল তার মনে আজ যেন সব শেষ হয়ে গেছে ।
‘তুমি ডাকলেই আমায় যেতে হবে নাকি ? আমি তোমার ট্রাপিজের খেলা শিখব না । তুমি কী করতে পার করে নাও ।’ তেরিয়া হয়ে জবাব দেয় মাম্পি ।
রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় জিমি । বেধড়ক পেটাতে শুরু করে । আর মাঝেমাঝে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘তোর নামটার জন্য এতদিন দয়া দেখিয়েছি । আর নয় । মারই তোর জন্য ঠিক শাস্তি ।’
রাত বাড়লে যতীন জোকার এসে দাঁড়ায় জিমি মাস্টারের তাঁবুর বাইরে ।
‘মাস্টার ঘুমোলে নাকি ? ও মাস্টার ?’
কিছুটা পর সাড়া দেয় জিমি । রাগের মাথায় মাম্পিকে অত মারধর করলেও, তারপর থেকে মনটা খুব খারাপ তার ।
‘কি বলছিস যতীন ?’
‘মাস্টার একবার মাম্পিদের তাঁবুতে চল । মেয়েটার ধূম জ্বর । আর ভীষণ ভুল বকছে ।’
বুকের ভেতরটা ধক্ করে ওঠে জিমির । এতটা রাগ দেখানো ঠিক হয়নি । কিন্তু এখন এসব ভেবে লাভ নেই । যতীনের সঙ্গে হাজির হয় মাম্পি যে তাঁবুতে আছে সেখানে । দেখে মাম্পির মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে জুনি । আর মাথায় জলপটি দিচ্ছে ।
কাছে যায় যতীন । আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । পমুহূর্তে চমকে ওঠে জিমি । মাম্পির গলার হারের খুলে যাওয়া লকেটে চোখ আটকে যায় । এ তো বিয়ের প্রথম বছরে তার নিলমকে দেওয়া উপহার । নিলমের গলায় পরিয়ে জিমি বলেছিল, ‘সোনা দিতে পারলাম না । তবে এই রূপোর লকেটে তুমি আর আমি এক হয়ে রইলাম ।’
জুনির কোল থেকে এক ঝটকায় মাম্পিকে কোলে তুলে নেয় জিমি । চিৎকার করে ওঠে, ‘আর তোকে হারিয়ে যেতে দেব না রে মাম্পি । ডাক্তার, ডাক্তার ...
সুচিন্তিত মতামত দিন