শিবানী শর্মা - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

শিবানী শর্মা

ফাঁদ !



রাতের একটা আলাদা গন্ধ আছে। এমনটা ভুবনের মনে হয়। প্রথম রাতের, শেষ রাতের এমনকি ভোরেরও একটা আলাদা গন্ধ আছে। জোরে শ্বাস টানে ভুবন। হাওয়ায় শিশিরে ভেজা ঘাস আর শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে। এই গন্ধটাতে মনটা কেমন করে উঠল। আজ মনটা সত্যিই অন্যরকম। সকাল থেকে কিছুই ভালো লাগছে না।
খুব সন্তর্পণে পা ফেলে চলছে ওরা তিনজন। আজ অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যা। একেবারে নিঝুম, নিষুতি রাত। খুব হাল্কা ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া বাঁশঝাড় ছুঁয়ে বয়ে যায়, তার অদ্ভুত মোহময় মৃদু শনশনানি আর একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক ওদের পায়ের শব্দ ঢেকে দিচ্ছে। অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে ভুবন। কাউকেই স্পষ্ট দেখা যায় না। অবশ্য সে জানে সবার আগে চলছে গণেশ তারপর কানাই আর তার ঠিক পেছনে সে । কানাইকে খুব আবছা দেখা যায়। এই পথ তার চেনা তাই নিশ্চিন্তে চলতে থাকে ভুবন। গণেশ এই দলের সর্দার। গণেশ একটু রগচটা, তাকে বেশ ভয় করলেও ভুবন মনে মনে বেশ ভালবাসে, বিশ্বাস করে । যেমন বিশাল চেহারা গণেশের, তেমনই বুকের পাটা, ভোজালি দিয়ে এক কোপে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিতে পারে এত সাহস। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিও ধরে গণেশ, তাই সব কাজের পরিকল্পনা সেই করে। কানাইয়েরও লোহা-পেটানো শরীর, এক নিমেষে হাওয়া হয়ে যেতে পারে এত ক্ষিপ্র, যে কোন সিন্দুকের তালা ভাঙতে পারার কাজে তার জুড়ি নেই। এদের তুলনায় ভুবনই খুব ছোটখাটো, কালো, রোগা-পাতলা। তবে তার কাজ আলাদা, খুব সূক্ষ্ম, পুরোপুরি অন্যরকম।
একটু জোর কদমে পা চালায় ভুবন। আজকের কাজটা বিশাল বড়। চৌধুরী বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে দিন দশেকের মধ্যেই। গণেশ ভালো করে সব খোঁজখবর নিয়েছে । বিয়ের গয়নাপত্র কেনা প্রায় শেষ, পণের টাকাও তুলে এখন বাড়িতেই রাখা। গত কয়েকমাস ধরে ওরা তাগ লাগিয়ে বসে আছে। কয়েকদিনের মধ্যেই আত্মীয়-কুটুম বিয়ে বাড়িতে এসে যেতে পারে তাই আর দেরী করা যাবে না। চৌধুরী বাড়ির ভাঁড়ার ঘরের পূর্বদিকের দেয়াল পুকুরপাড় ঘেঁষে, বাঁশঝাড়ে ঢাকা। এদিকটা সবসময়ই অন্ধকার । সেদিকটা দিয়েই ওরা ঢুকবে। লাগোয়া ডান দিকে বৈঠক আর বাঁ দিকে পুজোর ঘর। বৈঠক ঘরেই বড় সিন্দুক। সেটাই লক্ষ্য।
নিপুণ হাতে সিঁধ কাটছে ভুবন। এখন রাতের তৃতীয় প্রহর। গণেশ বলে রাতের এই প্রহরে গৃহস্থের ঘুম সবচেয়ে বেশী গাঢ় হয়। সিঁধ কাটতে এই তল্লাটে ভুবনের থেকে বেশী ভাল হাত আর কারোরই নেই। শুধুমাত্র ল্যাঙট পরা ভুবনের কালো রোগা শরীর অন্ধকারে দেয়ালের গায়ে প্রায় মিশে গিয়েছে। ঝুরঝুর করে একটু একটু মাটি পড়ে, খুব দক্ষ, দ্রুত হাতে মাটি সরায় ভুবন। গণেশ ভুবনের পাহারায়। পাশেই কানাই অন্ধকারে উবু হয়ে বসে আছে । অস্থির গণেশ খুব নিঃশব্দে পায়চারি করছে । সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি হাত চালাল ভুবন। এইসময় একটা অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এলো। এইরকম গন্ধ আগে কখনই পায়নি ভুবন। বুকটা ছ্যাঁত করে করে উঠল । একটু আনমনা হয়ে একবারের জন্য একটু হাত থামাতেই কারো গরম নিঃশ্বাস পড়ল কাঁধে। চমকে মুখ তুলে তাকায় ভুবন। অন্ধকারে গণেশের চাপা রাগের হিসহিসানি কানে আসে। আরও তাড়াতাড়ি হাত চালাল সে। মোটামুটি দেড় বিঘৎ খাড়া কাটার পর মাপ নিতে খুব সাবধানে দেয়ালের ভিতরে ডান হাতটা ঢোকাল ভুবন। এরপর অন্য পাশ দিয়ে কাটা শুরু করবে।
হটাৎ ঘরের ভিতর থেকে কারা যেন হাত চেপে ধরল ভুবনের। 'চোর', 'চোর' বলে চেঁচিয়ে উঠল। ভাঁড়ার ঘরের আলো জ্বলে উঠল। বিপদ দেখে এক দৌড়ে সদর দরজার বাইরে থেকে আগল তুলে দিয়ে এলো কানাই। ভুবন খুব চেষ্টা করছিল হাত ছাড়াবার, কিছুতেই পারছিল না। ভুবনের ডান হাতের কনুই অবধি ওরা ভিতরে টেনে নিয়েছে। তেল মাখা হাত তাই গামছা দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হইচই শুনে উঠে পড়েছে বাড়ির অন্য লোকজন।
গণেশ প্রাণপণে ভুবনের কোমর ধরে টানতে শুরু করে, কোন অবস্থাতেই ধরা পড়া চলবে না। ভাঁড়ার ঘরে রাতে বাড়ির লোক কেউ থাকে না বা শোয় না এমনটাই জানা ছিল গণেশের। তাহলে কি কাল কোন আত্মীয় এসেছিল চৌধুরী বাড়িতে ? কি করে কেউ আঁচ পেল? কি ভাবে চুপচাপ এই ফাঁদ পাতল ? একদম হতভম্ব গণেশ। সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে দুজনে মিলে চেষ্টা করছিল ভুবনের হাত ছাড়াতে। ওর গলা আর কোমর জড়িয়ে ধরে ক্রমাগত টানছিল। মনে হল ভিতর থেকে হাতটা কোন ভারী কিছুর সাথে বেঁধে দিয়েছে। এমন বিপদে তারা আগে কখনই পড়েনি। প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও ধস্তাধস্তির তীব্র যন্ত্রণা ভুবন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার চেষ্টা করছিল । বাড়ির লোকজন তখন ভিতর থেকে সদর দরজা ধাক্কাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত ভেঙ্গে ফেলবে। এবার প্রাণভয়ে কানাই পালাল। এক দৌড়ে ঝাঁপ দিল পুকুরে । গণেশ তখনও একাই প্রাণপণে চেষ্টা করছিল ভুবনকে ছাড়াতে। এখানে নিজেদের পরিচয় জানান দেওয়া কোনভাবেই চলবে না, কিছুতেই না।
ইতিমধ্যে সদর দরজা ভেঙ্গে লণ্ঠন আর লাঠি হাতে বেরিয়ে এসেছে চৌধুরী পরিবারে ছেলেরা। বাইরে তখনও বেশ অন্ধকার। কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। হাঁকডাক করে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে দৌড়ল তারা ভাঁড়ার ঘরের পিছনের দিকে যেখানে সিঁধ কাটা হয়েছে। দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছে চৌধুরীর বড় ছেলে প্রায় পা পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নিলো। লণ্ঠনের আলো একটু উঁচু করে ধরতেই এক ভয়ঙ্কর বীভৎস ও ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠল সবাই। ভাঁড়ার ঘরের পিছনের ঘাস জমির অনেকটা জায়গা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, সাথেই দেয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে একটি মুণ্ডহীন ধড়, ডানহাতটা দেয়ালের সিঁধকাটা ফাঁকটুকুতে আটকে আছে, উদোম গা, রোগা-পাতলা প্রাণহীন শরীরটা তখনও কাঁপছে তিরতির করে ।
বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে গণেশ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার দুই হতের তালু, কনুই, হাঁটু, পায়ের পাতা, বাঁশপাতা, পুকুর পাড়ের নরম মাটি, রাতের শিশিরে ভেজা ঘাস...
পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে, ভোরের নিজস্ব সুগন্ধে আকাশ বাতাস ভরে উঠছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র