রাজদীপ ভট্টাচার্য - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

রাজদীপ ভট্টাচার্য

হিসটেরেকটমি





নাচুনে হরিণের মতো পামেলা চরকি কাটছে পার্কের বৃত্তাকার পথে। শীতের সকালে মহার্ঘ্য রোদ্দুর সাদা স্লিভলেস গেঞ্জির গায়ে চলকে পড়ছে। ওর জানু, সুরম্য নিতম্বকে জাপ্টে ধরে ডেনিম জিন্স প্রায় হাঁটু ছুঁয়েছে। সেখান থেকে পায়ের আকাশি স্পোর্টস শু এবং অণুগল্পের মত সংক্ষিপ্ত মোজার মাঝে যে মাখন রঙা জলপ্রপাত সেখানে কুচো কুচো স্বেদবিন্দুর উপরে রোদ্দুরের খেলায় ফুটেছে গুঁড়ো হীরে ফুল।
অথচ হাঁটার কথা ছিল বিভাসের। ডাক্তার অন্তত সেরকমই বলেছিলেন। লাস্ট চেকআপে মার্জিনাল সুগার। সাথে এসিডিটি রেগুলেটরি সিস্টেমে স্থায়ী সমস্যা। ডা. ঘোষ বলেছিলেন, "রোজ কিছুটা হাঁটুন বিভাসবাবু। সকাল-সন্ধ্যে হাঁটা জীবনকে বড় করে দেবে। আর এসব সমস্যাও দেখবেন কমে যাবে।" তাই এই সকালবেলা বারান্দার আলো ছেড়ে পার্কের সবুজে।
কিন্তু ভোরবেলা উঠে কাঁহাতক হাঁটা যায়! চারতলার ফ্ল্যাট ছেড়ে সিঁড়ি ভেঙে সবুজ খুঁজতে খুঁজতে এখানে পৌঁছতে গিয়েই দম শেষ। আবার এতটা পথ ফেরা, এই অনেক। তাই পার্কে এসে পুরনো কাঠের চেয়ারে বসে লোক দেখতেই ওর বেশি ভালো লাগে। মানুষজন আসে যায়। কত রকমের মানুষ। বৃদ্ধদের আত্মমগ্ন ধীর পদক্ষেপ। নবীন যুবক-যুবতীর সচেতন জগিং। বয়স্কা মহিলাদের পায়চারির সাথে সাথে পারস্পরিক আলাপ। নতুন পরিচয়। হাল হকিকত জানা। এইসব। এ এক অন্য জগৎ। সকালবেলার পৃথিবী। শুধু এর জন্যই আজকাল এখানে আসতে ভালো লাগে বিভাসের।
এরমধ্যে আরও এক পাক ঘুরে নিলো পামেলা। অদ্ভুত ভাবে হাঁটার সময় ওর দিকে একবারও তাকায় না ফিরে। প্রথম দুএকদিন একসাথে হাঁটার কথা বলেছিল বটে। কিন্তু প্রথমত বিভাসের আর এখানে এসে পা চালাতে ইচ্ছে করে না। আর দ্বিতীয়ত, পামেলার সাথে হাঁটতেও কেমন দ্বিধা হয়। ওই শোভন পাদচারণার পাশে নিজেকে বেমানান লাগে। তবে পামেলার তাতে অবশ্য কোনও সমস্যা হয় নি। সুন্দরীর পাশে পাশে সুন্দরীরা হাঁটে না। ওতে বোধহয় পারস্পরিক বিকিরণে সংঘাত লাগে। তাই বেশ কয়েকজন আধবুড়ো প্রায়ই ওকে সঙ্গ দেয়। পিছু পিছু হাঁটে। টুকটাক কথা হয়। বিভাস দূর থেকে দেখে। ওর মনে তবু ঈর্ষার কোনো গোপন আগুন জ্বলে না, বরং মজা লাগে। পামেলার তীব্র নারীসুলভ নিতম্বের ছন্দময় দুলুনি, বুকের ডানা ঝাপটানো - এসব দেখতে দেখতে উদাস হয়ে যায় বিভাস। যদি এভাবেই কজন মানুষের আয়ু কিছু বাড়ে তো বাড়ুক! পৃথিবীর সব সুন্দরকে আগলে রাখার কোনও ঠিকাদারতো সে নয়।
চার-পাঁচ বছর আগেও সব কিছু অন্যরকম ছিলো। বারুইপুরের যৌথপরিবারে তখন একসাথে সবাই। মা বেঁচে ছিল। ফলে তখনও পারিবারিক আঁটুনি বেশ কড়া। বাড়ির ছোটো বউ ঘরে নাইটি পরে শোয় - একথা শুনেই মায়ের মুখ ভার। অবশ্য ঘরের বাইরে সারাক্ষণ শাড়িই পরত পামেলা। বারুইপুর থেকে সল্টলেক প্রতিদিন জার্নি করে অফিস করত বিভাস। তাই দিনের বেলা বাড়িতে সবার সাথে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে হত পামেলাকে। তখন পছন্দ করে কেনা চুড়িদারগুলো তোলা ছিল আলমারির তাকে। বছরে দু'চারদিনের বেড়াতে যাওয়া ছাড়া সে সব পরার সুযোগ হত না। মা মারা যেতেই পারিবারিক বাঁধন ছত্রখান। বাগান,জমি সব এক এক করে বিক্রি হয়ে গেল। তখন ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বুবাই সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ছে। তাই যাদবপুরে এই ফ্ল্যাট কিনে ওদের চলে আসা। জমিজমা বিক্রির টাকা কিছু হাতেই ছিল, বাকিটা পি এফ থেকে লোন করেছিল বিভাস। ছেলে দেখতে দেখতে মাস্টার্স করতে বেঙ্গালুরুতে। ফলে সেই যৌথপরিবারের ছাতার অভাবে এই নির্জন কোলকাতায় ওরা দু'জনে একা।
খুব দ্রুত বদলে গেল পামেলা। যেন এতদিনের না পাওয়া, না পারা কে সুদে আসলে পুষিয়ে নিতে চাইছিল ও। জীবনযাত্রা, পোশাক আশাক সব বদলে ফেলল জানলার পর্দার মত। সেই পনেরো বছর আগের চুলে তেল দেওয়া আলতা পরা পামেলার সাথে আজকের চেহারার যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। সেই এজমালি রান্নাঘর, খোলা রোয়াক, টানা বারান্দা, সদর দরজা, খিড়কির দরজা এসব শব্দবন্ধ মুছে ফেলে এখন ওর স্ক্রিনে লেখা পার্লার, স্পা, জিম, ডায়েটিং, স্লিম ফিট -এইসব ঝকঝকে অক্ষর। তবে বরাবরই পামেলা সুন্দরী। যেমন রং, তেমনি রূপ। শুধু এখন ফ্রেমটা পালটে গেছে। সেই সাবেকী থেকে একেবারে আল্ট্রা মর্ডান। ভিডিওকলে সেদিন মাকে দেখে বুবাইও অবাক।
কিচ্ছু বলে না বিভাস। কি বলবে! সবকিছু তো মুখফুটে বলা যায় না। অনুভব করে। একটা প্রবল কষ্ট ঢেকে রাখার জন্য পামেলার এই নিদারুণ প্রচেষ্টা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। যদিও ডাক্তার বলেছিলেন, " প্লেজার একইরকম থাকবে। শুধু মাঝের তিন-চার মাস একটু সাবধানে থাকবেন। তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব কিছু। "
বিশ্বাস করেনি পামেলা। বলেছিল, " ইউটেরাস, ওভারি বাদ কি না দিলেই নয়?"
বিভাসও উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "ম্যাডাম, অপারেশনের পরে ওর সেক্স ড্রাইভ একইরকম থাকবে তো?"
ডা. সুপ্রীতি ঘোষ খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "দেখুন ওনার ইউটেরাসে একটা বড় ফাইব্রয়েড আছে। তাছাড়া আরও একাধিক সমস্যা। এই যে বারবার ব্লিডিং হচ্ছে। এর থেকে বাঁচার একটাই উপায়, হিসটেরেক্টমি। ইউটেরাস আর ওভারি বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। প্রথম তিনমাস একটু অসুবিধে হতে পারে। তারপর পুরো নর্মাল জীবন। দেখুন এই অপারেশনে ওনার ভ্যাজাইনার তেমন কোনো চেঞ্জ তো হবে না। তাছাড়া ম্যাক্সিমাম ফিমেল সেনসেশন থাকে ক্লিটোরিস আর লেবিয়ায়। সে সব তো একই থাকবে। বরং অন্যান্য সমস্যা চলে গেলে ব্যাপারটা আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তাই ভয়ের বা আশঙ্কার তেমন কিছু নেই।"
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইতে অনেক কিছু লেখা থাকে। কিন্তু জীবনে সবকিছু কপিবুক হয় না। অভিজ্ঞতা দিয়ে বিভাস তা বুঝেছে। অপারেশন হল ঠিকঠাক। পোস্ট অপারেটিভ পিরিওড কেটে গেল। কিন্তু সেই উদ্দাম পামেলা ফিরল না। প্রথম প্রথম বিভাস ভেবেছিল আরও সময় লাগবে ধাক্কা সামলে উঠতে। শুধু সময় চলে গেল। এ ডাক্তার সে ডাক্তার করতে করতে শেষে সাইক্রিয়াটিস্ট। তবু কিছুতেই কিছু হল না। তা প্রায় দুবছর হতে যায়। গোপন উপত্যকায় সামান্য টাচও নিতে পারে না পামেলা। বিভাস কোনোদিন জোর করেনি ওকে। অপারেশনের আগে তো বরং পামেলার ইচ্ছের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে হিমসিম খেত, তাই জোরের প্রশ্নই ছিল না। আর আজও জোর করা ওর ধাতে আসে না। ওভাবে কিছু হয় নাকি। এতো শুধু যান্ত্রিক পদ্ধতি নয়, ইচ্ছে উভয়পাক্ষিক না হলে সবটাই ফিকে, পানসে।
সামনের ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পামেলা আলতো রুমালের ছোঁয়ায় ঘাম মুছছে। প্রসাধনী অটুট রাখার প্রচেষ্টা আর কি। এর মানে ওর আজকের হাঁটা শেষ হয়েছে। এবার ফিরে যাওয়া। মসৃণ ঘাড়ের কাছে লেপ্টে থাকা গুঁড়ো গুঁড়ো চুল যে কাওকে উষ্ণ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। সাতচল্লিশের স্ত্রীকে দেখে আজও সাঁইত্রিশের বেশি মনে হয় না বিভাসের। তবু পামেলাকে যত উষ্ণ দেখায় আজকাল ততই মায়া হয় বিভাসের। ওর হাত বেয়ে স্নেহ গড়িয়ে নামে। ভোররাতে বিছানায় সাদা স্বচ্ছ রাতপোশাকে ঘুমন্ত পামেলার চুলে বিলি কেটে দেয় বিভাস। ও আরও সরে আসে। পামেলার শ্বাসবায়ু বিভাসের মুখে এসে পড়ে।

Comments

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র