সুজাতা রায় - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

সুজাতা রায়

নষ্টবীজ



মাদের লাবুপিসির আসল নাম ছিল লাবণ্য।আমার ঠাকুমা যখন চিৎকার করে 'অ -লাবুউউউ' বলে ডাক পাড়তো আমার সংস্কৃতে পণ্ডিত জ্যাঠামশাই ঠাকুমার কান বাঁচিয়ে ফিচেল হেসে বলতো 'ওরে অলাবু কইলে নিমাই কেডা!' আমার সেই সদ্য কৈশোরের দিনে এই কথার মানে বোঝার ক্ষমতা ছিলোনা তবে মা - জ্যেঠিমার ঠোঁট টেপা হাসিতে বুঝতাম এর আরও কোন গূঢ় মানে আছে যেটা জিজ্ঞেস করলে পিটুনি নিশ্চিত।তখন দাদু ঠাকুমার ভরন্ত সংসার।বাবা-জ্যাঠা-কাকা তিনভাই, তাদের বউ বাচ্চা মিলিয়ে এক হইহই কাণ্ড।পিসিদের বিয়ে হয়ে গেছে এক ঐ লাবুপিসিই রয়ে গেছে।লম্বা -চওড়া গিটগাট চেহারার ফটফটে ফর্সা, সামান্য দাঁতউঁচু লাবুপিসির বিয়েটা কেন হয় নি বহুদিন পর্যন্ত এ রহস্য আমি উদ্ধার করতে পারি নি।সব পিসিদের কবেই বিয়ে থা হয়ে গেছে লাবুপিসির বিয়ের কোনও উচ্যবাচ্য নেই, অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি 'লাবুপিসি তুমি বিয়ে করোনি কেন গো?বিয়ে হলে কি মজা হতো আর একটা পিসির বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারতাম'। উঁচু দাঁতের সারি বের করে লাবু পিসি হাসতে হাসতে বলতো -'পিয়ারা গাছে দ্যাখসো না বড় পিয়ারাডারে ন্যাকড়া বাইন্ধ্যা থোয় কেউ খায়না,আমারে ওমনি বীচন রাখসে'!মা জ্যেঠিমারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তো এ ওর গায়ে,দাদু না শোনার ভাণ করতো শুধু ঠাকুমার চোখটা কেমন চিকচিক করে উঠতো যেন।আমার মনে হতো এটা মোটেই বিয়ে না হবার কোনও জুৎসই কারণ হতেই পারে না।লাবুপিসি কি পেয়ারা তাই যে!শেষে একদিন বাবার শরণাপন্ন হলাম।আমায় জানতেই হবে লাবুপিসি বিয়ে করেনি কেন।আমি এতো ছোট তাও ঠাকুমা কথায় কথায় বলে- "তোমার বিয়া না দেইখ্যা মরুম না সোনা"সেই ঠাকুমা বীচন রাখবে বলে লাবুপিসির বিয়ে দেয়নি এটা হতে পারে?সেদিন রবিবার, দুপুরে বাবা কাকা জ্যেঠু সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে,দাদুর আর আমাদের ছোটদের আগে খাওয়া হয়ে গেছে,মা -ঠাকুমারা পরিবেশনে ব্যস্ত, লাবুপিসি চানে গেছে, আমি দেখলাম এই সুযোগ এখনই সবার সামনে বলিনা কেন,বাবাকে বললাম - 'বাবা লাবুপিসি বলেছে লাবুপিসির বীচন রাখবে তাই বিয়ে হয় নি,তাই গো?মানুষের বীচন রাখে?পেয়ারার মতো?' বাবা তো আমার প্রশ্ন শুনে বিষম খেয়ে অস্হির।আমার সংস্কৃতের মাষ্টার জ্যাঠামশাই ভাইকে উদ্ধার করতে মাঠে নামলেন - 'তোমার প্রশ্নটা কি? মানুষের বীচন রাখে কিনা তাইতো? না রাখেনা,লাবুদি তোমার সঙ্গে মজা করেছে', 'তাহলে লাবুপিসির বিয়ে হয় নি কেন?লাবুপিসির শ্বশুর বাড়ি নেই কেন?'হাজারটা বেয়ারা ছাত্র চড়ানো জ্যেঠু একটুও না ভেবে মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বললেন -'বলতো তোমার লাবুপিসি কি খেতে সবচাইতে ভালোবাসে?' কে না জানে মাছ!একবেলা মাছছাড়া লাবুপিসি ভাত খেতেই পারে না।ঠাকুমা বলে - 'অরে আঁশধোয়া জল দিলেও চলবে কিন্তু মাছের গন্ধ চাই'।জ্যেঠু হাসতে হাসতে বললো-' আমাদের বামুনের ঘরে বর মরে গেলে তো মাছ খেতে পাবেনা তাই পাছে বিধবা হলে মাছ খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় সেই ভয়ে তোমার লাবুপিসি বিয়েই করলো না।' যাকবাবা এতোদিনে জানা গেলো কেন লাবুপিসি শ্বশুরবাড়ি যায় নি।ঠিকই তো মাছ ছাড়া কি ভাত খাওয়া যায়।আমিও বাবা বিয়ে করবোনা নইলে বর মরে গেলে আমাকেও তো নিরামিষ খেতে হবে!


লাবু পিসি কিন্তু আমার নিজের পিসি না,এক জটিল তুতো-খুঁতোর সুতো ধরে লাবুপিসি আমাদের সংসারে রয়ে গেছিলো,সেকালে এমন অনেক হতো অবশ্য ভেবে দেখলে লাবুপিসিকে রেখে লাভ বৈ লোকসান তো কিছু ছিল না।একা দশটা মানুষের কাজ সামলাতে পারতো।আমাদের বাড়িতে শুধু না আশেপাশের বাড়িতেও অনুষ্ঠান লাগলে লাবুপিসিকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতো।দূরের আত্মীয় স্বজনদের বিয়ে থেকে শ্রাদ্ধ সবেতেই লাবু পিসি মাসখানেকের জন্য পুটুলি বেঁধে রেডি।অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঠাকুমা যেতে দিতে বাধ্য হতো কেননা যতোই হোক নিজের মেয়েতো নয়, জোর কিসের? আর সারাবছর পরের সংসারে খাটতে খাটতে এই অনুষ্ঠান বাড়িগুলোই বোধহয় লাবুপিসির রিক্রিয়েশন ছিল।আমার ধারনা ঠাকুমার সত্যিই লাবুপিসিকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হতো।আমি জন্মাবধি লাবুপিসিকে ঠাকুমার সঙ্গে শুতে দেখেছি।ঠাকুমার সামান্য শরীর খারাপেও লাবুপিসির কী ছটফটানি!আমার নিজের পিসিদের সঙ্গে ঠাকুমার এতো ঘনিষ্টতা আমি অনুভব করি নি।


ছোটকাকার ছেলের অন্নপ্রাশনে খুব ধুম হয়েছিল।দাদুর মনে হয়েছিল জীবদ্দশায় এটাই দাদুর শেষকাজ সব আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে সে এক এলাহি ব্যাপার।লাবু থাকতে চিন্তা কি!আমার তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা আসন্ন ।তিনতলার চিলেকোঠা বরাদ্দ হলো আমার নিরালায় পড়াশোনার জন্য।অনুষ্ঠানের তিন চারদিন আগে থেকেই বাড়িভর্তি লোকজন।এতো ব্যস্ততার মধ্যেও লাবুপিসি ঠিক ফাঁকেফঁোকে এসে মাছের ডিমের বড়াটা, কুটুম বাড়ির মিষ্টিটা মুখে গুঁজে দিয়ে যেতো।অন্নপ্রাশনের দিন সকালেই খাওয়াদাওয়া।অতো নিমন্ত্রিত সব সারা হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল।সন্ধ্যাবেলায় আমি পড়তে বসেছি, লাবুপিসি সন্ধ্যা দেবে কোথাও ঘর ফাঁকা না পেয়ে চিলেকোঠার ঘরে এসেছে কাপড় ছাড়তে।আমার পিছনে লাবুপিসি,আমি বইমুখে উল্টোদিকে ফিরে পড়ছি হঠাৎ জানলার কাচে চোখ পড়তে লাবুপিসির প্রতিবিম্ব দেখে আঠেরো বছরের আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। এ কে!সম্পূর্ণ অনাবৃত স্তনহীন বুকে পুরুষেরমতো অস্ফুট বৃন্তের আভাসটুকু মাত্র।দিশেহারা আমি চকিতে ঘুরে দাঁড়াতেই হতভম্ব লাবুপিসির ঠোঁটে চেপে ধরা শায়ার প্রান্তটুকু খসে পড়লো,দুইহাত দিয়ে প্রাণপণ যৌনাঙ্গ আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যেই আমার চোখের ওপর থেকে এতদিনের সব রহস্যের কুয়াশা যেন ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগলো।একই অঙ্গে দুই বিপরীত প্রকৃতিকে বছরের পর বছর ধরে বয়ে বেরানোর কী বিপুল মানসিক চাপ সয়েও এই মানুষটা বেঁচে আছে! নিজের বলতে কেউ নেই।এর বাড়ি তার বাড়ি সেবা বিলিয়ে স্রোতের শ্যাওলার মতো ভেসে ভেসেও জীবনের থেকে মুখ ফেরায় নি তো।এই জন্যই লাবুপিসিকে সবাই এতো নিশ্চিন্তে সংসারে ঠাঁই দিয়েছে! নইলে সব স্বাভাবিক হলে মানুষ এতো সহজে বিশ্বাস করতো কি?ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত দুটো ধরে লাবুপিসির মিনতি - 'যা দেখলা কাউরে কইয়ো না সোনা তুমি আমার লক্ষ্মী মা না?

Comments

1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র