অতনু গঙ্গোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

অতনু গঙ্গোপাধ্যায়

একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ
                                                                                                                                                                                                                              
-                                                                - এক -
- তুই আর খাস না।তোকে ঝাপসা লাগছে।
- যদি বলিস তুই আমার ক্রাশ খেয়েছিস তাহলে এই খাওয়া বন্ধ।
- কেন বলব?
- কেন বলবি না?  তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস দেখিস কেন?
কারণ তুই আমাকেই ভালবাসিস। আর  বাসতেই হবে সবসময়।
-দ্যাখ সৌমি । নো বাওয়াল । একটা করে ঝাড় খাবি আর আমার কাছে প্যানপ্যানানি করবি।মাল খাবি, কবিতা শুনবি। আমার কোলে দুম করে মাথা রেখে বলবি - আমাকে আদর কর।আমাকে ঘেঁটে দে।
- কি করব আমার যে বেশিদিন হলেই একঘেয়ে হয়ে যায়।বড়জোর তিনমাস । তারপর সব ব্লকড আর ঝাড় দিয়ে দিই। । ধরে নে তুই আমার বিন্ধ্য পর্বত না না হল না । তুই আমার বটগাছ,একমাত্র সাক্ষী  ।  আর এক পেগ বানা না মাইরি। সিগারেটটা অনেক টেনেছিস। দে। 
- এই শুনশান দুপুর রোদে আমাকে অফিস ছুটি নেওয়ালি কেন? আমি তখনই ভাবলাম  মনের মধ্যে গাঁদ জমেছে। এই গরমে বাইরে একটাও লোক নেই। জোর করে আমাকে....
- আরে শালা কিংশুক শোন ।  বর ডিভোর্সের নোটিশ পাঠাবে বলছে  । রোজ ফোন করে একই ঘ্যানঘ্যানানি আর নাকে কান্না – আমাকে ছেড়ে দাও নয় সংসার করো।আমিও বোধহয় ছাড়তে চাই না। বলছে  হয় চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসো। তুমি শুধু ঘরকন্না করবে। নো মোবাইল,নো নাটক,নো  আবৃত্তি, নো লিটল ম্যাগ। আমি হাঁফিয়ে যাব। বিশ্বাস কর - এডজাস্টমেন্টের একটা সীমা আছে। নিজের মা কিটি পার্টিতে সেজেগুজে বেরোবে। নিজে মমস চাইল্ড। ধুর!  ধুর!  কিন্তু কি জানিস অনেক পুরানো তো ফিজিক্যাল বন্ডিং না থাকলেও মায়া লাগছে ছাড়তে।
- চলে যা। ঘরসংসার কর। বর অফিস থেকে এলে সুন্দর করে জলখাবার সাজিয়ে দিবি। তারপর দুজনে মিলে ঘুরতে যাবি। বড় রেস্টুরেন্ট এ ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করবি। উইক এন্ডে আউটিং যাবি। দুপুরবেলায় বর যখন অফিসে গাড়িটা নিয়ে বান্ধবীদের সাথে মিট করবি। স্কুল-কলেজের গ্রুপ। সেল্ফি তুলবি।পোষ্টাবি।
- আরে দূর। নেশাটা চটকে দিস না। বসে বসে ক'টা লাইক পড়বে। দেখব?  আমি জানিস যখন মঞ্চে উঠি তখন মনে হয় কখনো ধর্ষিতা,বিপ্লবী,নারীবাদী,নেত্রী, গৃহবধূ,নার্স শিক্ষিকা যে চরিত্রেই থাকি এভাবে একের মধ্যে বহু হয়ে ওঠার নিষেকের শৃঙ্গার উল্লাস পাই। সেল্ফিতে আমার কিস্যু হয় না। আমার অর্গ্যাজম মঞ্চে। আমি অভিনয়ের পর চাই তোর মতো কোনো  পুরুষ আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমার যখনই নৌকা উল্টায় আমি তোর লাইট হাউসের আলো লক্ষ্য করে চলে আসি।
-কেন?  এখানে ডানা শুকাবি? ক্ষতস্থান চেপে ধরে আমি তোকে উড়ালে ছেড়ে দিয়ে আসব। যা যা ফ্ল্যার্ট করিস না ।
-আমার কোনো ইশ্বর নেই,আছিস তুই। আচ্ছা কিংশুক, তুই কি বাই..?
- যা ওঠ। শালা নেশায় টপকে যাচ্ছে। চোখ- মুখে জল দিয়ে আয়। তারপর তোকে ছেড়ে আসব। আমার সাথে যাবি আউটিং- এ?
- যাব। যেদিন বলবি যাব।
- তার মানে জীবনেও যাবি না।ভ্যাট। পুরানো পাঁচালি। ছাড়। কাবাবের প্লেটটা এগিয়ে দে। সসের পাউচটাও। খিদে পেয়েছে। 
- আমি থেকেও নেই কারণ আমি কবিতায় তোকে নির্মাণ করি কিন্তু তোর পোষাক পাল্টানোর রিফু কর্মে আমাকে পাবি না।
- বাজে কথা। তুই থাকবিই আমার। আমি তোর থাকব না। আঘাতে আঘাতে আহত হলে তোর কাছেই আসব। বলে দিলাম কিংশুক।
- আমি সংসারী। বয়স আর অভিজ্ঞতায় অনেক বড়ো তাই পরিকল্পিত সময়ে বিশ্বাস করি সৌমি। আমার সবকিছু সময়কে ফিতে দিয়ে মেপে মেপে একটা করে লোকেশন সেটেলড করি। আমার সময় সারণিতে তুই যে নেই।
- তাহলে শোন আমিও তো আমার বাবার মত বাস্তববাদি মানুষ। আমার মা আমার মধ্যে নাটক,সাহিত্যের নেশা ঢুকিয়েছে। সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্নতার আদিখ্যেতা থাকত আর আমি পালিয়ে প্রতিশোধ  নিতাম কিন্তু  আমার বাবা ডাকেও নি খোঁজেও নি। যা হাতের কাছে নেই তাতে তার ভাবার সময়ই নেই ।   তুই কি জানিস ?এখন একটা ভীষন কম বয়সী প্রেমিক হয়েছে। আমি ওর বাইকে সন্ধ্যেবেলা অফিস ছুটির পর রেল ষ্টেশনের কাছে গিয়ে একসাথে গাঁজা টানি। আমি নেশায় বকবক করি আর ও আমাকে 'বউ' 'বউ' করে ডাকে। রাত বাড়ে, নেশায় আমার মাথা ঝুলে আসে বুকের কাছে অন্ধকারে দেখতে পাই নিকানো উঠোনে মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। ও আমার চারপাশে ঘুরছে আর কুলোয় করে আমার মাথায় ধান ঢালছে। সারা গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সোনালি ধানের দানা।
- কাছে আয় আরো কাছে। তোকে বাঁধার সময় আর ছাড়ার সময়ের যে ক্ষীণ গ্যাপ আছে সেই পাসওয়ার্ড আমার জানা আছে।বৃষ্টিতে ভিজবি। দ্যাখ বাইরে মুষল বৃষ্টি। জানলার শার্শিতে জল ঝরছে। আমার ছাদের দরজাটা খুলে দিই। বাইরে লোডশেডিং। কোনো দেখার সিন নেই। চল দুজনে ভিজি আর গান করি।
- না থাক কিংশুক। নেশাটা চটকে যাবে। আমি সব ঝেরেঝুরে উপুড় করে দিচ্ছি তোর কাছে।
- চল না সৌমি। বারিশওয়ালা হ্যামলিনের মত ডাকছে। চল ভিজি। আর ঘুরে ঘুরে গান গাই। জলের ধারা মাথার চুল ভিজিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সারা শরীর বেয়ে নেমে যাবে। জুড়াবে অবশ্যই জুড়াবে।
- বলছিস তবে চল।আমার স্যালাইনের সাথে মিশে যাক নিবিড় বারি ধারা। সবই তো সমুদ্রে মিশবে। ওখানে সব দুঃখের রং নীল। চল এখনই ঝাঁপ দিই অতল আঁধারে।                                                                                        - দুই –
কিংশুকের ফুলহাতা জামাটা আর পায়জামাটা ঢলঢল করছে। আয়নায় দেখে মনে হচ্ছে ক্লাউনের পোষাকে ও ঢুকে গেছে।শোবার আগে চুল আঁচড়ানোয় সময় সৌমির হাতে উঠে আসে কিংশুকের জামার একটা বোতাম।চুলে আটকে ছিল । সৌমি  চোখের খুব কাছে নিয়ে আসে বোতামটাকে। চারটে ফুটো। এক কোনে একটু লাল সুতোর ফেঁসো আটকে আছে। বর্গক্ষেত্রের যেকোনো বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করলে আবার বেসবল
খেলার মতো সুতোর দৌঁড় ফিরে আসবে শুরুতে। জামার সংসারে সহাবস্থানের জন্য বোতামের                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                        ফুটোয় সূঁচ-সুতোর উঠানামা আর তারপর একজোড়া ঠোঁট বুকের ঘেঁষে  আসে। 'টুক' করে এক কামড়ে নামিয়ে দেয় অবান্তর সম্পর্ক।  সৌমি জল খায়, বাথরুমে গিয়ে কমোডে বসে তারপর উঠে চোখমুখে জল দেয়। এখনো মাথাটা একটু টলছে। বিছানায় গিয়ে ধপাস করে শরীর ছেড়ে দেয়। দূরে ট্রেনের হুইসেল শুনতে পায়। ও পাদানিতে দাঁড়িয়ে। দীপাঞ্জন দৌড়তে দৌড়তে আসে। ট্রেন ছেড়ে দেয়। দীপাঞ্জন দৌড়চ্ছে আর মাইকে ঘোষনা হচ্ছে - সৌমি তুই চাকরি নিয়ে এতদূরে যাস না। তোর মতো তুই চলিস আমার বাড়িতে কিছু বলবে না। ফিরে আয়।আমাদের এতদিনের সম্পর্কটা নষ্ট হতে দিস না। ছোটবেলার স্কুল জীবনের বন্ধু দীপাঞ্জনকে বিয়ে করেছিল অনেক বন্ধুকে হতাশ করেই । সেইসময় দীপকে ওর ঘরোয়া, সংবেদনশীল মানুষ মনে হত।  সৌমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে যখন ফ্রেস হয়ে নিজের টিফিন বানিয়ে ঘরে ফিরত তখন দীপের মায়ের ঘরে বসে একমাত্র দিদি, ভাই আর মা মিলে দরজা বন্ধ করে গল্প করছে। দিদির ফ্ল্যাট কাছেই। খাবার টেবিলে যা দু-চারটে কথা।  রাতে যখন শুতে যেত তখন দীপ কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।দুজনের মাঝে শূন্যতার বুদবুদটা বেড়েই যাচ্ছিল আর তার সাথে বেড়ে উঠছিল আড়ষ্টতা । ওর নাটক করা  নিয়ে কম বিরোধিতা ? সৌমির ট্রেন ষ্টেশন ছাড়িয়ে চলে এসেছে অনেকটা।চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে নিজের শহর,নাটকের গ্রুপ,সংসার, লিটল ম্যাগাজিনের হুল্লোড় সময়। সৌমি ট্রেনের বাইরে থেকে দেখে রেল লাইনের কাছেই রাস্তায় লরি,ট্রাক্টর, মোটরসাইকেল, ভ্যান রিক্সায় সার,সবজি সব যাচ্ছে। উল্টোদিকে সরে যাচ্ছে সটাসট। হঠাৎ অন্ধকার। ট্রেন ঢুকে পড়েছে একটা টানেলে। সৌমি ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরে। বিকেলের এক বড় মাঠে ও ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়ির মুখটা নির্মাল্যের মত। ওর প্রথম প্রেমিক। আরেকটা লাটাইয়ে ঘুড়ি লাগাল। মুখটা অর্ঘদীপের। সেটাও কেটে গেল। ও পাগলের মত একটার পর একটা ঘুড়ি লাগাচ্ছে আর কেটে যাচ্ছে। সৌমি হাতড়ে যাচ্ছে চারপাশ। ' মা' করে একবার গুঙ্গিয়ে উঠল। ঘুমটা ভেঙ্গে গেলেও ও বুঝতে পারছে না। এখন সকাল না বিকেল। খিদে পাচ্ছে নাকি?  জোর করে উঠল।মোবাইলটার নেট অন করল। ওর এক নতুন বন্ধু হয়েছে ও ভুলেই গেছিল। নামটাও জানে না। ঘুম না আসা পর্যন্ত সৌমি ভাবল একটু বাজিয়ে নিলে কেমন হয়? মনে হয় ফেক আইডি।রাত প্রায় দুটো। একগাদা ম্যাসাজ ঝাঁপিয়ে পড়ল। জেগে আছে নাকি তাহলে? একটা ম্যাসাজ পাঠাতেই দেখালো - এক্টিভ নাউ। টাইপিং... তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছি। ছিলে কোথায়? 
সৌমি লিখল - আমি কোনোদিন কাউকে জবাবদিহি করি না। এমনকি বাবাও জানতে চায় না।
- ও স্যরি। তোমার সাথে যদি দেখা করতে চাই।
- সামনের মাসে প্রথমে ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাব। তখন দেখা করব।
-তোমার ওয়াল দেখেছি। মনে হয় তুমি আমার সেই শ্রেয়সী। তোমার মতই কোঁকড়া চুল,বড়ো টিপ,চোখের বড় বড় পাতার পলক ফেললে বুকের মধ্যে প্রকৃত সারস উড়ে যাওয়ার শব্দ পেতাম। মাথার সামনে কিছু কুচো চুল পড়ে থাকতো।
- কি হয়েছিল? হারিয়ে ফেললে কেন?
- হারাইনি। আছে। তোমার ছবির মধ্যেই ফিরে পেলাম। আমি যখন পৌছে গেছি রেল লাইনের ধারে। ততক্ষণে শ্রেয়সী  নিথর,  দু-টুকরো।রেল পুলিশের মর্গে। সব রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। আমি আর দেখতে যেতে চাইনি। ওলটানো দুপাটি জুতো আর রুমালটা পড়ে ছিল একটু দূরে। কোনায় সুতোয় বোনা ছিল 'এস'।দুজনের নামের একই আদ্যক্ষর আমি সেদিন দুপুর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত্য প্লাটফর্মে বসে ছিলাম ।রাতে ছাদে শুয়ে শুয়ে ওর প্রিয় সুর বাজিয়ে যেতাম। তোমার আইডি দেখার পর আমি মাউথ অর্গ্যানে তোমার জন্যও কিছু সুর তুলেছি। শুনবে? 
সৌমি গল্পের গন্ধ পেয়ে গেল। উপুড় হয়ে শুলো।
- পাঠাও। পরে শুনব।
- আমার নম্বরটা দিচ্ছি।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                               
- দিও। আমার ক্লাসে পড়ত সুতীর্থ। ও মাউথ অর্গ্যান বাজাত। ফুটবল পাগল।একই গাড়িতে আমরা দুজন স্কুল যাওয়া-আসা করতাম। ওকে ড্রপ করে চলে আসতাম। আমাদের কো-এড স্কুল ছিল। এখন ব্যাঙ্গালোরে আছে।
- তুমি কি বাইরে থাকো?
- আমি আই.টি। । চাকরি নিয়ে কলকাতা থেকে অনেক দূরে । তুমি ?
- তুমি কি সুতীর্থকে মিস কর? আমি প্রফেশনাল মিউজিশিয়ান । 
- আমি এখন সবার মধ্যে প্রত্যেক প্রেমিকের ভগ্নাংশ পাই বাকিটা ভ্যারিয়েশন।তোমার পাঠানো মিউজিকটা  শুনলে যদি আদ্যক্ষরে মিলে যায় । তারপর আমরা ডেটিং এ যাব। আমরা প্রিন্সেপ ঘাট থেকে নৌকা নেব। সন্ধ্যায় ব্রীজের আলোকমালার প্রতিফলন তির তির করে কাঁপবে। নৌকায় পর্দা কিন্তু পড়বে না। আমি পুরো চাঁদ দেখব আর তুমি মাউথ অর্গ্যানে সুর তুলবে। প্রমিস?
- আচ্ছা। তাই হবে। তবে ডিনার খরচ তোমার। 
- ওকে ডান। আমার নম্বর.....।
তারাগুলি ক্রমশঃ মুছে আসতে থাকে। দু- একটা পাখির ডাক শোনা যায়। আলো গভীর হয়ে যায়। আরো স্পষ্ট হয় দিন।মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ ভেসে আসে। ঘরের মধ্যে হাত থেকে ছিটকে পড়েছে মোবাইল। একটু হাঁ- মুখের চারপাশে চারপাশে ছড়ানো কোঁকড়া চুলের রাশি। অঘোরে ঘুমের মাঝে হাল্কা নাক ডাকা আর ফ্রিজের শোঁ শো শব্দ ছাড়া কিছু নেই। বিছানায় ছড়ানো ফুল হাতা জামাটা আর পায়জামা। ঘুমের মধ্যেই কখন একসময় ঠিকঠাক রিফ্লেক্সে দিন শুরু হয়ে যাবে সৌমির।                                                                                                - তিন-
অফিসে ঢুকেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। সৌমির প্রচুর প্রজেক্ট বানাতে হয়।  সব ভেন্ডারদের মেল চেক করে প্রত্যেককে উত্তর পাঠাতে হয়। কাজের মধ্যে মধ্যেই একটুখানি কিংশুক উঁকি দিয়ে গেলে বা ওরও একটু  দেখতে না পেলে ভাল লাগে না। সারাদিনের কাজের ফাঁকে একটু কথা বা কিউবিকলের ফাঁক দিয়ে একটু চোখাচোখি হয়ে গেলে আবার কাজে মন বসে যায়। সন্ধেয় নাটকের রিহার্স্যাল থাকে। ফেরার পথে কিংশুকই নামিয়ে দিয়ে যায় কখনো কখনো । আজ নাটক আছে। একাই চলে যাবে সৌমি একটু আগে। কিংশুক পরে বাড়ি থেকে নাটক দেখতে আসবে । একাই  আসার কথা ।। ওর বউ আর ছেলে আছে দিল্লীতে।  প্রতিবার  নাটক হওয়ার পর  ওরা দুজন একসাথে খেতে যায় শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরের ধাবায়। কিংশুকের নতুন লেখা কবিতা, ওর নাটকের অভিনয় নিয়ে আলোচনা, দুজনের গল্পের সাতকাহন সেরে আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। যে রাতে আর বাড়ি ফেরা হয় না। সারা রাত কিংশুকের বাড়িতে আড্ডা। সৌমি ভাবে  কিংশুকের ব্যক্তিত্বের এক অদ্ভুত আকর্ষণ  আছে যা পজিসেভনেসকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে রাখে।  কাজ শেষে বেলা বিকেল প্রায় গড়িয়ে আসে। সৌমি ঘড়ি দেখে একবার  আর অফিস থেকে  বেরোবার সময় বলে যায় -  তুমি কিন্তু টাইমলি পৌঁছে যেও। আমি বেরোলাম।
     নাটক যখন শেষ রাত প্রায় ন'টা। মেক আপ তোলার পর ড্রেস চেঞ্জ করে সৌমি বাইরে আসে। গাড়ি শহর ছাড়াতেই এসি বন্ধ করে জানলার কাঁচ নামিয়ে দেয়। হু হু করে বাদল হাওয়া সৌমির খুব তাজা লাগে নিজেকে। এতক্ষণ মঞ্চে থাকার পর এই রেস্ট যেন  আরো এনার্জি বাড়িয়ে দেয়।
সৌমি কিংশুককে বলে - আজ সবাই অভিনয়ের প্রশংসা করছিল। এত বড়ো রোল একা শেষ পর্যন্ত  টেনে নিয়ে যাওয়া । স্যারও পর্যন্তও মাথা হাত রেখে প্রশংসা করে গেল। তুমি কিছু বলছো না কেন?
- তোর অভিনয়ের বিষয়ে আমার বলার স্পর্ধা নেই রে। তবে মঞ্চে যতক্ষণ তুই আছিস মনে হয় ওই আগা থেকে গোড়া সব তোর দখলে।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           
- ইয়েস । ইয়েস । আই এম দ্য অনলি ডিক্টেটর অন স্টেজ।
তবে আজ রাতে তোমার ওখানে যাব না। একটু ঘুরেই বাড়ি ফিরব।অনেক বকেয়া কাজ মিটাতে হবে। ওহ! তোমাকে একটা কথা বলব। ভুলেই গেছিলাম।
- ওকে। চল।আমারও অনেক লেখা বাকি আছে। পাঠাতেও হবে।
- তোমার এই বইটা উদ্বোধনের দিন বলো। আমি কিন্তু আবৃত্তি করব। আগেরটায় তো ভুলেই গেছিলে। কবিরা বোধহয় এরকমই হয়।
বলেই 'চকাস' করে কিংশুকের গালে একটা চুমু খেল।
গাড়ি থেকে নেমে গেটে ঢুকবার আগেই আবার কি মনে করে ফিরে এল । ড্রাইভিং সিটের দিকে গেল। ওর হাতে একটা হাত রেখে বলল- তোমাকে আসল কথাটাই বলা হয়নি। আমি সাতদিন আগেই রেজিগনেশান লেটার মেল করে দিয়েছি। এক্সেপ্ট ও হয়ে গেছে। কলকাতায় নতুন একটা জব এসাইনমেন্ট হয়ে গেছে। আগামি সোমবার জয়েন। ওখানে অভিদার গ্রুপে নাটকেও নামব। কথাও হয়ে গেছে।
- বেরোচ্ছিস কবে?  টিকিট কাটা হয়ে গেছে? 
- পরশু। সন্ধ্যার ট্রেনে।
                                                                                      - চার -
স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে গেছে অফিসের গাড়িটা। ট্রেনে ছেড়ে দিতে সেকশানের  সব কলিগেরা এসেছিল আর তাদের ফ্যামিলি আরো নাটকের বন্ধু-বান্ধব। কিংশুক আজ সাইটে গেছে ফিরতে দেরি হবে। ফেয়ারওয়েলে সবাই মিলে হুল্লোড় হল শুধু বেচারা কিংশুক আর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ক'জন উইশ করেই বেরিয়ে গেল সাইটে। সৌমি স্টেশনে পায়চারি করে। লাগেজ তুলে দিয়েছে ট্রেনে। চার বছর হয়ে গেল এই শহরে। সপ্তপর্ণী গাছটার নিচে দাঁড়ায়। ষ্টেশনে ঢুকবার গেটের দিকে বার বার  তাকায়। চেনাজানা কেউ এল কিনা?  না। ট্রেনে ওঠে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। টানা হুইশেল দিয়ে একটি ছোট্ট বিরতি তারপর ট্রেন একটু একটু করে দুলতে দুলতে এগোতে থাকে। সৌমি গেটে দাঁড়িয়েই আছে।  বাতাসে উড়োউড়ি চুল। মুখের কাছে লেপ্টে যাচ্ছে। পিছনে ফিরে প্লাটফর্মের দিকে আবার তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর ইনডোর ঠেলে সিটের দিকে এগোয়।
কিংশুক সাইট থেকে বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনের হুইশেল শুনতে পেয়ে  গিয়ার চেঞ্জ করে গাড়ির স্পিডটা একটু বাড়িয়ে দেয় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র