সিরাজুল ইসলাম - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

সিরাজুল ইসলাম

মেয়েছেলের জুতো




বাবা গম্ভীর কন্ঠে হাঁক দিলেনঃ,"মোবারক! শুনে যাও! "
মোবারক আমার দূর সম্পর্কের মামা। ভাগ্যের সন্ধানে গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন শহরে কিছু করেকম্মে খাবে! নানান প্রতিষ্ঠানে ঢুঁ মেরে, অশিক্ষিত হওয়ার কারণে যখন নিরুপায় হয়ে স্বগ্রামে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করে ফেলেছেন, সেসময় বাবা তাকে একটা সিঙ্গার সেলাইমেশিন আর কিছু থানকাপড় কিনে দিয়ে আমাদের দোকানের একটা ঘর ছেড়ে দিলেন! খলিফাগিরি কাজ করার জন্য।
সহজ ভাষায় আমরা যাকে দর্জি বলি। বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলে এদেরকে খলিফা বলে ডাকে। কেন? সে প্রশ্নের জবাব আজও জানা হয়নি।
সময়টা সম্ভবত উনিশ শ আটষট্টি / উনসত্তর। আমার সবেমাত্র চার/পাঁচ। বাবুগিরি সভ্যতার সাথে পূর্ব পাকিস্তানী মধ্যবিত্তরা ভালোভাবে নিজেদেরকে( ঘরে ঘরে মাটির শানকির পরিবর্তে রংচঙ্গা টিনের বাসন, আর পায়ে কাঠের খড়মের পরিবর্তে প্লাস্টিকের চটি-স্যান্ডেল বাজারে আসতে শুরু করেছে সবেমাত্র!) মানিয়ে নিচ্ছে।
আমরা যারা পরিবারের ছোট সদস্য এদের জন্য কাঠের খড়ম।দু'আঙ্গুুলের ফাঁকে কাঠের গুটুলিটা ধরে রাখা কষ্ট হয় বলেই বাসের টায়ার কেটে বেল্ট তৈরি করা খড়ম বরাদ্দ ছিলো। তাও সেটা সাধারনতঃ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগ মূহূর্তে অথবা সন্ধ্যার আলো জ্বালানোর পূর্বমূহূর্তে মুখহাত ধুয়ে পড়তে বসার আগে খড়ম পায়ে দিয়ে চলার অভ্যাস শুরু হলো। বাকি সারাটা দিন খালি পায়েই গোল্লাছুট!
দু'দিন আগে মেজভাই গোয়ালঘরের বাঁশের খুঁটির ব্যাংক(জায়গাটা বাঁশের দুই গিরার উপরের দিকে কেটে, ফুটো করে নেয়া) কেটে পয়সা বের করে একজোড়া ঝাঁ-চকচকে পাম-সু কিনে এনেছে। পায়ে দিয়ে পথ চললে মচমচ মচমচ শব্দ বের হচ্ছে। বয়সে অনেক ছোট আমাদের দু'ভাইবোনকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার সে কি উচ্ছ্বাস! কারণ আমরা ছোট। ওই ধরনের জুতা পায়ে গলাতে অনেক বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে।
মেজভাইয়ের তাচ্ছিল্য আর অভিমানে আমার বোনটা চলে গেলো তার অভিমান প্রকাশের জায়গাতে। উঠোনের ওইপাশে ঝাঁকড়া হাস্নুহেনা গাছের আবডালে। গাছের নীচে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘেরাটোপ বানানো আছে দুঃখ প্রকাশের জন্য, সেখানে। আর আমি ভ্যাঁদা গোবিন্দের মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদলাম!
পিঠোপিঠি আমরা দু'ভাইবোন। দু'জনের জন্য মান অভিমানের দু'টো জায়গা আছে। একটা ওই হাস্নুহেনা গাছের নীচে, আর একটা শোয়ার ঘরে বড় কাঠের সিন্দুকটার আড়ালে। পাশাপাশি দু'টো ঘরের মাঝখানে! দরজা খুললে কপাটের আড়াল হয়ে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটাতে কোনমতে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা।
আমরা দু'ভাইবোন এই দু'জায়গার যে কোন একটাতে মান অভিমান করে থাকি মাঝেমধ্যে। যখন বড়রা এই দু'জনকে কানমলা অথবা চড়চাটি মেরে নিজেরা কৃতার্থ হন। তখন বোবাকান্নায় ভেঙে পড়ে ছুটে আসি এই নির্জন নিরালায়। আমি অবশ্য পারতপক্ষে হাস্নুহেনা তলায় যাই না, সাপের ভয়ে। ডালে জড়ানো থাকে সবুজ রঙের চিকন সাপ।
মেজভাইয়ের নতুনজুতো দেখে আমাদের দু'জনের ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হলো। মায়ের মুখে নরম সুরঃ, দিচ্ছি,দেবো! "
তাতে মন মানে না। বাবার কাছে বায়না ধরি। বাবা বললেন, হবে!
কবে হবে তার কোন সীমারেখা নেই!
ফন্দি আটলাম দু'ভাইবোন। সকাল থেকে নতুন করে বায়না হবে। যে কথা, সেই কাজ!ঘ্যানঘ্যানানির ফলে বোনের পিঠে রামধোলাই আর আমার জুটলো কানমলা!
নিদারুণ ব্যথা নিয়ে বোন চলে গেলো তার স্কুলে। আর আমি সেই গোপন ডেড়ায়, দরজার ফাঁকে নাকের জল চোখের জল একাকার করছি।
খাবারের থালা পড়ে আছে অথচ আমরা দু'ভাইবোন কেউই ভাত ছূঁইনি! বিশ্ময় প্রকাশ করে মা খুঁজলেন আমাদেরকে। খোঁজ! খোঁজ! সাড়া নেই। তখন মা যেয়ে বাবাকে দিলেন আচ্ছামতো বকেঃ-,
"ছেলেমেয়ে দু'টো সামান্য ক'পয়সার স্যান্ডেল চেয়েছে! তা যখন দিতে পারছো না, তাহলে ওদের মতই আমিও আর এ সংসারের ভাত খাবো না!"
মায়ের এ হুমকিতে বুঝি কাজ হলো।
দরজার ফাঁক গলে আমি দেখলাম, বাবার ডাক শুনে মোবারক মামা বলির পাঠার মতন কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এলো।
অনাথ এই মামাকে বাবা অত্যন্ত স্নেহ করেন। নিজে দেখে শুনে ক'দিন আগেই মামার জন্য মামী এনে দিয়েছেন। তারপরও সেই মামা কেন যে বাবাকে এত ভয় পায় জানি না। হয়তো শ্রদ্ধা! হয়তো সম্ভ্রম,বিনয়!
"তুমি তো দোকানের জন্য কাপড় কিনতে ঈশ্বরদী যাবে ? "
" জ্বী ভাইজান! "
বাবা একটা সিকি পয়সা বের করে দিয়ে মামাকে বললেনঃ,"এটা ধরো! খোকাকে সাথে নিয়ে যাবে! ওর জন্য ভালো একজোড়া চটি-স্যান্ডেল কিনে দেবে! "
জ্বী আচ্ছা বলে মামা দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে, সরে গেলেন।
খুশীর আবেশে আমার ছোট্ট পৃথিবীটা তখন দুপুরের সূর্যের মত আলো ঝলমলে!
অভিমানী গোপন ডেড়া থেকে দ্রুত বের হয়ে পুকুরঘাটলা থেকে ডুব দিয়ে এলাম। ক্যারোলিন কাপড়ের জামা আর হাফপ্যান্ট পরে, খেয়েদেয়ে মামার দোকানের চরাট(বাঁশের ফালিতে পেঁরেক পোতা। বেঞ্চের বিকল্প) এ অপেক্ষায় থাকলাম। ধৈর্যের শেষ সীমানা পার করে মামা এলো ঘর থেকে। আমাকে ডাক দিতেই একলাফে উঠে পড়লাম। চরাটে পোতা পেঁরেকের মাথায় বিঁধে চড়াৎ করে ছিঁড়ে গেলো প্যান্টের পিছনটা। অতিরিক্ত না থাকায় ছেঁড়া প্যান্টেই রওয়ানা হলাম! খুশীর অতিশার্যে মনে রইলো না প্যান্টের ছেঁড়া অঙ্গনের কথা।
লোহার রড বাঁকিয়ে "দ" বানানো হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক কসরৎ শেষে বাস ষ্টার্ট নিলো। ঝক্কড় ঝক্কড় শব্দ তুলে আর কালো ধোঁয়াতে আকাশটা অন্ধকার করে, এবড়োখেবড়ো পথে বাস এগিয়ে চললো যুদ্ধং দেহি মনোভাবে।
বাস থেকে নেমে ঈশ্বরদী বাজারের এমাথা সেমাথা ঘুরে ঘুরে দোকানের জন্য কাপড় কিনলো মামা। এ দোকানে সে দোকানের বিহারী মাড়োয়াড়ি দোকানীরা কত মুচকি হেসে চা খাওয়ালো মামাকে। মামাকে বলিঃ-,
"আমাকে একটু চা দিও মামা। "
"তুই চা খাবি! আচ্ছা দেবো! "
অন্য এক দোকানে বিহারীবাবু চা আপ্যায়ন করলো! পাশে বসে মামাকে খোঁচা মারিঃ,
"আমার চা কই? "
মামা ফিসফিস করে বলেঃ,
"আমি খেয়ে নিই,বাকিটুক তুই খাস!"
মামার আধখাওয়া ঢোঁক দিচ্ছি আর ঠ্যাং নাচাচ্ছি। ভাব এমন যেন কতদিনের চা-খোর আমি। গরমে জিহ্বা পুড়ে গেলো। তাতে কি!
চায়ে চুমুক দিতে দিতে একসময় পুরো চা মুখে পুরে দিলাম। আর তখনই মনে পড়লো, মামা তো আগে চা খেয়ে তলানী রেখে দিচ্ছিলো। এখন এখানে আমি যদি চায়ের তলানী না রাখি, তবে ওই বিহারীবাবু ভাববেঃ,
"বাঙালী ছেলে চা খেতে জানে না!"
একথা মনে হতেই মুখ থেকে পুঁকুৎ করে একদলা থুতুসহ কিছু চা উগরে দিলাম চায়ের পেয়ালায়। আঁড়ে চেয়ে দেখি, চাপদাড়ি ওয়ালা বিহারীবাবু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। লজ্জায় লাল হয়ে কেঁদে ফেললাম।
মামা ভাবলো, আমার স্যান্ডেল কেনার দেরি হচ্ছে বলে হয়তো!
জুতোর দোকানে ঢুঁকে মামা বললোঃ,
"মেয়েছেলের চটি দেখান দেখি!
"ফিসফিস করে বলিঃ,
"ও মামা! আমি কি মেয়েছেলে নাকি? তুমি বলবে ছেলেদের স্যান্ডেল দেখাতে। তা না, তুমি মেয়েছেলের চটি চাইছো। কী বোকা তুমি!"
শুনে মামা বাঁকা হাসে। স্যান্ডেল এলে বুঝলাম, মামীর জন্যই স্যান্ডেল নেবে মামা। তা একথা আগে বললে কি হয়?
আমার পালা এলো। অনেকক্ষণ ধরে, অনেক জোড়া স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে, দেখে দেখে শেষে পছন্দ হলো। কালো প্লাস্টিকের ওপর রেক্সিন পলেস্তরা করা নক্সাদার চটিজুতো। দাম পঁচিশ পয়সা। দরদাম।হাঁকাহাঁকি শেষে মামা দুইজোড়া কিনলেন চল্লিশ পয়সা দিয়ে।
মহামতি সম্রাট আলেকজান্ডার বিশ্ব জয় করে এতো খুশি হয়েছিলো কি না জানি না। তবে জীবনের প্রথম স্যান্ডেল পেয়ে সারা রাস্তা বাসের সিটে বসে, জানালার বাইরে দ্রুত অপসৃয়মান গাছগাছালী, আকাশের মেঘের সাথে কত গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি, মায়ের বুকে ঘুমিয়ে আছি। আর আমার সেই মহামূল্যবান স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বোনটা ফিকফিক করে হাসছে।
কারণ আমি যে স্যান্ডেল কিনেছিঃ -,
তা মেয়েছেলের জুতো!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র