অবনমন অথবা নিষ্ক্রমণের গল্প
ট্রেনের মধ্যেই কথাটা কানে এল। এমনিতে লোকাল ট্রেনে সুকান্ত খুব অন্যমনস্ক থাকে। আনমনা হয়ে প্রায়ই সে স্টেশন ছাড়িয়ে চলে যায়। আবার উজিয়ে উলটো পথে বাড়ি ফিরতে হয়।
তবু আজ কথাটা খেয়াল করল সুকান্ত।
সুমিত বাড়ি ফিরে এসেছে।
সুমিত। সুমিতনির্ঝর রায়। একই ট্রেনের যাত্রী। কল্যাণী টু শিয়ালদা। একই পথ। আর পাঁচজনের মতোই। একই পথে যেমন হয়। প্রথমে মুখ চেনা। তারপর আলাপ। ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়া। কখনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা। কখনও আলগোছে খুলে নেওয়া। এড়িয়ে যাওয়া। পিছনে নিন্দেমন্দ। সব নিয়েই একটা সংসার, হারিয়ে যাওয়া যৌথ পরিবারের টানাপোড়েনের আঁচ। আবার যে যার মতো একলা বাঁচা।
এইরকম পরিবারের মধ্যে সুমিত ছিল স্পেশাল। আলাদা। হইহই করছে। চেঁচিয়ে গান, টুকটাক উপহার একে তাকে। যে কোনও দরকারে হাসিমুখ। উপকার হোক বা না হোক, চেষ্টা থাকবেই। সুমিত এই রকমই। সুকান্তর মতো আপনভোলা লোকের জন্য সেরা সঙ্গী। কতদিন স্টেশনে নামার একটু আগে হাঁক পেড়েছে...
ও সুকান্তদা, আপনার অবনমনের সময় হল যে!
‘অবনমন’ শব্দটা নিয়ে খুব হাসাহাসি হত ওদের মধ্যে। ওদের মানে সুমিত আর সুকান্তর মধ্যে।
সুমিত বলত, সুকান্তদা, ভেবে দেখুন, নেমে যাওয়া সবচেয়ে সহজ। দেখবেন, ঠেলেঠুলে আপনাকে নামিয়ে দেবেই কেউ। আপনি নামতে না চাইলেও নেমে যাবেন। পাহাড়ের ঢাল ভাবুন... একবার হড়কালেই পপাত চ। ওঠাটাই শক্ত। সে ট্রেনেই বলুন, আর পাহাড়ে। দাদা চাপুউন বলে ঠেলেঠুলে উঠি আমরা... অথচ পাহাড়ে তো পুরো দম ফেল। চারতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠুন একদিন, না হাঁফালে নাম বদলে ফেলব আমার। অথচ নামতে চান... সরসর করে নেমেই যাবেন... নেমেই যাবেন...
ওর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলেছিল সকলেই। ট্রেনের কামরার সকলে। কিন্তু কথাটা অযৌক্তিক নয়। সেটাও মেনে নিয়েছে প্রত্যেকেই। তারপর থেকে স্টেশন এসে গেলে প্ল্যাটফর্মে পা রাখার সময় মুড ভাল থাকলে ‘অবনমন’ নিয়ে একটা হালকা মেজাজ ছড়িয়ে পড়ে। নেমে যাওয়ার গ্লানি আর ততটা বিঁধে যায় না অপরাধবোধের মতো।
সুমিত চলে গিয়েছিল। হঠাৎ। কোথাও কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল একদিন। দু’চারদিন ট্রেনে না ওঠায় সকলে ভেবেছিল অসুস্থ। তারপর ফোন। খোঁজাখুঁজি। খবরাখবর নেওয়া। জানা গেল, সুমিত নিরুদ্দেশ। সুমিত কোথায় গেছে, কেউ জানে না। সুমিত কাউকে বলেনি। সুন্দরী স্ত্রী, বৃদ্ধা মা, পাশের পাড়ায় বিয়ে হওয়া বোন, প্রায় সমবয়সী ভগ্নিপতি- কাউকে কিছু বলেনি। তার ছ’বছরের ছোট্ট মেয়েটার কেবল গাল টিপে আদর করে বলেছিল, মা, আসি রে। সে তো রোজই বলে। চুমু খায়। চুল ঘেঁটে দেয়। দুটো কান টেনে আদর করে। তারপর বলে, মা, আসি রে। সেদিনও তেমনই বলেছে। কিন্তু তারপর আর এই ট্রেনে ওঠেনি। রোজ যে ট্রেনে অফিসে যায়, সেই ট্রেনে অন্তত ওঠেনি। অফিসেও যায়নি। ওই সময় তাকে প্ল্যাটফর্মেই দেখেনি কেউ। সুন্দরী স্ত্রীয়ের সঙ্গে তার ঝগড়ার সম্ভাবনা পরমতম শত্রুও মনে করতে পারবে না। সংসারে তার নিশ্ছিদ্র শান্তি। ভরপুর আনন্দ। অন্তত টাকাপয়সা ধনসম্পত্তির মধ্যে যা যা উপকরণ থাকলে শান্তি পাওয়া যায়, তার সবকটিই তো মজুত। হুল্লোড়বাজ ভগ্নিপতির সঙ্গে সপ্তাহান্তে একবার মোলাকাত। সে’ও জানে না কিছু। পিঠোপিঠি বোন। দাদার চেয়ে একটু বেশিই বিচক্ষণ। তারও জানা নেই হঠাৎ তার দাদা কোথায় চলে যেতে পারে। মা তো এই সেদিনও চোখের ছানি কাটানোর কথা বলছিলেন। কত আলোচনা হল। সুমিত তারপরেও...
এত বিরাগ! কেন?
অনেকদিন অবধি ট্রেনের কামরার আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে সুমিত। সুমিতের প্রসঙ্গ। সুমিতের অজানা ছেলেবেলা। অল্প জানা স্কুল-কলেজ-ছাত্রজীবন ঘেঁটে দেখা-- কী কেন কবে কোথায়? তবে কি কোনও গোপন রাজনীতিতেই?
সুকান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে। কোথায় যেতে পারে সুমিত? কেন গেল? কোনও হিসেব মেলে না। দু’চারদিন সুমিতের আলোচনা এড়াতে ভেন্ডারের কামরায় ওঠে সুকান্ত। ভাল লাগছিল না। একে তো বাড়ি ফিরেই অবিশ্রান্ত চাপ। এটা করো, সেটা করো। আসার সময় টিফিনের কেক আনতে বলেছিলাম... এটাও ভুলে গেলে? মায়ের প্রেশারের ট্যাবলেটটা তো মনেই রাখতে পারো না। সব দায় তো আমার। আসার সময় আজ সোনামুগ ডাল আনতে বলেছিলাম। আনলে না! কোনদিকে মন থাকে বলো তো। মেঘলা হলে তুমিই তো খিচুড়ি খেতে চাইবে। ডাল বাড়ন্ত, কবে থেকে বলছি! আজ কিন্তু তুমি বিছানাটা পাতবে। পরপর তিনদিন ধরে আমি করছি। তুমি এটাসেটা অজুহাত দিয়ে শুয়ে পড়ছ। টুবলু স্কুলে ইতিহাসটা একদম পারছে না। মাঝেমধ্যে ছেলের পড়াটা নিয়ে তো বসতে পারো। আমি একা ক’দিক দেখব। শোনো, টুম্পাইয়ের বন্ধু নীপবীথির জন্মদিন সামনের সপ্তাহে— গিফট কিনতে হবে—কিছু টাকা রেখে যেও তো। অন্তত শ’তিনেক।
কত চাহিদা। ছোট-বড়-মাঝারি। রাশি রাশি চাই আর চাই। দাও আর দাও। করো আর করো। লাইন করে একে একে আসে। ভাল লাগে না। মাথা ঝিমঝিম করে। কত ভাবনা হারিয়ে যায়। কত চিন্তা মুছে তার ওপর চেপে বসে দুশ্চিন্তা। এই চাহিদার জীবন, এই ধুলোখেলা বড় ক্লান্ত করে। অথচ এছাড়া আর কী এমন চেয়েছিল সুকান্ত? কি চাইতে পারে সে? তার মতো একজন সরকারি কেরানি, অবসরে যার অবচেতনে অনেক শব্দ আর অক্ষর ভিড় করে... যার মাথার মধ্যে ছন্দে ছন্দে শব্দ গান গায়, যে এককালে শুধু কবিতা লিখে বেঁচে থাকার মতো অবাস্তব স্বপ্ন দেখে আবার সেই স্বপ্ন অক্লেশে গলা টিপে মেরে দিনগত পাপক্ষয় করে, সেইরকম একজন ছোটখাটো সাধারণ মানুষ কীই বা চাইতে পারে? সল্টলেকের পূর্ত ভবন থেকে বেরিয়ে অটোতে উঠে রোজ যে লোকটা বিধাননগর স্টেশন পৌঁছয়, যার পৈতৃক একখানা বাড়ি রয়েছে, যে বাড়ির দোতলার গাঁথনি শেষ হয়নি গত বছর পাঁচেক, যার স্ত্রী অত্যন্ত গোছালো গিন্নি, সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর, গৃহকর্মনিপুণা বলতে যা বোঝায়, যার দুটি নাবালক পুত্র-কন্যাই বড় শান্ত, বাধ্য আর আদুরে, যার বাবার নিজস্ব পেনশন আর মায়ের সুস্থ কর্মঠ জীবনযাপন রয়েছে, যার বাড়ির বাইরের ঘরে বড় পর্দার রঙিন টিভিতে সন্ধে থেকে বউ আর মায়ের জন্য একই টিভি সিরিয়াল চলতে থাকে... সেইরকম একটি মধ্য-চল্লিশের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মনখারাপ মানে তো আদিখ্যেতা।
সুমিতের নিরুদ্দেশের খবরে তোলপাড় হয়েছিল চারদিক। ফিরে আসার খবরেও তাই। সুমিত ফিরে এল। ঠিক উনত্রিশ দিন পরে। কোথায় গিয়েছিল তার কোনও উত্তর দেয়নি সে। কাউকে না। মা মাথা কুটেছেন। শোনা যায়, তার সুন্দরী স্ত্রীয়েরও প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া। তবু সুমিত বলেনি, সুমিত কোথায় গিয়েছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন উড়ে এসেছে। সেই একই কামরা। একই মানুষজন। একই ভিড়। সব একরকম। শুধু একটা লোক বেমালুম নিজের খুশিমতো হারিয়ে যায় আর নিজে নিজেই ফিরে আসে, তার কোনও কারণ থাকেনা, কারণ থাকলেও সে বলে না কাউকে।
মামদোবাজি নাকি! দেখুন কোথায় কি ঘোটালা ছিল। থানা-পুলিশ-হাজত কোথায় ফেঁসে ছিল কে জানে! যা দিনকাল মশাই। জেল খেটে এল কিনা কে বলতে পারে! বাড়ির লোকও হয়ত জেনেবুঝে নাটক করছে...
অভূতপূর্ব এক-একটি সম্ভাবনায় আবার কামরা মুখর। চারদিক থেকে টুপটাপ খসে পড়ে নিত্যনতুন সম্ভাবনার ফুলকি। কেউ লুফে নেয়, আরও রস মিশে যায়। সুমিত কামরায় উঠে এলেই সব শুনশান। সুমিতও নিস্পৃহ, নিরাসক্ত। এক আশ্চর্য উদাসীনতা তাকে মুড়ে ফেলেছে। সে যেন এই পৃথিবীর কেউ নয়। তার নীরব হাসিমুখের মধ্যে এক অদ্ভূত প্রশান্তি।
সুকান্ত দূর থেকে দেখে। মাত্র তো কয়েক বছরের ছোট তার চেয়ে। অথচ সুমিত পারল। সুমিতকে দেখে সুকান্ত। অবাক হয়। কিন্তু কিছুতেই সাহস করে তার কাছে এগোতে পারে না। খুব জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে, তুমি পারলে কি করে?
সুমিত একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ইশারা করে ডাকে।
দুজনেই দরজার কাছে। ছুটন্ত ট্রেনের দরজায় চোখেমুখে হাওয়ায় ঝাপটা।
যাবেন সুকান্তদা?
কোথায় সুমিত?
আমি যেখানে গিয়েছিলাম...
অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে যেন লটারি পাওয়ার আনন্দ। ঝলমল করে ওঠে চারদিক। আবহে স্যাক্সোফোন।
আমাকে ঠিকানাটা দাও সুমিত।
দেব, আপনাকেই দেব। আর কেউ জানবে না। শুধু আমি আর আপনি।
কিন্তু তুমি ফিরে এলে কেন সুমিত। আমি তো ফিরতে চাই না...
অনেকটা খাড়াই দাদা। অনেকটা উঁচু। দুর্গম। ওই যে পা ফসকে গেলেই পতন। পা ফসকে গেল দাদা। থাকতে পারলাম না। নেমে এলাম। আপনি পারবেন। আমি জানি আপনি পারবেন। আপনি ভাবুক মানুষ দাদা, আপনার মধ্যে শিল্পী মন, অবনমন হবে না আপনার, দেখবেন।
ঠিকানাটা দিও সুমিত, আজই।
ট্রেনের কামরায় কিছুদিন সুকান্তর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। হঠাৎ কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে কোথায় চলে গেলেন ভদ্রলোক? তবে ফিরে আসার সম্ভাবনাও আছে। ওই তো সুমিত যেমন চলে এল। সুমিত ছুটে যাওয়া ট্রেনের জানালায় একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবে, সুকান্ত কক্ষনও নেমে আসতে পারবেন না। কক্ষনও না।
...........................................................
সুচিন্তিত মতামত দিন