১
আজ সম্বাদ ভাস্করের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় একটি বিচিত্র বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। সকাল আন্দাজ দুই প্রহর হবে,নিমতলায় সুদৃশ্য বাড়ির বৈঠকখানায় একটি মেহগিনি কাঠের আরাম কেদারায় বসে বিজ্ঞাপনটি মন দিয়ে পড়ছেন বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র। কার্তিক মাস, খোলা জানলা দিয়ে কবোষ্ণ রৌদ্র ভেসে আসছে, বাড়ির সামনে চাঁপা গাছটির পাতাগুলি ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছে। রাস্তায় কোনও এক সাহেবের বগি গাড়ি হপ-হপ শব্দ তুলে চলে গেল চৌরঙ্গির দিকে, গাঢ় নীল আকাশে পথ হারানো নাওয়ের মতো দু-একটি ফানুস ঘুড়ি উড়ছে। পড়া থামিয়ে সেদিকে একবার তাকালেন প্যারীচাঁদ, এমন বিজ্ঞাপন সচরাচর চোখে পড়ে না, জনৈক ডি রুন লিখেছেন,
“আমার বিবাহিতা পত্নী শ্রীমতী ডরোথি বিগত কয়েক দিবস যাবৎ উদ্ভট আচরণ করিতেছে, একদণ্ড বিশ্রাম লইতেছে না, খাইতেছে না, উন্মাদিনীর ন্যায় দিবারাত্র কক্ষে অস্থির হইয়া পদচারণা করিতেছে। বর্ত্তমানে তাহার কণ্ঠস্বর কর্কশ হইয়া উঠিয়াছে তদুপরি বিজাতীয় উর্দু ভাষায় কথা কহিতেছে। আশ্চর্যের বিষয় হইল ডরোথি ইংরাজি ভিন্ন অপর কোনও ভাষা লিখিতে, পড়িতে বা বলিতে পারে না। এমতাবস্থায় সুচিকিৎসকের পরামর্শ লইয়াও কোনরূপ লাভ হইতেছে না। নিরুপায় হইয়া এই বিজ্ঞাপন পত্র দ্বারা সর্ব্বত্র জ্ঞাত করা যাইতেছে, যে সহৃদয় ব্যক্তি আমার পত্নীর আরোগ্য লাভের উপায় বাহির করিতে পারিবেন তাঁহাকে নগদ ১০০০।।০ টাকা পারিতোষিক স্বরূপ প্রদান করা হইবে। উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিম্নলিখিত ঠিকানায় যোগাযোগ করিতে অনুরোধ করা হইতেছে।
ইতি--
ডি.রুন.। ১০ নভেম্বর ১৮৬২।
৩ নং চার্চ লেন। কলিকাতা।
বি.দ্র. ভণ্ড ও অসৎ ব্যক্তির যোগাযোগ নিষ্প্রয়োজন।”
বৈঠখখানার মেকাবি ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটার ঘন্টা পড়ল, শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালেন প্যারীচাঁদ। স্নান, মধ্যাহ্নের আহার সেরে তাঁকে প্রস্তুত হতে হবে, বিকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়িতে একটি আলোচনা সভা রয়েছে, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনারায়ণ বসু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় সকলেই আসবেন, হিন্দুদের বহুবিবাহ প্রথা রদ করার জন্য ইতিমধ্যেই একটি খসড়া আবেদনপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে, সেই নিয়েই আলাপ আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে আজ। প্রায় ছয় বছর পূর্বে বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হয়ে যাওয়ার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় এখন নূতন উদ্যমে বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেছেন। প্যারীচাঁদ নিজেও সর্বান্তকরণে চান এই কুপ্রথা যেন অবিলম্বে দেশ থেকে উঠে যায়। নব্য বাবুরা এবং বিশেষত কুলীন ব্রাহ্মণরা একের পর এক বিয়ে করে চলেছেন, ইদানিং এঁদের কেউ কেউ আবার বিধবাদেরও বিবাহ করছেন, অতি সহজেই তাঁদের কামনা চরিতার্থ করার পথ প্রশস্ত হয়েছে। অন্তঃপুরে সেইসব বিবাহিতা নারীদের লাঞ্ছনার সীমা থাকে না, বিবাহের রাত্রির পর অনেকেরই সারাজীবনে স্বামীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার আর দেখাও হয় না! বঙ্গদেশে হতদরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের মুখ বুজে এ ব্যবস্থা মেনে নিতে হয়, অনূঢ়া কন্যা সমাজের চোখে অভিশাপের মতো, নিজের পিতার জীবনেও তারা গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। এই সমস্ত কন্যাদের অধিকাংশেরই বয়স দশ কি বারো বছর! প্যারীচাঁদের মনে হয় বহুবিবাহের সঙ্গে এই বাল্যবিবাহ প্রথাও বন্ধ হওয়া দরকার, আজ সভায় তাঁর ইচ্ছা এ-বিষয়ে সকলের সামনে একটি প্রস্তাব পেশ করবেন। সেই নিয়েই ভাবছিলেন কিন্তু অকস্মাৎ ওই বিজ্ঞাপনটি দেখে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন, আশ্চর্য ঘটনা, তাহলে কি তিনি যা ভাবছেন তাই সত্য ? গতমাসেই আমেরিকার বোস্টন শহর থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত প্রেততত্ত্ব বিষয়ক পত্রিকা ‘ব্যানার অফ লাইট’-এ এরকম একটি ঘটনার কথা পড়েছেন, তবুও নিজের চোখে বিশদে না দেখলে একটি খটকা থেকেই যায়। আগামী কাল সকালে একবার ডি.রুনের বাড়িতে যাবেন বলে প্যারীচাঁদ মনস্থির করলেন।
অন্দরমহলে দোতলায় খাওয়ার ঘরটি যথেষ্ট প্রশস্ত, দক্ষিণ দিকে বড় বড় দুটি জানলা রয়েছে, ওদিকের দরজাখানি খুললেই প্রশস্ত বারান্দা, সামনে বড় রাস্তা, একটি নাগকেশরের গাছ ডালপালা মেলে প্রায় বারান্দার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের এককোণে দিনের বেলা হওয়া সত্তেও একখানি সেজবাতি জ্বলছে! মাঝখানে নক্সা তোলা আসন পাতা হয়েছে, একটি বড় মার্বেল পাথর বাঁধানো কাঁঠাল কাঠের জলচৌকি রাখা সামনে, তার উপর রুপোর গোল থালায় যূথিকা ফুলের মতো ফুরফুরে ভাত সাজানো। থালার চারপাশে অন্তত সাত আটটি বাটিতে নানাবিধ ব্যঞ্জন, পায়েস ও পিঠা যত্ন করে রাখা, রুপোর গেলাসে ক্যাওড়া দেওয়া সুগন্ধি জল ঢাকা দেওয়া রয়েছে। প্যারীচাঁদ মিত্র স্নান করে এই ঘরে আসার পূর্বেই তাঁর দুজন পুত্রবধূ সমস্ত আয়োজন করে রাখেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, আরেকটি শূন্য রুপোর থালা প্রতিদিনই জলচৌকির নিচে মেঝের উপর রাখা থাকে, এর কারণ অবশ্য পুত্রবধূরা কেউই জানেন না। সবই নিরামিষ পদ, দুই বছর আগে স্ত্রী বামাকালীর মৃত্যুর পর থেকে প্যারীচাঁদ নিরামিষ আহার করেন, তাও মাত্র দ্বিপ্রহরে একবার, তিনি স্বল্পাহারী, রাত্রে খই-দুধ কি অল্প ছানা-মিছরি, এই তাঁর খাদ্য। স্ত্রী বিয়োগের পর মিত্র বাড়িতে একটি অদ্ভুত নিয়ম প্রচলন করেছেন, খাওয়ার সময় তাঁর সামনে কেউ উপস্থিত থাকতে পারবেন না! এই নিয়ে পুত্রবধূদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ রয়েছে কিন্তু মুখ ফুটে কারণ জিজ্ঞাসা করতে তাঁরা সাহস পান না।
আজও স্নান করে খাওয়ার ঘরে ঢুকে প্যারীচাঁদ দরজাটি ভেতরে থেকে বন্ধ করে দিলেন। তাঁর পরনে একখানি সাদা নরুণ পাড় ধুতি, গায়ে বেনিয়ান, কাঠের খড়ম জোড়া ঘরের চৌকাঠের বাইরে রাখা। জানলা দুখানিও বন্ধ করে দেওয়ায় সেজবাতির মৃদু আলোয় ঘরে ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়েছে, বন্ধ দরজার ওপাশে প্রতিদিনই অপেক্ষা করে থাকেন পুত্রবধূরা, যদি বাবামশাইয়ের কিছু প্রয়োজন হয়, কিন্তু আজ অবধি একদিনও ভেতর থেকে কোনও ডাক তাঁরা শুনতে পাননি। খাওয়া সাঙ্গ করে প্যারীচাঁদ বেরিয়ে এলে তাঁরা প্রতিদিনই ঘরে ঢুকে দেখেন শ্বেতপাথরের মেঝেয় রাখা থালাটির উপর পঞ্চব্যঞ্জন ও ভাত যত্ন করে সাজানো রয়েছে! বামাকালীর আমলের ঝি চন্দ্রলতা সেই সব তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়, প্যারীচাঁদের তেমনই নির্দেশ। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বাড়ির পোষা বেড়ালদেরও অবধি ওই খাদ্য মুখে তুলতে দেওয়া হয় না।
আহারের পর প্যারীচাঁদের দিবা নিদ্রার অভ্যাস নাই, নিজের ঘরে শয্যার পাশে একটি বড় আরাম কেদারায় বসে বই অথবা কোনও পত্র পত্রিকা পড়েন, একেকদিন নিজের লেখা নিয়েও বসেন। কয়েক বছর পূর্বে প্রকাশিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কলিকাতার শিক্ষিত সমাজে সমাদৃত হওয়ার পর কয়েকদিন হল একটি নূতন গ্রন্থ রচনার কাজে হাত দিয়েছেন, গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন ‘অভেদী’। এটির বিষয়বস্তু অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন, অধ্যাত্ম চেতনা ও ঈশ্বরকথাই এই গ্রন্থের মূল বিষয়, তার সঙ্গে গভীর থিওসফির আলোচনাও রয়েছে। প্যারীচাঁদের লিখন ভঙ্গিমাও এখন যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছে এবং এতদূর সে বদল, মাঝে মাঝে নিজের লেখা পড়ে নিজেই অবাক হয়ে যান। ভবিষ্যতে এই বিষয় অবলম্বন করে আরও একটি গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা তাঁর রয়েছে।
আজ ডাকে বিলাত থেকে কতগুলি চিঠি ও পত্রিকা এসেছে, আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর থেকে একটি চিঠি লিখেছেন কর্ণেল ওলকট, তিনি নিউইয়র্ক থিওসফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি। বাইরে রৌদ্র ম্লান হয়ে এসেছে, একফালি আলো করুণ কোনও রাগিনীর মতো শয্যার উপর শুয়ে আছে, অলস দ্বিপ্রহরে দূর থেকে একটি পায়রা আপনমনে ডেকে চলেছে। চারপাশ নির্জন, ফিরিওয়ালের সুর আজ শোনা যাচ্ছে না, দূর আকাশে কতগুলি চিল উড়ছে, শীতকালের বেলা বড় দরিদ্র, অল্পক্ষণ পরেই অপরাহ্নের কোলে ঢলে পড়বে। বন্ধ লেফাফার মুখটি কেটে চিঠিখানি বের করলেন প্যারীচাঁদ, সুদৃশ্য ইমারতের মতো অক্ষরে কর্ণেল ওলকট লিখেছেন,
“ডিয়ার বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র,
আশা করি, সব কুশল। একটি বিচিত্র ঘটনা জানাইবার নিমিত্ত আপনাকে এই পত্র লিখিতেছি। কয়েকদিন পূর্বে রবার্ট বলিয়া এক ব্যক্তির সহিত আলাপ হইয়াছে, তাঁহার মনের গঠন অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং একাগ্রতাও চমৎকৃত হইবার মতো। প্রাগুক্ত ব্যক্তি একজন ‘মিডিয়ম’, তাঁহার সাহায্য লইয়া আমি আমার মৃত পিতার সহিত সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হইয়াছি। একদিন নহে, পরপর তিন দিন পিতা আসিয়াছেন এবং আমার সকল প্রশ্নের উত্তরও দিয়াছেন। আমি জানি ইহা আপনার নিকট একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, এক্ষণে মূল কথাটি হইল পিতা আসিয়াছেন কিন্তু ফিরিয়া যান নাই। বলা ভালো ফিরিয়া যাইতে পারেন নাই, মজার বিষয় হইল রবার্ট কিন্তু সুস্থ অবস্থায় রহিয়াছে, ইহা কী প্রকারে সম্ভব ? আমার জ্ঞান ও বিচার মতে আত্মা ফিরিয়া যাইতে না পারিলে মিডিয়মের চরম শারীরিক ক্ষতি সাধিত হইয়া থাকে, এক্ষেত্রে ঠিক তাহার বিপরীত ঘটনা ঘটিয়াছে। পিতা সর্বক্ষণ আমার নিকট রহিয়াছেন, এমনকি যখন আপনাকে এই পত্রখানি লিখিতেছি,স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি অদৃশ্য কাহারও নিঃশ্বাস আমার গ্রীবাদেশে পড়িতেছে, যেন পশ্চাৎ হইতে আমি কী লিখিতেছি তিনি দেখিতেছেন। রাত্রিকালে অকস্মাৎ আমার শয্যার প্বার্শে রাখা পিয়ানোটি ইদানিং বাজিয়া উঠিতেছে, কেহ যেন নির্ভুল সুরে বাজাইতেছেন। গতকাল আমার লেখার কাগজের উপর স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, ‘এইস্থলে বড় কষ্ট হইতেছে। আমি ফিরিয়া যাইতে চাহি। কেন ডাকিলে আমাকে ?’। এমতাবস্থায় কী করিব কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, প্রেততত্ত্ব বিশেষজ্ঞা মাদাম ব্লাভটস্কিকে সকল কথা জানাইয়াছি, তাঁহার নিকটও ইহার কোনওরূপ সদুত্তর নাই। আমার সহিত বসবাসকারী ‘স্পিরিট’ কি সত্যই আমার পিতা ? আপনাকে ভরসা করিয়া লিখিলাম, সুপরামর্শ আশা করিতেছি।
ইতি,
আপনার বিশ্বস্ত
কর্ণেল এইচ.এস.ওলকট।
নিউইয়র্ক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
২৫ জুলাই। ১৮৬২।”
২
৩ নং চার্চ লেনে ডি.রুনির বাড়ির সামনে নিজের ল্যান্ডো গাড়ি থেকে ধীর পায়ে নামলেন বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র। বাড়িটি দোতলা, কলিকাতার এই অঞ্চলটি সাহেবপাড়া হওয়ায় নেটিভদের ভিড় একেবারেই নাই, নির্জন প্রশস্ত পথ, অন্ধকারের আস্তরণ ভেঙে সদ্যজাত পক্ষী শাবকের মতো দিনের আলো প্রস্ফুটিত হয়েছে। দক্ষিণে কুয়াশার সূক্ষ্ম বস্ত্রে নিজেকে আবৃত করে রেখেছে চরাচর, যেন অস্পষ্ট রহস্যময় কোনও জগত,কেউ কেউ এই রূপজগতকে মায়াও বলে থাকেন। পথের দুপাশে সারি সারি গাছপালা, দু একজন বিদেশি তেজি আরবি ঘোড়ায় চড়ে ময়দানের দিকে চলেছেন, অল্পক্ষণ পূর্বে কেল্লার তোপধ্বনি শোনা গেছে। পূর্ব আকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, যদিও দিনমণি এখনও স্বমহিমায় উদিত হন নাই। হুগলী নদীর দিক থেকে ভেসে আসছে বরফ শীতল বাতাস, যেন কোনও যুবতির প্রেমহীন রুক্ষ মুখছায়া। বাড়িটির সামনে ছোট বাগান, লোহার গেট পার হয়ে শীর্ণ পথ চলে গেছে ভিতরে, দুপাশে মরসুমি ফুল গাছ লাগানো, দোতলায় একটি রেলিং ঘেরা বারান্দা চোখে পড়ে, দেখেই বোঝা যায় এটি অবস্থাপন্ন মানুষের গৃহ কিন্তু সর্বাঙ্গ কেমন যেন মলিন! এ মলিনতা ঠিক অর্থাভাবের কারণে নয়, এখানে যেন আনন্দ কুসুম ফোটে নাই। গাড়ি থেকে নেমে প্যারীচাঁদ চারপাশ ভালো করে দেখলেন, বাগানের ভেতর জোড়া শিমূল আর প্রায় পত্রশূন্য একখানি বেল গাছ রয়েছে, বেলগাছের শুকনো ডালাপালা কোনও অস্থিচর্মসার মানুষের আঙুলের মতো বারান্দার উপর এসে পড়েছে। যেন আঙুল তুলে সে কাউকে ক্রমাগত ডেকে চলেছে!
গেটে পাগড়ি আর খেটো ধুতি পরা দারোয়ান রয়েছে, প্যারীচাঁদ নিজের পরিচয় দিতেই সেলাম জানিয়ে সসম্ভ্রমে ছুটে গেল বাড়ির দিকে। অল্পক্ষণ পর একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, গৌরবর্ণ দীর্ঘ দেহ, একমাথা সোনালী চুল, মুখমণ্ডল পরিস্কার করে কামানো, পরনে একখানি বুশ শার্ট আর খাঁকি হাফপ্যান্ট। সুপুরুষ মানুষটির মুখখানি ভারী ক্লান্ত দেখাচ্ছে, চোখের তলায় অনিদ্রার গাঢ় কালি, ম্লান হেসে প্যারীচাঁদ মিত্রকে তিনি বললেন,
-সুপ্রভাত। আপনার নাম আমি শুনিয়াছি, আপনি যে আমার গৃহে
তাঁর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই নমস্কার জানিয়ে প্যারীচাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন,
-আপনিই মি. ডি. রুন ?
-হাঁ, আমিই ডোনাল্ড রুন।
-আপনিই গতকাল সম্বাদ ভাস্করে বিজ্ঞাপন দিয়াছিলেন ?
প্যারীচাঁদের প্রশ্ন শুনে মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন ডোনাল্ড, ক্লান্ত গলায় বললেন,
-কী যে হইতেছে!
-আপত্তি না থাকিলে আমি একবার আপনার স্ত্রীকে দেখিতে চাহি।
-আপত্তি ? আপনি আসিয়াছেন ইহাই যথেষ্ট। অনুগ্রহ করিয়া আমার সহিত আসুন।
শীর্ণ পথখানি বেয়ে আসার সময় বাড়ির পিছনে অনেকটা পতিত জমি প্যারীচাঁদের চোখে পড়ল। বাড়ির নিচু প্রাচীরের ওপারে ঘন ঘাসে ঢাকা জমি, অদূরে একটি প্রাচীন বটগাছের নিচে মাটির ঢিপি, এখান থেকেই পরিস্কার দেখতে পেলেন প্যারীচাঁদ। ঢিপির চারপাশে বুনো ফুলের ঝোপ, কুচি কুচি হলদে রঙের ফুল জায়গাটি আলো করে রেখেছে। একটু অবাকই হলেন প্যারীচাঁদ, এমন ঢিপি তো সাধারণত মুসলিমদের কবরের উপর করা হয়, সেদিকে ইশারা করে ডোনাল্ডকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-উহা কি কোনও সমাধি ভূমি ?
-তাহা স্পষ্ট করিয়া কহিতে পারি না, তবে
-কী ?
-গত সপ্তাহে কয়েকজন ব্যক্তিকে ওই স্থানে আসিতে দেখিয়াছিলাম।
-গত সপ্তাহে ? আপনার স্ত্রী কতদিন যাবৎ এইরূপ অবস্থায় রহিয়াছেন ?
দু এক মুহূর্ত চুপ করে কী যেন চিন্তা করলেন ডোনাল্ড, তারপর বললেন,
-তা প্রায় সাত দিন হইবে। আজ শনিবার, গত শনিবার সন্ধ্যা হইতে, হ্যাঁ, গত শনিবার হইতেই এইরূপ
-যে কয়েকজন ব্যক্তিকে আসিতে দেখিয়াছিলেন, তাহা কি শনিবারের পূর্বে ?
পুনরায় কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে ডোনাল্ড বললেন,
-মনে হইতেছে শনিবার দ্বিপ্রহরেই উহাদের দেখিয়াছিলাম।
একতলার বৈঠকখানাটি যথেষ্ট বড়, সুদৃশ্য গদি আঁটা চেয়ার ও টেবিল দিয়ে সাজানো, ফায়ারপ্লেসের পাশে একখানি বড় পিয়ানো চোখে পড়ে, মেঝের উপর মির্জাপুরী কার্পেট পাতা রয়েছে। কড়ি বরগার ছাদ থেকে বিশাল আকৃতির একটি অসলারের ঝাড়বাড়ি ঝুলছে, দেওয়ালে পশ্চিম দেশের কতগুলি বাঁধানো তৈলচিত্র টাঙানো, ঘরে প্রবেশ করলেই গৃহকর্তার অভিজাত রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। বৈঠকখানা পার হয়ে উপরে ওঠার প্রশস্ত সিঁড়ি, ডোনাল্ড সিঁড়ির দিকে হাত দেখিয়ে প্যারীচাঁদকে বললেন,
-উপরে যাইতে হইবে, ডরোথি দ্বিতলের একটি কক্ষে রহিয়াছে।
সিঁড়িটি অন্ধাকারাচ্ছন্ন, এদেশীয় একজন রমণী সেজবাতি হাতে সামনে চলেছে, পিছনে ডোনাল্ড ও প্যারীচাঁদ ধীর পায়ে উপরে উঠছেন। ডোনাল্ড উঠতে উঠতে ম্লান গলায় বলছেন,
-ডরোথি একজন চিত্রকর, তিনমাস পূর্বে সে ভারতবর্ষে আসিয়াছে। এইদেশে আসিবার পর হইতেই তাহার মন অস্থির হইয়া রহিয়াছে। ইংলণ্ডে যে প্রাণচঞ্চল, উচ্ছল তরুণীকে দেখিয়াছি, এখানে আসিয়া সহসা কী যে হইল! ঈশ্বরই তাহা জানেন।
-এখানে আসিবার পর হইতেই কি তাঁহার মন অস্থির হইয়া রহিয়াছে ?
-খাইতে পারিত না, রাত্রে নিদ্রা হইত না, সর্বদা কী যেন ভাবিতেছে। সারা দেহে লাল লাল একপ্রকারের দাগ, কোনও বিষাক্ত কীটের দংশনের ন্যায়, বলিত জ্বালা করিতেছে।
ডোনাল্ডের প্রতিটি কথা খুব মন দিয়ে শুনছেন প্যারীচাঁদ, এই কথাটি শুনে একটু চমকে উঠলেন, দু এক মুহূর্ত পর জিজ্ঞাসা করলেন,
-চিকিৎসকের পরামর্শ লইয়াছিলেন ?
-হাঁ, চিকিৎসক বলিয়াছিলেন অধিক উষ্ণতার কারণে ত্বকের অসুখ হইয়াছে। ঔষধও দিয়াছিলেন।
-সে ঔষধ খাইয়া কমিয়াছিল ?
-সম্পূর্ণ না কমিলেও অনেকাংশে উপশম হইয়াছিল।
দোতলায় চার-পাঁচটি ঘর রয়েছে, বামদিকের একটি ঘরের দরজা বন্ধ, এই জায়গাটিও অন্ধকার, সমস্ত জানলাগুলি বন্ধ থাকায় দিনের আলো প্রবেশ করতে পারে নি। ঘরটি দেখিয়ে ডোনাল্ড বললেন,
-এইটিই ডরোথির কক্ষ।
একটু ইতস্তত করে প্যারীচাঁদ বললেন,
-মি. ডোনাল্ড, একটি ব্যক্তিগত কথা কি আমি জিজ্ঞাসা করিতে পারি ?
ডরোথির ঘরে প্রবেশের আগে প্যারীচাঁদের কথা শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাঁর মুখের দিকে তাকালেন ডোনাল্ড। পরিচারিকার হাত থেকে সেজবাতিটি নিয়ে তাকে নিচে যাওয়ার কথা বলে শান্ত স্বরে বললেন,
-বলুন।
-আপনার সহিত ডরোথির সম্পর্ক কীরূপ ?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ডোনাল্ড ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
-আপনি কি আমাদিগের দাম্পত্য সম্পর্কের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন ?
-হাঁ!
-ওয়েল, সি বাবু, ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, এই দেশে আসিবার পর হইতেই আমাদিগের সম্পর্ক শীতল হইয়াছে।
দু এক মুহূর্ত পর পুনরায় বললেন,
-গত এক মাস হইল ডরোথি পৃথক কক্ষে তার নিজের শয়নের ব্যবস্থা করিয়াছে। শুধু তাহাই নহে
ডোনাল্ডের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই সহসা ঘরের ভিতর থেকে তীক্ষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, খিলখিল হাসির শব্দ, যেন কোনও চঞ্চলা বালিকা পুতুল খেলা ভেঙে কৌতুকের সুরে হাসছে! প্রায়ান্ধকার গৃহে সেই হাসি অপার্থিব কোনও জগতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
ঘরে প্রবেশ করতেই প্যারীচাঁদের সারা শরীরে এক মুহূর্তের জন্য কদম কাঁটা ফুটে উঠল। সমস্ত ঘরটি কোনও ধূপের সুবাসে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, পশিমমুখো ঘরটি বেশ বড়, তিনটি জানলা রয়েছে কিন্তু সবকটিই বন্ধ। প্যারীচাঁদ মনে মনে হিসাব করে বুঝতে পারলেন জানলাগুলির ওপারেই রয়েছে সেই পতিত জমি। বড় শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর একটি সেজবাতি জ্বলছে, ডোনাল্ডও তাঁর হাতের বাতিখানি রাখলেন টেবিলে, অস্পষ্ট কুয়াশার মতো আলোয় ভরে আছে সমগ্র ঘরটি, পালঙ্ক থেকে একটু দূরে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন এক তরুণী। আলুলায়িত সোনালি কেশরাজি মুখের উপর এসে পড়েছে, পরনে শুধু একখানি মিহি রেশমের গাউন, কাঁধের কাছ থেকে হাত দুটি অনাবৃত, গাউন বুকের উপর থেকে কিছুটা নিচে নেমে এসেছে, শ্বেত পারাবতের মতো স্তন যুগলের শিখরদেশ অল্প দেখা যাচ্ছে, সেদিকে একপলক তাকিয়েই প্যারীচাঁদ চোখ ফিরিয়ে নিলেন। ঠোঁট দুটি মৃত মানুষের মতো রক্তশূন্য, হিম শীতল স্বরে প্যারীচাঁদের দিকে তাকিয়ে ডরোথি ভদ্র ভাষায় বললেন,
-তসরিফ লাইয়ে!
বাইরের লোকের সামনে স্ত্রীর পোশাক ও রূপ দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড। প্যারীচাঁদ একবার ডরোথির দিকে তাকিয়ে জানলাগুলি খুলে দেওয়ার জন্য এগোতেই একটি বিশ্রী ফাটা কাঁসির মতো গলায় ডরোথি চিৎকার করে উঠলেন,
-গুরজকী বাচ্চা, খিড়কি না খুল!
অশ্রাব্য গালি শুনে দু পা পিছিয়ে ডরোথির দিকে একবার কঠিন চোখে তাকালেন প্যারীচাঁদ। কিন্তু অতি স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
-মুঝে সব কুছ বাঁতাও!
সে-কথা শুনে একজন অবোধ বালিকার গলায় হেসে উঠলেন ডরোথি। এক মুহূর্তের জন্য প্যারীচাঁদের হঠাৎ যেন তাঁর পৌত্রীর মুখটি দেখতে পেলেন, মনে হল ডরোথির পাশেই সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্ত্রীর আচরণ দেখে পাশ থেকে ডোনাল্ড নিচু স্বরে বললেন,
-বাবু, আমাকে মার্জনা
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ডান হাত তুলে তাঁকে চুপ করার জন্য ইশারা করে প্যারীচাঁদ ডরোথিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-তোমহারা নাম কেয়্যা হে ?
প্রশ্নের উত্তরে ধীর স্বরে ডরোথি প্যারীচাঁদকে উল্টে প্রশ্ন করলেন,
-তুম জানতে নেহি ?
-মে আপকে মু সে শুননা চাহাতা হু।
সামান্য হেসে তাচ্ছিল্যের গলায় ডরোথি বললেন,
-কিঁউকি আপ নেহি জানতে!
কোনও কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে ডরোথির দিকে চেয়ে রইলেন প্যারীচাঁদ। সেজবাতির আলো অতীত কালস্রোতের মতো দুলছে তরুণীর মুখে, সোনালি কেশরাজি অন্তরমহলের চিকের পর্দার মতো আড়াল করে রেখেছে চোখদুটি, ধূপের সুবাস আরও তীব্র হয়ে উঠেছে এখন, অদূরে কোথাও একটি চিল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে পরপর তিনবার ডেকে উঠল। হঠাৎ দুহাতে চুলগুলি নিয়ে এলোখোঁপা করলেন ডরোথি, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীল দুটি নয়ন, মণির চারপাশে সাদা অংশটি দিনান্তের পশ্চিমাকাশ হয়ে উঠেছে, তিনিও অপলক তাকিয়ে রয়েছেন প্যারীচাঁদের দিকে। বয়ে যায় সময়, কেউই কারোর চোখ সরাচ্ছেন না, কয়েক মুহূর্ত পর প্যারীচাঁদ স্নেহার্দ্র স্বরে বাইবেলের একটি লাইন স্মরণ করে বলে উঠলেন,
-কাস্টিং অল ইয়োর অ্যাংসাইটিস অন হিম, বিকজ হি কেয়ারস ফর ইউ!
ডরোথির কাছ থেকে আবেগশূন্য উত্তর ভেসে এলো
-ইয়ে সচ নেহি হ্যায়!
দু এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন প্যারীচাঁদ, এমন বিচিত্র পরিস্থিতির কথা তিনি কখনও শোনেননি, থিওসফিক্যাল জার্নালেও পড়েননি। কোরাণ শরীফের দু-একটি আয়াত তাঁর মুখস্থ ছিল, হঠাৎ কী যেন ভেবে ধীর স্বরে একটি আয়াত বললেন,
-কো-তেবা আলায়-কুমোল-কেতা লো-অহুঅ কোরহোল্লা-কম
প্রগলভা যুবতির মতো কণ্ঠে ডোরথি বেজে উঠলেন,
-কিতনা বুঢ়া তলফফাজ হে!
-ফির আপ ক্যাহতে হে!
এবার একটু গম্ভীর স্বরে পরিস্কার বাংলায় ডোরথি বলে উঠলেন,
-আর কতা কইতে ইচ্চে কচ্চে না! বুড়ো মিনসে তুই এবার আয়!
সামান্য হেসে প্যারীচাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন,
-আমি চলিয়া যাইলে কি আপনার সুবিধা হইবে ?
-মিনসে তোর বামাকালীর কাচে যা!
-বামাকালীর সহিতও আপনার পরিচয় হইয়াছে ?
চৈত্র বাতাসের মতো গলায় খিলখিল করে হেসে উঠে ডোরথি বললেন,
-আই অলসো নো কর্ণেল ওলকট! আই নো হিম!
কর্ণেল ওলকটের নাম শুনে চমকে উঠলেন প্যারীচাঁদ। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে পড়ল গতকালের পত্রের কথা, তার মাঝেই শুনতে পেলেন ডোরথির কণ্ঠস্বর,
-কাল চিটি পেয়েচিস না ? সে মিনসে মরেচে!
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তেজিত গলায় প্যারীচাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন,
-কী ?
-কেন তোর বামাকালী বলেনি তোকে ? দুপুরে সে মাগীকে সোহাগ করে অত ভাত গেলাস, বলেনি তোকে ?!
কথাক’টি শেষ করেই পালঙ্কের উপর এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন ডরোথি। সেই মুহূর্তেই হঠাৎ সেজবাতি দুটি একইসঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল, যেন বন্ধ জানলা ভেদ করে রুক্ষ শীতবাতাস ছুটে এসে তাদের নিভিয়ে দিল! সমস্ত ঘরটি গাঢ় অন্ধকারের সমুদ্র হয়ে উঠল নিমেষে, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা নক্ষত্রের আলোর মতো শোনা গেল ডোরথির গলা,
-ঘুম পাইতেছে...ঘুম...ঘুম...তোমরা চলিয়া যাও! চলিয়া যাও!
৩
পরদিন সকালে নিজ গৃহের বৈঠকখানায় বসে রয়েছেন বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। সারারাত্রি দু চোখের পাতা এক করতে পারেন নাই, আজ কলিকাতাও মেঘাচ্ছন্ন, ভোরবেলা থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, উত্তুরে বাতাস সহসা দিকবদল করে এখন পূর্বগামিনী। অন্যদিন এইসময় বড় বাড়ির মেয়ে-বউরা পালকি করে গঙ্গাস্নানে যায়, একটি দুটি করে কেরাঞ্চি গাড়ির যাতায়াত শুরু হয় পথে, বিলাসী বাবুর দল সারারাত্রি বারাঙ্গনার গৃহে কাটিয়ে অবসন্ন শরীরে ল্যান্ডো কি ব্রুহাম হাঁকিয়ে বাড়ির পথ ধরেন, আজ সব শুনশান। যুবতির কাজলের মতো কালিবর্ণ ধারণ করেছে আকাশ, অদ্ভুত তন্দ্রাচ্ছন্ন আলোয় আবৃত চরাচর, এমন দিকে আড়কাঠি ফড়ে কি দালালরাও ঘরের বাইরে পা রাখে না, কাদের বাড়ির ঘড়িতে ঢং ঢং করে সকাল সাতটার ঘন্টা পড়ল। গঙ্গায় বোধহয় জোয়ার আসার সময় হল, পথঘাট জলকাদায় থৈ থৈ করছে, মাঝে মাঝেই ঝোড়ো বাতাস বইছে, মনে হয় বেলার দিকে ঝড়-বৃষ্টির বেগ আরও বাড়বে। প্যারীচাঁদ কাল থেকে ডরোথির কথাই শুধু চিন্তা করছেন, এমন বিচিত্র ঘটনার কথা কখনও শোনেননি তিনি। বিখ্যাত স্পিরিচুয়ালিস্ট ডক্টর ফ্ল্যামারিয়ানের একটি লেখায় পড়েছিলেন, যদি কোনও গৃহে অতৃপ্ত ভোগবাসনা নিয়ে কেউ মারা যান তাহলে সাধারণত সে বাড়ির কোনও যুবতি মেয়েকে নানাভাবে উৎপীড়ন করে, কিন্তু এখানে ডরোথিকে দেখে তো অত্যাচারিত বলে একেবারেই মনে হল না! চেহারাও যথেষ্ট স্বাভাবিক, তাহলে কি সে নিজেই বিষয়টি উপভোগ করছে ? ডোনাল্ড বললেন আঠাশ বছর বয়স, যৌন জীবন স্বাভাবিক নয়, হয়তো অন্য কোনও অবসাদও রয়েছে, তাহলে কি ডিরেল্ডমেন্ট অব ব্রেন ? বা হিস্টিরিয়া ? পরক্ষণেই প্যারীচাঁদের মনে পড়ল, তা অসম্ভব, কারণ দুটি ভিন্ন ভাষায় সে কাল কথা বলেছে, ওরকম উর্দু উচ্চারণ বহু বছরের অভ্যাস ভিন্ন আয়ত্ত করা মুশকিল। কলিকাতার দেশীয় বাঙলা ভাষাই বা জানবে কী করে! তার উপর বামাকালীর নাম, ওলকট এবং সর্বোপরি প্যারীচাঁদের নিজের প্রেতচর্চার কথাও সে জানে! আশ্চর্য! এই ঘটনাটি একজনের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে, পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ ভেবেছিলেন বিকেলে পূর্ণচন্দ্রের বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে একবার যাবেন কিন্তু আজ প্রকৃতিদেবী স্বয়ং বাধ সাধলেন!
হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বরে প্যারীচাঁদের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল, তাকিয়ে দেখেন সামনে দারোয়ান লক্ষ্মীপ্রসাদ দাঁড়িয়ে আছে, একটু বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন,
-কী, কিচু বলবি ?
সেলাম করে একখানি মুখবন্ধ লেফাফা প্যারীচাঁদের দিকে এগিয়ে দিল লক্ষ্মীপ্রসাদ। এত সকালে আবার কার পত্র এল!
-চিঠি ? কে দিল ?
-আজ্ঞা, এক সায়েবের বানিয়ান দিয়ে গেল!
-সায়েব ?
-জী হুজুর!
-কোনও নাম কিচু বল্ল ?
-না হুজুর!
-বেশ, তুই যা একন!
তাড়াতাড়ি লেফাফার মুখটি কেটে দেখলেন ডোনাল্ড রুন পত্র পাঠিয়েছেন। অতি সংক্ষিপ্ত চিঠি, একটি মাত্র লাইন শুধু লেখা রয়েছে,
“গতকাল মধ্যরাত্রে ডরোথি দক্ষিণ হস্তের ধমনী কাটিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে।
ইতি,
আপনার বিশ্বস্ত
ডি.রুন.
১২ নভেম্বর,১৮৬২। কলিকাতা। ”
৪
সাতদিন পর আঠারোশো বাষট্টি খ্রীষ্টাব্দের উনিশে নভেম্বর সম্বাদ ভাস্করের তৃতীয় পাতায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, সংবাদদাতা লেখেন,
“সংবাদ। ১৯ নভেম্বর.১৮৬২। ১০৫ সংখ্যা
অকাল মৃত্যু
গতকাল প্রভাতে সরকারি আয়কর বিভাগে কর্মরত শ্রীযুক্ত ডোনাল্ড রুন সাহেবের মৃত্যু হইয়াছে। প্রত্যক্ষদর্শী এক সৈনিক জানাইয়াছে ময়দানের নিকট প্রাতঃভ্রমণ কালে কর্নেল হ্যামপটনের কোচ গাড়িতে ধাক্কা লাগিয়াছিল, পরে চিকিৎসকের নিকট লইয়া যাইলে তাঁহাকে মৃত বলিয়া ঘোষণা করা হয়। কর্নেল হ্যামপটন ঘটনার কথা স্বীকার করিয়া কহিয়াছেন, উক্ত ব্যক্তিকে দূর হইতে দেখিয়া বহুবার চিৎকার করিবার পরেও পথিমধ্যে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন, শেষ মুহূর্তে অশ্বকে সামলাইতে না পারিবার কারণে দুর্ঘটনার হাত হইতে তাঁহাকে রক্ষা করা সম্ভব হয় নাই। আয়কর বিভাগের রুন সাহেবের এক সহকর্মি জানাইয়াছেন, মাত্র কয়েকদিন পূর্বে পত্নী বিয়োগের পর হইতেই তিনি মানসিক অবসাদে ভুগিতেছিলেন। কেহ কেহ ইহাকে আত্মহত্যা বলিয়া অনুমান করিতেছেন। ”
এই ঘটনার প্রায় আঠারো বছর পর আঠারোশো আশি সালের নভেম্বর মাসে বাবু প্যারীচাঁদ মিত্রের একান্ত চেষ্টায় কলিকাতায় ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অব স্পিরিচুয়্যালিস্ট’ নামে একটি সমিতি গঠিত হয়। তার সভাপতি ছিলেন জে.জি.মিউগেন্স আর সহকারী সভাপতিরূপে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তবে অনেক চিন্তা ভাবনা করেও শেষ পর্যন্ত ডরোথির বিষয়ে তিনি কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নাই। শুধু পরে বুঝতে পেরেছিলেন সেদিন একটি কথা তাঁকে ডরোথি মিথ্যা বলেছিল, সেটি হল কর্নেল ওলকট সাহেবের মৃত্যু সংবাদ! কারণ কিছুদিন পরেই নিউইয়র্ক থেকে তাঁর পত্র পান প্যারীচাঁদ আর সভা প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর অর্থাৎ আঠারোশো বিরাশি সালের মার্চ মাসে কলিকাতায় আসেন স্বয়ং ওলকট সাহেব, ডরোথির ঘটনাটি প্যারীচাঁদের মুখ থেকে শুনে তিনিও বিস্ময় প্রকাশ করেন।
আশ্চর্যের বিষয় প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রতিষ্ঠিত ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অব স্পিরিচুয়্যালিস্ট’ সমিতির কার্যালয়ের ঠিকানা ছিল ৩ নং চার্চ লেন! ঠিক কী কারণে ওই বাড়িটিকেই তিনি সমিতির কার্যালয় হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন সে-কথা কারোর কাছে কখনও প্রকাশ করেননি।
---০---
ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন