গো ভক্ষণ কি হিন্দু ধর্ম বিরোধী? গো হত্যায় কি ক্রুদ্ধ হন দেবতারা?
সম্প্রতিককালে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গোহত্যার অজুহাতে মব লিঞ্চিং বা কেন্দ্র সরকার কর্তৃক গোহত্যা নিষিদ্ধকরণের বিষয়টি পুনরায় রাজনীতির চর্চার বিষয় হয়ে উঠছে৷ কিন্তু সত্যিই কি গো হত্যা হিন্দুধর্ম বিরোধী? সত্যিই কি গো হত্যায় ক্রুদ্ধ হন দেবতারা? নাকি এসবই জল-জমি-জঙ্গল কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়া, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব বৃদ্ধির মতো জাগতিক বিষয়গুলি থেকে মানুষের নজর ফেরাতে এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক চাল মাত্র? আসুন দেখে নিই একটু খোলা মনে।
প্রথমেই সোজাসাপটা বলে নেওয়া যাক, গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ আদৌ হিন্দুধর্ম বিরোধী তো নয়ই, বরং তা সম্পূর্ণ 'হিন্দুধর্মসম্মত'। হিন্দু ধর্মেই ঢালাও বিধান আছে গো হত্যার ও গো মাংস ভক্ষনের। বলাবাহুল্য হিন্দুদের নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই৷ হিন্দুধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থ হিসাবে যেগুলিকে মোটামুটি ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সেগুলি (যথা বেদ উপনিষদ ইত্যাদি) প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের উদ্ভবের বহুপূর্বে রচিত। এগুলো সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বসবাসকারী যাযাবর পশুপালক আর্যদের রচনা। এই আর্যদের ধর্ম ও পরবর্তীকালে উদ্ভব হওয়া হিন্দুধর্ম বহুলাংশে পৃথক৷ অর্থাৎ বেদ, উপনিষদ বা অনান্য গ্রন্থগুলি সঠিক অর্থে হিন্দুধর্মগ্রন্থ হবার দাবীদার নয়৷ তবুও হিন্দুরা যেহেতু এগুলির বিধানকেই নতমস্তকে মেনে চলেন, এগুলির প্রতিই শ্রদ্ধায় গদগদ হন, তাই এগুলিকেই হিন্দুধর্মগ্রন্থ হিসাবে ধরে নিয়ে এগুলিতে গো হত্যাকে কোন চোখে দেখা হয়েছে আসুন দেখে নেওয়া যাক।
ক) প্রাচীন যুগে ব্রাহ্মণরা ছিলেন গো মাংসের অনুরক্ত৷ ঋগ্বেদ সংহিতায় অগ্নির কাছে প্রার্থনায় বারবার "গাভীদের খন্ড খন্ড করে ছেদন' করার কথা বলা হয়েছে।
খ) ঋগ্বেদে ইন্দ্রের প্রতি প্রার্থনায় বলা হয়েছে 'তুমি আমার জন্য পনেরো কুড়িখানা ষাঁড় রান্না করে দাও। আমি তা খেয়ে পেট ভরাই। আমার শরীর স্থূল করি' (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০-৭-৬, ১০-৮৪-১৪)।
গ) অগ্নির কাছে প্রার্থনায় যে সব প্রানীর বলিদানের উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বলদ, ষাঁড় ও দুগ্ধহীনা গাভী (ঋগ্বেদ সংহিতা ১/১৬২/১১-১৩, ৬/১৭/১১, ১০/৯১/১৪)।
ঘ) কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে আগত অতিথিদের গোমাংস প্রদান করে আপ্যায়নের কথা বলা হয়েছে (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০/৮৫/১৩)।
ঙ) বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে "কোনো ব্যক্তি যদি এমন পুত্রলাভে ইচ্ছুক হন যে পুত্র হবে প্রসিদ্ধ পন্ডিত, সভাসমিতিতে আদৃত, যার বক্তব্য শ্রুতিসুখকর, যে সর্ববেদে পারদর্শী এবং দীর্ঘায়ু, তবে তিনি যেন বাছুর অথবা বড় বৃষের মাংসের সাথে ঘি দিয়ে ভাত রান্না করে নিজের স্ত্রীর সাথে আহার করেন" (বৃহদারণ্য উপনিষদ ৬/৪/১৮)।
চ) বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত গৃহ্যসূত্রগুলিতেও গরু বলি এবং গোমাংস ভক্ষনের অনুমোদন দেওয়া আছে সুস্পষ্টভাবে। যেকোনো অনুষ্ঠানে গোমাংস পরিবেশনের কথা বলা হয়েছে দ্ব্যার্থহীনভাবে (পারস্কর গৃহ্যসূত্র ১/৩/২৬-৩১, শাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্র ২/১৫, গোভিল গৃহ্যসূত্র ৪/১০/১৮-২৬, হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ১/৪/১৩-১৯, আপস্তম্ভ গৃহ্যসূত্র ৫/১৩/১৫-১৬, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/২৪/৩০-৩১)।
অতিথিকে গোমাংস প্রদান করা এইসময় এমনই 'বাধ্যতামূলক' হয়ে উঠেছিলো যে বাড়িতে অতিথি আসলে গরুগুলিকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসা হত যাতে অতিথিরা মনে করে বাড়িতে কোনো গরু নেই (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/২৪/২৫)।
ছ) দেবতার উদেশ্যে গো বলি দিলে এবং সেই মাংস ভক্ষন করলে বিত্ত, জমি, পবিত্রতা, পুত্র, গবাদি পশু, দীর্ঘ আয়ু ও ঐশ্বর্য লাভ হবে বলে বলা হয়েছে শাস্ত্রে (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ৪/৮, পরস্কর গৃহ্যসূত্র ৫/১৩/১৫-২০ এবং হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ২/৫/১৩-২০)।
জ) গরু বলি দিয়ে সেই মাংস ঘি এবং ভাতের সাথে মিশিয়ে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার বিধান রয়েছে হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্রে (২/৫/১-১৩)।
ঝ) বশিষ্ঠস্মৃতিতে বলা হয়েছে ব্রাহ্মন, রাজা বা বিশিষ্ট অতিথিকে গোমাংস দিয়ে আপ্যায়ন করার কথা (বশিষ্টস্মৃতি ৪/৮)।
ঞ) মনুস্মৃতিতে সরাসরি গোমাংস খাওয়ার বিধান নেই। কিন্তু মনু বলেছেন যেসব প্রানী 'এক ক্ষুর বিশিষ্ট' তাদের মাংস খাওয়া বিশেষ কারণ ছাড়া বারণ। এর মধ্যে স্বভাবতই গরু পড়ে না। আবার যেসব প্রাণী 'এক পাটি দাঁত বিশিষ্ট', তাদের মাংস খাওয়ার অনুমতি রয়েছে মনুস্মৃতিতে৷ এর মধ্যে গরু পড়ছে।
ত) রামায়ণে বলা হয়েছে বনবাসকালে রাম সীতা লক্ষ্মন ভরদ্বাজমুনির আশ্রমে গেলে ভরদ্বাজমুনি তাদের গোমাংস দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন (বাল্মীকি রামায়ণ ২/৫৪)।
থ) মহাভারতেও উল্লেখ রয়েছে গোমাংস ভক্ষনের৷ অনেক উদাহরণের থেকে একটা তুলে ধরি৷ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর প্রিয়জনের বিয়োগে শোকে কাতর যুধিষ্ঠিরকে স্বান্তনা দিতে গিয়ে কৃষ্ণ নানা কথাপ্রসঙ্গে 'মহাত্মা' রন্তিদেবের মাহাত্ম্যের কথা বলেন। কৃষ্ণ বলেন যে রাতে তার (রন্তিদেবের) গৃহে অতিথি সমাগম হতো সে রাত্রে কুড়ি হাজার একশোটি গরু কেটে তার মাংস অতিথিদের পরিবেশন করা হতো। এবং কৃষ্ণ বললেন এই কারণে মহাত্মা রন্তিদেব যুধিষ্ঠিরের চেয়ে অনেক বেশী পূণ্যবান ছিলেন (বেদব্যাসী মহাভারত ১২/২৯)। আবার মহাভারতেই অন্যত্র বলা হয়েছে গো-মেধ যজ্ঞের কথা যাতে শয়ে শয়ে গো হত্যা করা হতো (বেদব্যাসী মহাভারত ১২/২৬৬)।
দ) বিষ্ণুপুরাণে ব্রাহ্মণদের গোমাংস পরিবেশনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাইয়ে হবিষ্যি করালে পিতৃপুরুষ এগারোমাস অবধি পরিতৃপ্ত থাকেন (বিষ্ণুপুরাণ ৩/১৬)।
ধ) চিকিৎসার জন্যেও গোমাংস ভক্ষণ প্রাচীন ভারতে চালু ছিলো। চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতায় পরিষ্কারভাবে গোমাংস ভক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গরুর মাংসের উপকারিতার কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে এই মাংস বাত, নাক ফোলা, জ্বর, শুকনো কাশি, অতিরিক্ত খিদে এবং কৃশতা রোগে বিশেষ উপকারী (চরক সংহিতা ১/২৭/৭৯। সুশ্রুত বলেছেন এই মাংস পবিত্র, ঠান্ডা এবং হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, সর্দিকাশি, অতি ক্ষুধা ও বায়ু বিভ্রাটের নিরাময় করে (সুশ্রুত সংহিতা ১/৪৬/৪৭)।
ন) হিন্দুত্ববাদীদের নয়ণের মণি বিবেকানন্দও স্বীকার করে গেছেন প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণদের গোমাংস ভক্ষণের কথা। বিবেকানন্দ বলেছেন "এই ভারতবর্ষেই এমন এক দিন ছিলো যখন ব্রাহ্মণ গরুর মাংস না খেলে ব্রাহ্মণই থাকতে পারতেন না। আমরা বেদে পড়ি যে যখন কোনো সন্ন্যাসী, রাজা কিংবা বড় মানুষ বাড়ীতে আসতেন, তখন সবচেয়ে ভালো ষাঁড়টিকে কাটা হতো।"
সুতরাং উপরের বিস্তৃত আলোচনা থেকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, গো হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ 'হিন্দুধর্ম বিরোধী' তো নয়ই, বরং তা অতিমাত্রায়ই 'হিন্দুধর্মসম্মত'। হিন্দুশাস্ত্রের কোথাও নিষেধ নেই গো হত্যা বা গো মাংস ভক্ষনে।
প্রশ্ন উঠবে তাহলে কখন এবং কেন গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষন নিষিদ্ধ হলো।
এ বিষয়ে ঐতিহাসিকরা মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে নির্দেশ করেছেন৷ তাঁদের মতে এই সময় থেকেই সমাজে নিষিদ্ধ হতে থাকে গো হত্যা ও গোমাংস খাবার প্রথা৷ দুটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা এর পিছনে। প্রথম কারণ কৃষিকেন্দ্রিক। এইসময় থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক লোহার খনি আবিষ্কার হতে থাকায় লোহার দাম ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তা চলে আসে সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে। এতদিন যার ব্যবহার ছিলো শুধুমাত্র সৈন্যদের অস্ত্রের ক্ষেত্রে, এবার তার ব্যবহার শুরু হয় দৈনন্দিন জীবনেও৷ কৃষিক্ষেত্রেও এক ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এর। ইতিপূর্বে যে সব রুক্ষ পাথুরে জমি পাথর বা ব্রোঞ্জের লাঙলের ফলার সাহায্যে কর্ষণ করা অসম্ভব ছিলো, লোহার ফলাযুক্ত লাঙল সেইসব জমিকেও নিয়ে আসে কৃষিকার্যের আওতায়৷ পাশাপাশি লোহার কুঠারের সাহায্য ব্যাপকভাবে জঙ্গল পরিষ্কার করে বাড়ানো হতে থাকে চাষযোগ্য জমির আয়তন৷ ফলে এই সময় থেকে ব্যাপক প্রসার ঘটে কৃষিকার্যের। কৃষিকার্যের প্রসারের সাথে তাল মিলিয়ে চাষীদের অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি ঘটতে থাকে৷ কৃষিকার্যের প্রসার ঘটলে, অর্থাৎ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষকদের প্রদেয় খাজনার পরিমানও বৃদ্ধি পাবে সেই হিসাবকে মাথায় রেখে এই সময়ে রাজারাও সক্রিয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন কৃষিকার্যের প্রসারের। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়াটিতেই সমস্যা বা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো গোমাংস খাওয়ার বিধি ও ক্রমাগত গোহত্যা। ব্রাহ্মণদের তুষ্ট করতে ক্রমাগত গো হত্যা করতে থাকার ফলে গবাদিপশুর সংখ্যা হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছিলো মারাত্মকভাবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিলো কৃষিকার্যে। ফলে কৃষিকে বাঁচানোর জন্য গোরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় সমাজে। শুরু হয় গোহত্যার বিরোধিতা, যা কালক্রমে এক ধর্মীয় গোঁড়ামির রূপ ধারণ করে। দ্বিতীয় কারণ ছিলো ধর্মনৈতিক। ব্রাহ্মণ্যধর্মের নানা কুসংস্কার, ব্যায়বহুলতা, আচারসর্বস্বতা, শূদ্রশোষনের বিরুদ্ধে এইসময় সমাজে শুরু হয় এক গণজাগরণ, যার ফল বৌদ্ধ, জৈন বা আজীবিকদের মতো একের পর এক প্রতিবাদী ধর্মের উদ্ভব৷ ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের বিপরীত মেরুতে থাকা এইসমস্ত ধর্মের সবগুলিরই মূল কথা ছিলো 'অহিংসা'। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যাচার ও ব্যায়বহুলতা থেকে রক্ষা পেতে দলে দলে মানুষ আশ্রয় নিতে থাকে এইসমস্ত ধর্মগুলির ছত্রছায়ায়। আবার শোষিত জনগনের ক্ষোভের হাত থেকে, গণবিদ্রোহের সম্ভাবনার হাত থেকে রেহাই পেতে তাদের মধ্যে অহিংসার বাণী প্রচার করা যে এক মারাত্মক কার্যকরী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে তা টের পায় রাজশক্তিও। ফলে তারাও ঢালাও পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে এইসমস্ত প্রতিবাদী ধর্মগুলিকে৷ এইসমস্ত প্রতিবাদী ধর্মগুলির মূল কথাই যেহেতু ছিলো 'অহিংসা', তাই এর অনুগামীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই নিষিদ্ধ হয় খাদ্যের কারণে প্রাণী হত্যা। অনান্য প্রানীর সাথে বন্ধ হয় গো হত্যাও। অন্যদিকে তুমুল জনপ্রিয় হতে থাকা এই সমস্ত ধর্মগুলির চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মেরও প্রচলিত নিয়মকানুনের কিছু পরিবর্তন করতে হয়৷ একদিকে ক্রমাগত গো হত্যা হতে থাকার ফলে কৃষক অসন্তোষ, অন্যদিকে প্রতিবাদী ধর্মের বিপুল জনপ্রিয়তা, এই দুই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম স্বাভাবিকভাবেই তার পূর্বের পথ থেকে কিছুটা সরে আসে। বাধ্য হয় মানুষের দাবীর কাছে মাথা নোয়াতে। মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহনযোগ্য করে তোলার তাগিদে ব্রাহ্মণ্যধর্মেও সামাজিক বিধিনিষেধ আরোপিত হয় গোহত্যার উপর। আর এভাবেই একসময় তুমুল জনপ্রিয় গোমাংস 'নিষিদ্ধ' হয়ে ওঠে মানুষের মধ্যে। যা অন্ধভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে আজও।
গো হত্যা বন্ধের প্রতিক্রিয়া
এবার দেখা যাক হিন্দুত্ববাদীদের দাবী মেনে ভারতজুড়ে গো হত্যা বন্ধ হলে কী প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে তার সমাজে ও অর্থনীতিতে
সাধারণভাবে আমাদের মনে হতে পারে গো হত্যা বন্ধের সাথে অর্থনীতির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই৷ বরং এতে অনেক নিরীহ প্রাণী অকালে মারা যাবার হাত থেকে রেহাই পাবে। গো সংকট দেখা না দেওয়ায় গো নির্ভর ভারতীয় কৃষিও হয়ে উঠবে সম্পদশালী।
কিন্তু বাস্তব কী সত্যি তাই? ?
প্রথমত আসি খাদ্য হিসাবে গো মাংসের গুরুত্বে। গো মাংস সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও উচ্চমানের প্রোটিন সমৃদ্ধ। নানাপ্রকার মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে ভরপুর। রান্না করা ৭৫ গ্রাম গোমাংসে পাওয়া যায় প্রায় ২৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৭০ ক্যালোরি, ৬.৩ গ্রাম ফ্যাট, ২.৬ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং প্রায় ৫০ মিলিগ্রাম মতো সোডিয়াম৷ তাছাড়াও ১৪ রকম অতিপ্রয়োজনীয় পুষ্টিদ্রব্যে ভরপুর গোমাংস, যার মধ্যে আছে লোহা, জিংক, সেলেনিয়াম থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি এবং ফসফরাস। শরীর গঠনে ও মস্তিষ্কের বিকাশে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এইসমস্ত খাদ্যগুনগুলি৷
আপনি বলতে পারেন তার জন্য গোমাংস খাবার কী দরকার? চিকেন বা খাসী খেলেও তো হয়৷ গোমাংসই কেন?
হ্যাঁ হয়৷ চিকেন ও বীফের খাদ্যগুন প্রায় কাছাকাছিই৷ কিন্তু সেটা মূল ব্যাপার নয়৷ আসল হিসাব লুকিয়ে আছে অন্য জায়গায়৷
গো মাংস কারা খায়? উত্তর ভারতের কিছু রাজ্য বাদ দিয়ে ভারতের সর্বত্রই কিন্তু গোমাংস ভীষনভাবে প্রচলিত৷ বিশেষ করে দক্ষিণভারত ও উত্তর পূর্ব ভারতের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ নিয়মিতভাবে গোমাংস ভক্ষন করে থাকেন৷ এবং এক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিমের কোনো ব্যাপার নেই৷ হিন্দুদের মধ্যে প্রায় সত্তরটা সম্প্রদায়ের রোজকার খাদ্যতালিকায় আছে গোমাংস। গোমাংস খান কেরালা সহ বিভিন্ন দক্ষিনভারতীয় রাজ্য, মেঘালয় মিজোরামের উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষরাও। খান মুসলিমরাও। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ভারতের একটা বড় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সিংহভাগেরই গোমাংসে কোনো ছুঁৎমার্গ নেই।
গোমাংস এইসমস্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের কাছে প্রোটিনের এক বড় উৎস যার বিকল্প চিকেন বা খাসী হয়ে উঠতে পারে না কখনই৷ এর মূল কারণ বীফের সাথে এগুলির দামের পার্থক্য৷ গোমাংস চিকেন বা খাসীর মাংসের তুলনায় অনেকটাই সস্তা (ইন্টারনেটে বীফের দাম দেখে লাভ নেই৷ কারণ ইন্টারনেটে বীফের যে দাম দেওয়া আছে তা ভালো কোয়ালিটির গরুর প্রসেসড মাংসের দাম। এগুলো খান তুলনামূলকভাবে সম্পন্ন আয়ের মানুষেরা৷ সাধারণ মানুষরা খান লোকাল দোকানে বিক্রী হওয়া গোমাংস, যা বুড়ো, অশক্ত গরু থেকে পাওয়া যায়। গরু বুড়ো বা অশক্ত হয়ে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই গরীব চাষীর পক্ষে সম্ভব হয় না তাকে বসিয়ে খাওয়ানো। ফলে তাকে তুলে দেয় কসাইয়ের হাতে। সেই মাংসই লোকাল দোকানে বিক্রী করেন স্থানীয় গোমাংস বিক্রেতারা। এই মাংস দামে অনেক সস্তা চিকেন বা খাসীর মাংসের চেয়ে)। যার ফলে এইসমস্ত অঞ্চলের গরীব, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে প্রানীজ প্রোটিনের একমাত্র উৎস সস্তার গোমাংস। গোমাংস নিষিদ্ধ হলে টান পড়বে এই সমস্ত খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের পুষ্টির জোগানে৷ ভাঙতে থাকবে তাদের শরীর৷ দেখা দেবে নানাপ্রকার প্রোটিনহীনতাজনিত রোগ যথা কোয়াশিওরকর, ম্যারামাস, ফ্যাটি লিভার, নানা প্রকার লিভার ডিজিজ ইত্যাদি। চিকিৎসা খাতে বেরিয়ে যাবে রোজগারের একটা বড়ো অংশ। পাশাপাশি নানা রোগে ভুগতে থাকায় ঘন ঘন কাজে অনুপস্থিতির কারণে টান পড়বে রোজগারেও। সবদিক থেকেই এক সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে হতদরিদ্র পরিবারগুলি।
না। উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খেয়ে এই ঘাটতি পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব নয়৷ কারণ কোনো উদ্ভিজ্জ প্রোটিনই প্রানীজ প্রোটিনের মত সমস্ত প্রকার অ্যামাইনো অ্যাসিডে সমৃদ্ধ নয়৷ ফলে প্রানীজ প্রোটিনের বিকল্প উদ্ভিজ্জ প্রোটিন হতে পারে না কখনই৷ ডাল বা সোয়াবীন প্রচুর পরিমানে খেয়ে এই ঘাটতি কিছুটা হয়তো পূরণ করা সম্ভব৷ কিন্তু তাতে যে পরিমান ডাল বা সোয়াবীন গরীব মানুষগুলিকে খেতে হবে রোজ তাতে অচিরেই ঘটি বাটি বিক্রী করে পথে বসতে হবে তাদের।
গোমাংস নিষিদ্ধকরণ তাই প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র জনগনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সোজাসুজি এক যুদ্ধঘোষণা।
এ তো গেলো পুষ্টির দিকটা। এবার দেখা যাক অর্থনীতির উপর কী প্রভাব পড়বে এর।
বীফ ইন্ড্রাস্ট্রি ভারতের অন্যতম সংগঠিত ইন্ড্রাস্ট্রি। লক্ষ লক্ষ লোকের রুজি রোজগারের জায়গা এই ইন্ডাস্ট্রি। স্লটারিং হাউস থেকে শুরু করে চর্মশিল্প, রাসায়নিক শিল্প থেকে ফার্টিলাইজার শিল্প সহ বিভিন্ন শিল্প প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বীফ ইন্ডাস্ট্রির সাথে। গোমাংস ভারতজুড়ে নিষিদ্ধ হলে শুধু যে মানুষের পুষ্টির জোগানে টান পড়বে তা নয়, পাশাপাশি আকস্মিকভাবে কর্মহারা হবেন লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ সার্বিকভবে মন্দা দেখা দেবে সেইসমস্ত রাজ্যের অর্থনীতিতে, যেখানে গোমাংসের উপর নির্ভর করেন জনসংখ্যার একটা বড় অংশ।
উদাহরণ হিসাবে কেরালার কথাই ধরা যাক।
গোমাংস উৎপাদন ও ভক্ষনে কেরালা ভারতের শীর্ষস্থানীয় একটি রাজ্য। প্রায় আড়াই লক্ষ টন গোমাংস উৎপাদিত হয় কেরালায় প্রতি বছর। কেরালায় রেজিষ্টার্ড বীফ স্লটারিং হাউজ আছে প্রায় দশ হাজারের মত। রেজিস্ট্রেশনহীন স্লটার হাউজের সংখ্যা আরো অনেক বেশী৷ শুধুমাত্র রেজিষ্টার্ড স্লটার হাউজগুলির উপরেই নির্ভরশীল এক লক্ষ মানু্ষের কর্মসংস্থান৷ রেজিষ্টার্ড ও আনরেজিষ্টারড স্লটারিং হাউজ মিলিয়ে প্রায় দু লক্ষেরও বেশী লোকের কর্মসংস্থান হয় শুধুমাত্র কেরালায়।
শুধু কেরালাতেই যদি এত মানুষের জীবিকা স্লটারিং হাউজের সাথে যুক্ত হয়, সারা ভারতে তাহলে এই সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে একটু ভেবে দেখুন প্রিয় পাঠক।
এরপরে আছে চর্মশিল্প ও অনান্য শিল্প।
শুধুমাত্র কেরালাতেই ট্যানারি আছে চার হাজারের মতো৷ এগুলো কাঁচামালের জন্য মূলত নির্ভর করে গোরুর চামড়ার উপরেই৷ তাছাড়া আছে আরো কয়েকহাজার ছোট বা মাঝারি চামড়াজাত দ্রব্যের কারখানায়৷ শুধুমাত্র কেরালাতেই চর্মশিল্পের সাথে যুক্ত আছেন পঁচিশ লক্ষ মানুষ। এর এক তৃতীয়াংশই মহিলা।
শুধু কেরালাতেই যদি ট্যানারিশিল্প এত মানু্ষের কর্মসংস্থান করে, তাহলে গোটা ভারতের ক্ষেত্রে ছবিটা কী হতে পারে সেটাও একটু ভাবুন।
আর শুধু তো চামড়া বা মাংস নয়, গোরুর শরীরেও অনান্য অংশও নানা কাজে লাগে৷ গোরুর রক্ত, হাড় সবই কাজে লাগে৷ রক্ত থেকে তৈরী হয় নানা রাসায়নিক। হাড় ও শিং থেকে তৈরী হয় সার, পোলট্রীর খাবার, ক্যালসিয়াম ও জিলোটিন। এগুলোর উপর নির্ভর করেও গড়ে উঠেছে নানা শিল্প৷ কর্মসংস্থান হচ্ছে আরো হাজার হাজার মানুষের। গো হত্যা বন্ধ হলে এক ধাক্কায় বেকার হয়ে পড়বেন বীফ ইন্ডাস্ট্রি ও এইসব আনুষঙ্গিক ইন্ডাস্ট্রীগুলোর সাথে জড়িতে লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ সার্বিকভাবে যার প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতির উপর।
গো হত্যা বন্ধ হলে তার প্রভাব পড়বে রপ্তানীশিল্পের উপরেও। গো জাত দ্রব্যের একটা বড় অংশই ভারত রপ্তানী করে বাইরে। রপ্তানীকারকদের মতে গো হত্যা বন্ধ হলে ভয়ংকর প্রভাব পড়বে রপ্তানী বাণিজ্যের উপর। আমার কাছে সাম্প্রতিক হিসাব নেই৷ যা আছে তা ২০০২-০৩ সালের হিসাব৷ ওইসময়েই চামড়া শিল্প থেকে ভারত আয় করতো বছরে একাশি কোটি টাকারও বেশী৷ ভারতীয় চামড়া শিল্পের বছরে ৭৭ কোটি ৬০ লক্ষ জোড়া জুতো, ১ কোটি ৮০ লক্ষ পোশাক, ৬ কোটি অনান্য চামড়াজাত দ্রব্য, ৫ কোটি ২০ লক্ষ শিল্পে ব্যবহৃত গ্লাভস উৎপাদনের ক্ষমতা আছে এবং তারা বছরে ২০০ কোটি টাকা রপ্তানী করে আয় করে, যার প্রায় ৬০% ই আসে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প থেকে। গোহত্যা বন্ধ হলে মারাত্মক সংকটের মুখে পড়বে এই শিল্পও।
অন্যদিকে গো হত্যা বন্ধ হলে গভীর সমস্যায় পড়বেন প্রান্তিক চাষীরাও৷ রুগ্ন বা অসুস্থ গরুগুলিকে তারা বেচে দেন কসাইদের কাছে। কারণ বসিয়ে বসিয়ে রুগ্ন বা বৃদ্ধ গরুকে খাওয়াবার সংস্থান তাদের থাকে না। একটা হাড় জিরজিরে মৃতপ্রায় গরু কসাইদের কাছে প্রায় দেড় হাজার টাকায় বিক্রী হয়। গোমাংস ভক্ষন নিষিদ্ধ হলে একদিকে এই আয় থেকে বঞ্চিত হবেন গরীব চাষীরা, বাধ্য হবেন গরুগুলিকে পথেঘটে ছেড়ে দিতে, অন্যদিকে গরুগুলিও খাদ্যের অভাবে বা বিষাক্ত খাবার খেয়ে মরে পড়ে থাকবে পথে ঘাটে৷ ফলে ছড়াবে দূষন ও রোগ সংক্রমন। মধ্যপ্রদেশে গো হত্যা নিষিদ্ধ হবার পর থেকে প্রতিদিন সেখানে কয়েকশো করে গোরু মারা যায় স্রেফ না খেতে পেয়ে বা ডাষ্টবিনের বিষাক্ত পচা খাবার খেয়ে বা পলিথিনের ব্যাগ খেয়ে৷ সারাভারতে গো হত্যা নিষিদ্ধ হলে এই সংখ্যা বাড়বে আরো বহুগুন। সার্বিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উঠবে জনজীবন।
তাই গোহত্যা বন্ধের এই সর্বনাশা রাজনীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠুন। গো প্রেমের নামে দেশের হতদরিদ্র মানুষকে ভাতে মারার কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বনাশা চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সোচ্চার হন৷
নয়তো খুব ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে আমাদের দেশের শ্রমজীবী জনগনের সামনে আগামীদিনে সেকথা বলাই বাহুল্য।
* প্রবন্ধে ব্যবহৃত সমস্ত হিসাব ২০১০-১১ সালের বাজারদর অনুযায়ী।
অসাধারণ এবং মূল্যবান একটি রচনা।
উত্তরমুছুন