চমকে উঠলো রূপমতী।গরম নিঃশ্বাস একেবারে ঘাড়ের কাছে। না তাকিয়েও বোঝে, কেউ খুব কাছে ! কে? প্রশ্ন ,কৌতূহল, লজ্জা, ভয় মেরু বাতাসের গরম ধুলোয় মেশামিশি করে ভেসে গেল দূর রুক্ষ পাহাড়ের দিকে। ঘাঘরায় উপেক্ষার ঘূর্ণি তুলে দ্রুত পা চালালো কোঠির দিকে। বাড়ীতে সব বসে আছে। দেরী করলে চলে? তার চলার পথের পিছনে , গোলাপী ওড়না নীল ঘাঘরার উড়ে যাওয়া প্রান্ত ঘিরে মিলিয়ে গেলো চৈত্রের দুপুরের শুকনো বাতাসের প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাস।
আজ তিনদিন হলো উচাটন সুলতান বাজ বাহাদুর। ব্যস্ত মানুষ। সুলতানী করা ছাড়াও নিয়মিত শায়েরী লেখেন। ছবি আঁকেন। নানা ধরণের বাদ্য বাজান। সুলতানী তার পেশা। নেশা তাঁর কাব্য, সাহিত্য, সংগীত। শাসন নয় সাধন তার কাম্য। মান্ডু নগরীর আকাশ বাতাস ভরে থাকে সুরে, কবিতায়।
অথচ কত ভয় চারিদিকে! পরাক্রমী মুঘল থাবা চাটে সীমানায় বসে। লকলক লোভের জিভ দোলায় মুঘল সেনাপতি আদম খান। চড়াই পাখির মত ছোট্ট মান্ডুর উপরে লোভী হায়নার শিকারি চোখ!
*****
দিল্লীর মসনদ আলো করে বসে আছে শাহেনশাহ আকবর। সাচ্চা ইনসান। শাসন যেমন , সোহাগ তেমন।
ছোট বড় সব রাজ্যের প্রতি সমান নজর। দেশের লোক দুই হাত তুলে দোয়া করে এমন সম্রাটের জন্য।
আদম খান ঘুর ঘুর করে। বার বার বোঝায় , মান্ডু এখনো স্বাধীন। এখনো মোগল আধিপত্য নেই সেখানে। এই আস্পর্ধা সহ্য করা মোগল সম্রাটের পক্ষে অপমানজনক। আর মাণ্ডুর সুলতান বাজ বাহাদুর ? সে সুলতান কম, কবি বেশি। অপদার্থ এক। সারাদিন গান বাজনা কবিতা নিয়ে পড়ে থাকে। এমন লোকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নাও মান্ডু।
সম্রাট আকবর আমল দেন না। তিনি শাসক। লোভী শার্দুল নন। চতুর আদম খান সুযোগের প্রতীক্ষা করে। তার রাগ হয়, বড্ড রাগ। ওই এক ফোঁটা সুলতান বাজ বাহাদুর! এখনো স্বাধীন? দিনরাত ভালোবাসার গান গায় বেয়াদপ, তার ওতো গুমোর কিসের? ধূর্ত চিতার মত চুপ করে নজর রাখে আহমদ খান।
এই সব চক্রান্ত, রাজনীতির বাইরে বাজ বাহাদুরের নীল চোখে এক আশ্চর্য সরোবর খেলা করে। সুঠাম দীর্ঘ ঝকঝকে শরীরে সুগন্ধী ছড়িয়ে মাঝে মাঝে দাঁড়ান প্রিয় উদ্যানে। সন্ধ্যা আকাশের তারা, মিঠে চাঁদের আলো ,নদীর ওপর থেকে ভেসে আসা মন কেমনের হাওয়াতে ঘোর লাগে চোখে ,হাতে তুলে নেন প্রিয় বীণা। নিজের রচিত সুর বেজে ওঠে। মোচড় দেয় বুকের মধ্যে। কাকে খোঁজেন সুলতান? এই শাহী দুনিয়ার বাইরে কে আছে তার জন্য অনন্ত প্রতীক্ষায়?
আজ তিনদিন হলো শিকারে বেড়িয়েছেন বাজ বাহাদুর। শিকার নামেমাত্র। এক তীব্র গতিতে দৌড়োনো হরিণের পেছনে খেলাচ্ছলে যাচ্ছিলেন ঘোড়ায় চেপে। অরণ্য ,আকাশ, পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে সূর্য ডুবছিলো ধীরে ধীরে। অরণ্য আকাশ আর পাহাড়ের বিস্তীর্ণ প্রান্তর ঘিরে সূর্য যখন ডোবে-- চারিদিকে সবুজ কমলা নীল রঙের ঢেউ খেলতে থাকে চরাচর জুড়ে।এমন অপার্থিব সৌন্দর্যের সামনে থেমে গেলো সুলতানের ঘোড়া।ভুলে গেলো কোথায় আর কেন আসছিলো তারা।
হঠাৎ এক সুর যেন বেরিয়ে এলো পাহাড় চিরে নাকি সুলতানের অন্তর চিরে ? এ সুর যেন তাঁর জন্যেই অপেক্ষা করেছিলো। তার একাকিত্ব তার প্রেমিক সত্তার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বেজে উঠলো এই সুর। ঘোড়া থামিয়ে সুরকে অনুসরণ করে চললেন নিয়তি নিদির্ষ্ট পথে এবং দেখলেন তাকে। যাকে দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলো তার যৌবন। তার পুরুষ হওয়াই যেন এই নারীর জন্য। নীল ঘাঘরা আর হলুদ দোপাট্টা, লাল রেশমী কাঁচুলিতে থরথর অপরূপ নিষ্পাপ এক গোলাপ। চোখ তুলে তাকালো সে বাজ বাহাদুরের দিকে,সমস্ত চরাচর জুড়ে শুধু সেই সুর আর সুরের মালিকা রূপমতী। কেউ কোনো কথা বললো না। বলার দরকারও ছিলো না আর। এক শিল্পী চিনে নিলো অন্য শিল্পীর মন। মনের এক নিজস্ব শক্তি থাকে। দুজন অপরিচিত মানুষ অথচ মনের তার এক জায়গাতে বেজে উঠছে। এমন তো হয়। আর যখন দুই তার বেজে ওঠে একসুরে তখনকোনো শর্ত ছাড়াই, অঙ্গীকারবদ্ধ হয় তারা পরস্পরের। হাত বাড়িয়ে দিলেন বাজ বাহাদুর। এক নরম কোমল সুরেলা বুলবুল আপনি এসে ধরা দিলো ভালোবাসার শেকলে।
******
দুই হাতের পাতায় প্রিয়ার মুখখানি ধরে সুধায় সুলতান:
চলো আমার সঙ্গে।
নীল সরোবরের মত স্বচ্ছ দুটি চোখ তুলে তাকায় রূপ:
তোমার সঙ্গে জাহান্নাম যেতে রাজি , সুলতান। আমার নিজের বলতে আর কিছুই নেই। সব তোমায় দিয়ে এখন আমি ভিখারী। জানো, মীরাবাই তাঁর প্রাণের ঠাকুর গিরিধারির পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। দুজনকে আর আলাদা করা যায় নি।
: সে তো ভগবান ছিল রে আসমানী। আমি তো বেচারা ইনসান।
পাহাড়ী ঝর্ণার মত হেসে ওঠে , বাজ বাহাদুরের আসমানী। রূপমতি। বলে:
প্রেম নিজেই ঈশ্বর। কোনো ফারাক নেই।
**
মান্ডু দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো রূপমতী। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা এক অপরূপ শৈল শহর। অবশ্য ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে থাকলে সব জায়গাই কেমন অন্যরকম লাগে। দুজন শিল্পী মানুষ কবিতা গানে ভরিয়ে দিতে লাগলো একে অন্যকে। চাঁদের আলোর কি জাত ধর্ম থাকে? ফুলের সৌরভ, বাতাস, আকাশের রং__ কোথায়ও কি লেখা থাকে কে হিন্দু কে মুসলমান? রুপমতী আর বাজ বাহাদুর দুই শরীর, এক আত্মা। মনেই রইলো না জাত ধর্মের কথা। আদরে, চুম্বনে, শরীরে ,হিদয়ে দিন দিন পূর্ণ হতে লাগলো ভালোবাসার ভান্ডার।
তবু যেন একটু উদাসীন লাগে রূপমতী কে? প্রিয়াকে বাঁধলেন স্নেহের আলিঙ্গনে রাজা_-
" কি হয়েছে খুলে বলো রানী?"
" আমার মা নর্মদা নেই রাজা। তাঁকে দর্শন না করে জল টুকুনি খাইনা আমি!"
মা নর্মদা? তিনি তো বহুদূরে। কি করে মান্ডুতে আসবেন তিনি? পৃথিবীতে প্রেমই তো পারে সব অসম্ভব সম্ভব করে তুলতে! তিনহাজার ফুট উঁচু এক অপরূপ মহল বানালেন বাজ বাহাদুর। যার ছাদে উঠে দেখা যায় মা নর্মদাকে। ভালোবাসা তো এমন এক শক্তি যার কাছে সব বাধা তুচ্ছ হয়ে যায়। বাজ আর রূপমতী -- রাজা রানী নামেই। তাদের কাছে শুধু তারা দুজনে সত্য। পৃথিবীর আর কোনো কিছুতে তাদের আগ্রহ ছিল না।
রূপমতী হিন্দু। অথচ মনে পড়লোনা সে কথা একবারও। জাত ধর্ম কোথায় হারিয়ে গেল যেন। ভোর বেলা সূর্যের প্রথম কিরণ যখন ফুটি ফুটি, রাজার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে সরিয়ে নর্মদা দর্শন করে আসেন রূপ। তারপরে তার স্নান। ওখানে একটু বিলাস করেন মহারানী। ফুলের থেকে নিংড়ে নেওয়া সুগন্ধী থাকে তার স্নান কক্ষে। চুল থেকে পা পর্যন্ত নানা ধরণের ভেষজ মাখিয়ে নরম গৌরী তনুকে আরো উজ্জ্বল করে তোলে দাসীরা। সূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্র, খোলা চুল, কাজল ঘেরা চোখ, অল্প কিছু অলংকার পরে দেবী সরস্বতীর মতো গিয়ে বসেন তাঁর সংগীত কাব্য চর্চার ঘরে। ঘর না বলে মাঠ বলাই ভালো। চারিদিকে বড়ো বড়ো জানালা। দূরে পাহাড় আর নদী। হাওয়া বইছে অকাতর। রূপমতী ভৈরবীর প্রথম আলাপে বন্দনা করেন মা নর্মদাকে। আর সেই বন্দনার সুর শুনে চোখ মেলেন সুলতান। তিনি নাকি মুসলমান ? চোখ বুজে সেই স্বর্গীয় সুর কে নিজের মধ্যে নিতে থাকেন বাজ। মাথায় ভীড় করে আসে কবিতার লাইন। প্রতিদিন ফুল ফোটে। প্রতিদিন সূর্য ওঠে। হিন্দু মুসলমান নয়,প্রতিদিন সুর কবিতা আর প্রেমে বিভোর থাকে দুটি হৃদয়।
মান্ডু প্রথম থেকেই দিল্লীর নজরে ছিলো। অপছন্দের তালিকায় ছিল বলা যায়। অপছন্দ কারণ মান্ডুতে তখনো দিল্লী নখ বসাতে পারেনি। এতো ছোট এক রাজ্য, সৈন্যবল যার এক মুঠি, যার সুলতান নাকি বাজ বাহাদুরের মতো নিকম্মা কবি! সেও কিনা দিল্লীর সামনে নতজানু হয়ে বসেনি এখনো? ভারত সম্রাট আকবর কিঞ্চিৎ উদাসীন হলেও তার সেনাপতি আদম খান কোকা উঠেপড়ে লেগেছে মান্ডু কে কব্জা করবার জন্য। নানারকম কায়দা করেও সে ভাবে আকবরকে তাতাতে না পেরে, সে শুরু করলো রূপমতী র রূপ আর গুণের বর্ণনা করা। নানা ভাবে , নানা লোকের মুখ দিয়ে রূপমতী শুনে শুনে আকবর সামান্য একটু উৎসুকুতা প্রকাশ করলেন মাত্র। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে আকবরের নাম দিয়ে এক পত্র গেলো মান্ডুতে।
রাজসভাতে আসতে একটু দেরী হয়ে যায় সুলতান বাজ বাহাদুরের। যে অলৌকিক সরল সকাল রোজ তাকে উপহার দেয় রূপমতী ,তাকে ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে এই সব রাজ্য, রাজনীতি ,মিথ্যে কথা গুলোর মধ্যে ঢুকতে আর ইচ্ছে করেনা সুলতানের। মান্ডু এমনিতেই বেশ শান্ত রাজ্য। বিশেষ কিছু করবার থাকেও না অবশ্য। তাই রাজদরবারেও সেই কাব্য সংগীত ই আলোচনা হতে থাকে। রাজ কর্মচারী, সেনাপতি, অমাত্য পুরোনো বন্ধুর মতো।হাসি গল্প কাব্য আলোচনা হতে থাকে। রূপমতীর লেখা কবিতা পড়ে শোনায় বাজ বাহাদুর। সভা জুড়ে " বাহা" বাহা" রব ওঠে।এমন এক অলস কাব্যময় দুপুরে শাহেনশাহ আকবরের দূত এসে সালাম করে দাঁড়ালো।
যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে বাজ বাহাদুর দূতের কাছ থেকে বার্তা পত্র চেয়ে নিলেন। বার্তা পড়তে পড়তে সুলতানের সুন্দর মুখ ক্রমশঃ বদলে যেতে লাগলো। উত্তেজনায় ঘন ঘন নিঃস্বাস পড়তে লাগলো। রক্তবর্ণ মুখে তিনি জবাব লিখলেন -----
" আপনি আপনার দরবারে রানী রূপমতীকে নিয়ে যেতে বলেছেন, সম্রাট। বিনিময়ে আপনার মহিষীও আসবেন তো মান্ডুতে?"
বাজ বাহাদুরের চাবুকের মতো জবাব গিয়ে পৌঁছলো আদমখানের হাতে। এতো সাহস কোথায় পেলো ঐ মূর্খ সুলতান টা? অবাক হয়ে যান আদম খান। দু হাতের তালু ঘষতে ঘষতে স্থির করেন এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা , শায়েস্তা করতে হবে ঘাড়বেঁকা প্রেমিক টাকে। " য়া আল্লা! প্রেম কি খরগোশের বুকে জাগাতে পারে সিংহের সাহস? তাই তো দেখছেন আদম খান! এক মুঠির মতো রাজ্য, যার সৈন্য গুলো পর্যন্ত কবিতা বলে! সে কিনা ভারত সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে নিজের প্রেমিকাকে তুলনা করে? মানতে হবে কিছুতো আছে এই বাজ বাহাদুর আর রূপমতীর মধ্যে। যার খবর জানতে হবে। যেভাবেই হোক।"
ঠোঁট কামড়ে মনে মনে এক ভীষণ সিদ্ধান্তে এলেন আদম খান। একাধারে মান্ডু আর রূপমতী দুটোই ছিল তার বাসনা। বাজ বাহাদুরের এই পুরুষোচিত জবাব যথেষ্ট ছিল আদমখানের জন্য। গোঁফে মোচড় দিতে দিতে, হিংস্র কুটিল মস্তিষ্কে এক নৃশংস মতলব আঁটলেন। না! মোটেও সম্রাট আকবর জানবেন না, এই জঘন্য মতলব। আকবরের জন্য সম্পূর্ণ অন্য চিত্র পেশ করা হলো। বাজ বাহাদুরের আকবরের প্রতি আস্পর্ধা, ঔদ্ধত্ব প্রকাশ পেল সেই পরিকল্পনায়। সুকৌশলে অনুমতি আদায় করে, বিরাট এক সেনাবাহিনী নিয়ে শিকারী চিতার মতো ধীরে ধীরে ঘিরে ধরলো মান্ডুকে চারিদিক থেকে।
সেদিন ছিল চৈত্র পূর্ণিমার রাত। চরাচর ভেসে যাচ্ছে এক অলৌকিক জোছনায়। গভীর নিথর রাত গম্ভীর পবিত্রতায় নিঃশব্দ। সারি দেওয়া পাহাড় শ্রেণী, ঘনঅরণ্য, পাথরেরকেল্লা -- স্নান করছে চাঁদের আলোতে। ফুটফুট করছে চারিদিক।
রূপমতী এমন রাত বড়ো ভালোবাসে। তার মন কেমন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কি এক আবেগ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সাদা রেশমী পোশাকে সাজায় নিজেকে। খোলা চুলে সাদা সুগন্ধী ফুল। কিল্লার ছাদে খোলা আকাশের নিচে বীণা হাতে বসে প্রিয় সুর বাজাতে থাকে সে। বন্ধ চোখের কোল বেয়ে ঝরে জল। গোলাপী ঠোঁটে অপার্থিব হাসি। একটু দূরে নিঃশব্দে বসে থাকে তাঁর মুগ্ধ প্রেমিক বাজ বাহাদুর। তারও দু চোখে জল। কিল্লার অনেক অনেক নীচে অন্ধকার জমি ঘিরে মোগল শিবির।মৃত্যু যেন হাতছানি দেয় এই প্রেমিক যুগলকে। কিন্তু, তাদের প্রেম মগ্ন দেওয়ালে আঁচড় ধরাতে পারে না কোনো ভয়! প্রেমই পারে মানুষের হৃদয়কে ভয় শুন্য করে তুলতে!পৃথিবী নিজেকে ধন্য মনে করে এমন অলৌকিক দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরে। আহা! প্রেম যদি না সৃষ্টি হতো তবে জীবন অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতো।
বাজ বাহাদুর খড়ের মতো উড়ে গেলেন মোগল সেনাদের হাতে। তবে এতোটুকুর জন্য মাথা নিচু করেননি তিনি। যুদ্ধে যাবার সময় প্রিয়ার হাত ধরে বলে গেছিলেন---" তিনদিন অপেক্ষা করে তারপর তুমি যা প্রাণে চায় করো। কিন্তু যাই ঘটুক, তিনদিন অপেক্ষা করবে!"
আদমখান হৈ হৈ করতে করতে কিল্লার অধিকার নিয়ে প্রথমেই রূপমতীকে দখল করতে গেলেন। হাতজোড় করে তিনদিন সময় ভিক্ষা চাইলেন রানী। আদম খানের মাথা ঘুরে গেছিল রানীকে দেখে।পারলে নিজের গলা কেটে রূপমতীর পায়ে রাখে, তিনদিন তো কোন ছার। শিকারী চিতার মতো থাবা চাটতে চাটতে অপেক্ষায় রইলো আদম খান সেই দুর্লভ মুহূর্তের। যখন সাদা হরিণীর মতো রূপমতী তার থাবার নীচে এসে পড়বে !
বাজ বাহাদুর পালাতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন রানী ঠিক অপেক্ষা করবে তিনদিন। কিন্তু কিছুতেই কিল্লাতে ঢুকতে পারলেন না ! শ্বাস বন্ধ করে ঘন্টা মিনিট গুনতে গুনতে রানী বুঝলেন , বাজ বাহাদুর আসতে পারবেন না।তিনদিনের দিন, খুব যত্ন করে সেই বিয়ের রাতের সাজ সাজলেন রূপমতী। উফ! সে কি সাজ! সে কি রূপ! লাল আর সোনার জরিতে বোনা লকলকে পোশাক, ঝক ঝক হীরের গয়না, কালো চোখে নিবিড় সূর্মা, টুকটুকে ঠোঁট। বিশাল আয়নায় প্রতিফলিত রূপমতীর রূপ এক প্রশ্ন বাণ হয়ে আছড়ে পড়লো পৃথিবীর সব কামুক পুরুষের বুকে। শ্বাস ফেলে তাকালেন অপরূপ করে সাজানো সেই মেহগনি কাঠের, অপূর্ব কারুকার্যের পালঙ্কের দিকে, যে কিনা
বাজ বাহাদুর আর রানীর অনেক সুন্দর রাতের সাক্ষী।
রানী সেই পালঙ্কের উপর গর্বিত সুন্দর শরীর মেলে দিলেন, ঠিক যেমন করে প্রিয়া অপেক্ষা করে প্রিয়তমের জন্য। চারিদিকে কত স্মৃতি ভোরের কুয়াশার মত ছড়ানো! উদাস হাতে বীণা তুলে বাজালেন রাগ ইমন। সন্ধ্যে নেমে আসছে। প্রাসাদের ছাদে বসে গুলাবী আতর , কবিতা আর ইমন রাগ সঙ্গী করে কত নিবিড় সন্ধ্যে কাটিয়েছেন ! আজ তার সব অবসান। মৃদু হাসলেন রানী। তারপর পরম যত্নে বীণা খানি বুকে জড়িয়ে, নিজের মুখে তুলে দিলেন ভয়ঙ্কর বিষ।
বাইরে তখন বসন্তের সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত নামছে। আদম খান এগিয়ে আসছে রূপমতীর মহলের দিকে। মনের আনন্দে মাটিতে পা পড়ছে না তার।
যুগে যুগে ভালোবাসা এভাবেই মাথা উচুঁ করে থাকে লালসার বিপরীতে।
______________________________________________
সুচিন্তিত মতামত দিন