সুনেত্রা সাধু

মায়াজম
0
দুই মহাদেশ



দুপুরের পর থেকে অন্তত ছ সাত বার নীচু কাঠের গেটটা ধরে রাস্তার দিকে চোখ রেখেছে মধুরা। উফ আর কত দেরী যে করবে! কতদিন তার সাথে দেখা নেই, শেষ মুহুর্তের অপেক্ষাটুকু বড় অসহনীয় বলে মনে হয়। কর গুনে সময়ের হিসেব করে সে, চার বছর। চার চারটি বছর নেহাত কম সময় নয়। এই কটা বছরের মধুরার জীবনের ছকটাও আমুল বদলেছে। বাবা তো কবেই একলা করে দিয়ে চলে গিয়েছিল, মা পিছু নিল বাবার , একলা পড়ে রইল মধুরা। তখনও কলেজ শেষ হয়নি। টাকার অভাব ছিল না, তাই এত বিপর্যয়ের পরেও পড়াশোনা শেষ হয়েছে নির্বিঘ্নে। তারপর কলেজ পাস করে যখন চাকরিটা জুটেই গেল তখন মধুরা আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি, উত্তরবঙ্গের পাহাড় ঘেরা এই ছোট্ট সুন্দর শহর এখন তার কর্মস্থল।
দীপ্ত আর মধুরা সেই স্কুল বেলার বন্ধু, শুধু কি বন্ধু? কে জানে! এদেশে কলেজ পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপ গিয়েছেল দীপ্ত, মাঝে ফিরতে পারেনি।চিঠির যোগাযোগটা রয়েই গিয়েছে, তাই সম্পর্কের তার ছিঁড়ে যায় নি, এখনও দিব্যি সুরে বাজে। এত গুলো বছর পার করে সে দেশে ফিরেছে, দিন সাতেক বাড়িতে কাটিয়ে আজ আসছে মধুরার কাছে। ট্রেন ঢোকার কথা ভোরের দিকেই, তারপর পাকদন্ডী বেয়ে এ পাহাড় সে পাহাড় ঘুরে এই শহরে পৌঁছতে লাগবে আরও ঘন্টা তিনেক। ট্রেন কি তাহলে লেট! গেটের হাতলটা আনমনে নাড়াচাড়া করতে থাকে মধুরা।মনে হয় পৃথিবীর সব ঘড়ি গুলো যেন স্থির হয়ে আছে।
বাগানের নুড়ি ফেলা রাস্তাটা দিয়ে ঠুক ঠুক করে লাঠি ঠুকে এগিয়ে আসছেন মিসেস ব্রিগেঞ্জা, মধুরার বাড়িওয়ালি। শহর থেকে একটু দূরে একটা ছোট্ট একটা বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকে সে, নীচে থাকেন মালকিন মিসেস ব্রিগেঞ্জা। মেয়ের মতো স্নেহ করেন মধুরাকে। দুজনের মধ্যে এক অসমবয়সী সখ্যতা আছে। শেষ বয়সে মধুরাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচছেন যেন। পিতৃ মাতৃহীন মধুরাও অভিভাবক পেয়ে খুশি। দুজন দুজনের ভরসা। মিসেস ব্রিগেঞ্জাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া ওষুধ পত্র এনে দেওয়া মধুরাই করে । এছাড়া ছুটির দিনে হাতে হাত মিলিয়ে বাগানের কাজ করা, ক্রিসমাসে দুজনে মিলে কেক বেক করে পাশের গ্রামের অনাথ আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে আসা, এসব কাজ করতেও মধুরার মন্দ লাগে না, সময় কেটে যায়, অনেক কিছু ভুলে থাকতে পারে সে। মিসেস ব্রিগেঞ্জার কন্টিনেন্টাল রান্নার হাতটিও অপূর্ব, মাঝে মাঝে রেঁধে খাওয়ান৷ এখন মধুরারর গায়ে যে সোয়েটার সেটাও মিসেস ব্রিগেঞ্জার বুনে দেওয়া। তিনদিকে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট কাঠের বাংলো আর বাড়িওয়ালির প্রতি মায়া জন্মে গেছে মধুরার।
“তোমার অপেক্ষার বহর দেখে তো আমার প্রেমিক বনে যেতে ইচ্ছে করছে”, একগাল হেসে বললেন মিসেস ব্রিগেঞ্জা, লজ্জা পেল মধুরা। আর ঠিক তার পরপরই ঢালু রাস্তার শেষ মাথায় দেখা গেল তাকে। নীল, লাল আর সাদায় মেলানো জ্যাকেট গায়ে এক কাঁধে গিটার আর এক কাঁধে রুকস্যাক ঝুলিয়ে আসছে সে। কত্তদিন পরে দেখা, সেই রোগাপাতলা ছেলেটা জাদুবলে জেন্টেলম্যান বনে গেছে ৷ আনন্দে মধুরার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল, একে বুঝি আনন্দাশ্রু বলে!
ছোট্ট বাংলো ধাঁচের বাড়িটার গা ঘেঁষে একটা সবুজ পাহাড় উঠে গিয়েছে অনেকটা উপরে, ছোট্ট জলপ্রপাতও আছে কাছাকাছি ৷ পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ছোট ছোট ঝোরা একটানা কুলকুল শব্দ করে বয়ে যায় বাড়ির পাশ দিয়ে । রাস্তার ওপাশে বার্চ গাছের অরন্য, খুব কাছে একটা পাখি একটানা শিষ দিয়ে চলেছে। চারটি বছর বিচ্ছেদে থাকা এক জোড়া নবীন প্রাণ এখন আষ্টেপৃষ্টে একে অপরকে জড়িয়ে তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে, হয়তো নিঃশব্দে বিনিময় হয়ে চলেছে বহু না বলা কথা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস ব্রিগেঞ্জার উপস্থিতি তারা বেমালুম ভুলেছে।
-“অনেক হয়েছে, এবার চা কফি খাওয়া হোক,” বলে তাদের ডাক দিয়েছে মিসেস ব্রিগেঞ্জা। আগে খেয়াল করে নি এখন কাছেই একজন বয়স্ক মানুষকে দেখে বেশ লজ্জা পেয়েছে দীপ্ত, মধুরা আলাপ করিয়ে দিল দুজনের।
দীপ্ত আসবে বলে কাজের লোক প্রেমাকে চায়ের টেবিলটা বাগানে পেতে দিতে বলেছেন মিসেস ব্রিগেঞ্জা , সাথে তিনটি চেয়ার। টেবিলে বিছিয়েছেন নিজের হাতে কাজ করা সাদা ধবধবে টেবিল ক্লথ, সাজিয়েছেন মানানসই ন্যাপকিন। তারা বসলে প্রেমা চায়ের সরঞ্জাম আর জলখাবার সাজিয়ে দিয়েছে টেবিলে। শীতের দেশে পড়ন্ত দুপুরের রোদ মেখে দুই নবীন ও এক প্রবীন আলাপচারিতায় মেতেছে। সাথে আছে সুস্বাদু চিকেন পাই, অরেঞ্জ কেক আর কফি। এহেন জামাই আদর দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে দীপ্ত। টুকটাক গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করছে তারা। মিসেস ব্রিগেঞ্জা ইউরোপের খবর নিচ্ছেন, একটা সময় থাকতেন ওখানে। দীপ্ত জানাচ্ছে এটা সেটা। মধুরা সে দেশের কিছুই চেনে না। সে শুধু চোখের পলক না ফেলে দেখে যাচ্ছে দীপ্তকে।
জলখাবারের পর্ব সমাধা হলে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে থাকে মধুরা, পিছনে দীপ্ত। লাগেজ গুলো আগেই তুলে দিয়েছে প্রেমা। তাদের বুকের ভিতরে কে যেন হাতুড়ি পিটছে। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই এক্কেবারে একলা হবে তারা। সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকায় মধুরা, দীপ্ত অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই সিঁড়িতে উঠতে পারছেনা। শীতের বিকেলেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার প্রতিটা পদক্ষেপ নিস্ফল। মাঝে কটা মাত্র সিঁড়ির ব্যবধান,তবু যেন বহুদূর। মধুরা তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে, তার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে আলগা একটুকরো হাসি। দীপ্ত দেখতে পাচ্ছে না মধুরাকে, নাকি দেখতে চাইছে না! সিঁড়ির মাঝে এখন অসংখ্য নদী, সাগরে মিশবে বলে তারা ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। নদীর ছোট ছোট ঢেউ ক্রমশ বদলে গিয়ে বড় বড় সামুদ্রিক ঢেউএর আকার ধারণ করছে। ফুঁসে ওঠা সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে মধুরার পায়ে। আটলান্টিক মহাসাগরে উথাল-পাতাল লোনা বাতাসে উড়ছে মধুরার চুল। সে এখনো তাকিয়ে আছে দীপ্তর দিকে, তার দুচোখে অপেক্ষা। দুই মহাদেশের ব্যবধান বাড়ছে ক্রমশ।
একটা রাতচড়া পাখি সমানে ঢেকে চলেছে। মধুরা উঠে বসেছে বিছানায়, জল তেষ্টা পাচ্ছে তার। গায়ের মোটা ব্ল্যাঙ্কেট পাথরের মতো ভারি বলে বোধ হচ্ছে। একটানে সে খুলে ফেলে আচ্ছাদন, তারপর থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে । কম দিন তো হল না, তবু কেন ফিরে ফিরে আসে সেই একই স্বপ্ন! সে জানে এখন কিসে মন শান্ত হয়। বিছানা থেকে নেমে গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে নিয়ে বারান্দার দরজাটা খুলে দেয় মধুরা, বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে জুড়িয়ে যায় তার শরীর। আলো জ্বেলে বইয়ের তাক থেকে বার করে সুনীল গাঙ্গুলির কবিতার বই, কষ্ট করে খুঁজতে হয়না কাঙ্খিত কবিতা, বুকমার্ক দেওয়া ছিল। ধীরে ধীরে পড়তে থাকে সে ...
“কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।”
চোখ থেকে ঝরে পরা জল ভিজিয়ে দেয় বইয়ের পাতা, অক্ষর গুলো ঝাপসা হয়ে আসে।
সিঁড়ি দিয়ে নামা যতটা সহজ ওঠা বোধহয় ততটা নয়......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)