পূর্বা মুখোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২২ অক্টো, ২০২০

পূর্বা মুখোপাধ্যায়

 

                            কুসুমবনের ওপার






দাহিকাশক্তি। ছেড়ে যাবার আগে একবার চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয় তার আঁচ কতদূর তোলা সম্ভব, কতটা ধ্বক তোমার। সেই আঁচে দেহ পুড়ে ছারখার, মন শুকনো পাতার মতো গুটিয়ে শুধু একটা বাতাসের অপেক্ষা করে। তুমি কি টের পাও কিছু? পাই। পাওয়া হয়। ওই দেহের সদগতি হল। ওই মনের মুক্তি হল। মাটির শরীরে শিহর তুলে কমলবনে সরে যাচ্ছে সাপ...






পাথর হব। রোদেজলে পড়ে পড়ে ক্ষইবো ধীরেসুস্থে। ঝড় ফিরে যাবে। বিদ্যুৎ ঠিকরে যাবে, ব্যর্থ। পাথর হতে হতে কি অনুভূতি মরে যায়? কোনও ডাকেই সাড়া আসেনা? দেবতা কি এইজন্যেই পাথর?
আমার ভেতর আমি গলন্ত দাহ্যের ফোয়ারা টের পাই। শীতল নয়। শান্ত নয়। ফুটছে। তার এমন এক প্রাণজুড়নো বাতাস দরকার, যাতে সে আর না টলে। কোথায় আছে সেই হাওয়া? আছে কি কোথাও? আমার কেবলই খেই হারিয়ে যায়। আমি হাওয়া খুঁজতে এদিক ওদিক কত কুঠুরিতে মুখ বাড়াই। মুখে গরম ভাপ এসে লাগে। আর সেই ঝাঁঝালো খণিজগন্ধ, যা সমস্ত অতলে ঘুরপাক খাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসার আগে এইবার আমার বেরিয়ে পড়া দরকার। ফুঁড়ে ফেলা দরকার উপরকার এই খোলস। হাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে জুড়িয়ে যাব। পাথর হবো। রৌদ্রে গরম। ছায়ায় শীতল। শীতল না হলে শীতলতাকে টের পাওয়া যায়না। কে আমায় শীতল করবে? তুমি, অচিন হাওয়া।




তোমার চোখের দিকে তাকালেই পলক খসে যাবে। একত্রে ধরা পড়বে গৃহস্থ ও চোর, নিহত ও আততায়ী । মাছ হয়ে চিনিয়ে দেবো সেই জলতল,যেখানে শাবলের ঘায়ে ঠং করে উঠবে কবেকার মাটিচাপা ঘড়া। ঘড়ার ভেতর দুখানি মঞ্জীর। কে পরতো? তার কঙ্কালের হাড় মিশে গেছে এই পাঁকের ভেতর। তাকে নিজহাতে,কত যত্ন করে, বিবিধ অলংকার দিয়ে সাজিয়েছি ! নাকের বেশরটি পর্যন্ত বাদ যায়নি। অত সাজপরা মেয়ে কি ধুলোর মানবী হয়? তাই ওকে নিজহাতে নিষিদ্ধ করলাম। দেবী। এইবার বিসর্জন সিদ্ধ। ভয়... তোমার চোখের ওপর চোখ রেখে যদি পলক খসে যায় একবার, যদি মরা মাছ জ্যান্ত হয়ে জলে চলে যায়, সেই আমার শাস্তি। সেই আমার শান্তি।





এসো, ধুয়ে দাও কালি,অকথিত ছাই ধুয়ে দাও। আমার অসুখে চুরমার অস্তিত্ব। ভুলগুলি নিয়ে বসে আছি, স্থবির। এই ব্যবধান ধুয়ে দাও। খিদেতেষ্টা নেই। এই চিন্তাসূত্র লালারসে গুটি বোনে শুধু। তেতো জিভ। এই কালো পিত্তরস ধুয়ে দাও।...
সুধাসার, কুসুমের রেণু চেটে ভরিব ভৃঙ্গার
পুষ্পলাব, উড়ে যাব রূপময় তোমার বাগানে
শোষণে অমিয় প্রিয় মন্থনে কুহক
ছিঁড়ে দাও,ধুয়ে দাও শোকপরাভূত এই রুগ্ন ভস্মাধার...
এ কেমন খেলা বল, ভস্মেরও কি ভাষ্য কিছু থাকে?
তরঙ্গ, নির্জন ঘাটে, কী সংকেত পাঠালে আমাকে!...

একটি অসমাপ্ত রচনা, সারণিহীন। একে কি ফেলে দেবো? অথচ নিরুপায় হয়েই তো এসেছে! খেই হারিয়েছি তারপর। চিন্তাজট। খুলতে না পারলে সন্ধান অসমাপ্ত থাকে। বলবার কথাগুলি শাদা পাতায় উপুড় হয়ে পড়লেও উজাড় হয়না। একটি দীর্ঘ অসমাপ্ত রচনাই যে শেষাবধি আমার ভবিতব্য, জানি। শব্দসংখ্যা বাঁধা-ই আছে অথচ আমি যে তাও ভুলে গেছি, হে জীবন!






যাত্রাপথ, সিঁথির মতো বাঁকা। কে চিরকুমারী হাতে মালা নিয়ে অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছে... কার কাছে সে চলেছে? জানিনা। শুধু এই একটি অন্ধকারের ছবিকে বড় আপন মনে হয়। অভিসার। অবনীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন। একটি চলে যাওয়ার দৃশ্য। লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো বিশ্বাসে ওই যে তার আলতো পিছু ফিরে চাওয়া ! যেন কত চেনা। কিন্তু তার বাঁকা পথটি অন্ধকারে ঢাকা আর হাতের মালাটি অদৃশ্য।





আমি ভাগ্যবান যে তিনি আমায় ভুলে গিয়ে উন্মুখ করলেন। আমায় আর সারজল দিলেন না। তেষ্টা পেলে হাহাকার হয়। সেই হাহাকার গিলে অনেকক্ষণ তেষ্টা ভুলে থাকি। তিনি কি দেখতে পান তাঁর বাগানে সারজল পাক, না পাক, প্রতিটি গাছই ঘুমিয়ে পড়ছে? তিনি আমায় নিশ্চিত একদিন মাটি করবেন। তার আগে যা পেলাম তাই সই। দুটো প্রসন্নতার ফুলও কি ফোটাবো না?




এই যা কিছু আমার সঞ্চয় , সব তোমায় উৎসর্গ করলাম। এই যা কিছু আড়ালের অগোছাল রচনা, তার দ্বিতীয় পাঠক নেই, শুধুমাত্র তুমি।...
আদুল গায়ে ভোরের আলোকে আমার এখনও সেই ঋষিকুমারের মতোন লাগে, যার সঙ্গে মাত্র একবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দেখা হয়েছিল। তখন আমার কতই বা বয়স? বছর চার। না সে আমার ভাষা জানতো , না আমি তার। কিন্তু দুজনে সমস্বরে গাইছিলাম হরি ওঁ তৎসৎ ...তার বাবার শ্মশ্রুশোভিত উজ্জ্বল মুখখানি, হাতে কালো পাথরের কমণ্ডলু... তার পীতধড়া, চুড়োবাঁধা ঝুরুঝুরু চুল, কপালে হলুদ-চন্দনে মেশা তিলক আর চোখেমুখে ছড়ানো সেই হাসির রৌদ্রাভা... আমার দু হাত ধরে সে গেয়েছিল হরি ওঁ তৎসৎ...
ভিখারি নটবালকের বেশে একবারমাত্র এসে যে সুর আমায় শিখিয়ে গেল, ভুলিনি, সঙ্গে রইল আজীবন। হ্যাঁ, ওই সুরের ভেতর তুমি আছ। এই যা কিছু অগোছাল বেসুর, তোমায় খুঁজতে খুঁজতে একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে, নাম ধরে ডাকছে তাও সাড়া পাচ্ছেনা, এদের দু হাত ধরে ওই সুরে বসাতে একটিবার কি তুমি হাত বাড়াবে না, মাধব, ওগো মোহনিয়া ?

৩টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র