অনসূয়া খাসনবীশ - মায়াজম

Breaking

২২ অক্টো, ২০২০

অনসূয়া খাসনবীশ

                                                            

                            অবোধকাল





সে কথা বলা যাবে না…
কত কথা এভাবেই না বলা থেকে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসে,নীল হয়ে আসে চরাচর।
সূর্যের তপ্ত কপালে মোলায়েম হাত রাখে রাত্রি।
বনদেবীর মত আকাশে তারা ফুটিয়ে পায়ে পায়ে নেমে আসে সে।
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আরেকটা দিন কেটে গেল বড় রাস্তার পাশে, গাড়ির চাকার ধূলোয় ধূলোয়।
বড় মায়া চারিদিকে। ভাবি, চলে যাই।
সেই মুসুরি মায়ের বেদীর পাশ দিয়ে, রাঙা মাটির রাস্তা।রুক্ষ রুষ্ট মাটির উপর পড়েছে বৃষ্টির স্নেহ। অভিমানে সবটুকু জল টেনে সে অপেক্ষমান, আরও আরও মানভঞ্জনের। সে রাস্তার গা ঘেঁষে চলে গেছে পলাশ,কৃষ্ণচূড়ার সারি। টুপটাপ পাতা খসে পড়ছে। অকালের ঐ ছোট্ট ফুলটা, এত ধারে পড়ে থাকলে কেউ তো দেখতে পাবে না! খোঁপায় গুঁজে দিই,ভেবে,পথটার মাঝামাঝি রেখে দিলাম।যেখান থেকে আকাশ দেখা যায়। শৃঙ্গার হয়ে থাক।
পথের উপকণ্ঠে গ্রাম। সে দিকেই হাঁটি । গলায় সুর দেয়নি গোঁসাই। দোরে গিয়ে বসে থাকব, গোবিন্দের কথা বলব,টুংটুং খঞ্জনি বাজাতে থাকবে হাতের তালে। কস্ত্বং কোহহং কুত আয়তঃ/ কা মে জননী,কো মে তাতঃ …
দেখি, পদ্মপুকুরে মোষ ডুবে আছে। ভনভন করছে মশা তাদের মাথার উপর। তাদের রাখাল কই! সে অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন বাক্স খুলে ভাত খাচ্ছে অবেলায়। পেঁয়াজ,লঙ্কা,নুন একপাশে একটু আচার। আর মুসুর ডাল, শুকনো লঙ্কা দিয়ে শুকিয়ে দেওয়া। গবগব করে গ্রাস উঠে যাচ্ছে মুখে।
এমন খাওয়া অপলক তাকিয়ে দেখতে হয়,দুচ্যখ ভরে দেখতে হয়। ওই তৃপ্তির খাওয়ায় কী এক পরম শান্তি থাকে। নেশা ধরে, বুঁদ হয়ে যাই। পরিপূর্ণ হতে দেখার নেশা।
গোধূলিকালে আকাশের দিকে তাকালে সেরকম এক নেশা এসে ধরে। তার সাথেই শেষ হয়ে যাবার এক আকুলতা। এই সোনালী মায়াসময় ফুরিয়ে যাবে, এ সত্য এক আকুলতা নিয়ে আসে বুকে। যেন কী হারাই হারাই। যেন কী চলে গেল ছেড়ে।
আমি হাঁটতে থাকি।
গ্রামের দিক থেকে মানুষ আসে,সাইকেলে চেপে। ব্যস্ত,পিছনে বেকারির খাবারে ভরা ছোট ট্রাঙ্ক। রোজগারে নিয়ে যায় তাকে দুটো চাকা। আরও আরও একটু দ্রুত হলে আরও একটু সচ্ছলতা, আরও একটু উপার্জন। মায়ার চাকা, প্রাণপন ছোটে। তারও আগে ছোটে মানুষটার মন। আমি দেখতে পাই। ওই তার কেক বিস্কুট বিক্রি হল ভালো,ওই তার টাকা হল কিছু,ওই সে চাল ডালের সাথে,মেয়েটার জন্য একটা ভালো বাঁধানো খাতা কিনে নিল,ওই তার বৌয়ের জন্য একজোড়া চটি,ওই তার বাবার জন্য কিছু ওষুধপত্র।
নিজের জন্য কী! সব তো নিজেরই। পরিপূর্ণ মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা লোকটা এখন উড়ে যাচ্ছে সাইকেলে। দূরে যেখানে সন্ধ্যায় আলো মিটমিট করে,সেই শহরের রাস্তায় ফিরি করে বেড়াবে তার স্বপ্নগুলো।
ক'টা ছেলে মেয়ে আসে, ইস্কুলের জামা পরে। পিঠে ব্যাগ। মেয়েটা রাস্তার এপাশ থেকে আড় চোখে চায়, ছেলেটি আসছে কিনা পিছনে। ঠোঁট চেপে হাসে। ছেলেটি চুল ঠিক করতে করতে তাকিয়ে থাকে তার মরালীর দিকে।
আমি এগিয়ে যাই। বাচ্চারা টায়ার ছোটায়।তাদের তাড়নায় হাঁসগুলো দৌড়ে যায় পুকুরের দিকে। মুরগী খুঁটে খাবার খায়। চালা বেয়ে উঠে গেছে দেখি পুষ্ট পরিপূর্ণ লাউয়ের লতা।
ঘোমটা টেনে নিয়ে কোন ঘরের কোলে বাচ্চাটিকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার পাশে। সাথে অল্প বয়সী মেয়েদের দল। কলকল করে হাসে,খিলখিল করে কথা বলে। সকলের মুখে ঝিকিয়ে উঠছে হাসি। আমায় দেখে কথা বন্ধ হয়,খানিক,সরে এসে জায়গা ছেড়ে দেয় রাস্তায়। আমি দাঁড়াই,অকারণে হেসে বলি, জয় রাধে!
কমবয়সী মেয়েটা, মাথা নাড়ে। বৌমানুষ, কাঁখালে বাচ্চা নিয়ে ঝুঁকে আসে।রসকলি এঁকে দিই তার সুখী কপালে। বলে, দাঁড়াও বোষ্টুমী। মিতু যা, মা'কে বল,বোষ্টুমী এসেছে।
ঝোলা খুলে দিই। বৌটি ঢেলে দেয় দুটো চাল কলা আলু। আমি তাকিয়ে থাকি তার নিটোল মুখের দিকে। পরিপূর্ণ সংসার তার,পরিপূর্ণ মায়া।
দেখি একে একে মুদীর দোকানে বাচ্চারা চানাচুর কিনে খায়। টকঝালমশলা মাখা অবোধকাল। ঝালে কষ্ট হয়,সর্দি ঝরে। তবু আহা কী মধু কী মধু।
এগোই বাঁয়ে পুকুরঘাট,বাঁশের বন,বাদাজমি,তিনটে তেঁতুলের গাছ পাকিয়ে উঠেছে। পূবেল হাওয়ায় শিরশিরানি লাগে তাদের পাতায়। সেই শিরশিরানি বেয়ে আসে মনে। শিশুকালে শুনতাম,তেঁতুল গাছে পেত্নীর বাস। তখনকার সেই শিউড়ে ওঠা মনে পড়ে দেহকোষে।
কোথায় পেত্নী! রোদ পড়ে ছোট গোলাকার পাতাগুলোতে। কামারপাড়ার তিনমাথা বুড়ির মতো পেঁচানো শরীর ওদের। কবে কোনকালে তিনদিনের জ্বরে কি অনাহারে তাদের সব চুকে বুকে গেছে। এখন পেত্নী একা,তার লাঠির ঠুকঠুক আওয়াজ,ভরসাহীন পায়ের টেনে চলা শুনতে পাই হাওয়ার ঝিরিঝিরিতে। উনুন মিললে দিনের শেষে ভাতে ভাত ফুটিয়ে, মাটির মালসায় খেতে দিতাম তাকে। দুটো ফ্যানভাত আর নুন। আর কিছু দেব আমার সাধ্য কী! তবু,একজনের যে জোটায়, দুজনেরও সেইই জোটায়।
শান্ত হয়ে মাথায় হাত বোলাতে চেয়ে ডাল নামিয়ে দেয় বুড়ি পেত্নী।তার লোলচর্ম,কোটরগ্রস্ত চোখ,কর্মক্ষমতাহীন অপেক্ষা,আর হাহাকার,খেতে দে,খেতে দে- শুনতে পাই।
এই মায়াদুনিয়ায় সমস্ত অশরীরীরা এভাবেই হাত বাড়িয়ে থাকে,খেতে দিবি? খেতে দে…
আমি গ্রাম পেরিয়ে এসে দাঁড়াই। পিছনে কচুরবনে শিয়াল আসে,সন্ধ্যা হয়ে আসে তো। আমাকে হাঁটতে হবে আরও অনেকটা। সামনে আল বেয়ে নেমে যাই।
সন্ধ্যে বুকের উপর চেপে বসে। হিসাব করি,কত হল দিন? কত গেল দিন?
ওপাড়ের ঘনবনরাশির ভেতর থেকে কে যেন হাত বাড়িয়ে থাকে,আয় আয়।
আজ প্রতিপদ। এবার ধীরে ধীরে জ্যোৎস্নার দুধে ধুয়ে যাবে মাঠ ঘাট জীবন। গোখরো পথ কেটে চলে যাবে চুপে। আমায় হাঁটতে হবে আরও খানিক পথ।ঘরে ফিরতে হবে।
এসব ভাবি,বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে। চোখের সামনে মেলা থাকে ভাবলেশহীন ছাদ।তার পলেস্তারা খসে পড়তে চায় চোখের জলের মত।
বাইরে তখন রাতের কালোয় মিশে যাচ্ছে দুটো জগত। একে একে জ্বলে ওঠে রাস্তার আলো।
সমস্ত কুসুম সরিয়ে একটুকরো বাক্সজীবন ভেসে ওঠে মরা মাছের চোখের মত। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে হিসাবের সাপ। জিভ লকলকায়। পাক দিয়ে একখানা খোঁপা বেঁধে ফেলি চুলে। নেমে আসি মেটে রঙ শাড়ি ছেড়ে। সন্ধ্যার শাঁখ বেজে ওঠে,জলছড়া দিই দুয়ারে দুয়ারে। জলে চায়ের পাতা ফেলে ভাবি,বড় স্বাদ এই অবোধকালের।
জানলার বাইরে আলপথ দিয়ে তখন বোষ্টুমি হেঁটে চলে যায়। তার ঝোলায় মায়ার মেয়েরা ভরে দিয়েছে চাল। রাতে দুটো ফুটিয়ে খাবে। এখনও অনেকটা হাঁটতে হবে তাকে। দূরে জ্বলে থাকে তার সেই ঘরের আলো।ওই যে…
কিন্তু,এসব কথা কি বলা যায়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র