সুমন মহান্তি

মায়াজম
3

                                    তারা খসে পড়ে





নামী বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি আছে মোহন। পেটে প্রচন্ড ব্যথা,ঘন ঘন হেঁচকি ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে দু’দিন আগে এখানে ভর্তি হয়েছে সে। লিভার সিরোসিস হয়েছে ছ’মাস আগে, তবু মোটের ওপর ভালোই ছিল। আজ ঘন ঘন বমির দমকে মোহন নেতিয়ে পড়ল। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল সব বমির সঙ্গে বেরিয়ে আসতেই মোহনের নাকে রাইস টিউব লাগানো হল। পরপর দুটি ইঞ্জেকশন দেওয়া হল তাকে। ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরেই ঝিমিয়ে পড়ল মোহন। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না, চোখ খুলে সে শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ডানহাতের শিরায় স্যালাইনের ছুঁচ ঢোকানো, ফুলে উঠেছে তা। ঐ অবস্থাতেই সে ডানহাত দিয়ে গালে হাত বোলাল।
কেয়া ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে, “ দাড়ি কাটাতে চাও?’’
মোহন মাথা অল্প নাড়ে।
কেয়া হেসে বলে, “ আচ্ছা। অবস্থা একটু ভালো হোক। আমি বলেকয়ে বন্দোবস্ত করে দেব।”
মোহন চোখ বন্ধ করে দেয়। তার মনে হচ্ছে, এবার সে কোমাতে চলে যাবে। কোমায় যাওয়া রোগীর কি দাড়ি কাটা যায়? কোমা মানে সংজ্ঞাহীন অবস্থা, সেই অচেতন অবস্থা থেকে সে আর এই চেতনার জগতে না ফিরতেও পারে। সেই অবস্থায় মরে গেলে ছবিটা খুব বিচ্ছিরি দেখাবে। একগাল পাকা দাড়ি, হাঁ-করা মুখ, চোখে ভয় এমন অবস্থা নিয়ে মরে গেলে তার শেষ ছবিটা ভয়ানক বাজে হবে। তার চেয়ে মুখে হাসি থাকুক, কামানো সবুজ গালের আভা ফুটে উঠুক, ঠোঁটে প্রশান্তি লেখা থাকুক। কোমা স্টেজ থেকে মৃত্যুর দিকে চলে গেলে মুখে প্রশান্ত হাসি কীভাবে থাকবে তার? না, না, কোমাতে সে যাবে না। এই অবস্থাতেই মরতে চায়, শেষ মুহুর্তে মুখে হাসি ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টাটা অন্তত করা যাবে। ফুলের মালায় ঢাকা প্রসিদ্ধ গায়ক মোহন মন্ডলের ছবি দেখাবে টিভি-তে, কাগজে বেরোবে। লেখা হবে, শেষযাত্রার সময়েও তাঁর মুখে ছিল এক স্নিগ্ধ প্রশান্ত হাসি। শিল্পীর কখনো মৃত্যু হয় না, নশ্বর দেহটার মৃত্যু হয় শুধু। তিনি তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে অমর থাকবেন।
কেমন এক নেশায় আচ্ছন্ন লাগছে এখন। মোহনের ভয় হল। কোমায় চলে যাবার মুহুর্ত কি এগিয়ে আসছে তাহলে?
কেউ যেন তাকে ফিসফিস করে গালাগাল দিল, “ শালা উজবুক, এখনো লোভ তোর? ক্যামেরার ফ্ল্যাশের লোভ করছিস এই অবস্থায়? সারাজীবন যশের লোভেই তো দৌড়ে গেলি। তোকে দেখে আমার করুণা হচ্ছে, হাসি পাচ্ছে।’’
মোহনের কানে অট্টহাসি ভীষণ শব্দে ফেটে পড়ল। সে ছটফট করল, কেঁপে উঠল তার শরীর। লিরিকস, গান, রেকর্ডিং স্টুডিয়ো, প্লে-ব্যাক, স্টেজ শো, রিয়েলিটি শো, রয়্যালটি ইত্যাদি শব্দ তার মাথার মধ্যে ক্রমাগত হাতুড়ি পিটিয়ে চলছিল। মোহন শুনতে পেল, কোনও এক টিভি চ্যানেলে বিশেষ প্রোগ্র্যাম চলছে। মোহন মন্ডলের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে। ঘোষিকা ললিত কন্ঠে বলছেন—আমরা জানি যে বিখ্যাত গায়ক মোহন মন্ডল তিনবছর আগে এই দিনটিতে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। গানে আর কথায় এই সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে তাঁকে আমরা স্মরণ করব আজ।
#
হচ্ছেটা কী এসব? হাসপাতালের বেডে নাকে রাইস-টিউব, হাতে স্যালাইন, চার-পাঁচটা ইঞ্জেকশন নিয়ে আমি কোমার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছি। মৃত্যু অনেক পরের ঘটনা, কোমা স্টেজেই যেতে চাই না। এদিকে আমার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হচ্ছে টিভি-তে?
টিভি চ্যানেলে সরাসরি ফোন করে জানতে চাইলাম, “ এসব হচ্ছেটা কী?’’
“ আপনি কে বলছেন?’’
“ মোহন মন্ডল।’’
“ কোন মোহন মন্ডল?’’
“ মজা হচ্ছে? টিভিতে অনুষ্ঠান চলছে আমাকে নিয়ে আর বলছেন কোন মোহন মন্ডল? জীবন্ত মানুষকে নিয়ে ছ্যাঁচড়ামো হচ্ছে?’’ রাগে আমার নাকের পাটা ফুলে উঠছিল।
“ মোহন মন্ডল পৃথিবীতে একজনের নাম শুধু? আপনি কোথাও ভুল করছেন। বিশিষ্ট গায়ক মোহন মন্ডল তিনবছর আগে মারা গিয়েছেন।”
“ মারা গিয়েছেন? এ কেমন রসিকতা আপনাদের? জানেন, এখন আমি হাসপাতালে মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি?’’
“ তাই? শুনুন, রোগী কখনো লড়ে না। ওটা ডাহা মিথ্যে। আসলে ডক্টর আর নার্সরা লড়াইটা করে যান। আপনি কি হসপিটালের বেড থেকেই ফোন করছেন এখানে?’’
“ ইয়েস।’’
“ গেট ওয়েল সুন।’’
“ শুনুন, শুনুন, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন একবার, ” মরিয়া হয়ে বলি, “ মোহন মন্ডল তিনবছর আগে মারা গিয়েছেন! এতবড় মিথ্যাটা পেলেন কোথায়? কে বলল আপনাদের?’’
ওপাশ থেকে শীতল, নিস্পৃহ গলায় উত্তর আসে, “ কোনো মিথ্যে নেই এর মধ্যে। গায়ক মোহন মন্ডল লিভার সিরোসিসে মারা গিয়েছেন আগেই। খুব করুণ মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। শত বারণ উপেক্ষা করে তিনি গলা অব্দি মদ্যপান করে ফুটপাতে পড়েছিলেন। একেবারে অচেতন অবস্থা। ওই অবস্থাতেই তিনি মারা যান। আমরা তাঁর সম্মানের কথা মাথায় রেখে পাবলিককে তা জানাইনি। বলেছি, ঘুমের মধ্যেই তাঁর ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যায়। বুঝেছেন?’’
“ এ হতেই পারে না,” মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ করি।
ওদিকে এখন কেউ আর নেই। পরপর তিনবার চেষ্টা করেও লাভ হল না। রিং হয়ে গেলেও কেউ ধরল না আর।
চোখ খুলে কেয়াকে দেখতে পেলাম। বেডের পাশে টুলে বসে আছে। একজন ডক্টর এসেছেন, খুঁটিয়ে সমস্তকিছু দেখে বললেন, “ সিস্টার, অক্সিজেন চালু করে দিন।’’
ডক্টর চলে গেলে কেয়া গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ এখন কেমন লাগছে?’’
আনুনাসিক স্বর বেরোল গলা দিয়ে, “ ভালো।’’
“ ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে,” কেয়ার ঠোঁটে হালকা হাসি।
ডানহাতের আঙুল তুলে নাক ছুঁয়ে চিঁ-চিঁ করে মোহন, “ রাঁইঁস টিঁউঁব।’’
“ কিছু পেটে থাকছে না। বমি হয়ে যাচ্ছে। রাইস-টিউব না থাকলে পেটে কিছু যাবে কীভাবে?’’
“ অঁ।’’
#
আনুনাসিক স্বর যেন আমাকে একটানা ব্যঙ্গ করে যাচ্ছিল। আহা, এই সুমধুর কন্ঠ নিয়ে কত গর্ব ছিল! আমার নাম-যশ- অর্থ সমস্তকিছুই দিয়েছে এই গলা। বয়স হলে গলা আগের মতো থাকে না কিন্তু আমার বয়স তো সবে বাহান্ন। এই সময়েই তো তা চরম উৎকর্ষে পৌঁছতে পারত। গানের ব্যাকরণ তেমন জানতাম না, প্রথাগত গানের শিক্ষাও ছিল না। তবু এই সুকণ্ঠ আমাকে একটা জায়গা অব্দি নিয়ে আসতে পেরেছিল। তারপর গানের তালিম নিয়ে তাল-লয়-ছন্দ ইত্যাদির ব্যাকরণ শিখেছি। প্রথম যেদিন টিভি-র একটি চ্যানেলের জন্য গান রেকর্ড করি, প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ হাত ধরে ঝাঁকিয়েছিলেন, “ আপনার গলায় কী একটা আছে। সেটা যে কী তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। আপনি অনেকদূর যাবেন।’’
উনিশ বছর বয়সে প্রথম কোনও বড় অনুষ্ঠানে গাই। শাসকদলের এক গণসংগঠনে নাম লিখিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম গ্রুপে গনসংগীত গাইতাম। এক সভায় প্রচন্ড ভীড়, মিটিং তখনো শুরু হয়নি, মাঠে লোক পিলপিল করছে। বিপ্লবদা আমাকে ঠেলে মঞ্চে তুলে দিল, “ কিছু একটা গা। ভীড় শান্ত হোক।’’
দোতারাটা আমার সঙ্গেই থাকত সবসময়। মঞ্চে উঠে দো্তারা বাজিয়ে একটার পর একটা লোকগীতি গাইতে শুরু করলাম। দেখলাম ভীড় কোলাহল থামিয়ে গান শুনছে, বিরক্ত হচ্ছে না, পরপর চারটা গান শুনিয়ে মঞ্চ থেকে নামার সময়ে প্রবল হাততালি জুটল।
মঞ্চ থেকে উচ্ছ্বসিত মনে নেমে গেলেও উত্থান আসলে শুরু হল। দলের বড় বড় সমাবেশে গান গাইবার ডাক আসতে লাগল। গণসংগীতে গলা মেলানো ছেড়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানে লোকগীতি এককভাবে গাইছি। কলকাতার যুবছাত্র সমাবেশ হল নেতাজি ইন্দোর স্টেডিয়ামে। হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রাণ উজাড় করে গাইলাম। মাসখানেক পরেই টিভি-তে গান গাওয়ার সুযোগ এসে গেল। আমার গানের সঙ্গে ‘মাটির মূর্ছনা’ আছে, ‘গ্রামজীবনের সহজ সুর’ আছে, ‘ প্রান্তিক মানুষের ঘ্রাণ’ পাওয়া যায় । এমন অনেক প্রশংসা আর বাহবা জুটছিল বিভিন্ন কাগজে-চ্যানেলে। তখন ক্যাসেটের যুগ ছিল। প্রথম ক্যাসেট প্লাটিনাম ডিস্ক-এর সাফল্য পেল, দ্বিতীয় ক্যাসেট গোল্ডেন ডিস্ক। রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকে, গ্রামগঞ্জ থেকে অনুষ্ঠানের ডাক আসতে আরম্ভ হল। কলেজ-ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামেও ভালোই চাহিদা ছিল আমার। ততদিনে আমি সাফল্যের সহজ অঙ্ক বুঝে গিয়েছি। বাবা লোকগীতি গাইতেন, গ্রামেগঞ্জের মেলায়, ওর বেশি এগোতে পারেননি। তাঁর ধারা পেয়েছিলাম। গলায় সহজেই লোকগীতি খেলা করত, দরদ আর প্রাণ দিয়ে গাইতাম, গানের শিক্ষা সেভাবে ছিল না। তা যে আমাকে খ্যাতি দেবে কখনো ভাবিনি।
বাবার গান শহর অব্দি পৌঁছয়নি, তাই অবহেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। বাবার স্বকীয়তার কাছে আমি আসলে কিছুই নই। শহুরে শিক্ষিত লোকজনের কাছে লোকগীতি হল একটা ফ্যাশন, একরকম শখ। মাটির কাছাকাছি থাকার একরকম দেখনদারি। বাবার গাওয়া গানগুলিকে আধুনিক পালিশ দিলাম, জ্যাজ-সিন্থেসাইজার-ড্রাম-গিটার ইত্যাদি যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র মিশিয়ে পরিবেশন করা শুরু করলাম। পাবলিক ছন্দ চায়, নাচের তাল খোঁজে, তাদের মর্জিমাফিক গানগুলো ভেঙেচুরে গাইতে লাগলাম। প্লে-ব্যাকের সুযোগ এল। দুটো সিনেমায় মোট তিনটি গান, তিনটিই সুপারহিট, লোকের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজতে লাগল। আরও উঁচুতে উঠে গেলাম। নতুন খেলা শিখলাম- ‘ ফিউশন’। ওয়েস্টার্ন মিউজিকে লোকগীতি, পাবলিক ‘ফিউশন’ খেল, আমার স্টেজ-প্রোগ্রামের, প্লে-ব্যাকের রেট বাড়ল। ক্যাসেট অচল হয়ে বাজারে এসেছে সিডি। প্রথম সিডি বেরোল, তেমন চলল না। নাহ, লোকগীতির স্টক ফুরিয়ে যাচ্ছে, কত আর নতুন লোকগীতি তৈরি হবে, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ওই ঘরানার গীতিকার নেই বললেই চলে। সিনেমাতে লোকগীতি ব্যবহার আর হচ্ছে না, আমিও প্লে-ব্যাক করার ডাক পাচ্ছি না। গান শিখতে শুরু করলাম, একেবারে প্রথাগত শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, তা মন দিয়ে একবছর শিখলাম। পথ বদলানোর আগে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।
বিবাহিত জীবন বারো বছর পেরিয়েছে, একমাত্র ছেলে ধ্রুব দশে পা দিয়েছে। কেয়া বর্ধমানের মেয়ে, কলকাতার এক কলেজে পড়ায়, একটি অনুষ্ঠানে আলাপ, আলাপের সূত্র ধরে প্রেম এবং বিয়ে। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত আবাসনে হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট, স্বচ্ছল নাগরিক জীবন, ভেন্টিলেটর দিয়েও গ্রামজীবনের ধূলোমাটি ঢোকার উপায় নেই। দুখানা ক্যাসেট এবং প্লে-ব্যাক গানের সাফল্যের পরেই জীবনে সুরা এসেছে। পরিমিত পান করি, তবে প্রোগ্রামে স্টেজে ওঠার আগে বেশ কয়েক পেগ না চড়ালে মুড আসে না। আশেপাশে অসংখ্য বন্ধু, তাদের সঙ্গে ফুর্তি করি, মদ্যপান চলে, গভীর রাতে বাড়ি ফিরি। কেয়া দরজা খুলে দেয়। আশ্চর্য নারী, তা নিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করে না, তিরস্কার-ঝগড়া কিছুই হয় না। সকালে শান্তভাবে শুধু বলে, “ যা করছ করো। গানটা যেন বেঁচে থাকে।’’
#
প্লে-ব্যাকের জগতে তবু সুযোগ মিলল না। তদ্দিনে বাংলা সিনেমায় দক্ষিণী সিনেমার রিমেকের ঢেউ এসেছে, অবাঙালি প্রোডিউসার, চ্যাংড়া নাচগান, তাতে অবাঙালি গায়কেরা আধভাঙা বাংলায় গান করে। প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় শিল্পীরা সুযোগ পায় না, দরকার পড়লে বলিউডের নামী বাঙালি গায়ক-গায়িকাদের দিয়ে গান গাওয়ায়। ফ্রাস্ট্রেটেড বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু হলাম না। যুগের হাওয়া বুঝে বাংলা গানের ব্যান্ড খুললাম। নাম দিলাম ‘সহজিয়া’। পাশ্চাত্য গানের ব্যান্ডের গায়কদের জীবন মনে ধরল। উদ্দাম,বেপরোয়া একটা ইমেক বানাতে হবে আমাকে। গাঁজা, চরস ধরলাম। ব্যান্ডের বাকিদেরও ধরালাম। হাল্কা ক্লাসিকাল, মাঝেমধ্যে দু-তিন লাইন ফোক-সং ফ্লেভার,ওয়েস্টার্ন রকের আদলে তিন-চার লাইন, তারসঙ্গে গিটার,হেভিমেটাল আর জ্যাজ। ঠিকঠাক মাত্রায় মেশানো এই ককটেল বাজারে জমে গেল। ব্যান্ডের সুনাম আর চাহিদা বাড়ল, গুঞ্জন শুরু হল যে মোহন মন্ডল নেশাভাঙ করে স্টেজে গান। কিছু ভদ্রলোক নাক সিঁটকে সমালোচনা করলেও তা শাপে বর হল। কলেজ-ইউনিভার্সিটি-ক্লাবের প্রোগ্রামে ডাক আসতে শুরু হল আবার, ডেট দিতে হিমশিম খাই। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা উদ্দামতা চায়, বাঁধনছাড়া কিছু চায়, গাঁজায় টান মেরে তাদের চাহিদা মেটাই প্রোগ্রামে।
বেশ একটা সিস্টেম-বিরোধী,প্রতিবাদী ইমেজ তৈরি হয়ে গেল আমার ব্যান্ডের। ব্যান্ডে দুজন তরুণীও ছিল, তাদের বিছানায় পেতে দেরি হল না। আলট্রামডার্ন মেয়ে, কোনো ট্যাবুতে বিশ্বাস করে না, সেক্সের ব্যাপারে তারা সহজ এবং খোলামেলা। গাঁজা,চরস, মদ তো ছিলই, এবার নারীতে আসক্তি বাড়ল। প্রোগ্রাম করতে কোথাও দূরে গেলেই প্রায়ই রাতের সঙ্গিনী জুটে যেত। কেয়া বোধহয় কিছু বুঝেছিল। সে আমার সঙ্গে এক বিছানায় শোওয়া বন্ধ করে দিল। মুখে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। ব্যান্ডের দুজন মেয়ে তো আছেই, দরকার হলে কলগার্ল আছে। যৌন চাহিদা ঘরের বাইরেই মিটে যাচ্ছে। শুধু কী আর চাহিদা, এর আনন্দই অন্যরকম, বিচিত্র স্বাদে ভরপুর। তাছাড়া নিত্যনতুন মেয়েদের সঙ্গে না শুলে আমার গানে ভ্যারিয়েশন আসবে না। বেপরোয়া বোহেমিয়ান এই আমাকেই পাবলিক পছন্দ করে। মুখভর্তি দাড়ি রেখেছি, ঘাড় অব্দি অগোছালো চুল, হাতে বালা। আমার ব্র্যান্ডের ছেলেরা পরে সাদা পাঞ্জাবি আর ফাটা জিনস, মেয়েরা সাদা টপ আর তাপ্পিমারা জিনস পরে সমানে উদ্দামতায় পাল্লা দেয়।
বেশ চলছিল। ধুমকেতুর মতো বাজারে উঠে এল ‘ দোতারা’ ব্যান্ড। মূলত লোকগীতি বেসড গান, সঙ্গে কিছু রবীন্দ্রসংগীত আর অতুলপ্রসাদের গান। এতেই বাজার মাত করে দিল ‘দোতারা’। আমাদের চাহিদা শেয়ার-মার্কেটের গতিতে তুঙ্গে উঠেছিল, পড়তেও বেশি সময় লাগল না। আমারই অস্ত্রে নতুন ব্যান্ড আমাকে ঘায়েল করে দিল। একসময় আমার গানের প্রশংসায় যা বলা হত, ঠিক তেমন বিশেষণ পেতে লাগল ‘দোতারা’। বলা হল যে এই নতুন ব্যান্ডের মধ্যে মাটির সোঁদাগন্ধ আছে, সুস্থ সংস্কৃতি ফিরিয়ে এনেছে এই ব্যান্ড। ব্যান্ডের নামে চিরায়ত বাংলা গানের আদ্যশ্রাদ্ধ করা, উচ্ছন্নে যাবার অন্ধকার সুড়ঙ্গ দেখানো,হিপি কালচারের আমদানি করা ব্যান্ড নয় এটা। তির যে আমাদের ব্যান্ড-কে লক্ষ্য করে ছোঁড়া তা বুঝতে দেরি হল না।
সেই সমালোচকের সঙ্গে এক পার্টিতে দেখা হল। পাঁচ পেগে টালমাটাল আমি, দেখামাত্রই খিস্তি দিয়ে কথা শুরু করলাম।
“ সোহম রায়গুপ্ত! বিশিষ্ট সমালোচক। তা আমার পেছনে লেগেছেন কেন? ঢ্যামনামো হচ্ছে?’’
“ যা সত্যি তাই লিখেছি। এতে জ্বলে যাওয়ার কিছু নেই। সমালোচনা নিতে শিখুন।”
“ সতীপনা দেখানো হচ্ছে? কত টাকা খেয়েছেন ওদের কাছে? পেইড রিভিউ লিখে মাইলেজ দিচ্ছেন! আমাকে বাঁশ দেওয়ার মতলব হল কেন গাড়োল?’’
সোহম রাগলেন না। শান্ত স্বরে বললেন, “ আপনি এখন প্রকৃতিস্থ নেই। তাই কিছু মনে করছি না। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। মদ,গাঁজা,চরস টেনে টেনে আপনার গলায় কিছু নেই। গলা দিয়ে বিকৃত স্বর বেরোয়। চড়া বাদ্যযন্ত্র আর কোরাসে ওটা চাপা পড়ে যায়। আপনার ইউ এস পি ছিল সুন্দর মিষ্টি গলা আর আবেগ। নিজে একটা মৌলিক গান গেয়ে দেখাতে পারবেন? ভালো লাগলে এই আমিই অকুন্ঠ প্রশংসায় ভরিয়ে দেব, বুঝেছেন?’’
আমি নির্বাক, নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরোল না। সোহম রায়গুপ্ত মৃদু হেসে বললেন, “ চ্যালেঞ্জটা নিয়ে আমাকে ভুল প্রমাণিত করতে পারলে খুব খুশি হব।’’
#
ক্যাসেটের পর সিডির চল হয়েছিল, সিডি অচল হয়ে এল ইউ টিউব। প্লে-ব্যাকে সুযোগ পাব না, অ্যালবাম করার যুগ আর নেই। মরিয়া হয়ে একটা গান রেকর্ড করে ইউ টিউবে আপলোড করে দিলাম।
ভেবেছিলাম প্রশংসায় ভরে যাবে কমেন্টবক্স। খুব পরিচিত কয়েকজন বাহবা দিলেও কটুক্তিই বেশি। কেউ লিখেছে- এই কি সেই মোহন মন্ডল? মনে হয় না। যার গলার জাদুতে আচ্ছন্ন হতাম একসময় সে এই মোহন
নয়।
কেউ লিখল—এর চেয়ে বাথরূম সং শোনা ভালো।
-- গলা না ফাটা কাঁসরের শব্দ?
-- সুর নেই। গলা বসে গেছে।
-- উনি গান গাইতে ভুলে গেছেন। এখন উনি গানম্যান। যা শুনলে পাড়ার কুকুর ক্ষেপে যায়।
-- ওনাকে ওই উৎকট আওয়াজেই মানায়। সোলো সং গাইবার মুরোদ নেই বলে ব্যান্ড খুলেছেন।
-- নিজেই তো গানের ব্যান্ড বাজিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে।
-- নেশাভাঙ করে গান হয় না। ওটার জন্য সাধনা লাগে।
-- গাঁজায় টান মেরে গান গাওয়ার শখ কেন রে?
ফাঁদে পড়ে চরম বোকামো করে ফেলেছি। সোহম ঠিকই ধরেছিলেন। আমার বেসুরো গলা পাবলিকের কাছে ধরা পড়ে গেছে। লোকসংগীতই গেয়েছিলাম, কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটার খুব অভাব। রেকর্ডিং্যের সময় বুঝতে পারিনি নাকি বুঝতে চাইনি? চর্চাটাই তো নেই, এ-গান সে-গান খুবলে জোড়াতালি আর চটুল রিদম বানাতে ব্যস্ত ছিলাম। ব্যান্ড ভেঙে গেল, দুটি ছেলে নিজেরা অন্য নামের ব্যান্ড খুলল। যে দুজন তরুণী ছিল আকর্ষণ, তাদের একজন বিয়ের পর স্পেনে চলে গেছে, আর একজন যৌন হেনস্থার অভিযোগে ব্ল্যাকমেল করে লাখ দশ নিয়ে ব্যান্ড ছেড়ে দিল।
এবার নিয়মিত রাতে ঠিক সময়ে ঘরে ফেরা শুরু হল। অবশ্য বাইরে বেশি আর থাকিই না, হাতে কাজ নেই, প্রোগ্রামের ডাক আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কেয়ার কাছে রাতে গেলে মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, “ কতজনের সঙ্গে শুয়েছ কে জানে? ক’জনের নাম আর জানি আমি?এখন সব দরজা বন্ধ হতেই মনে পড়েছে। আমার প্রয়োজন অনেক আগেই ফুরিয়েছে।’’
নিজেকে কেমন যেন নগ্ন মনে হচ্ছিল। তবু ম্লানমুখে বললাম, “ তা হতে পারে না। আবার সব ফেরানো যায়।”
নাইট-ল্যাম্পের আলোতে কেয়াকে দূরতম কোনো প্রবাসের নারী মনে হচ্ছিল। চোয়াল কঠিন করে বলল, “ যে মোহনকে আমি ভালোবাসতাম সে তিন বছর আগেই মারা গিয়েছে। অনেক দোষ মেনে নিয়েও ভেবেছিলাম তার গানটা অন্তত বেঁচে থাকবে। ধৈর্য রেখে সেই প্রতীক্ষাতেই ছিলাম। এখন গান মরে গেছে, সে-ও আর বেঁচে নেই।’’
আমারও বেঁচে থাকার আর কোনো ইচ্ছে ছিল না। গান গাইতে পারি না, অত্যাচারে গলা নষ্ট হয়ে গেছে। কী লাভ আর এভাবে বেঁচে থেকে? ধ্রুব আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে, চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট ঘৃণা দেখি তার। নাগপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, ফোর্থ ইয়ার চলছে। লজ্জায় তার সঙ্গেও সহজভাবে কথা বলতে পারি না। বড় হয়েছে, আমার উদ্দাম যৌনাচার আর বিশৃঙ্খল জীবনযাত্রার খবর নিশ্চয়ই সে জানে। গাঁজা, চরস, সিগারেট ছেড়ে দিলাম। শুধু মদ ছাড়তে পারলাম না, হতাশা আর নিঃসঙ্গতার একমাত্র অবলম্বন হল ওটা। লিভার সিরোসিস ধরা পড়ল। শূন্য থেকে শুরু করে ঘুরেফিরে সেই শূন্যেই ফিরে গিয়েছি শেষমেশ। এক রাতে মুঠো মুঠো স্লিপিং পিল খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার চেষ্টা করি। তা-ও হল না। নার্সিংহোমে চোখ খুলে দেখলাম কেয়া পাশে বসে আছে। হাত ধরে বলল, “ আমার কথা একবারও ভাবলে না?’’
কেয়া শারীরিকভাবে ফিরে না এলেও কত দীর্ঘ দিন আর রাতের ক্লান্ত অপেক্ষার পরে ফিরে এসেছিল। আত্মহত্যার প্রয়াস খবর হয়নি। অবশ্য আমার ব্যাপারে মিডিয়ার আগ্রহ রাখে না আর।
মদ্যপান একেবারে কমিয়ে দিয়েছিলাম। মাঝেসাঝে পরিমিত মাত্রায় খেতাম, সিন্থেসাইজার নিয়ে বসতাম। হঠাৎ
এক নামী পরিচালকের ফোন পেলাম। তিনি তাঁর নতুন সিনেমার জন্য আমার গলায় একটি গান রাখতে চান। রেকর্ডিং হয়ে গিয়েছে, সুরকার খুশি, গানটা নাকি তাঁর মনের মতো গাইতে পেরেছি।
সিনেমা রিলিজ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে যে বেঁচে থাকতেই হবে। দেখতে দেখতে আমি পৌঁছে গেলাম এক শীর্ণ খালের ধারে, বকেরা উড়ে বেড়াচ্ছে, চারপাশে ঘন সবুজ ঘাস, একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে ফুলে আগুনরঙা হয়ে আছে। নিঝুম দুপুর ফুরিয়ে বিকেল নামছে, মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে নাকে, গরু চরাতে আসা একটি কিশোর আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। তাকে বলি, “একটা গান গাইব। তুমি বাঁশিতে সঙ্গত করবে?’’
কিশোরটি হেসে আমার দিকে তাকাতেই চমকে উঠি। এ যে অবিকল আমার মুখ। নিষ্পাপ, সরল মুখখানি পরম বিস্ময়ে চেয়ে আছে। বলছে, “ গান? কবে ফুরিয়ে গেছে সমস্ত গান। তোমার গান আর আছে?’’
“ তাহলে?’’
“ চুপচাপ বাঁশি শুনে যাও। শান্ত হয়ে বোসো। সারাজীবন তো নিজেকে ভালোবেসেই কাটালে। গান আর তেমন ভালোবাসতে পারলে কই?’’
“ আমাকে ভালো করে দাও। একটিবার আবার আগের মতো গান গাইতে চাই। বাতাসে উড়তে উড়তে সে সুর পৌঁছে যাবে আমার ভিটায়। তুলসিমঞ্চের কাছে সন্ধ্যা নামবে, প্রদীপ জ্বলে উঠবে, বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলবে, এসেছিস টোকন? দোতারা হাতে ধুলো মেখে পথে পথে গান গেয়ে বেড়াতে চাই একবার। তুমি মুরলীধর, সব জানো, একবার অন্তত ফিরে যেতে দাও।’’
“ তা হতে পারে না। ইহজগতে তোর ভূমিকা শেষ। তোর গলা আর কোথাও পৌঁছবে না, নিজেকে শেষ করে দিয়েছিস তুই।”
“বিশ্বাস করো, এবার বেঁচে উঠে বাঁচার মতো বাঁচব। এই দুর্বল গলা দিয়েই সুন্দরের জয়গান করব, তার পাশে বসে থাকব। নষ্টজীবন ভুলে নিজেই নিজের স্বরে মুগ্ধ হতে চাই আবার। শ্রোতা চাই না, আলো ঝলমল মঞ্চ চাই না, শুধু প্রাণভরে কেয়া আর ধ্রুবকে গান শোনাতে চাই।’’
“ মুক্তি কি এতই সহজ? তার চেয়ে তোকে এই জীবন থেকেই বরাবরের মতো মুক্তি দিলে কেমন হয়?’’
#
মোহন জেগে উঠে চোখ মেলে তাকাল। সে স্বপ্ন দেখছিল? ঘোর অসুস্থ মানুষও তাহলে স্বপ্ন দেখে? ওপারে যাওয়ার আগে নাকি বিভ্রম হয়, কতকিছু দেখতে পায় মানুষ শেষমুহুর্তে। তার কি সময় হয়ে এল তাহলে? মোহন আঙুল বাড়িয়ে কেয়ার হাত খুঁজতে লাগল। তার খুব ভয় করছে। এখনো যে অনেক বাকি। জীবনের শেষ রেকর্ড করা গান কেমন সাড়া ফেলে তা সে দেখতে চায়। আর সে কখনো গান রেকর্ড করবে না, মঞ্চে গাইবে না। ঐ শেষ গানটায় যে সে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে!
কেয়া হাসল, “ অনেকক্ষণ ঘুমোলে। ঘুমের মধ্যে ঠোঁট নড়ছিল। স্বপ্ন দেখছিলে?’’
“উঁ।’’
“ কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’’
মোহনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। রাইস-টিউব খুলে দিয়ে গেল নার্স। মোহন অপলক চোখে তাকিয়ে রইল।
“ বললে না? কারও সঙ্গে কথা বলছিলে?’’
“ শ্যাম।”
“ শ্যাম?’’ কেয়া অবাক হয়ে তাকাল।
“হ্যাঁ গো, শ্যামসুন্দর এসেছিলেন। তাঁর কাছে সুন্দরের ভিক্ষা চাইলাম। দিলেন না,’’ ক্ষীণ কাঁপা গলায় বলল মোহন।
“ কী বলছ তুমি?’’ উদভ্রান্ত কেয়া চিৎকার করে ওঠে।
মোহনের দু’চোখ জুড়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আদিগন্ত শ্যামল অন্ধকার, ঘন বৃষ্টিতে নদীর দুধারের সবুজ অন্ধকার হয়ে যায়। যেভাবে ছেলেবেলায় ‘ আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ গান গাইত, সেভাবেই কোনো অতল জলের আহ্বানে ঠোঁট বেয়ে সুর ভেসে আসে। প্রাণের গভীর থেকে শ্বাসনালী বেয়ে উঠে আসছে সহজ স্বর।
মোহন বুঝতে পারল না, সে কোথায় যাচ্ছে। কোমায় না কোনো চিরন্তন ঘুমের দেশে? সে যেন গাঙচিল হয়ে সে উড়ে যাচ্ছে দূরে। উড়তে উড়তে কাশফুলে ভরা চরে নেমে এসে সে কেয়াকে খুঁজছিল।
কেয়া দেখল, মোহন আস্তে আস্তে আঙুলের বন্ধন ছেড়ে দিচ্ছে।
সে কাঁদল না। মোহনের ঠান্ডা কপালে হাত বুলিয়ে দিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন