হিন্দোল ভট্টাচার্য - মায়াজম

Breaking

২২ অক্টো, ২০২০

হিন্দোল ভট্টাচার্য

                                                              

তক্ষক






কাপটা টেবিলে রাখার সময়েই নাসির টের পেল এই ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেছে। এমন অনেকবারই তার মনে হয়। কিন্তু নাসির কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না, একই ঘটনা আগে কখনও ঘটতে পারে। এমনকী অন্য কোনও নাসির অন্য কোনও সময়ে এই একইরকম একটা ঘরে অন্য কোনও একটা ভাবে যে জীবন কাটাচ্ছে, এই অদ্ভুত সায়েন্স ফিকশন তার কাছে আধুনিক রূপকথা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।


তার কাছে বরং গুরুত্বপূর্ণ লাগে, ওই যে পোকাটা জলের উপর পড়ে ছটফট করছে, তা নিশ্চয় আগে কখনও ঘটেনি, এই বিষয়টিই। কারণ সেই পোকাটির মৃত্যুযন্ত্রণা, জলের মধ্যে পড়ে শ্বাস নিতে না পারা বা ক্রমশ ডুবে যাওয়ার ঘটনাটি ওই পোকাটির জীবনে এই মাত্র ঘটল এবং যদি এই সময়টিকে শুধুমাত্র নাসিরের জীবনের সময় হিসেবে ভাবা না হয়, ওই পোকাটির জীবনের সময় হিসেবেও ভাবা হয়, তাহলে ওই মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে বাস্তব আর কিছুই নেই, ওই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুহূর্তের চেয়ে বাস্তব আর কিছুই নেই, কারণ এই মুহূর্তেই একটি জীবন জলের উপরে পড়ে আছে, ক্রমশ ডুবছে এবং এই ঘটনাটি আর পৃথিবীর কোনও সময়েই কোথাও ঘটছে না, ঘটবেও না আবার, এবং নাসির নিশ্চিত, আগেও কখনও ঘটেনি।


কিন্তু জলের উপর একটা পোকা ঠিক কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে? নাসির টেবিলের উপরে রাখা কাপটার কাছে গেল, দেখল পোকাটি সত্যিই এখনও ছটফট করছে। অর্থাৎ বাঁচার চেষ্টা করছে। পোকাটি দেখতে ঠিক একটি পোকারই মতো। অনেকটা শ্যামাপোকাগুলির মতো। একটু লম্বাটে। কালো। ছোট ছোট করে ছটি পা। দুটি শুঁড়। পেটের দিকটা অনেকটা আরশোলার মতো। দুটি ডানাও আছে। কিন্তু ভিজে কেমন অসুস্থ হয়ে আছে। হয়তো শক্তিহীন। আর জলের উপর উলটো হয়ে পড়ে থাকায়, পোকাটি আর একবার জীবনে সোজা হতে পারবে কিনা সন্দেহ। কাপটার আরও কাছে মুখটা নিয়ে গেল নাসির। ছটফটানি কি একটু কমছে? পোকাটা জলে ভাসছে। নাসির চাইলেই পোকাটিকে তুলে টেবিলের উপরে রেখে দিতে পারে। অথবা পোকাটিকে আরও বেশি করে জলে ডুবিয়ে দিতে পারে। কিন্তু নাসিরের কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মারতেও না, বাঁচাতেও না।


ভেন্টিলেশনের পেশেন্ট ইনটিউবেটেড অবস্থায় থাকার সময়,শ্বাসপ্রশ্বাসের যে শব্দটি পাওয়া যায়, তা বস্তুত মৃত্যুর চেয়ে কম ভয়ংকর নয়। নাসির একবার শম্পাকে বলেই ফেলেছিল, বাবা যদি শুনতে পান এমন ভাবে শ্বাসের শব্দ হয়, তাহলে মনে হয় তখুনি হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে। শম্পা অত্যন্ত রেগে গিয়েছিল। ‘এতটা ইনসেনসিটিভ তুমি? সে কি নিজের বাবা নয় বলেই? দেখছ আইসিউতে লড়াই করছেন। তোমার কি সামান্য একটু শ্রদ্ধাবোধও নেই? যদি না থাকে, তবে লোক দেখাতে আর প্লিজ হাসপাতালে এসো না। দিনে দিনে তুমি কি নৃশংস হয়ে যাচ্ছ?’


সেদিন থেকে শ্বশুরমশাইকে দেখতে আর নাসিরকে হাসপাতালে যেতে হয় না। শম্পাও এখন মোটামুটি ভাবে বাপের বাড়িতেই দিন কাটাচ্ছে। সকাল বিকেল রাত হাসপাতাল। রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় কোমায় সুবিমলবাবু। এক মাস কেটে গেছে। একজন মানুষ এখন কিছু ভাবতেও পারেন না, কোনও অনুভূতিমালাও নেই, কিছু বুঝতে পারছেন না, শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে এবং চলছে শরীরের ভিতরের অরগ্যানগুলি। কিন্তু ডাক্তারের বক্তব্য ব্রেন প্রায় মৃত। কিন্তু যেহেতু সম্পূর্ণ মৃত নয়, তাই আশাও ছাড়া উচিত নয়। কারণ ডাক্তাররা এখনও ব্রেন সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কিছুই জানেন না।


জলে পোকাটা এখন আর তেমন নড়ছে না। জলের উপরে ভেসে আছে। এর দুটি অর্থ হতে পারে। এক, পোকাটার যন্ত্রণাবোধ আর নেই। আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে পোকাটা। আর দ্বিতীয় যে অর্থ উঠে আসছে, তা হল, পোকাটা বুঝে গেছে ছটফট করে লাভ নেই। নিজেকে জলের কাছে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। নাসির ভাবল, এই দ্বিতীয় অর্থটি একটু বেশি হিউম্যানাইজ করা হয়ে গেল। এমন দার্শনিক যদি পোকাটা হয়, তবে, তার কাছ থেকে আরও বেশি কিছু আশা করা যেতে পারত। তার মধ্যে প্রথম বিষয়টিই হল, কাপের জলে না পড়া। দুর্ঘটনাবশে যদি কাপের জলে পড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আলাদা প্রশ্ন। দুর্ঘটনা ব্যাপারটির উপরে সত্যিই কারো হাত নেই। আবার বড় করে ভাবলে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই আসলে দুর্ঘটনাই। কিন্তু পোকাটি যদি সত্যিই এমন উদাসীন হয়ে পড়ে বেঁচে থাকা নিয়ে, তাহলে তা সত্যিই ভাবার। তবে কি সেও মৃত্যুর সঙ্গে এখন কথা বলছে? একটি পোকা কি পারে মৃত্যুর সঙ্গে কথা বলতে? কিন্তু যদি বলেও থাকে, তাহলেও এই ঘটনাটি আগে কখনও ঘটেনি ওই পোকাটির জীবনে এবং আগামীদিনেও কখনও ঘটবে না।

নাসির যে কঠোর ভাবে বাস্তববাদী তেমন কিন্তু নয়। বরং বাস্তবতা বিষয়টিকেই সে খুব সন্দেহের চোখে দেখে। বাস্তবতাকে সন্দেহের চোখে দেখলে একটা লাভ হয়, আর তা হল, বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত সব ইহকাল পরকাল পাপ পুণ্যের ধারণাগুলো এক নিমেষে মুছে যেতে থাকে। সুবিমলবাবু মানে শম্পার বাবা বা নাসিরের শ্বশুর। কিন্তু তাঁকে এই কোনও পরিচয়েই কি এখন আর ফেলা যায়? তিনি একজন মৃত্যুপথযাত্রী কোমায় পড়ে থাকা দেহ। জন্মের আগে তাঁর কোনও পরিচয় ছিল না। মৃত্যুর পরেও তাঁর কোনও পরিচয় থাকবে না। এখনও আসলে তাঁর কোনও পরিচয় নেই। অর্থাৎ তিনি এখন বাস্তবতার ঊর্ধে। কিন্তু অন্যের কাছে চরম বাস্তব। বাস্তবতা বিষয়টিই আসলে নিজের দিক থেকে বিচারের কিছু বিষয় নয়। অন্যের দিক থেকে বিচারের বিষয়। যেমন এই পোকাটা, আবার জলের উপর একটু নড়ল, শুঁড়টা একটু নাড়াল, পা গুলো শূন্যে সামান্য শক্তিতে সাঁতার কাটছে। জলের উপরে অল্প একটু তরঙ্গ। হয়তো কিন্তু এই অঙ্গসঞ্চালনের মধ্যে পোকাটির কোনও যন্ত্রণা নেই, কোনও ভয় নেই। বরং রয়েছে একপ্রকার জড়তা। যেন অভ্যেসবশে পোকাটি তার অঙ্গগুলি নাড়াচ্ছে। কিন্তু এত সব কে ভাবছে? নাসির ভাবছে। কারণ নাসির লক্ষ রাখছে পোকাটিকে। হতে পারে, নাসির সেই নিয়তি, পোকাটি যাকে মৃত্যু ভাবছে। আবার হতে পারে, নাসির সেই ঈশ্বর, পোকাটি যাকে সামনে পেয়ে মৃত্যুভয় ভুলে গেছে। আর ঠিক এই জায়গাতে এসে, নাসির এবং পোকাটি উভয়েই বাস্তব থেকে বেরিয়ে গেল। কারণ বাস্তবতায় কেবল নাসির তাকিয়ে রয়েছে পোকাটির মৃত্যুর দিকে। আর পোকাটির কাছে হয়তো যন্ত্রণা এমন একটা স্তরে পৌঁছে গেছে, যেখানে ঈশ্বরের বা মৃত্যুর হ্যালুসিনেশনটাও একটা বাড়তি অবাস্তব বিষয়।


কিন্তু নাসির নিজেই বুঝতে পারছে না, এখানে তার ভূমিকাটা কী? যদি এমনটাও সত্য হয়, যে, পৃথিবীর সমস্ত কিছুর সঙ্গে সমস্ত কিছু যুক্ত, তাহলে এই ঘর, এই সম্পর্ক, এই কাপ, ওই জল, -- এই সবকিছুর সঙ্গে হাসপাতালে পড়ে থাকা সুবিমলবাবু এবং জলের উপর পড়ে থাকা পোকাটির সঙ্গে নাসিরের একটা সম্পর্ক রয়েছে। একটা বিশেষ মুহূর্তের জন্য এই সমস্ত কিছু ঘটছে। সেই মুহূর্তটি অন্যরকম হলেই, আর এমন কিছুই ঘটত না। পোকাটিও মরত না, সুবিমলবাবুও দুর্ঘটনায় পড়তেন না এবং হাসপাতালে কোমায় পড়ে থাকতেন না। আর যদি এমন হয় যে এই ঘরের পাশেই অন্য একটা ঘর রয়েছে, যেখানে আসলে এসব কিছুই ঘটেনি, তাহলে পোকাটিও জলের উপর পড়েনি, ছটফট করেনি এবং মরছে না। সুবিমলবাবুও হাসপাতালে কোমার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন না। নাসিরও এমন ভাবে তাকিয়ে নেই জলের উপর মৃত্যুযন্ত্রণায় ভাসতে থাকা পোকাটির দিকে। বা, এমনটাও হতে পারে, সুবিমলবাবুর জায়গায় নাসির নিজেই হয়তো আইসিইউতে। সবসময় ভাল বিষয়টি ঘটছে অন্য কোনও মাত্রায়, এমনটা তো নয়। হতেই পারে, আরও খারাপ কিছু ঘটছে। কিন্তু সব ভাল সবার জন্য ভাল নয়, আবার সব খারাপ সবার জন্য খারাপ নয়। সবকিছুই একপ্রকার বিশেষ পারমুটেশন মাত্র। কিন্তু নাসির বাস্তববাদী। বাস্তববাদী হওয়ার দুর্বলতার জায়গাটি নাসিরের মধ্যে চূড়ান্ত। নাসিরের মনের মধ্যে তাই আরেকবার হাজির হল সেই ভাবনা, মৃত্যুযন্ত্রণা বা মৃত্যু কখনও দুইবার ঘটে না। এখানে সুবিমলবাবু যে অবস্থায়, তা একপ্রকার মৃত্যুই। ব্রেন ডেথ হতে হয়তো আর কয়েকদিন। এখানে যদি সুবিমলবাবু মারা যান, তাহলে অন্য মাত্রা থাকলে, সেখানে সুবিমলবাবুকে মৃত্যুহীন হতে হবে। তা সম্ভব নয়।
পোকাটা আবার নড়তে শুরু করেছে। এইবার নাসির মুখটা জলের কাছে নিয়ে গেল। আবার কেমন যেন অসহয় ভাবে পোকাটা পা ছুঁড়ছে। একেই কি বলে জীবনের শেষ সীমায় চলে এসে শেষবারের মতো বাঁচার আকুতি? নাসিরের মনে হল, ঠিক এই মুহূর্তে সেই পোকাটির কাছে সে মৃত্যু অথবা ঈশ্বর। অর্থাৎ কেবল নাসিরের হাতে বিপুল ক্ষমতা। একটা প্রাণকে হয় সে বাঁচার সুযোগ দিতে পারে আর নয়তো চিরকালের মতো সেই পোকাটিকে এই জগতের থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। সবটাই তার ইচ্ছের উপর নির্ভর করছে। নিজেকে কেমন অলমাইটি সর্বশক্তিমান মনে হতে লাগল নাসিরের। সর্বশক্তিমান শব্দটি বলতে তার মনে আসে ‘মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য’ এই বাক্যটি। কতটা সর্বশক্তিমান মার্ক্সবাদ? তুমি কি মৃত্যুর চেয়ে বড়? এই যে নাসির এখন স্বয়ং মৃত্যু অথবা ঈশ্বর, এমন সর্বশক্তিমান কি মার্ক্স ছিলেন? লেনিন কি ভেবেছিলেন ঈশ্বর বা মৃত্যুর অবতার হয়ে কার্ল মার্ক্স নেমে এসেছেন পৃথিবীতে? পয়গম্বর? স্বয়ং আব্রাহাম? নাসিরের মনে হল, একবারের জন্যেও পোকাটিকে সুযোগ দেওয়া উচিত কারণ, কাপে যে জল থাকবে, আর সেই জলটা যে নাসির পুরোটা খাবে না, এটা সত্যিই পোকাটির জানার কথা নয়। এমনকী জলে অন্য কিছু মেশানোও ছিল না যে তার গন্ধে পোকাটি জলে ঝাঁপ দেবে। তার মানে একটাই, পোকাটির এই কাপের জলে পড়ে যাওয়া একেবারেই একটা দুর্ঘটনা।



দুর্ঘটনা বলতেই আবার সুবিমলবাবুর কথা মনে পড়ে গেল নাসিরের। নাসির-শম্পার প্রেম বা বিয়েতে যাঁর আপত্তি কোনওকালে ছিল না। বরং নাসিরের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনায় যিনি মেতে উঠতেন, এমনকী নাসিরের সঙ্গে মদ্যপানেও যাঁর সমস্যা ছিল না। কিন্তু এইগুলি কারো পরিচিতি হতে পারে না। মোদ্দা কথা হল, একজন নির্বিরোধী শান্ত মানুষ, যিনি বইপত্রের মধ্যে ডুবে থাকতেন আর চাকরিতে নিজের কাজটুকু করেই শান্ত থাকতেন। খুব একটা পদমর্যাদার প্রতি লোভ তাঁর ছিল না। আর যা ছিল না, তা হল, নিজেকে অকারণ একটা রাজনীতির ঘোড়া করে তোলার অদম্য বাসনা। সম্ভবত তিনি জীবনের অর্থহীনতা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। একটু হয়তো উদাসীনও ছিলেন। গোপনে কবিতা লিখতেন কিনা কেউ জানে না। কিন্তু সকালে বাগান করতেন এ তো সকলেই দেখতে পেতেন নিজের চোখেই। ‘একটি বাগান একটি কবিতার মতো’, এ কথা নিজের মুখেই বলতেন সুবিমলবাবু। সুতরাং, সুবিমলবাবু যে আজ এক জড় পদার্থ হয়েই পড়ে রয়েছেন বিছানায়, যাঁর মস্তিষ্ক প্রায় মৃত, শরীরের যন্ত্রগুলি এখন কেবল যন্ত্রই, এর পিছনে অন্য কোনও কারণ থাকার কথা নয়। ভবিতব্য সবসময় মানুষের কাজ অনুসরণ করে চলে না। ভবিতব্যের নিজস্ব একটা ইচ্ছে আছে। আর সেই ইচ্ছেরও কোনও অতীত ইতিহাস নেই। সহসা ইচ্ছের মতো কিছু। এটিও বাস্তব। ওই পোকাটি এখন প্রাণপনে হয়তো বাতাসের ভিতর বাঁচার শেষ চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কিন্তু এই চেষ্টা কি তাকে কষ্ট দিচ্ছে না? এ কথা মনে হতেই, নাসিরের মনে হল, সুবিমলবাবু এবং সেই পোকাটি কারণ ছাড়াই পড়ে আছেন এমন এক অবস্থায়, যাকে বাস্তব বলাও চলে, আবার পরাবাস্তবও। কারণ মৃত্যু এক ভয়ানক বাস্তব, যার বাস্তবতা আছে, কিন্তু কোনও দৃশ্য নেই।


নাসির আর একটু কাছে গিয়ে নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করল পোকাটিকে। পোকাটি এখনও আশাবাদী। কিন্তু সে কি তার মন থেকে বেঁচে আছে এত পরেও, না কি সে মরেই গেছে, শুধু তার শরীরের যন্ত্রগুলো ক্রিয়াশীল? নাসির যেহেতু তার মৃত্যুর একমাত্র বিধাতা এখন, অন্তত সে মনে করছে তাই, তাই তার মনে একটা অন্যরকম ভাবনা এলো।
আস্তে আস্তে একটা কাগজের টুকরো দিয়ে জলের উপরিতল থেকে সে পোকাটিকে তুলে রাখল টেবিলের উপর। সোজা করেই। অর্থাৎ পোকাটি এখন টেবিলের উপরে। তার ডানাগুলো ভিজে চপচপ করছে। পোকাটি নড়ছে না। তার পা গুলো কেমন ভারসাম্যহীন ভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শুঁড়টা অল্প অল্প দুলছে। পোকাটি কি একটু হাঁপাচ্ছেও? শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে তবে? অল্প অল্প করে হালকা ফুঁ দিয়ে নাসির পোকাটিকে শুকনো করে তোলার চেষ্টা করল। আবার একটা শুকনো কাগজ নিয়ে পোকাটিকে তুলে রাখল পাশে। এবার আশা করা যায় পোকাটি শক্তি ফিরে পাবে। ডানাগুলো থেকে আর জল ঝরছে না। আবার হালকা করে ফুঁ দিতে শুরু করল নাসির। যদি বাঁচার থাকে, তাহলে এই পোকাটি এখানেই বাঁচবে। ও বাঁচবে, কারণ এই বাস্তবতাতেই এই পোকাটি শেষ পর্যন্ত পা নেড়ে শুঁড় নেড়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। ইট হ্যাজ দ্য রাইট টু লিভ। নাসির একটু একটু করে ফুঁ দিয়ে গেল, শুকনো করে গেল পোকাটিকে। কিন্তু পোকাটি নড়ছে না। আবার মরছেও না।
ভাল করে এবার পোকাটিকে লক্ষ্য করতে লাগল নাসির। কালোর সঙ্গে হালকা নীল রঙের আভাস রয়েছে। ডানাগুলো স্বচ্ছ। পাগুলো সরু সরু সুতোর মতো। পিছনের দিকে হালকা সরু কাঠির মতো কী একটা বেরিয়ে আছে। দুটো মাছির মতো চোখ। মাছির মতো কয়েকহাজার চোখ আছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। পোকাটির গায়ে আর জল নেই। পোকাটি দাঁড়িয়েও রয়েছে কাগজের উপর। কিন্তু মরে গেছে না বেঁচে আছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। আর ঠিক এই সময়েই মোবাইলটা বেজে উঠল নাসিরের। শম্পা।
‘ বাড়িতে আছ?’
‘ হ্যাঁ’।
‘ একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের’
‘ কীসের সিদ্ধান্ত?’
‘ একটু আগে ডাক্তার রাউন্ডে এসেছিলেন। বললেন, ব্রেনডেথ হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে’।
‘শ্বাস-প্রশ্বাস?’
‘ হার্ট চলছে’।
‘ ডাক্তার বলছেন...
‘ অরগ্যান ডোনেট করতে?
‘ কী করে বুঝলে?’
‘এটাই এখন স্বাভাবিক। তুমি বা তোমরা কষ্ট পাবে ভেবে আমি বলছিলাম না। সুবিমলবাবু এতে কষ্ট পাবেন বলে মনে হয় না।‘
‘ তুমি কি আসবে একটু?’
‘ হ্যাঁ যাব। তবে প্রোসিডিওর শুরু করাই উচিত বলে মনে হয়’।
শম্পা ফুঁপিয়ে উঠল।
‘ দ্যাখো, বাবার অরগ্যানগুলোই জীবিত আছে এখন। আর কিছু নেই। তুমি যদি তাদের আরও জীবিত রাখতে চাও, তো ডোনেট করো’।
‘ হ্যাঁ, কিন্তু ভেন্টিলেশন খুলে দিতে হবে’
‘আমি আসছি’।
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল নাসির। সুবিমলবাবু তাহলে পারলেন না। পারাটা যেমন বাস্তব,না পারাটাও তেমনই। এই যে কিছুক্ষণ বাদে সুবিমলবাবুর ভেন্টিলেশন অফ করে দেওয়া হবে। খুলে নেওয়া হবে সমস্ত নল। তিনি আস্তে আস্তে আরও ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যাবেন। আর তাঁর শরীর থেকে খুলে নেওয়া হবে হার্ট, কিডনি, লিভার, লাংস, চোখ,ত্বক, এতে, শরীরের যন্ত্রগুলো অন্য একটা শরীরে ঢুকে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। ওই যন্ত্রগুলোর বাস্তবটাই পাল্টে যাবে। একটা নয়, অসংখ্য বাস্তবের মধ্যে বাঁচতে শুরু করবে অরগ্যানগুলো। একটা শরীর তো নয়, বেশ কয়েকটা শরীর। বেশ কয়েকটা শরীর মানে বেশ কয়েকটা অতীত, বেশ কয়েকটা স্বপ্ন, বেশ কয়েকটা ইচ্ছে, বেশ কয়েকটা ব্যাকগ্রাউন্ড, বেশ কয়েকটা প্রেম, ভয়, হতাশা, লোভ। এখন যে নির্বিরোধী সুবিমলবাবু বাগান করতেন আর অফিস, হয়তো একটা দুটো কবিতা লিখে লাজুক খাতার মধ্যে লুকিয়ে রাখতেন, সেই মনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে থাকবে না সেই সব অঙ্গ। সেগুলোর বাস্তবতাই বদলে যাবে। অঙ্গও কি বিষণ্ন হয়? কান্না পায় কি তাদের? আনন্দে কি থাকে তারাও? হয়তো চায়। কিন্তু আমরা সে সব বুঝতে পারি না। শরীর তো একটা সামগ্রিক ব্যাপার। খণ্ড হলেই বাস্তবতাও প্রচুর।


কিন্তু পোকাটা নড়ছে না। আরও কাছে এল নাসির। আশ্চর্য বিষয়, জলে পড়ে থাকা অবস্থায় পাগুলো নাড়ছিল, ডানাগুলোও অল্প অল্প নাড়ছিল। কিন্তু এখন সে সব কেমন স্তব্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। তবে কি পোকাটা সুইসাইড করতে গিয়েছিল? সুইসাইড করতে জলে ঝাঁপ দিয়েছিল? তার মানে তো এটা দুর্ঘটনা নয়। এর জন্য নাসিরের কোনও ভূমিকাও নেই। জাটিঙ্গা পাখিরা যেমন ঝাঁপ দেয়, পিঁপড়ের ডানা গজালে তারা যেমন আগুনের দিকে ঝাঁপ দেয়, তেমন কি তবে এটা? কিন্তু কেন? এ উত্তর তো নাসিরের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। জলে পড়ে থাকা অবস্থায় পোকাটি নড়ছিল, বাঁচার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাকে জল থেকে ওঠানোর পর সে স্থির হয়ে আছে। নড়ছেও না। সে কি বিস্মিত? অভিভূত? মৃত্যুর মুখ থেকে সহসা ফিরে আসায় কিছুটা স্তম্ভিত? শক পেয়েছে? আস্তে আস্তে কপালে ভাঁজ পড়ল নাসিরের। এ তো এক অন্য রহস্য। নাসির যে বিধাতা নয়, তা সে জানে। কিন্তু অল্প মুহূর্তের জন্য হলেও, তার জীবনের নিয়তি থেকে তাকে রক্ষা করে একপ্রকার আনন্দই হচ্ছিল মনের মধ্যে। প্রাণ দেওয়ার আনন্দ। কিন্তু পোকাটি কি তাকে সেই আনন্দ দিতে চায় না? তবে কি পোকাটি বেঁচে নেই? না কি বাঁচতে চায় না? এভাবে একটা কাগজের উপরে পোকাটি স্থির অবস্থায় বসে থাকবে, এ জন্যই কি নাসির ওকে জল থেকে তুলে এনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে শুকনো করল? পোকাটি কি পারবে না তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে? না কি পোকাটি চায় না? এইবার বুকের মধ্যে অল্প উত্তেজনা টের পেল নাসির। এই ধুকপুকানিটা বেড়ে গেছিল শম্পার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু সুবিমলবাবুর ব্রেন ডেথের খবর শুনে সেই ধুকপুকানি কমে যায়। আবার সে তার বুকের মধ্যে এই ধুকপুকানি টের পেল। পোকাটি কি তার সঙ্গে মজা করছে? জলের উপর যে বাঁচার জন্য তীব্র সংগ্রাম করছিল, তাকে যখন জল থেকে তোলা হল, আর তার কোনও নড়াচড়াই নেই। সে এবার আরও কাছে এল পোকাটির। পোকাটি কিন্তু উড়ে গেল না। কোনও ভয়ের লক্ষণ নেই। পা দুটোও নড়ল না। শুঁড়টাও নড়ল না। তবে কি পোকাটি নাসিরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে? কিন্তু তাই বলে এমন স্থির হয়ে থাকবে? নাসিরের কপালে একটু একটু করে ঘাম জমতে শুরু করল। আবার একটা ফুঁ দিল হালকা করে। কিন্তু পোকাটি পড়েও গেল না। আর একটু জোরে ফুঁ দিল, পোকাটি একটু হেলে গেল বলে মনে হল। তবে কি পোকাটি মরেই গেছে?
আবার ফোন বেজে উঠল। শম্পা।
‘ ভেন্টিলেশন খুলে দিয়েছে। তুমি এসো, প্লিজ’।
‘ এখুনি বেরোচ্ছি, শম্পা’।
এইবার বেরোতেই হবে। কিন্তু পোকাটি? পোকাটি নড়ছে না। সম্ভবত পোকাটি মরেই গেছে।
আস্তে আস্তে কাগজটিকে পোকা শুদ্ধ হাতে আঙুলে তুলে নিল নাসির। কী করা উচিত? সুবিমলবাবু আর নেই। সুবিমলবাবুর সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে না। সুবিমলবাবুর মস্তিষ্ক একটা ঠান্ডা মাংসের মতো হয়ে গেছে এখন। আত্মা কোথায় থাকে? বাস্তবতা কোথায় থাকে? স্বপ্ন কোথায় থাকে? সব শীত হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে নাসির কাগজশুদ্ধ পোকাটিকে কাপের কাছে নিয়ে গেল। তার পর কাগজ থেকে পোকাটিকে ফেলে দিল জলের উপরে।

বেরোনর সময়ে, দরজার দিকে এগোতে এগোতে নাসিরের চোখ পড়ল কাপে। কাপের ভিতর আবার পোকাটির পাগুলো নড়ছে। শুঁড়টা নড়ছে। যেন বাঁচার চেষ্টা করছে। পোকাটি কি বাঁচার চেষ্টাই করছে, না কি মৃত্যুর মধ্যে এ আরেক বাঁচার ইঙ্গিত?
কাপটা হাতে নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাসির। পোকাটা সত্যিই আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে মনে হয়। তবে কি ওকে জল থেকে আবার তুলে আনা উচিত? কিন্তু আর দেরি করা যাবে না।
কাপটা টেবিলে রাখার সময়েই নাসির টের পেল এই ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেছে। এমন অনেকবারই তার মনে হয়।

১০টি মন্তব্য:

  1. এই গল্পটি পড়ে এক শক্তিশালী লেখকের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আমার খুবই ভালো লেগেছে।

    উত্তরমুছুন
  2. এ এক আশ্চর্য ঐশ্বর্যময় গল্প ।শক্তিমান অথচ নোতুন।
    বিশ্লষণধর্মী গল্পের ধারার দ্যুতিমান সংযোজন।

    উত্তরমুছুন
  3. মনে পড়ে গেল দ্য ফ্লাই;খুব শক্তিশালী লেখা। অসাধারণ উপস্থাপনা

    উত্তরমুছুন
  4. এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেললাম। চমৎকার। তোমার কবিতাই পড়েছি, গল্প বেশি পড়ি নি -- কয়েক বছর আগে "দেশ" পত্রিকায় পড়েছিলাম তোমার একটা গল্প। তুমি লিখে যাও নিয়মিত। শুভেচ্ছা জেনো । 

    উত্তরমুছুন
  5. খুব ভালো লাগল, এক টানে পড়ে ফেললাম, খুবই আনন্দ পেলাম।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র