সন্মাত্রানন্দ

মায়াজম
0

 





কনককুসুম


শীলিত শব্দের ধারে কার্যোদ্ধার হবে না মোটেই,
যে কথা বলার ছিল যদি তাও বলি ঠোরে ঠারে ।
‘ধারে না কাটেও যদি বই তোর কেটে যাবে ভারে’—
এই কথা বলে যারা চলে গেলো উদাসীন পশ্চিম পাহাড়ে...
বোঝে নি তো জীবনের জলাভূমি ছাড়া আর কবিতার বীজতলা নেই ।

যানের জটিল জট খুলে গেলে শহরের হেভি ভেহিকেল
রঙিন স্বপ্নিল স্পেসে উড়ে যায় সময়ের অপায়ী বুদ্বুদ,
দুই হাতে রক্ত মেখে হা-হাঃ শব্দে হেসে ওঠে বিজেতা মামুদ...
জমায় রিক্সার হর্ন মফস্বল শহরের বিষন্ন বিকেল ।

তোর ও চোখের কাছে আমি শুধু একব্রত ঋণী,
অনঙ্গ চাঁপার ফুল ঊষর হৃদয়ভূমে জাগালি কী কনকমুদ্রায় !
তোকে খুঁজি বনস্থলী, নদীমুখ, পাহাড়ের সুবর্ণজঙ্ঘায়...
অনিবার্য তোকে ঘিরে লিখে চলি পৃথিবীর অলিখিত প্রথম কাহিনী ।



সাম্প্রতিক

যেখানে আমি থাকতে চাই,
সেখানে এরা থাকতে দেবে না আর,
যেখানে আমি চাই না যেতে
সেখানে এরা বানালো ঘর খাঁচার ।
চাওয়ার বেশী পাওনা দিয়ে
কিনতে চায় সময় সব আমার,
যখন আমি ফুল ফোটাবো
ভরাতে হয় তাদের গোল খামার ।
কাজ না দিয়ে বসিয়ে রাখে
বলে এমন অকাজটাই আচার,
আমি এখন অন্ধকারে
শ্বাসনিরোধী অর্থ খুঁজি বাঁচার ।



কথা-উপকথা


রাত্রি বলছে, এসো। আমার ভিতর সুপ্তি বসে আছে। এবার তোমাকে সে গ্রাস করতে চায়। তুমি ঘুমাবে না?

আমি বললাম, যতক্ষণ না মাথা ঝুঁকে পড়ছে, চোখ জড়িয়ে আসছে, ততক্ষণ এই অন্ধকারের ভিতর নিঝুম হয়ে বসে থাকব।

অনেক দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলো অন্ধকারের ভিতর একা জেগে থেকে আমাকে সমর্থন জানালো। আমার জেগে থাকাকে স্বাগত জানালো।

তবুও ঘুমোতে হয়। কেননা নির্ঘুম দশা মেধাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।




দৌড়

যদিও দৌড়শেষের দড়িটার কথা তুমি স্টার্টিং লাইন থেকেই শুনেছিলে, তবু কত দূরে সেটা আছে কিংবা সেটা নাইলনের নাকি খড়ের এ ব্যাপারে বিতর্ক ছিল, অনুমান ছিল দড়ির ওপারে কী আছে সে বিষয়ে বহুতর, ফলত ভারতে এবং গ্রীসে নানা প্রমিত ও উদ্ভট দার্শনিক পরম্পরা এসমস্ত বিষয়কে দুরবগাহ করে রেখেছিল। সে যাই হোক, কখনও সেটা আসবে অর্থাৎ যখন হোক আসুক ভেবে স্বেচ্ছাবিলাসে তুমি কখনও দৌড়ে গিয়েছ লেপার্ড, কখনও বা হরিণের মত দিকশূন্যহীন, অথচ তোমাকে নিয়েও গূঢ়তর ছক তৈরী হচ্ছিল , তুমি জানতে না, কখনও শেয়ার বাজারের সেনসেক্সের গ্রাফের মত লাফিয়ে উঠছিলে, কখনও আবার নেমে আসছিলে খাদের ভিতর, দেহ যেমন নামে ঘুমের সর্বাঙ্গে; সেরকম। এখন অনেকটা পথ দৌড়ে এসে দড়িটা দেখতে পাচ্ছ, যে কোনও মুহূর্তেই ছুঁয়ে দিতে হবে—এ অর্থে একটা বয়সে সকলেই দার্শনিক, এখন নিঃশ্বাস ফেলছে নিশ্চিত অন্তিমতা গায়ের উপর...রক্তচাপ ধাক্কা দিচ্ছে হৃদ্দেশকে, শর্করা মাপছে কিডনির সহনক্ষমতা...অপযশ, বন্ধুহীনতা, যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা এবং অসুখ ভাটফুলরাশি হয়ে উঁকি দিচ্ছে নোনা ধরা দেওয়ালের ওপার থেকে... তুমি কি আদর করতে পারো সেইসব ঘাসেদের, যাদের মাড়িয়ে এসেছ? অথবা এই যে এতটা অর্থহীনভাবে ছুটে এলে, চুম্বন করতে পারো এর অর্থরিক্ততাকে? এসব মীমাংসা করার জন্য কিন্তু দৌড় থমকে থাকবে না; বাকী পথটুকু দৌড়তে দৌড়তেই এসব সহসমীকরণের অজ্ঞাত পদগুলিকে বের করে আনতে হবে...দৌড়শেষের দড়ির অন্তিম স্পর্শ ওই এসে গেল...



পোকামাকড়

প্রত্যেকে একটা নির্দিষ্ট স্থানাংকে দাঁড়িয়ে আছে । প্রতিটি মানুষের জন্যে একটি করে নিজস্ব স্থানাংক । কেউ নিজের স্থানাংক থেকে নড়তে পারছে না । একটা বিশাল মাকড়সার জালের বিভিন্ন বিন্দুতে পা আটকে গেছে পোকাদের । তারা শিকার হয়ে গেছে মাকড়সার । কেউ কারুর যন্ত্রণাগুলো বুঝতে পারছে না, কারণ প্রত্যেকের স্থানাংক ভিন্ন ।

মাকড়সাটা কিন্তু কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসে জালের যে কোনও বিন্দুতে যেতে পারে । যে কোনও বিন্দু থেকে গোটা জালটা দেখতে পারে । গিলে ফেলতে পারে পোকাদের, হজম করে ফেলতে পারে প্রতিটি পোকার অভিজ্ঞতা । তাদের সুখ, দুঃখ, রোদন, বেদনকে আত্মস্থ করে নিতে পারে ।

যদি মাকড়সাটাও কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসতে না পারত, যদি ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুতে দাঁড়িয়ে পুরো জালটাকে অবলোকন করতে না পারত, তাহলে সে নিজেই নিজের জালে আবদ্ধ আরো একটা পোকা হয়ে যেত । নিজের মুখ থেকে নিঃসৃত লালা দিয়ে বোনা জালে জড়িয়ে মরে যেত মাকড়সাটা ।

যে কোনও প্রশাসকই ওই নড়তে না পারা মাকড়সার মতই আত্মঘাতী ।

.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)