সাইকেল
আজকাল অল্পেতেই চোখে জল এসে যায়।সন্ধ্যে থেকে রাত গড়িয়ে গেলেও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। তখন আমার সব সময়ের সঙ্গী সাইকেলকে নিয়ে দূর থেকে সুদূরে চলে যাই। বৃষ্টির জল চারপাশ ভেজা ভেজা।লোক চলাচল থেমে গেছে। সতী মা'র বাড়ির পাশে কুকুর ঘুমিয়ে আছে।গুমটি দোকান থেকে আমি সিগারেট , দেশলাই কিনে নিলাম। চিনির কুঠির পর থেকে ঘন অন্ধকার।তবু আকাশের মৃদু নীলাভ আলো চুঁইয়ে নামছে।তাতে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকালেও কেমন অস্পষ্ট লাগে।
ইসলামপুর পেরোনোর পর সাইকেল থামালাম।নীল আলো চলে গিয়ে বেশ গাঢ় আঁধার এখানে। নালা দিয়ে তিরতির করে জল বয়ে চলেছে।জলের রঙ রূপালী।ভালো করে চাইলে বোঝা যায় রূপো নয় নির্জনতায় একলা জল ওমন চকচক করছে।একটু এগোলেই অনেকদিনের কবর রয়েছে সারি সারি।কবেকার কারা মরে গিয়ে সাদা হাড় হয়ে পচাপাতার নীচে শুয়ে আছে।আমি একটা গাছের নীচে বসলাম।গাছের পাতাগুলো একে অপরকে এমন করে জড়িয়েমড়িয়ে আছে যে , যেন সুন্দর মাকড়সার জাল বোনা।
নীরব হাওয়া এসে আমার মন সারিয়ে তুলছে।নরম অন্ধকার আলো আমার ফাটা কলিজাতে ঢেলে দিচ্ছে আরোগ্যজল।সিগারেটে আগুন দিলাম।একটি কাঠি নিয়ে সম্পূর্ণ দেশলাই মুচড়ে দিলাম।বাকি কাঠিগুলো ঢেলে দিলাম জলে।
এখানেই অনেক আগের এক রাতের বেলা আমি আর আমার একজনা , দুজনায় আসতাম।আজ সে আমাকে পথে ফেলে চলে গেছে গাঢ় সুপুরীবনের স্ফীত সুখের দিকে।তবু সেই রাতের আসার মুহূর্তগুলি মিথ্যে হয়ে যায়নি।হাতে হাত রেখে দেওয়া , আত্মার ভিতর আলো জ্বলে ওঠার ক্ষণ জলে ধুয়ে যায়নি।
গাছের মাথা থেকে জমা জল পড়ছে টুপটুপ। আমি টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম অসীম শূন্যতার ভিতর। মাটির ফুলে ওঠা পেটের নীচে। যে জল মাথায় পড়ছিলো তা বুকে এসে লাগতে লাগলো। বৈশাখে এখানে তো পীর বাবার মেলা হয়। মাটির ঘোড়ার মূক মুখখানি মনে আসে। যেখানে শুয়ে আছি এখানে নাগরদোলা থাকে।নাভির কাছে ঘূর্ণন টের পাচ্ছি।হাতের বালিশে মাথা পেতে দিলাম। বাম পাশে কেউ নেই। গর্ভস্মৃতির মতো মনে পড়ছে বহুদিন আগে শোনা আলি আকবরের বাজনা। সারোদ দ্রুত হচ্ছে। ধুনোগন্ধের ভিতর বসে কে যেন সারেঙ্গী বাজাচ্ছে।
ছেড়ে যাওয়া আমার সেই একজনকে আমি সিগারেটের ঘ্রাণে , দেশলাই কারখানার নরম কাঠে , বায়ুমণ্ডলে অনুভব করছি। শুঁকছি মাটির গলা , চোখ ,নাক , মুখ দূরে আলো জ্বেলে কেউ চলে গেলো। আমি গুবরে পোকার অধিক হয়ে শুয়ে আছি।
সুচিন্তিত মতামত দিন