সম্পাদকীয়
আকাশে ইস্কুলছুট বালকের মতো সাদা জামা পরা মেঘ দেখলেই আমার বহু পুরাতন জীর্ণ এক দেবদেউলের কথা মনে পড়ে। অনেকদিন আগে ওইরকম একটি দেউলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, এক বৃদ্ধ সাধক দেবী পূজার আয়োজন করেছিলেন, লোক নাই জন নাই অনাড়ম্বর নির্জন আশ্বিন অপরাহ্নে ভগ্ন দেবী মন্দির বৈরাগ্য ও ভক্তি আলোকে গমগম করে উঠেছিল।
সদ্য স্নান শেষ করে উঠে এলেন সাধক, তাম্রবর্ণ দেহ, সুগঠিত বাহু, কাঁধ অবধি নেমে এসেছে শ্বেতশুভ্র কেশরাজি। পরনে রক্তবস্ত্র, শ্বেত বর্ণের উপবীত যেন তাঁর শরীরের অলঙ্কার।
জীর্ণ নাটমন্দির, কার্নিশে শিশু বটগাছ আশ্বিনের বাতাসে চঞ্চল হয়ে উঠেছে,সামনে ধু ধু ফসলি জমি, মন্দির সংলগ্ন দীঘিখানি দেবীচক্ষুর মতো স্নেহময়ী, দু-পাশে আগাছার মাথা আলো করে ফুটেছে কুশি কুশি নীলবর্ণ বনকুসুম। ভগ্ন সোপান পার হয়ে গর্ভগৃহ, প্রায় তিনশো বৎসরের পুরাতন প্রস্তর বেদির উপর দেবী বিরাজমানা, একখানি প্রকাণ্ড প্রদীপের পীতবর্ণ আলোয় ভাবগম্ভীর হয়ে উঠেছে চারপাশ। দেবীর প্রস্তরমূর্তি, দশভূজা, হাতে উদ্যত ত্রিশূল,সিংহবাহিনী, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, পদতলে করুণা ভিক্ষা করে চেয়ে রয়েছে রণক্লান্ত অসুর। শুধু দেবীর চোখে কোনও ক্রোধ নাই, কী অসীম স্নেহ আর করুণা, অভয়াদাত্রী জননী তিনি।
তাঁরই ইচ্ছায় বাইরের আকাশ ঘন নীল, দু এক টুকরো সাদা মেঘ চালচিত্র হয়ে ফুটে আছে। দূর নদীর ঘাটে গয়নার নৌকো থেকে ঘাটে নামছেন মানুষজন। উজ্জ্বল হাসি তাদের মুখে। হাতের পুঁটলি বাক্সে সজ্জিত প্রিয়জনের জন্য আনা উপহার। শিশু পুত্র, পুত্রীর জন্য বাবার নিয়ে আসা নতুন বস্ত্র। তরুণী বধূর জন্য ফিরে আসছেন স্বামী। প্রেমিকার জন্য শহর থেকে গোপনে স্নো পাউডার নিয়ে ফিরছেন যুবক প্রেমিক।
মাধবীলতা সুবাস পার হয়ে তাদের উঠান ঘেরা বাড়ি। গতরাত্রির শিউলি ফুল পড়ে আছে পথের ধুলায়, তবে গৃহে ফেরার কথা মনে ভেসে উঠলেও ফেরা হয়না, পথভ্রষ্ট হয়ে আমরা কত কীর্তনখোলার জনশূন্য বালুচরে কাশ-উৎসব পার হয়ে তিন পয়সার খেয়া ধরে কোলাহলে জড়িয়ে পড়ি, বিস্মৃত হই ঘর-দুয়ার দালানকোঠা স্নেহময়ী জননীর সুবাস-যা কিনা আমাদের পরম প্রেমধন, আমাদের যে তিনি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসেন না, সে-প্রেম ভুলে এই জগতের দুয়ারে দুয়ারে আমরা ভালোবাসা ভিক্ষা করি। কতকাল কেটেছে এইভাবে, রক্তাক্ত হয়েছি বারংবার, মুখে লেগে রয়েছে অপমান আর গোপন অশ্রু তবুও নিজগৃহের কথা ভুলে রই!
আমাদের এই যাত্রাপথের দুপাশে আপনমনে যে কুসুম ফোটে তাই দিয়ে সাজাই শব্দ, একটি একটি করে শব্দ নিয়ে গড়ে ওঠে সাতমহলা প্রাসাদ, আমাদের সাহিত্য, আর দেবী পূজার প্রাক্কালে শারদ সাহিত্য যেন পূজার উপচার। মহামারী দুর্ভিক্ষ গৃহবিপ্লব দারিদ্য অনাহার শত বিপদেও আমরা দেবী আরাধনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই না, সেই তাঁর কৃপা, কারণ দেবী বন্দনা আমাদের কাছে নিছক কোনও উৎসব নয়, তা প্রাণ সমর্পণের-নিজেকে উৎসর্গ করার পূজা, নিজ অন্তরের অসুর বধের পথ, দুই শুম্ভ-নিশুম্ভের নাম অহংকার ও আসক্তি। সাহিত্য ওই অসুর বধের অস্ত্র, সেইরূপ সৎ ও আন্তরিক সাহিত্য নিয়ে গড়ে উঠল এবারের মায়াজম পত্রিকার উৎসব সংখ্যা বা পূজা সংখ্যা, আমাদের সকলের শব্দপুষ্পের অঞ্জলি গ্রহণ করে দেবী কৃতার্থ করুন, আনন্দ-অভয় প্রদান করুন, যা আমাদের জন্য হিতকর তাই যেন তিনি দান করেন, তাঁর কাছে কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা জানাই।
আজ মায়াজম পত্রিকার প্রকাশ মুহূর্তে সেই পুরাতন জীর্ণ মন্দিরের গর্ভগৃহে শুরু হল গম্ভীর শান্ত গলায় মন্ত্রোচ্চারণ,
নতেভ্যঃ সর্ব্বদা ভক্ত্য চাপর্ণে দুরিতাপহে ।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
সুচিন্তিত মতামত দিন