শ্রীজাতা গুপ্ত - মায়াজম

Breaking

২২ অক্টো, ২০২০

শ্রীজাতা গুপ্ত

                                        শিশিরবিন্দু





১.
কাল সাতটায় বার্সেলোনা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম। সেখান থেকে পৌঁছোতে হবে বার্সেলোনা মিউনিসিপালিটি অফিস। আমার নতুন কর্মক্ষেত্র৷ তা' যাবো কীভাবে? একটাও সাইনবোর্ডে এক অক্ষর ইংরিজি নেই। আমার ব্যাগে একটা 'লার্ন স্প্যানিশ ইন টোয়েন্টি ডেজ' আছে ঠিকই, কিন্তু এসে পড়েছি কাতালান রাজ্যে। ভাষা সামান্য ভিন্ন। তাছাড়া, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তর্জমা করতে গেলে আর অ্যাপোয়েন্টমেন্টের সময়রক্ষা হবেনা। ভিড়ে মিশে বাইরের দরজা অবধি এলাম৷ পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে জনস্রোত। কাকে ছেড়ে কাকে জিজ্ঞেস করব, ভাবতে ভাবতেই পাকড়াও করলাম মাঝবয়সী ভদ্রলোককে। ট্যাক্সি কোথায় পাবো বলতে পারেন? ট্যাক্সি? তিনি উত্তরে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন, যার কিছুই আমি বুঝতে পারছিনা দেখে খপাৎ করে আমার হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে থামলেন ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে। তারপরেই, দৌড়। 'মুচাস গ্রাথিয়াস' বলে সামান্য কলারটুকু তুলে ভাষা আয়ত্তের গরিমা প্রকাশ করার অবকাশও আমাকে দিলেন না।



চিরকুট লেখা ঠিকানা দেখিয়ে অফিসে পৌঁছোনো গেল। তারপর? তখন সকাল সাড়ে আট। কেউ কোত্থাও নেই। অফিস টাইমের আগে কাউকে ফোন করতে আমার বরাবরের দ্বিধা। এদিকে ৯টা সময় দেওয়া। অমুক ডিপার্টমেন্টের জর্ডি-র সঙ্গে দেখা করতে হবে। ক্যাম্পাসে তখন কয়েকজনের আনাগোনা। দু'চারজন কে জিজ্ঞেস করায় উত্তর পেয়েছি, 'নো সে'। সেটুকু শিখে গেছি, এই দুই শব্দের মানে, 'জানিনা'। অগাস্টের মাঝামাঝি। পাতাঝরা মরশুমের শুরু। ক্যাম্পাসে অনেক লম্বা-লম্বা গাছ। ইউরোপের গাছ চিনতে শিখিনি তখনও। প্রথম উড়ানে ফিনল্যান্ড, সেখানে সপ্তাহখানেক থেকে দ্বিতীয় উড়ান স্পেন। এইটুকুই আমার ইউরোপের সঙ্গে পরিচয়। যে দেশগুলোর কথা এতকাল বইয়ের পাতায় ছিল, হঠাৎ তার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার তখনও ঘোর কাটেনি। মনে হয়, বইয়ের পাতাতেই ঢুকে পড়েছি গল্পের মায়ায়। বই বন্ধ করার দেখব, সব আবার আগের মত। দু'দিন আগে শিখেছি প্রথম ফিনিশ শব্দ- রুস্স্কা। জলের ধারে হালকা বাদামী, গাঢ় বাদামী, লালচে পাতার হেমন্ত গাছ দেখিয়ে আমার বন্ধু বলেছিল, এই রঙের নাম রুস্স্কা। সেই থেকেই আমি মনে মনে হেমন্ত কে ওই নামেই ডাকি। একটা শব্দ, যার ভাষায় তার অর্থ এক, তাকে আমি আপন করে নিলাম অন্য এক অর্থে। একটা শব্দের মধ্যে, একটা ভাষার মধ্যে, এই যে প্লুরালিসম বর্তমান, তা বিস্ময়কর! অথবা, অন্যদিক থেকে ভাবতে গেলে, মানুষের মনের মধ্যে এক থেকে অন্যতে যাওয়ার ক্ষমতাটুকু সঞ্চয় করে রেখেছি 'রুস্স্কা' শব্দের মধ্যে।


জর্ডির খোঁজে অপেক্ষা করার ফাঁকে দেখলাম, স্পেনে তখনও জাঁকিয়ে বসেনি অটাম। আবহাওয়াতে উষ্ণতা কিঞ্চিৎ বেশি। তাও, পায়ে চলার পথে ইতস্তত শুকনো পাতা। সকালের রোদ এসে পড়েছে। আমার চোখ অনুসরণ করছে হঠাৎ উড়তে চাওয়া পাতার ঘূর্ণি। তার পাশে এক গোলগাল মানুষ। হাতে লম্বা ঝাঁটা, রোজ সকালে মরশুমি রুখুসুখু ডালাপালা পরিষ্কার করে চলার পথ মসৃণ করাই কাজ তার।


আমাকে দেখে কাজ ফেলে দঁড়িয়ে পড়েছেন। আমিও মাটির থেকে চোখ তুলে তার দিকে কিছুক্ষণ অপ্রস্তুত দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, জর্ডিকে চেনেন? জর্ডি? মানুষটির মধ্যে কোনও হেলদোল হল না। এরপর ফেটে পড়লাম অসহায়তায়। পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলাম, কী আশ্চর্য্য! এই লোকটার সঙ্গে দেখা করতেই হবে আমাকে। এই তার নাম, এই তার ডিপার্টমেন্ট! কেউ চেনে না! ভারি মুশকিল হল তো! ভদ্রলোক এবার তার হাতের ঝাড়ু ঠেস দিয়ে রাখলেন পাশের বেঞ্চে। আমার কাঁধে আলগোছে হাত রেখে নির্দেশ দিলেন ইশারায়। এই পায়ে হাঁটা পথ ধরে যাও, ডান দিকে ঘোরো, একটা গোল চত্ত্বর পেরিয়ে আরেকটু এগোলে বড় বিল্ডিং। তার তিনতলায় অফিস। ওঁর কথা শুনে বুঝিনি, ঠিক বুঝলাম কিনা। নির্দেশ মেনে পৌঁছিয়ে বুঝলাম, হ্যাঁ, ঠিক অফিসেই এসেছি।
পরে জানলাম, স্পেনের যে কোনও চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে 'জর্ডি' বলে একটা হাঁক পাড়লে অন্তত ১৫-২০ জন জড়ো হবেন। ওই ঝাড়ুদার কী করে বুঝলেন? আমার কোন জর্ডিকে প্রয়োজন?




২.
ফিনল্যান্ডের ভাষায় ফিরি। য়োয়েন্স্যু নামের গ্রামে ছিল আমাদের ইউনিভার্সিটি। হেলসিঙ্কি থেকে আরও উত্তরে তার অবস্থান। যদিও লেখাপড়ার বিষয়ে স্থানীয় ভাষার প্রয়োজন ছিল সামান্যই, বাধ্যতামূলক ভাবে আমাদের শিখতে হয়েছিল ফিনিশ৷ প্রথাগত ক্লাস করে, তার ব্যকরণ শিখে, পরীক্ষা দিয়ে একটি নতুন ভাষা যেভাবে শিখতে হয়। অদ্ভূত ভাষা। অন্যান্য ইয়ুরোপিয় যে সব ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে তা' একটু শুনলেই বোঝা যায় ল্যাটিনের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ। আমাদের ইংরিজি অভ্যস্ত কান মিল খুঁজে অর্থ উপলব্ধি করতে চায় ইংরিজির নিয়ম মেনে। ফিনিশ ভাষায় একটি শব্দেরও সাদৃশ্য নেই ইংরিজির সঙ্গে। ল্যাটিন থেকে আসেনি এই ভাষা৷ শুনেছিলাম ইউরোপিয়ান ভাষাগুলোর মধ্যে হাঙ্গারিয়ান এর সঙ্গে সামান্য মিল পাওয়া যায়। হাঙ্গারিয়ান শেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে, ফিনিশ শব্দসম্ভারে মেতে উঠলাম।


ইউনিভার্সিটিতে সে ভাষায় কথা বলার সুযোগ প্রায় ছিলনা। কোর্স ইংরিজিতে, আদ্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল সহপাঠিরা। একমাত্র মেন্সা, মানে ক্যাফেটেরিয়াতে, খাবার নেওয়ার সময়ে দু'চার অক্ষর। ফিনল্যান্ডের মানুষ বড় মুখচোরা। ও দেশে পৌঁছয়ে কালচারাল ওরিয়েন্টেশনের সময়ে শেখানো হয়েছিল, ফিনল্যান্ডের মানুষ তোমাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করবে, সারা সন্ধ্যা একটাও কথা বলবেনা। তুমি মনে মনে ভাববে, কী অভদ্র! সে মনে মনে ভাববে, আমার কী সৌভাগ্য! ও আমার বাড়ি এসেছে! আমরা সারাজীবনের বন্ধু হলাম! তা' এ হেন পরিবেশে আর ভাষাশিক্ষা এগোবে কী করে? নতুন শব্দ শেখা হয়না। তার মধ্যে একটা আধটা শব্দ পেলে তার সঙ্গে অনুষঙ্গ খুঁজি। মনে রাখার মত পারিপার্শ্বিক রেফারেন্স খুঁজি। ওই যেমন লিখলাম আগে, রুস্স্কা মানে হেমন্তের পাতা। আমার অভিধানে।



বন্ধুর মেয়ের নাম শুনলাম কির্সিক্কা। নাম শুনলেই তার অর্থ জিজ্ঞেস করা হয়ত খুব বাঙালি অভ্যেস। আমি তার বাইরে বেরোতে পারিনি। বেশিভাগ দেশেই তার প্রয়োজন হতনা, কারণ তাদের নাম বিব্লিকাল। ফিনল্যান্ড ব্যতিক্রম দেখেছি। ওদের নামের অর্থ থাকে, আমাদের মত। কির্সিক্কা শব্দের অর্থ চেরি-ফুল। জানলাম। তার বিখ্যাত জাপানি নাম 'সাকুরা' আমার তখনও অজানা। তবে রাইসপেপারে চেরিফুলের নরম জলরঙ দেখেছি অনেক৷ সেরকম হাতে আঁকা ছবির মত ছোট্ট মেয়ে কির্সিক্কা।
ওদের বাড়িতে আমি দু'বার মিলিয়ে থেকেছি দিন পনের। কথা বেশি বলেনা, ঘুরঘুর করে আমাদের আশেপাশে। মিটিমিটি হাসে৷ হঠাৎ একদিন বন্ধু জানালো, কির্সিক্কা তোমায় নাচ দেখাতে চায়। ফুরফুরে গোলাপি জামা পরে ব্যালেরিনা-শ্যু নিয়ে ঘরে ঢুকলো লাজুক ফুল। জুতোর স্যাটিন ফিতে বেঁধে দু'তিনবার টিপ-টো প্র্যাক্টিস করে দেখালো ব্যালেস্কুলে শেখা নতুন মুভমেন্ট। তারপর আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। আমি দেখলাম, একটি ফুলের হঠাৎ ফুটে ওঠার ভঙ্গি। কোমল, নরম আলো। কির্সিক্কা-চেরিফুল- এই সবকিছুর অর্থ আমি মনে রাখলাম বালিকার মনের কোণায় লুকিয়ে থাকা ইচ্ছার মত। ও যে আমাকে পছন্দ করেছে একটু, তার বহিঃপ্রকাশ নাচের অংশবিশেষ ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই ছিল। তাই, উষ্ণতার মানে হল কির্সিক্কা। আমার অভিধানে।
ফিনিশ ক্লাসে শেখা ব্যকরণগত শব্দভান্ডার বা বাক্যরচনা আমার একটাও মনে নেই। রুস্স্কা আর কির্সিক্কা কেন আজও মনে আছে?



৩.
আরেকবার ফিরে যাই স্পেইনে। বার্সেলোনার অফিসের কাজ মিটিয়ে বুঝলাম আমার আসল কাজ মনসেনি ন্যাচারাল পার্কে৷ বার্সেলোনা থেকে ৫০কিমি উত্তর, কাতালুনিয়ার ছোট গ্রাম। গ্রামে একটি দূর্গ, একটি গির্জা, একটি স্কুল, দু'টি রেস্তরাঁ-পাব-ক্যাফে। আর ইংরিজি-ভাষী মানুষের সংখ্যা শূন্য। তখন এমনটাই ছিল। সহকর্মিনী অ্যানা আমার আসার কথা জেনে দু'সপ্তাহ যাবৎ ইংরিজি শিখেছে ওদের গ্রামের ছোট স্পোকেন-ইংলিশ ইস্কুলে। এক মাসের কোর্সে ভর্তি হয়েছিল, ছাত্রছাত্রী বাকিরা মাঝপথে ছেড়ে দিল বলে ক্লাস চলল না৷ আমাদের তখন এত অনলাইন সবকিছুর রমরমা হয়নি, যেখানে সেখানে বসে যা ইচ্ছা শিখে নেওয়া যাবে। বলাই বাহুল্য, আমার কাতালান আর ওর ইংরিজি প্রায় সমগোত্রীয়, ও বরং খানিক এগিয়ে৷ এই দিয়ে আমাদের কাজের শুরু। তারপর বন্ধুত্ব।


অ্যানার সঙ্গে আমার অনেক কথা হত। হয়ত গাড়িতে এক ফিল্ড-সাইট থেকে অন্যটায় যাওয়ার পথে কিছুতেই একটা শব্দ একে অপরকে বোঝাতে পারছিনা৷ শুনশান পাহাড়ি-জঙ্গুলে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে অভিধান ঘেঁটে যুৎসই শব্দ খুঁজে নিতাম আমরা। কখনও শব্দের আবিষ্কার লগ্নে আমাদের হা-হা হাসিতে মনসেনি পাহাড় কেঁপে উঠত। বিচ-বনের গায়ে সেই হাসির রেশ এখনও অমলিন।


অ্যানার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ওর ঠাকুমার বাড়ি নেমন্তন্ন। আমাকেও সঙ্গে নিতে চায় অ্যানা। ঠাকুমা থাকেন 'গ্রামে'। মনসেনি নিজেই গ্রাম, তা' আগেই বলেছি। তার বাসিন্দারা ঠাকুমার বাড়িকে বলে 'গ্রামের দিকে', সে কেমন হবে, দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। ঠাকুমা থাকেন খামারবাড়িতে। বিশাল জমি। একটু ছাড়াছাড়ি দুটো বাড়ি। অন্যটায় অ্যানার বাবা-মা থাকেন। তাদের ডিভোর্সের প্রস্তুতি চলছে, তাই, মা থাকেন ঠাকুমার সঙ্গে। বাদবাকি অঞ্চল হাঁস, মুর্গি, শুয়োর, গরু, ভেঁড়া, খরগোশ ইত্যাদির চারণভূমি। এছাড়া রয়েছে ফুল-ফল-ফসলের বাগান। জমিতে সকলেই একসঙ্গে কাজ করেন, নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হলেই বা কী। জন্মদিনের আহার অবশ্য একসঙ্গে খাওয়া হবে সবাই মিলে। এইসব গল্প সারাসপ্তাহ ধরে অ্যানা বলল। সঙ্গে বলল, বাড়ির সকলেই খুব উত্তেজিত, 'ফরেইনার' আসছে। ওঁরা এর আগে টিভিতে ছাড়া কোনও ভারতীয় দেখেনি। এসব শুনে আমি খুব ভেবলে গেলাম, কিন্তু আমার মনে অন্য প্রশ্ন। ওঁরা কি ইংরিজি জানেন একটুও। সকাল থেকে সারাদিন তো শুধু হেসে আর অভিধান খুলে কাটানো যাবেনা! অ্যানার মাথায় এই চিন্তা আসেনি। একটু থমকে বলল, ইংরিজি কেউ বলতে পারেনা, ওর বাবা স্বল্প জানেন। তবে, কোনও ভাষার ব্যবধানই নাকি ওর ঠাকুমার অনর্গল কথাবার্তায় কখনও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।


আমার জীবনের দীর্ঘতম দ্বিপ্রাহরিক আহার ছিল অ্যানার ঠাকুমার বাড়িতে। দুপুর ১টায় শুরু হয়ে শেষ হল সন্ধ্যা ৭টায়। সমস্ত আলাপ আলোচনা আমি বুঝলাম। কোন শুয়োরটা ক্রিসমাসের জন্য তৈরী হচ্ছে। কোন খরগোশের দাদু-দিদা আভেনে রোস্ট হচ্ছে, তার মধ্যে পারিবারিক কলহ শুরু হল সামান্য, সেই বিতন্ডা সামাল দিল অ্যানার সঙ্গী রুবের্ত। এ সব বুঝলাম।
শব্দ খুঁজতে আঁতিপাতি দৌড়ে বেড়ানো আমাদের অভিধান হার মানল অত্যন্ত ছাপোষা গ্রাম্য পারিবারিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাছে। কেন?



৪.
এবার একটু ভাষার বিবর্তনের ধাপগুলির দিকে তাকাবো। উপরের গল্পগুলোর নিরিখে। নইলে আর এত কথা বলে লাভ কী?
ধরুন, এয়ারপোর্টে যে লোকটির সঙ্গে দেখা হল, যে আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে, বিজ্ঞানীরা বলবেন, তার এই কর্মটির মধ্যে কোনও যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার হয়নি। সে আমার অসহায়তা বুঝতে পেরেছিল, কারণ অসহায়তা একটি অতি প্রাচীন ইমোশান। যার বোঝার জন্য আমাদের আলাদা করে প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ দরকার পড়ে না। জিনের মধ্যেই লেখা আছে। আর ট্যাক্সি শব্দটা যেহেতু এখন ইউনিভার্সাল, তাই দুইয়ে দিয়ে চার সে করেছিল সহজেই। সে আমাকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড চিনিয়ে দেবে, এই তার মূল উদ্দেশ্য। তাই, আমাকে অন্য আরেকটি স্তুর মতই, শারীরিক মাধ্যম প্রয়োগ করে স্থানান্তরিত করল। মেকানিক্যালি এফেক্টিভ হল কাজটি, কারণ মূল লক্ষ্যে পৌঁছোনো গেল। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে পৌঁছোনোর আগে অবধি আমি তার অভিসন্ধি বুঝতে পারলাম না কারণ এই আদানপ্রদানের মধ্যে কোনও মনের ভাবের সংযোগ ছিলনা। অথচ, দ্বিতীয় ঝাড়ুদার ভদ্রলোক আমাকে হাত ধরে অফিসে পৌঁছিয়ে দেন নি। তিনিও আমার অসহায়তা বুঝেছিলেন প্রথম জনের মতই, জিনের ম্যাপিং মেনে। এরপর, আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন সমাধান। বোঝানোর বিষয়ে ওঁর মনে যে যে ভাব জেগেছে তা' আমি অবধি এসেছে যোগাযোগের মাধ্যমে। যাকে আমরা কমিউনিকেশান বলে থাকি। আমার মন ওই পরিস্থিতিতে কী ধরণের ইঙ্গিত বুঝতে সক্ষম, তার ধারণাও তৈরী করে নিতে হয়েছে তাঁকে। অতএব এক মনের সঙ্গে অন্য মনের যোগাযোগ স্থাপন হয়ে একটি কার্যসিদ্ধি হল। এইটি অধ্যায়টিকে ধরা হয় ভাষার বিবর্তনের প্রথম ধাপ। আমি বলছিনা। বিদ্বজ্জনেরা বলেন। এই যে ওঁর ডানদিক বাঁদিক আমারও ডানদিক বাঁদিক, তার একমাত্র কারণ, আমরা দু'জনেই দুইপেয়ে সোজা দাঁড়াতে পারা মানুষ। সেদিন যদি আমার দেখা হত একটি মাকড়শার সঙ্গে যার চোখ আমার চোখের চেয়ে অন্যরকম দেখে, বা একটি পাখি, যার আমার মত মাথার সামনের দিকের বদলে মাথার দুপাশে চোখ, বা, যদি ভাগ্যক্রমে দেখা হত একটি বাদুড়ের সঙ্গে, যে শব্দের সাহায্যে দূরত্ব মাপে, পদসঞ্চারে নয়, তাহলে আমার সঠিক অফিসে সময়মত পৌঁছোতে দেরী হত অনেক। শরীরের আকার, পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার যাবতীয় উপায়ের উপর নির্ভর করে আমাদের মন কীভাবে ভাববে, এবং সেই ভাব প্রকাশ করবে। এম্বডিড কগনিশান নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাঁদের সেরকমই মত। মনের ভাব প্রকাশ করার আগে সেই ভাবের একটা প্রতিচ্ছবি তৈরী হয় মনে। সেটা নাকি যোগাযোগ স্থাপনের বা ভাষা বিবর্তনের পথে অন্যতম ধাপ।


এবার আসি ফিনল্যান্ডের রঙ এবং ফুলের প্রসঙ্গে। রুস্সকা বা কির্সিক্কা শব্দের যে ফিনিশ ভাষায় একটা প্রতিষ্ঠিত অর্থ রয়েছে তা' আমাদের কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যেতে হবে। আমার কাছে শব্দদুটো ধ্বনিসমষ্টি হয়ে প্রথম এলো। তাদের আগমনের সময়কালে আমার চারিদিকে যে রেফারেন্স গুলো ছড়িয়েছিল তার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আমি ধ্বনিসমষ্টিকে অর্থবহ শব্দ করে তুললাম নিজের অভিধানে। এইভাবেই প্রথম শব্দের সূচনা। একএকটি শব্দ এক এক জিনিসের জন্য ভাষায় নির্ধারিত হয় অনুরূপ প্রক্রিয়ায়। তারপরের ধাপ, শব্দগুলির অক্ষরের রূপে চিহ্নিকরণ। সিম্বলাইসেশন। কেবল শব্দ নয়, ভঙ্গিমার সঙ্গেও জুড়ে যায় এইসব অনুষঙ্গ। যেমন উর্ধ্বগামী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে আমরা জানিয়ে দি, পছন্দ! এই ধাপটি কেবল মানুষের ভাষাতেই পাওয়া যায় বলে আমরা বর্তমানে জানি। যদিও সিম্বলিক কিছু ভঙ্গিমা শিম্পাঞ্জিরাও ব্যবহার করতে পারে বলে দাবী এক দল বিজ্ঞানীর।


একবার যেই রেফারেন্স ভিত্তিক ভাষা শুরু হল, মৌখিক ভাষার উপর সমস্ত যোগাযোগের মাধ্যম নির্ভরশীল হয়ে পড়ল, তার কারণেই আমাকে এবং অ্যানাকে মাঝেমধ্যে গাড়ি থামিয়ে বইপত্র ঘাঁটতে হত। ধরুন, অতীত নিয়ে কথা বলছি,বা বর্তমান, সেখানে আমাদের আলোচনায় এসে পড়ল 'গাধা' শব্দটি (একেবারে সত্যি ঘটনা। উদাহরণের খাতিরে বলছি না)। সেই মুহূর্তে 'গাধা'-অর্থ বোঝানোর কোনও অনুষঙ্গ আমাদের সামনে নেই। তাই, দু'জনের জানা ভাষায় শব্দ ছাড়া সে যোগাযোগ সম্পন্ন হবে না। ডেক্লারেটিভ কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে এই কারণেই মৌখিক (বা লিখিত, যা মৌখিক ভাষার রূপান্তর, একপ্রকার) ভাষার এত রমরমা। বিবরণভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা কেবলমাত্র মানুষের ভাষায় নিহিত। আর কোনও প্রাণীর মধ্যে এই ক্ষমতা এখনও আমাদের অজানা।


তাহলে, ঠাকুমার বাড়িতে সব বুঝলাম কীকরে? সেখানে আমাকে একটি লম্বা সময়ের পরিসর দেওয়া হয়েছিল। বোঝার এবং বোঝানোর কোনও তাড়া ছিলনা। তার আগে, আমাকে একটা ছোট্ট ইতিহাস দেওয়া হয়েছিল, কার সঙ্গে কার কীরকম সম্পর্ক। এর সঙ্গে ছিল, পরিবার বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত সামাজিক অভিজ্ঞতা। সব মিলেমিশে একে অপরের মধ্যে আদানপ্রদানগুলো আমি বুঝলাম প্র্যাগম্যাটিক্স এর মাধ্যমে। ভাষাবিদ, মনোবিদ, বিবর্তনবাদী, দার্শনিক, এরা সকলেই আজকাল বলছেন, ভাষাশিক্ষা এবং ভাষা অনুধাবন, দুইই পড়ে প্র্যাগম্যাটিক্সএর আওতায়। যেখানে যোগাযোগের কোনও একটি মাধ্যম-ই মূল মাধ্যম নয়, তারা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এই মিশ্র প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি ভাষা বা সফল যোগাযোগ সাধন। তা' কেবল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্যি।


এই কয়েকটি ধাপে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে ভাষা বা যোগাযোগ মাধ্যম। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ লক্ষ-লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তন, পরিবেশের কারসাজি, জটিল স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপ, জিনের খেলা, মানসিক ও শারীরিক মাধ্যম, বিবিধ সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস। এর যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, তাতেই অপার বিস্ময়। যা জানতে পারিনি, তার বিস্তার সুদূরপ্রসারি। তবে, একটি ধানের শিষের উপর শিশিরবিন্দুর মত অকিঞ্চিৎ জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, অসীমের সূত্র বরাবর ক্ষুদ্রের অভ্যন্তরে বাস করে। ফিবোনাচি সিকোয়েন্সের মত। যেমন, আমার এয়ারপোর্ট-বার্সেলোনা মিউনিসিপালিটি-মোনসেনি গ্রাম-ফিনল্যান্ডের জাপানি ফুল-ঠাকুমার খামারবাড়ির ধাঁধাঁয় খোঁজা যেতে পারে ভাষার বিবর্তন।

৩টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র