মোগলি
আমার এক বন্ধু ট্রাক চালাত।
অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন আমি লেখক, আর আমার বন্ধু ট্রাক-ড্রাইভার?
এবার যদি আমি পালটা প্রশ্ন করি, সে-ও মানুষ, আমিও মানুষ, তাহলে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না?
যাই হোক, আজ তো আপনাদের বিচারবুদ্ধি বিশ্লেষণ করতে বসিনি, আমার বন্ধুর গল্প বলতে হবে যে। বন্ধু ট্রাকের চালক বটে, তবে সে যখন থেকে আমার বন্ধু ছিল, তখন ট্রাক চালাত না। স্কুলবেলার বন্ধু। ছোটবেলায় কি আর কেউ ট্রাক চালায়? নাকি কেউ লেখালিখি করে?
স্কুলে সর্বসাকুল্যে আমার মাত্র চারজন বন্ধু ছিল। আমরা একসঙ্গে খেলতাম, এক বেঞ্চে বসতাম। টিফিন খেতাম ভাগাভাগি করে। একজন স্কুল না-গেলে অন্য তিনজনের মধ্যে কারো খাতা নিয়ে ক্লাসের পড়া টুকতাম।
আমার এই ট্রাক-চালক বন্ধুটি আমাদের সবার চেয়ে বেঁটে ছিল। লিলিপুট বলে রাগানো হতো। ছোটখাটো চেহারা। লম্বা লম্বা চুল ঘুঙুরের মতো দুলতো। মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথে। আমরা বাকী তিন বন্ধু বা ক্লাসের আর সবার চুলে সিঁথে কাটা ছিল এক পাশ দিয়ে। হয় ডাঁয়ে, নয় বাঁয়ে। আমাদের মতো সভ্য গোপালের মাঝে ও যেন রাখাল বালক ছিল।
তা ওই বন্ধুর বাবা ছিল রাঁধুনি বাউন। ওরা উড়ে। উড়িয়া ঠাকুরের ছেলের টিফিন বক্সে নিত্য নতুন খাবার থাকত রোজদিন। আমরা নিয়ে যেতাম লাল আটার রুটি। ও আনতো গাওয়া ঘিয়ের পরোটা। কোনো দিন রাবড়ি আনতো, কোনো দিন ফিশ কাটলেট।
এক নম্বরের বাতেলাবাজ ছিল আমার বন্ধু। একদিন স্কুলেই এল না। পরদিন আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, কী হয়েছিল?’
বলল যে, ওদের পাড়ার মল্লিকাদি ওকে আমবাগানে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে, চকাস করে হামি খেয়েছে। সেই আনন্দে ও আর স্কুলে আসেনি। শালা, ঢপ মারার আর জায়গা পেত না! কোথায় বেঁটে বাউন, আর কোথায় ওদের পাড়ার মল্লিকা। মল্লিকা তো নয়, মনে হতো শাহজাহানের মুমতাজ। মল্লিকা – এ- আজম! কী তার চলা, কী তার কথা বলা! বয়েসে অন্তত তিন – চার বছরের বড়, সে ওকে হামি খাবে? তবে আজকাল মনে হয় যে, কথাগুলো বাতেলা নাও হতে পারে। তখন তো সব বুঝতাম না।
কোথা থেকে একদিন এক শিশি টিংচার নিয়ে এল। গোটা ক্লাস গন্ধে ভরপুর। এইসব করত ব্যাটা।
আবার একদিন বলল, ‘যা জিনিস এনেছি না, খেলে পুরো পাগলা হয়ে যাবি তোরা!’
আমরা বললাম, ‘কী জিনিস?’
ব্যাগের চেন খুলে ম্যাজিসিয়ানের মতো বের করে আনল ক’টা সুপুরির পাউচ। মোগলি সুপারি। মধ্যপ্রদেশের জিনিস। ওর বাবা রান্নার কাজে গিয়ে এনেছিল।
ওই সময়ে বড়দের মুখে গুটখা খুব চলত। সুপুরি খেত আরেকটু বড়োরা। পয়সাওয়ালা লোকে খেত পানবাহার। মোগলি সুপুরি আমাদের এদিকে কখনও দেখিনি। প্যাকেটের ওপরে মোগলির ছবি আঁকা। জঙ্গল জঙ্গল বাত চলি হ্যায়-এর মোগলি। সুইটি বলে একরকমের সুপুরি ছিল, তার থেকে মোগলি ছিল একদম আলাদা। নেশা ধরে যায়। ঝিম লাগে। মুখে দিয়ে মাথা ঘোরে। সুপুরি মুখে দিয়ে অমন নেশা নেশা ভাব নিয়েই আমি চোখ মেরে ওকে বলেছিলাম, ‘শালা তুই নিজেও তো মোগলি। জংলি ভূত!’
মাধ্যমিকের পর আমরা চারজনেই আলাদা হয়ে গেলাম। সবাই নিজের নিজের পথে। পরে এক বন্ধু ডাক্তার হল। একজন এখন টলিউডের আর্ট ডিরেক্টর। তৃতীয় জন এই আমি, পত্রপত্রিকায় গল্প লিখে সিগারেটের খরচটুকুও তুলতে জীবন জেরবার হয় যার। আর রইল বাকী ওই মোগলি – ট্রাক চালক। স্কুলে এক বেঞ্চে বসা চার বন্ধুর জীবন যে এমন ভিন্ন ভিন্ন খাতে বইবে কেই বা জানত? স্কুল আমাদের এক করেছিল, আর জীবন আমাদের আলাদা করে দিল।
দিন, মাস, বছর আর তার পর বছরের পর বছর – পাঁচ, দশ, কুড়ি, পঁচিশ। মাঝে কেটে গেছে অনেকখানি সময়। লেখালিখির বাইরে একটা পত্রিকার দফতরে প্রুফ দেখার কাজ করি। পার্ট টাইমে। একদিন সেখান থেকে কাজ সেরে বেরোচ্ছি, দেখি অফিসের সামনে একটা ট্রাক এমন ভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে বেরোনো প্রায় অসম্ভব। চেল্লামেল্লি করলাম। এদিক ওদিক দেখছি এমন সময়ে পিঠে কেউ প্রচণ্ড জোরে একটা চাপড় মারল। হতভম্ব হয়ে গিয়ে তাকিয়ে দেখি বেঁটে, মোটা চেহারার একটা ছেলে। আমারই বয়েসী। রোদে তামাটে হয়ে গেছে মুখ। ঘামে ভেজা। কপালে ডানদিকে একটা কাটা দাগ। বেশ গভীর। মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথে। ঘুঙুরের মতো চুল ভাগ করা হয়েছে সিঁথের দুদিকে। সমান ভাবে।
চেনার চেষ্টা করলাম। ছেলেটা আমাকে বলল, ‘শালা, এখন বাবু হয়েছিস বলে না-চেনার ভান করছিস? মরে যাওয়া উচিত তোর!’
‘তুই?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ রে শালা!’
‘এতদিন পর!’
এর পর আর কথা হয়নি। আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম মোগলিকে।
একসঙ্গে বসে চা খেলাম। তারপর মোগলিকে বললাম, ‘কাল তোর বাড়ি যাব। নিয়ে যাবি? কোথায় থাকিস এখন?’
‘এলাকা ছেড়ে দিয়েছি। ট্রাক লোড আনলোডের সুবিধের জন্যে রেল কলোনির দিকে এফ সি আই গোডাউনের কাছে থাকি। কাল চলে আয় সকালের দিকে। মোবাইল নম্বরটা রাখ। ওখানেই খাবি। মনে আছে তো আমার বাবা রাঁধুনি ছিল? বাবার রক্ত আমার গায়ে বইছে। রান্নাটা আমিও মন্দ করি না। পোস্ত আর কলাইয়ের ডাল করব।’
আমি হেসে বললাম, ‘সব মনে আছে। তোর বাবা...’
‘বাবা আর নেই। কাল আয়। কথা হবে।’
আমি গেলাম। ডাল – ভাত – পোস্ত খেলাম। পেট ভরে। দারুণ বানিয়েছিল। রেলের লাইনের ধারে খাটালা ছে। মোশের দুধ আনাল। মোটা দুধ দিয়ে চা করল। দুধ কম, পাতা বেশি। পুরোনো কিছু কথা উঠল। জানলাম ট্রাক ওর নিজের নয়। যত ট্রিপ, তত কমিশন। মার্কেটের এমন কোনো মাল নেই যেটা ও বয় না। দেশের এমন কোনো কোণা নেই যেখানে ওর যায় না। ঘাটে ঘাটে জল খায়। নানা রকমের মানুষ দেখে। যত মত, তত পথে চলে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়ে থা করিসনি?’
‘করেছিলাম। বউ পালিয়েছে।’
‘সে কী?’ বলে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলাম যেন।
‘আর যাবে না? মাসের পর মাস বাইরে বাইরে থাকি। সংসারধর্ম করতে পারি না। একটা ছেলে হল। ছেলেটার জন্মের সময়েও বাইরে ছিলাম। ছেলেটাও আমার কিনা কে জানে?’
‘সেই ছেলে এখন কোথায়?’
‘মা-ই নিয়ে গেছে সঙ্গে করে। ভালো হয়েছে। কার না কার আপদ!’
আর কথা আসছিল না। আমি বললাম, ‘উঠি এবার।’ ও মাথা নাড়ল। বাইরে ছাড়তে এল আমাকে।
এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই কাটা দাগটা কীসের?’
‘ট্রাক ড্রাইভারের বোনাস। একবার ওয়ারাঙ্গল থেকে লাল লঙ্কা নিয়ে আসছিলাম এদিকে। ইন্দোরের কাছে হাইওয়েতে আসছি যখন আচমকা দেখি উলটো দিক থেকে একটা বাস রং সাইডে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ইউ টার্ন বাঁচানোর চক্করে সে মাল এমন একটা ভুল করে বসেছিল যে আর কোনো উপায় ছিল না। আমিও ঠিক করলাম শালা যা হয় হবে। এগোই। আমাদের ড্রাইভার লাইনে ট্রাক হল ব্যাটাছেলে, আর বাস মেয়েছেলে। মাদী হয়ে মদ্দাকে মাত দেবে হয় নাকি? ভাবলাম, হয় এস্পার, নয় ওস্পার! মর শ্শালা!’
‘তারপর?’
‘ধাক্কা তো হতোই। ঠিক পাঁচ ছ সেকেন্ড আগে বাসের ড্রাইভার - কেবিনে একটা জিনিস দেখেছিলাম। মাথা ঘুরে গিয়েছিল আমার। টাইম পাইনি ভাবার মতো। আমার হাত নিজে থেকেই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিয়েছিল। রোড বেরিয়ার ভেঙে নেমে গেল ট্রাকটা। আমি টাইম মতো জানলা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। মাথায় লেগেছিল জোরে। এই যে এইখানে। অজ্ঞান হওয়ার আগে দেখেছিলাম লঙ্কার পাহাড় আমার ওপর এসে পড়ল।’
‘দিয়ে! কী হল?’
‘কী আর, এই তো বেঁচে আছি। মালিক হেবি খচে গিয়েছিল। লসের টাকা এখনও কাটে আমার ট্রিপের পাওনা থেকে। দুহাতে প্লাস্টার হয়েছিল। কানমুতোয় লেগেছিল জোরে। আর কপাল তো আমার বরাবরই ফাটা।’
আমি চুপ করে গেলাম। দেরী হয়ে যাচ্ছিল। প্রুফ দেখার কাজে যেতে হবে। তবুও প্রশ্নটা করেই ফেললাম,‘ তুই স্টিয়ারিং ঘোরানোর আগে কী দেখেছিলিস? কী ছিল?’
একটা বিড়ি জ্বালাল ও। তারপর মাথা চুলকে বলল, ‘ড্রাইভারের পাশে একটা মেয়েছেলে বসে ছিল। ঢেমনিটাকে দেখতে আমার বউয়ের মতো। আর তার কোলে ছিল একটা ছোট্ট ছেলে। লম্বা চুল ঘুঙুরের মতো। মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথে। জংলি জংলি দেখতে। মোগলির মতোই। আমার ছেলে হলে ঠিক ওরকমই দেখতে হতো।’
আমি আর কিছু বলিনি। মানে, বলতে পারিনি।
---
সুচিন্তিত মতামত দিন